#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ১১)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
তারপর আরিয়ান আমার পাশে এসে শিঁড়িতে বসলো। আমার দুই গালে হাত রেখে, আমার কপালের সাথে ওর কপাল ঠেকালো। চোখ বন্ধ করে আমকে বলতে লাগলো,
— আমি তোমার ভালোবাসাকে মন থেকে সন্মান করি। নিজের মনে কোনো দ্বিধা রেখো না প্লিজ। তুমি তো আমার জীবনের ভালোবাসায় মোড়ানো পবিত্রতার শুদ্ধতম মোমবাতি, যে নিজেকে পুড়িয়ে আমার হৃদয়ে আলো জালিয়েছে।
.
.
.
কিছুদিন ধরে ঐ বাড়িতে আর যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু আয়াতের কান্নার কাছে আমার ইচ্ছাটা হেরে যায়। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে আরিয়ান আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যায় আর রাতে আমাদের বাসায় আবার দিয়ে যায়। আর মাত্র একটা সপ্তাহ, তারপর থেকে আরিয়ানকে এই ডিউটি আর পালন করতে হবে না। কারন তখন তো ওবাড়িতেই থাকবো। হ্যা, এক সপ্তাহ পরেই আমার আর আরিয়ানের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। ওই বাড়িতে না যাওয়ার ইচ্ছার কারন, বিয়ে নিয়ে তাদের অতিরিক্ত মাতামাতি। কিন্তু আমি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছি বিয়েটা যেন একদম ঘরোয়া ভাবে হয়।
.
সে দিন আমার আম্মুর কাছে থেকে ফাহমিদা আন্টি ওয়াদা আদায় করে, তবেই বাড়িতে ফিরেছিলেন। রাতে আম্মুকে আমি বলেছিলাম যে, বিয়ে টা আমি করতে চাই না। কথাটা শুনে আম্মু রুম থেকে বের হয়ে গেলেন, এক মিনিটের ব্যবধানে ফিরে আসলেন হাতে নারকেল তেলের বোতল নিয়ে। আমাকে ফ্লোরে বসিয়ে দিয়ে তিনি বিছানায় বসলেন। আমার মাথায় তেল দিতে দিতে বলেছিলেন,
— দেখো পাখি একটা মেয়ে কখনো সারা জীবন একা থাকতে পারেনা। তুমি যতোই মনে করে, কিছু না কিছু উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করবে, তুমি পারবা না। কারন জীবিকার থেকেও তোমার বেশি প্রয়োজন হবে নিজের নিরাপত্তা। যা একজন পুরুষ তোমাকে দিতে পারবে। আর সে পুরুষের সঙ্গকে বৈধতা দিতে, একটা উপায়ই আছে। তা হলো বিয়ে। আরিয়ান খুব ভালো ছেলে মা। তোমার কি একবারও মনে হয়েছে যে, সে তেমাকে অসন্মান বা অমর্যাদা করেছে ?
.
আম্মু রেগে গেলে বা সিরিয়াস থাকলে আমাকে তুমি করে বলে। কিন্তু তখন যে, সে কোন অবস্থায় ছিলো আমি বুঝতে পারিনি। আস্তে আস্তে বলেছিলাম,
— আম্মু এমন টা না, আসলে… (আমার কথা শেষ না হতেই বলতে লাগলো)
— তাহলে সে কি অসৎচরিত্র ?
— না, তাও না।
— সে চরিত্রবান এবং সাহসী। তোমাকে সারা জীবন আগলে নিরাপদে রাখবে, ভালোবাসবে। সবচেয়ে বড় কথা, ~আয়াত~। ঐ ছোট্ট বাচ্চাটা তোমাকে সুস্থ হতে সাহায্য করবে। আমি কখনো তোমার মতের বিরোধ হইনি। আমার অনুরোধ পাখি, একটা বার আম্মুর কথা শুনো। তুমি সুখি হবে। আমি কতোদিনই আর বাঁচবো ? তোমাকে সুখি দেখে যেতে চাই।
— আমি ফাহাদকে এখনো ভুলতে পারিনি। আর ওকে ভুলতে চাইও না আম্মু।
— আমিও চাই না তুমি ফাহাদকে ভুলে যাও। তোমার দোয়ার মাঝে ফাহাদ বেঁচে থাকবে। তবে আমি এটাও চাই যে তুমি আরিয়ানকে মনে রাখো। ওকে সুযোগ দাও তোমাকে ভালো রাখার।
— ………. (নিশ্চুপ)
— আশা রাখছি তুমি কথাটা বুঝবে। রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পরো। (এটা বলে তেলের বোতল টা হাতে করে উঠে পরেছিলেন, আমি সাথে সাথে ডেকেছিলাম)
— আম্মু,,,, তোমার কোলে একটু মাথা রাখি,,,, ?
