#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ০৮)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
সূর্যটা হয়তো ক্লান্ত তাই ভুল করে তার, সন্ধ্যার
লালিমা বিকালেই পৃথিবীতে ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু এখন সন্ধ্যা না। তাই হয়তো এমন কমলা রং দেখাচ্ছে সব। সাথে প্রচুর সতেজ বাতাস খেলে বেড়াচ্ছে। আমার বেশ শীত লাগছে। আনমনেই আমি হেসে দিলাম।
.
হঠাৎ কোথাথেকে আরিয়ান এসে আমার চুল গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো, তারপর নেশাতুর দৃষ্টি আমার উপর নিক্ষেপ করে আমার চুলের ঘ্রাণ শুকতে লাগলো। ওর এমন কাজে আমি কেঁপে উঠলাম। এ কি করছে আরিয়ান। ওর উচিৎ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। ওকে জোড়ে করে ধাক্কা দিয়ে আমি পিছনে কয় এক কদম দূরে সরে আসলাম। হঠাৎ ধাক্কা খেয়েও তার ঠোঁটে আমি হাসি দেখতে পারছি। আমি যেন কিছুই ভাবতে পারছি না। আমার খুব ভয় করছে। পুরো শরীর কাঁপছে। আমাকে সে এভাবে ছাদে ডেকে আনলো, আমার চুলের ঘ্রাণ শুকার জন্য ! নিজের মনকে ওর প্রতি বিষিয়ে দিয়ে কোঠর কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম,
— এটা কোন ধরনের অসভ্যতা ?
.
আমার কথাটা যেন গা ঝেড়ে ফেলে দিলো আরিয়ান। হো হো করে হাসতে লাগলো। ছাদের রেলিং এ হেলান দিয়ে, তার দু’হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে আমাকে বললো,
— এই আরিয়ানকে ভয় হয় তোমার ? ঘৃণা হয়? (আবারও পাগলের মতো হাসতে লাগলো)
.
ওকে কেমন ভয়ংকর আর অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। আবার এই রক্তিম আলোয় তার অগোছালো শরীরি ভাষায় উন্মাদ প্রেমিক উপাধিও দেওয়া যেতে পারে। আমার ভেতরকার স্বত্বা বলছে, এক্ষুনি সে তোমার হৃদপিণ্ডে প্রেমের বিষাক্ত বাণ ছুড়বে। এবং ঐ বিষ তোমার পুরো শরীরকে দ্বিতীয় বারের জন্য কলঙ্কিত করবে। নিজেকে বাঁচাতে চাইলে, সব মমতার বন্ধন ছিন্ন করে পালাও। জলদি করো।
.
আরিয়ান আমাকে এমন ভীত হতে দেখে বলতে লাগলো,
— তুমি খুব বোকা পাখি, খুব বোকা। যদি চালাক হতে, তাহলে এতোক্ষণে তোমার গলার ঐ আবেদনময়ী তিলকে আঁচলের নিচে ঢেকে রাখতে।
— আপনার চোখ অন্ধ হয়ে যাক।
— এতেও লাভ হবে না। তোমার শরীরকে আমি মুখস্থ করে ফেলেছি।
— অসভ্য
.
বলেই আমি দৌড় দিলাম নিচে যাওয়ার জন্য। কিন্তু থমকে দাড়াতে হলো আমাকে ছাদের দরজার কাছে গিয়ে। কারন দরজায় তালা দেওয়া। রাগ, ক্ষোভ আর ভয়ে আমার শরীরের সমস্ত পশম দাড়িয়ে যাচ্ছে। পিছন ঘুরে আরিয়ানকে দেখলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে তার হাতের আঙ্গুলে চাবির রিং ঘুরাতে। উফফ্,,, কি চাই সে আমার কাছে। সে কি বুঝতে পারছে না, খুব দ্রুত আমি জ্ঞান হাড়াবো।
.
