#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#সূচনা_পর্ব
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
বরাবরের মত সাদা শাড়িটা শরীরে জড়িয়ে নিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে চোখের পানি ফালানোটা মনে হয় নিত্যদিনের সাথী হয়ে দাঁড়িয়েছে জুঁইয়ের জীবনে । জীবনের তিনটা বছর যে কিভাবে অতিবাহিত হয়ে গেলো টেরও পায় নি সে । ভালো-মন্দ , হাসি-খুশি এইসবের মাঝে কিভাবে যেন চোখের পলকে তিনটা বছর পার হয়ে গেলো তার জীবন থেকে । ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকেও আজকাল বড্ড বেশি অচেনা লাগে তার ।
– কতটা বদলে গেছি আমি । কলেজের সেই হাসি খুশি প্রাণচঞ্চল মেয়েটা আজ এই সাদা শাড়িতে লেপ্টে থাকা এক অঙ্গার নারী । গত এক বছরে সাদা রঙ শরীরে এতটাই লেপ্টে আছে যে এখন আর অন্য রঙ এই শরীরে মিশতে চায় না । চেহারার মাধুর্যতা কমে গেছে নাকি বেড়েছে বুঝতে হয়তো মোটা ফ্রেমের চশমা লাগবে কয়দিন পর ।
জুঁইয়ের ভাবনায় ছেদ করে তার মায়ের প্রবেশ ঘটে রুমে । মেয়েকে বিভোর হয়ে ধ্যানে মগ্ন থাকতে দেখে সামনে এগিয়ে গিয়ে মেয়ের কাঁধে হাত রাখেন ফয়জুন্নেসা বেগম । চেনা হাতের স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকায় জুঁই । মাকে দেখে মলিন মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে হালকা স্বরে কথা বলে ,
– কিছু বলবা মা ?
– উহু ,
– ওহ ,
– রেডি হয়ে গেছিস ?
– হ্যাঁ , প্রায়ই ।
এমন সময় খাট থেকে নান নান শব্দ করে
জুঁইয়ের ছোট্ট মেয়েটা হাতে ইশারা করছে
জুঁইকে । হ্যাঁ জুঁইয়ের একটা দেড় বছরের মেয়ে আছে । মুখে আধো আধো বুলি তার । মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে জুঁই । তারপর শাড়িতে পিন আটকে খাটের সামনে গিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নেয় জুঁই ।
– আম্মুন উঠে গেছেন আপনি ? আরও আগে উঠলে কি হতো । আম্মুন তো এখন চলে যাবো । নানুমনির কাছে থাকতে হবে আজ আপনাকে ।
মেয়ের কোল থেকে নাতনিকে কোলে তুলে নেয় ফয়জুন্নেসা বেগম । তিনিও বুঝেন এই কলিজার টুকরাটা ছাড়া তার মেয়ের বাঁচার অবলম্বন কিছুই নেই ।
– ইফসি সোনা নানুমনির কাছে থাকবে । তাই না নানু ?
নানুর কোলে গিয়ে ছোট্ট ইফসি যেন চুপ করে নানুর কাঁধে মাথা ফেলে শুয়ে থাকে ।
জুঁইও তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয় । ওমনি ফয়জুন্নেসা বেগম দাঁড় করায় জুঁইকে ।
– খেয়ে যাবি না ?
– নাহ , আজ আর খাবো না । তাছাড়া নতুন জায়গায় প্রথম পোস্টিং । বুঝোই তো ।
– ওহ ,
– আর মা শুনো , আসার সময় ভাবছি একটা বাসা দেখবো ।
– হঠাৎ বাসা ?
– আমি ছোট বাচ্চা নই মা । সবই বুঝি , ভাই আর ভাবী কাল রাতে তোমাকে যা যা বললো সবটাই কানে এসেছে আমার । বিপদে পড়ে আসি নাই তোমাদের সংসারে আমি । ট্রান্সফার করেছে বলেই আসা । আমাকে বলতে পারতো যে জুঁই তুই কি সংসারে কন্ট্রিবিউট করতে পারবি কি না । আর তাছাড়া ওরা ভাবলো কি করে মা যে আমি এখানে বসে বসে খাবো । সম্পর্ক গুলো তিক্ততায় রুপ নেয়ার আগে সরে যাওয়া ভালো মা । ইফসিকে খিচুড়িটা খাইয়ে দিও মা । আমি বের হচ্ছি মা , আসসালামু আলাইকুম ।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম , সাবধানে যাস ।
ছোট্ট ইফসি হাত দিয়ে তার মাকে টা টা করে দেয় ।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায়
জুঁইয়ের । চেনা শহরের এই রাস্তায় আজ আবার তিন বছর পর দাঁড়ানো । রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের সাথে কথা বলে জুঁই ,
– রাজশাহী থেকে এখানে ট্রান্সফার না করলেই ভালো হতো । চেনা শহরে তিন বছর আগে সব মাটি চাপা দিয়েছিলাম । এখন আবার সেই পুরাতন ঘা টা জীবিত হবে হয়তো ।
হঠাৎ করেই একটা রিক্সা এসে সামনে দাঁড়ায় তার ।
– মামা কই যাইবেন ?
রিক্সাওয়ালার কথায় রিক্সাওয়ালার দিকে তাকায় জুঁই ।
– মামা ১০ নাম্বার যাবা ?