.
তারপর আম্মু কোলে মাখা রাখলাম, আম্মু আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে একটা শেষ কথায় বলেছিলো যা এখন খুব মনে পরছে। তা হলো,
— তোমাকে ভরসা দেওয়ার জন্য একটা হাতের প্রয়োজন যে হাত তোমার কাঁধে থাকবে। আর তা হলো আরিয়ানের।
.
.
.
আম্মুর ঐ রাতে বলা প্রতিটা কথায় আমি খুব ভালো করে ভেবেছি। কথা গুলোর মধ্যে একটা কথাও ভুল ছিলো না। আয়াতকে আমি আমার মনের অজান্তে, আমার সন্তানের জায়গা দিয়েছি। ও আমাকে ছাড়া ভালো থাকবে না, আর না আমি শান্তি পাবো ওকে অন্যের ভরসায় রেখে। আরিয়ানও আমাকে চাই। তাই আমি বেঁচে থাকার জন্য একটাবার চেষ্টা করবো। যদি সফল হই, মানসিক ভাবে সুস্থ হতে। এই যন্ত্রণা যে আমাকে মেরে ফেলবে। শুনেছি মানুষের মস্তিষ্ক নাকি বার বার প্রেমে পরে, যদি বিপরীত মানুষটির চেষ্টা থাকে। সেটা আমার ক্ষেত্রে কার্যকর হলে, হৃদয়ের বিদীর্ণ যন্ত্রণা থেকে তো মুক্তি পাবো,,,,।
.
আমাদের বাড়িটা আব্বু বানিয়েছিলেন। আমরা নিম্নমধ্যবিত্ত। একতলা বাড়ি, বাড়িতে চারটা রুম, একটা রান্নাঘর, দু’টো বাথরুম, দু’টো বারান্দা। আমার রুম টা বাড়ির পেছনের দিকে। ওদিকে হাল্কা বাগান মতোন করা। আর ওদিকেই বাড়ির শেষ অংশে ছাদে উঠার জন্য একটা লোহাটা পেঁচানো শিঁড়ি আছে। এবং পুরো বাড়ির সীমানাটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা।আব্বুর কাছে আবদার করে ঐ লোহার শিঁড়িটা বানিয়ে নিয়েছিলাম। তবে আমি কোনো কিছুই আবদারের সাথে সাথে পেতাম না। আমাকে অপেক্ষা করতে হতো। আর শিঁড়ির আবদার টাও, এক বছর পর পূর্ণ হয়েছিলো।
.
আম্মু এখন ঘুমে, কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। আমি আমার ঘরের বারান্দার দরজা টা খুলে আস্তে আস্তে শিঁড়িটার কাছে গেলাম। আমার পায়ে জুতা নেই, খালি পায়েই মাটিতে নেমেছি। এক পা, দু’পা করে শিঁড়িটা বেয়ে উঠতে লাগলাম। লোহাটা আমার পায়ে স্পর্শ করতেই মনে হলো আমি বরফের উপর হাটছি। রেলিং টা দুই হাত দিয়ে ছুঁয়ে ধরে ধরে উঠছি। বুকের মধ্যে একটা চাপা ব্যাথা অনুভব হচ্ছে যা আমার গলার কাছে এসে আটকে রয়েছে। চোখের কোনা গুলোও কেমন ভেজা ভেজা লাগছে…..ওহ্.. হ্যা…. আব্বুর কথা মনে পড়ছে।
.
আমাদের ছাদে কোনো রেলিং নাই । আমি হাটতে হাটতে ছাদের সামনের দিকে গেলাম। একদম ধারে। এখান থেকে মেইন রাস্তাটা দেখা যায়। আকাশে চাঁদ উঠেছে। বেশ আলো চারিদিকে। তবে আজ পূর্নিমা না। কেমন জানি শুখনো খেঁজুর গাছের ডালের মত, চিকন এক ফালি চাঁদ। কিন্তু এতেই যেন জোছনা উতলে পরছে। আচ্ছা, আমি যদি এখান থেকে লাফ দেয় !… না না লাফ দিলে মরবো না। শুধু হাত পা ভাঙ্গবে, যেটা আরো বেশি অসহ্যকর।
.
