হৃদয়ের সম্পর্ক পর্ব ১০

#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ১০)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
তারপর আম্মু আমাকে যা বললো, তা শুনে যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো। সবাই মিলে আরিয়ানের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। কথাটা শুনে আমার মগজে মনে হলো অগ্নুৎপাত শুরু হয়ে গেছে। রাগে আর ভয়ে আমার মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। এরা আমাকে একবারও জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করলো না। আর ফাহমিদা আন্টিরও জবাব নেয়। আম্মু আমাকে কথাটা বলার দু’সেকেন্ড ও পার হতে পারলো না, আর উনি তোতলাতে তোতলাতে আয়াতকে বলতে লাগলো,
— দাদুভাই, আ.. আজ থেকে… পা..পাখি তোমার মাম্মাম… হি হি হি। (আমার দিকে তাকিয়ে জোর পূর্বক হাসি দিয়ে।)
.
ব্যাস… আয়াতকে এইবার দেখে কে। লাফাতে লাফাতে হাত তালি দিচ্ছে আর মাম্মাম মাম্মাম করে সারা ঘর মাথায় তুলছে। ওকে শান্ত করা আমার পক্ষে এখন সম্ভব না। আর আরিয়ান,,, সে মিটমিট করে হাসছে। ও আমাকে বলেছিলো সময় দিবে। এই ওর সময় দেওয়া ! আরিয়ানের সাথে আমার কথা বলতে হবে। বলতেই হবে। ওকে জানাতে হবে আমার অতীতের কথা।
.
আমার সবচেয়ে বেশি রাগ লাগছে, আমার আম্মু আর আরিয়ানের উপর। ফাহমিদা আন্টিকে কি আর বলবো, উনি তো আমার চোখে পাগলাগারদের পেসেন্ট। আচ্ছা আমার বিয়ে না দিলে কি, আম্মুর কি পেটের ভাত হজম হচ্ছে না ?
.
আম্মু বলতে লাগলো,
— পাখি যা তো সোনা, এই খুশির সংবাদে মিষ্টি জাতীয় কিছু রান্না করে আনতো মা।
আংকেল সাথে সাথে মাথটা উপর নিচ করে নাড়ালেন। বললেন,
— হ্যা পাখি মা, এই খুশির সংবাদে মিষ্টি না খেলে হয় নাকি বলো। হি হি
.
আমি রাগে গজগজ করতে করতে রান্নাঘর থেকে চিনির বোয়াম এনে টি-টেবিলের উপর ঠাস্ করে রাখলাম। আর অমনি ফাহমিদা আন্টি বোয়ামের মুখ খুলে এক চামচ চিনি হাতে ঢেলে চেটে চেটে খেতে লাগলো, আয়াতও বাদ নেই। আংকেলও তার ডান হাতটা চিনির বোয়ামের দিকে বারাচ্ছিলো কিন্তু আন্টি চট করে ঐ হাতের উপর একটা বারি মারলো। তারপর দুজনায় খিল খিল করে হাসতে লাগলো।
.
এদের এসব অদ্ভুত কান্ড দেখে রাগে আমার কান্না লাগছে। ওদিকে আমার আম্মু রেগে রেগে আমাকে বলতে বলতে লাগলেন,
— এটা কোন ধরনের অভদ্রতা পাখি ? আমি তোমাকে বললাম মিষ্টি কিছু তৈরী করে আনতে আর তুমি তোমার হবু শশুড় শাশুড়ীদের চিনি খাওয়াচ্ছো ?
ফাহমিদা আন্টি আম্মুর কথা শুনে বলতে লাগলো,
— না না কোনো সমস্যা নাই। চিনি তোহ মিষ্টিই।
.
আমি এদের প্যাঁচাল মার্কা কথা উপেক্ষা করে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে ওকে রাগি কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলাম, “আপনি একটু দয়া উঠে দয়া করে আমার সাথে আসুন। আমার কিছু কথা আছে আপনার সাথে।”
.
.
আমার রুমটা আমাদের বাড়ির ভেতরের দিকে। রুমের ছোট্ট বারান্দার দরজাটা খুলতেই একটা অনেক বড় মেহগনি গাছ আছে। গাছটা খুব মোটা। গাছের সবথেকে নিচের ডালে পাটের দড়ির একটা দোলনা বাঁধা আছে। দোলনায় বসার জন্য একটা কাঠের পিড়ি পাতা। আমার জীবনের ষোড়শীর দিনে ওই দোলনায় বসে, আমি ফোনে ফাহাদের সাথে প্রেমলীলায় ব্যস্ত থাকতাম। কতই না মধুর ছিল সেসব প্রণয় বাক্য।
.
আর আজ,,,, ঐ একই দোলনায় আরিয়ান বসে অপেক্ষা করছে, আমার কথা শুনার জন্য। কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য এখানে টেনে আনলাম, হয়তো এটাই ভাবছে। বারান্দার বাইরের দিকে দুটো শিঁড়ির ধাপ আছে। আমি ওই শিঁড়িতে বসে আছি। আরিয়ানের চঞ্চল দৃষ্টি আমার উপর নিক্ষিপ্ত আর আমার শান্ত দৃষ্টি মেহগনি গাছের সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকা কামিনী গাছের দিকে।
.
আরিয়ান তার ধৈর্যের সমাপ্তি ঘটিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
— পাখি তুমি আমাকে কি বলতে চাও ?