– হ উডেন ।
রিক্সা নিয়ে জুঁই তার গন্তব্যে রওনা হয় । বিগত এক বছর যাবত রাজশাহীতে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে যাচ্ছে জুঁই । গত মাসেই তাকে ঢাকার হেড অফিসে ট্রান্সফার করা হয়েছে । যার জন্যে আবার ঢাকায় আসতে হলো তাকে । পিছুটান তো কবেই পিছনে ফেলে দিয়েছিল সে । কিন্তু নিয়তির কাছে সবার হাত পা বাঁধা । ভাগ্য বা কপাল মানুষকে একদম কাঠের পুতুল বানিয়ে রেখে দিয়েছে , যখন যাকে যেভাবে পারছে নাচাচ্ছে । তেমনটাই হচ্ছে জুঁইয়ের সাথে ।
হঠাৎ রিক্সাওয়ালার ডাকে ধ্যান ভাঙে জুঁইয়ের ।
– মামা ১০ নাম্বার আইয়া ফরছে ।
ভাড়া মিটিয়ে অফিসে পা রাখে জুঁই । সেখানে আগে থেকেই জুঁইয়ের জন্যে কেবিন ঠিক করে রাখা ছিল । জুঁই গিয়ে পরিচয় দেয়ার পর পরই তাকে তার কেবিন দেখিয়ে দেয়া হয় । কেবিনে বসার পর পরই টেবিলে থাকা ল্যান্ড লাইনে একটা ফোন আসে । জুঁই কিছু না ভেবেই ফোনটা রিসিভ করে নেয় ।
– আসসালামু আলাইকুম , নাদিরা ইয়াসমিন বলছি ।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম । পিওনকে পাঠানো হয়েছে , ওনার সাথে আমার কেবিনে আসুন ।
– জ্বি ।
জুঁইয়ের ধারণা যতটুকু তিনি তার বস ছিলেন । এরই মাঝে পিওন এসে হাজির । পিওনের পিছন পিছন বসের কেবিন পর্যন্ত যায় জুঁই ।
– এটাই স্যারের রুম , ম্যাডাম ভেতরে যান
– ধন্যবাদ ।
রুমের ভেতরে প্রবেশ করে জুঁই । সে দেখে একজন ভদ্রলোক সেখানে চেয়ারে বসা ।
– স্যার আসবো ?
– জ্বি আসুন ,
জুঁই সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । ডেস্কে থাকা নেইমপ্লেটে একটা নাম তার নজরে পড়ে ।
” মোঃ মাহবুব হোসেন ”
জুঁই বুঝে যায় স্যারের নাম মাহবুব হোসেন । জুঁইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় তাকে বসতে বলে মাহবুব সাহেব ।
– নাদিরা ইয়াসমিন জুঁই ?
– জ্বি স্যার ,
– আপনার ওয়ার্কিং নিয়ে অনেক সুনাম শুনেছি । এইবার আমরাও দেখতে পাবো , কি বলেন ?
– জ্বি স্যার ইনশাআল্লাহ ।
– অল দ্যা বেষ্ট , কোন সমস্যা হলে জানাবেন ।
– জ্বি স্যার ,
– আপনি এখানে নতুন ?
– রি অফিসে নতুন আর শহরটা অনেক পুরাতন ।
– বুঝলাম না ?
– স্যার জীবনের ২২ টা বছর এই শহরেই অতিবাহিত করেই তবে অন্য শহরে পা দিয়েছিলাম ।
– ওহ আচ্ছা , বাড়িতে কে কে আছেন আপনার ?
– নিজের বলতে আমি আর আমার দেড় বছরের মেয়ে । বাবার বাসায় মা ভাই ভাবী
– আর স্বামী ?
– আমি বিধবা ,
মাহবুব সাহেবের সব কথাগুলো কোথায় যেন উবে গেছে । একদম চুপ হয়ে আছেন তিনি । নিরবতা ভেঙে জুঁই বলে ওঠে ,
– স্যার আমি কি যেতে পারি ?
– জ্বি অবশ্যই ।
কেবিনে এসে নিজের উপর নিজেই হেসে উঠে জুঁই । হাসতে হাসতে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে যায় চোখ দিয়ে ।
– আজও বিধবা বললে সবার কথা বন্ধ হয়ে যায় । হয়তো আমার শরীর কিংবা বয়সের সাথে বিধবা ট্যাগটা যায় না । রাজশাহীর অফিসেও প্রথম প্রথম এমনটা হয়েছে । এখানেও হয়তো প্রথম প্রথম হবে পরে ঠিক হয়ে যাবে ।
চট করেই ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে নেয় জুঁই । কলমের ছিপি খুলে ডায়েরির মাঝ পাতায় লিখা শুরু করে ,
” আমি আমাতেই বিলীন
আমি আমাতেই অঙ্গার
আমি আমাতেই উচ্ছসিত
আমি উচ্ছ্বাসের মাঝে নুয়ে যাওয়া এক কলি মাত্র
কথা দিয়েছিলে ফিরবে ”
চোখের পানি মুছে নিয়ে ডায়েরি রেখে ফাইলে মুখ গুজে জুঁই । কাজের পরে আবার বাসা খুঁজতে হবে তার । জীবন অতিমাত্রায় তাকে কষ্টের দিকে ধাবিত করছে । আর সে অতি আনন্দেই সেই কষ্টকে আপন করে নিচ্ছে ।
.
.
.
চলবে………………………..