এসব ভাবতেই দেখলাম, বাড়ির সামনে রাস্তায় একটা কার গাড়ি এসে থামলো। দেখতে একদম আরিয়ানের গাড়ির মতো।
.
আরিয়ানের মত লম্বা একটা ছেলে, গাড়ি থেকে বের হয়ে, গাড়ির সাথেই হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। হাত দুটো ভাজ করে বুকের কাছে নিয়ে, উপরে মুখ তুলে আমার দিকেই তাকালো। ও মা…. এটা তো আরিয়ানই। রোড লাইটের আলো মুখটায় এসে পরছে। তাই চিনতে পারলাম। কারন জোছনার আলো থাকলেও তা দিয়ে কারোর মুখ চেনা সম্ভব না। ও কিছুক্ষণ আমাকে দেখে, হাত দিয়ে ইশারা করলো ওর কাছে যেতে। আর আমিও যেন সম্মোহিত হয়ে এক পা এক পা করে বাড়ি থেকে জুতা পরে বের হয়ে বাড়ির দরজা লাগিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সব সময়ের মতো শান্ত কন্ঠে ও আমাকে বললো,
.
— এতো রাতে ছাদে কি করছিলে ?
ওর কথায় যেন আমাকে বেঁধে রাখা সম্মোহনের অদৃশ্য ফিতাটা কাঁচাত করে কেটে গেল। আমিও একই শান্ত কন্ঠে উল্টো প্রশ্ন করলাম,
— এতো রাতে আপনি এখানে কি করছেন ?
— তুমি কখনোই আমার প্রশ্নের উত্তর সোজা ভাবে দাও না। প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করা তোমার স্বভাব।
— ঘুম আসছিলো না তাই ছাদে হাওয়া খেতে গিয়েছিলাম। (বিরক্তি সুরে)
— আমারও ঘুম আসছিলো না।
.
দুজনায় কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করলাম। তারপর আরিয়ান প্রচুর চঞ্চল হয়ে আমাকে বললো,
— পাখি চলো চা খেয়ে আসি। আমার একটা খুব প্রিয় দোকানের চা।
( আরিয়ানকে এতোটা চঞ্চল হতে দেখে আমার ফাহমিদা আন্টির কথা মনে পরলো। তবে কি আরিয়ান আগে এমন চঞ্চল, রাগি, অশান্ত একটা ছেলে ছিলো ? )
আরিয়ান আমার উত্তর না পেয়ে আবারও বললো,
— কি হলো যাবে না ?
— এতো রাতে কি দোকান খোলা থাকে নাকি ?
— এই শহরের কিছু কিছু জিনিস আছে যা গভীর রাতেও ঘুমায় না। ( কথাটা বলতে বলতে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে, গাড়ির দরজা খুলতে লাগলো)
— আরেহ্ আরে পুলিশ ধরবে তোহ্ !
.
আমাকে গাড়ির মধ্যে ঠেলে বসায় দিয়ে কৌতুকের ছলে বললো,
— ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন মিস পাখি, ইয়োর উডবি হাজবেন ইজ আ পুলিশ ইন্সপেক্টর । হাহ হাহ হাহ।
.
অতঃপর আমরা ওর প্রিয় চায়ের দোকান থেকে চা খেলাম। ওর এই পাগলামি কান্ডে যদিও আমার রাগ হচ্ছিলো, তবে চা টা অসাধারণ ছিলো। এরপর সারা রাত ধরে আমাকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরলো। ফজরের আযানের সময় গাড়িটা আমার বাড়ির সামনে এনে থামালো। তারপর এক অদ্ভুত আবদার করে বসলো। বললো, “পাখি তোমার গলার তিলটাতে আমি একবার আঙ্গুল দিয়ে ছুয়ে দিই ? একটুখানি প্লিজ ! ”
.
ওর আবদারের কি উত্তর দিবো আমি ভেবে পেলাম না। আমার হৃদপিণ্ড ধুক ধুক শব্দ করতে করতে আমার পুরো শরীরে রক্ত ছড়িয়ে দিতে লাগলো। আমি নিশ্চুপ থাকলাম। নিরবতা সম্মতির লক্ষন ভেবে আরিয়ান ওর একটা আঙ্গুল আমার গলার তিলটার উপর রাখলো। আঙ্গুলটা ওখানে রেখেই, আমাকে বললো,
— তিলটার একটা নাম দিই আমি ?