চাবির রিং ঘুরাতে ঘুরাতে আমার কাছে আসলো। চাবিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি যেই নিতে গেলাম অমনি, তার হাত সরিয়ে নিলো। যেন এখন তার এটা নিয়ে খেলতে ইচ্ছা করছে। পরাজয়ের নিশ্বাস ফেলে আমি মাথা নিচু করে নিলাম। সে বলতে লাগলো,
— আজ আমি তোমাকে কিছুই বলবো না। যা বলার আমার মন বলবে।
— আমি নিচে যাবো।
— তোমাকে শুনতেই হবে।
— দয়া করেন।
— দয়াটা আমার বেশি প্রয়োজন। একটু শান্ত হও। আমাকে একটু শুনো প্লিজ !
— হুম
.
আমার হাত শক্ত করে ধরে রেলিং এর কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো। আমার থেকে এক হাত দূরত্বে সেও দাঁড়ালো। তারপর মাথা নিচু করে বলতে লাগলো,
— তুমি খেয়াল করেছো পাখি, আমাদের বাবা মায়েদের এ্যরেন্জ ম্যারেজের বিষয়টা। তখনকার দিনে লাভ ম্যারেজ খুব কম,,, আমাদের বাবা মায়েরা বছরের পর বছর এক সাথে জীবন কাটায়। কারন একসাথে থাকতে থাকতে তাদের মধ্যে দ্বায়িত্ব, বিশ্বাস, ভরসা, একে অপরের প্রতি দূর্বলতা এবং সব শেষে ভালোবাসা টা হয়েই যায়। এখনকার লাভ ম্যারেজের মত ডিভোর্স হয় না তাদের। কারন তারা ভাগ্যে বিশ্বাস করে, ভালোবাসার চেষ্টা করে।
.
আমার যা রাগ লাগছে বলে বুঝানো যাবে না। আমাকে এখানে আটকে রেখে বিবাহের পাঠ পরাচ্ছে। ও মাথা টা নিচু করেই বলতে লাগলো,
— আমারও এ্যরেন্জ ম্যারেজ হয়েছিল। কিন্তু তাতে শুধু আমার দ্বায়িত্ব ছিল। ভালোবাসা ছিলো না। আমরা এক বিছনায় ঘুমাতাম। একসাথে… আবেগ আর শরীরি চাহিদায় কাছেও এসেছি দুজন, যার ফলস্বরুপ আয়াতকে পেয়েছি। কিন্তু ঐ বিশ্বাস, ভরসা, দূর্বলতা, ভালোবাসার কোনো চেষ্টা ছিলো না। আর তাই ভালোবাসা নামক অনুভূতির সাথে আমি ছিলাম অপরিচিত। এতে মিরার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নাই।
.
এইবার ওর কথাগুলো তে আমি মনোযোগ দিলাম। ও বলতে থাকলো,
— তবে মিরা যদি সামান্যতম চেষ্টা করতো তাহলে আমি ভালোবাসার অনুভূতির সাথে পরিচিত হতে পারতাম। কিন্তু ও উল্টো অপচেষ্টা করেছে।সারা রাত আমারই পাশে শুয়ে শুয়ে ফোনে অন্য কারোর সাথে প্রণয় বার্তায় ব্যস্ত থাকতো। আমি প্রায়ই বাইরে ওকে দেখতে পেতাম। কিন্তু ওর হাত ধরে থাকতো অন্য কেউ। তাই আমাকে ও ভালোবাসার অনুভূতি না, ঘৃণার অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়েছে। মা কে কিছুই বলিনি। কারন তার বিশ্বাস ছিলো যে আমরাও পারবো তাদের মত সুখি থাকতে। অবশেষে মিরা নিজেই আমার মায়ের বিশ্বাস ভেঙ্গে দিলো। আমার বিশ্বাস ভাঙ্গতে পারিনি। কারন ওর প্রতি কোনো বিশ্বাস তো আমার তৈরিই হয়ে ছিলো না। আমার এতে কোনো যায় ও আসে না। শুধু বুকটা কাঁপতো আমার ছেলের জন্য। ভাবতাম কেউ কি নাই, যে ওকে মায়ের আদর দিবে।
.