— আ…. আসলে….। (আমি বুঝতে পারছি না কোথা থেকে শুরু করবো ? কি বা বলবো? যে আমার একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিল,,, যা এখন আর বর্তমান নেই।)
— পাখি আমি অপেক্ষা করছি,,, আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। তুমি হেরে যাবে।
— আমি একজনকে ভালোবাসি। (চোখ বন্ধ করে)
— হুম,,, কে সে বলা যাবে ? (খুবই স্বাভাবিক হয়ে)
— ফাহাদ,,, আমার বাবা যে কোম্পানিতে চাকরি করতো, সেই কোম্পানির অনারের একমাত্র ছেলে। বাবার মৃত্যুর সময় প্রথম আমি তাকে দেখেছিলাম। এবং সেও।
— হুম,,, তারপর,,, ?
— আমরা দুজন ধীরে ধীরে ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে পরি।
— কতো দিনের সম্পর্ক ?
— তিন বছর যাবত সম্পর্ক ছিলো।
— ছিলো ? তারমানে এখন সম্পর্কটা নেই ?
— আমি তাকে এখনও ভুলিনি।
— আর সে ?
— আমি বিশ্বাস করি সে আমাকে এখনোও ভালোবাসে।
— সে এখন কোথায়।
— সে আর জীবিত নেই। একটা কার এক্সিডেন্টে আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি। (কথাটা বলতে গিয়ে মনে হলো আমি ফাঁসির দড়িতে ঝুলছি, গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হতে চাইছে না)
.
— ভালোবাসা সব সময় সুন্দর। আমি শ্রোদ্ধা করি তোমার ভালোবাসাকে। আমি তোমাকে সাহায্য করবো পাখি সামনে এগিয়ে যেতে। দয়া করে আমার হাতটা একবার ধরো ! (ভালোবাসা মিশ্রিত কন্ঠে)
— বিষয়টা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়।
— আমি শুনছি !
— আমি গর্ভবতী ছিলাম। তার সন্তান আমার গর্ভে ছিলো।
— আবারও,,,, ছিলো ?
— যখন তার কার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো, আমি তখন তার সাথে ছিলাম। সে আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়, তার সন্তানকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলো।
— হুমম্,,, এখন যা কিছু আমাকে বললে তার সবটাই আমি জানি। এবং আমার বাবা মাও জানে।
— মানে ?
— আমি যখন নতুন ইন্সপেক্টর পদে পদন্নোতি করি তখন আমার হাতে একটা Missing file দেয়, আমার উর্ধোতন কর্মকর্তা। আমকে বলা হয়েছিলো এই কেইসটা খুবই ইম্পরট্যান্ট এবং আর্জেন্ট। কারন যে ব্যাক্তি এ মিসিং রিপোর্টটা করেছে সে এই শহরের একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি। তার ছেলে এবং ছেলের বান্ধবীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষবার তাদের একসাথে একটা প্রাইভেট কারে দেখা গিয়েছিলো। কারের নম্বর আমাকে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাকে বলা হয়, এই কাজ গোপনে করতে হবে যেন মিডিয়া-প্রেস এ বিষয়ে কিছু জানতে না পারে। তার একদিন পর আমার টিম গাড়িটাকে বিদ্ধস্ত অবস্থায় পাই একটি হাইওয়েতে। আমি সেখানে গিয়ে তার ছেলে আর বান্ধবীকে পাই। তবে ঐ শিল্পপতির ছেলের শ্বাস চলছিল না আর তার বান্ধবী ছিল অজ্ঞান এবং মেয়েটির পরো মুখ রক্তাক্ত ছিলো। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর ডক্টর, ছেলেটিকে মৃত ঘোষনা করে, বলে যে চার ঘন্টা আগেই সে মারা গেছে। আর জানায় মেয়েটি বেঁচে আছে কিন্তু তার গর্ভপাত হয়েছে। আমি ছেলেটির ডেড বডি দেখার পর কাটায়খানায় পাঠিয়ে দিই। তারপর মেয়েটিকে দেখতে যায়। নার্স আমাকে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা একটি জীর্ণ শীর্ণ শরীরের সামনে দাঁড় করায়। দেখলাম মেয়েটি খুব সুন্দরী কিন্তু অতিরিক্ত রক্তপাতের কারনে তার উজ্জ্বল মুখটা মলিন ছিলো। ছেলেটির ডেড বডি হস্তান্তর করার সময় তার পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সূত্রে জানতে পারি, ছেলেটির নাম ফাহাদ। এবং মেয়েটি তার প্রেমিকা ছিলো। তখনই আমি আন্দাজ করেছিলাম মেয়েটির গর্ভের সন্তান টা হয়তো ঐ ছেলেটার ছিলো। তারপর ঐ শিল্পপতি আমাদের বলে, “আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি, আমার সন্মানটা আর হারাতে চাই না।” অতঃপর সেই কেইস ফাইলটা বন্ধ করে দিই আমরা।
— তারমানে….
— হ্যা, সেইদিন আমি প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম।
— কিন্তু আপনি যে বলেছিলেন, আপনি আমাকে নদীর ধারে আয়াতের সাথে প্রথম দেখেছিলেন।
— হ্যা,,,, আয়াতের সাথে প্রথম দেখেছিলাম। তারমানে এই নয় যে আগে তোমাকে কখনো দেখিনি।
.
তারপর আরিয়ান আমার পাশে এসে শিঁড়িতে বসলো। আমার দুই গালে হাত রেখে, আমার কপালের সাথে ওর কপাল ঠেকালো। চোখ বন্ধ করে আমকে বলতে লাগলো,
— আমি তোমার ভালোবাসাকে মন থেকে সন্মান করি। নিজের মনে কোনো দ্বিধা রেখো না প্লিজ। তুমি তো আমার জীবনের ভালোবাসায় মোড়ানো পবিত্রতার শুদ্ধতম মোমবাতি, যে নিজেকে পুড়িয়ে আমার হৃদয়ে আলো জালিয়েছে।
·
·
·
চলবে…………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here