— ……. (নিশ্চুপ)
— ওর নাম “লজ্জা”
— ……. (নিশ্চুপ)
— পাখি, আমার এই অবাধ্য ইচ্ছে গুলোকে বুঝি প্রেম বলে ?
— …….. (নিশ্চুপ)
তারপর ও চোখটা বন্ধ করে হাতটা সরিয়ে নিলো। আর বললো,
— বাড়িতে যাও
.
.
সকাল থেকেই ফাহমিদা আন্টি তার রুমের বিছানায় শাড়ি আর গয়নার পশরা সাজিয়ে, আমার আগে পিছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ তাদের বাড়িতে একটা ফাংশন আছে। আংকেল তার স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসাবে আরিয়ানের নাম এনাউন্স করবে আর তাই তার ব্যবসার সাথে জরীত গন্য মান্য ব্যাক্তিদের ইনভাইট করেছে সন্ধ্যায়। এবং বিশেষ ভাবে মিরা এবং ওর বাবা মা কেও ইনভাইট করেছে। তার কারন আজ সন্ধ্যায় আমাদের এনগেজমেন্ট ও হবে। মূলত ওদের জ্বলানোর জন্যই এরা এই কাজ করছে। তবে এতে আমার খুব একটা মন সাই দিচ্ছে না। যেহেতু বিয়েটা ঘরোয়া ভাবেই হবে তাই, এই ছোট্ট আয়োজনটা সবাই করতে চাচ্ছে।
.
দুপুরে আরিয়ান আম্মুকে নিয়ে এসেছে এ বাড়িতে। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল টর্চার আমার উপর। আম্মু আর ফাহমিদা আন্টি জোর করে আমাকে মিষ্টি কালারের একটা জর্জেট কাপড়ের শাড়ি পরিয়ে দিলো। কিন্তু এতেও তাদের মন খারাপ। তাদের ভাস্যমতে শাড়ির রং আর আমার গায়ের রং প্রায় মিলে গিয়েছে। এখন আবার চেঞ্জ করতে বলছে। কিন্তু রাগি চোখ দেখে চুপ হয়ে গেল। অতঃপর চুল গুলো আচরিয়ে বেলি ফুলের গাজড়া দিয়ে ছেড়ে দিলো। কানে স্বর্ণের কানজোরা দুল আর হাতে মিষ্টি কালারের কাঁচের চুরির সাথে স্বর্ণের কাঁকন। আমি মানা করলাম। কিন্তু ফাহমিদা আন্টি এইবার সাহস করে আমাকে বলেই দিলো, আমার বাড়ির বৌ কে স্বর্ন ছারা বাইরের মানুষ দেখবে এটা আমি কখনোই মেনে নিবো না।
.
মহিলাটাকে আর কষ্ট দিতে মন বলছে না। সবারই অনেক আশা থাকে। করুক না একটু তার আশা গুলো পূরণ। তারপর আমি চুপ থাকলাম। নিজের হাতে আমার চোখে কাজল পরিয়ে দিলো আর ঠোঁটে লাল-খয়েরি রঙের লিপস্টিক। আয়নায় দেখলাম বেশ ভালোই লাগছে। কাজল লিপস্টিক পরা, তিন চার বছর হলো বাদ দিয়েছি। কেন জানি ঠোঁট দুটোকে আবেদনময়ী দেখাচ্ছে তাই টিসু পেপার দিয়ে লিপস্টিক টা মুছে ফেললাম। তবুও হালকা ভাবে রয়েই গেল ঠোঁটে।
.
হঠাৎ করে আম্মু আর ফাহমিদা আন্টি একই সাথে আমার দুই গালে চুমু খেলো। মনটা বললো, এইতো সবাই আমার পাশে আছে,,, কিসের ভয় আমার !
.
গলার ফিনফিনে চেইনটা আঙ্গুলে ঘোরাতে ঘোরাতে রুম থেকে বের হলাম। মাথাটা নিচু করে প্রশান্তির এক চিলতে হাসি ঠোঁটে মাখিয়ে হাটতে হাটতে দরাম্ করে কিসের সাথে যেন বারি খেলাম। তাকিয়ে দেখি আরিয়ান। সে পুরো কালো রঙের কমপ্লিট সুট পরেছে। মনটা একটা কথায় আমাকে জানিয়ে দিলো, মানুষটা আসলেই সুদর্শন। ওর চোখ দুটো আমার সবকিছুতে নির্বিঘ্নে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে…..
·
·
·
চলবে………………….