তারপর আমার দিকে আরিয়ান মাথা তুলে তাকালো। ওর চোখ দেখে এতোক্ষনে আমার মায়া করতে লাগলো। আসলেই, ওর তো কোনো দোষ নায়। দোষ ভাগ্যের, আর যদি কোনো মানুষের হয়ে থাকে তবে তা মিরার। এবার আরিয়ান আমার চোখে চোখ রেখে বলতে লাগলো,
— জানো পাখি, আমি যেদিন প্রথম তোমাকে আয়াতের হাত ধরে নদীর ধারে দেখলাম,,, অবাক হয়ে ছিলাম। তারপর যখন তোমাকে বলতে শুনলাম, আয়াতকে বুঝিয়ে বলতে। বিশ্বাস করো মনে মনে বলছিলাম, যদি তুমি ওর মা হতে…
তারপর আয়াতের রুমে যখন ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলে, আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো আমার চোখে তোমাদের। আমার মন সেদিন বলেছিলো, তোমাকে আমার লাগবে, আমার ছেলের জন্য।
কিন্তু যে রাতে আয়াতের জ্বরের জন্য আমি তোমার রুমে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, সেই রাতে আমার ধারনা পাল্টে গিয়েছিল। আমি দৃঢ় কন্ঠে নিজেকে নিজেই বলেছিলাম, তোমাকে আমার ছেলের জন্য না,,, আমার নিজের জন্য লাগবে। ওসময় ভোরের আবছা আলোয় তোমার মুখের আদল আমি মুখস্থ করে নিয়ে ছিলাম। আর তোমার গলার তিলটা,,, (হালকা হেসে) আমার জন্য মরণবান হয়ে গিয়েছিলো। কিভাবে যে ঐ নেশার ঘোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে রুম থেকে আমি পালিয়ে এসেছি তা আমিই জানি। ~তোমাকে আমি চাই পাখি, আমার নিশ্বাসের মতো~ ।
.
প্রথম বারের মতো আরিয়ান আমার হাত দু’টো আলতো করে ধরলো। তারপর হাতের মধ্যে চাবিটা দিয়ে, আমকে নেশাক্ত কন্ঠে বললো,
— আমি তোমাকে সময় দিচ্ছি। কিন্তু আমি তোমার উত্তর চাই না, আমি তোমাকে চাই।
.
তারপর সে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছাদের অপজিটে চলে গেল। আমার মাথাটা ঘুরছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আরিয়ানের প্রণয় বাক্যে সূর্যটা লজ্জা পেয়েছে। তাই নিজেকে লুকিয়ে ফেলে পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামিয়ে দিয়েছে।
.
নিচে নেমে এসে আমি আয়াতের রুমে গিয়ে বসলাম। আরিয়ানে পাগলামি গুলো ভাবছি। পিছন থেকে আয়াত আমাকে বললো,
— পাখি,,,
— বলো আয়ু সোনা। (ওর দিকে না তাকিয়েই)
— আমি না… প্যান্তে হিসু করে দিছি…
আচ্ছা এরা বাবা আর ছেলে মিলে কি আমাকে পাগলা গারদে পাঠানোর জন্য উঠে পরে লেগেছে ? হালকা রাগ লাগলো কথা টা শুনে। পিছুন ঘুরে তাকাতেই আমার সব রাগ হাওয়া হয়ে গেল। আয়াত ওর দুই আঙ্গুল দিয়ে চিমটি দিয়ে প্যান্ট টা একটু খানি ধরে আছে। আর মুখটা কুঁচকে অন্য হাত দিয়ে নাক চেপে ধরে আছে। আমি আর আমার হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। হাসতে হাসতে ওর কাছে গিয়ে দু’গালে চুমু খেলাম। মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলাম।…..
·
·
·
চলবে…………………