বুকের উপর ভারী অনুভূতি হতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো রিত্তের, দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে ভারী কোনো কিছু বুক চেপে আছে। খুব কষ্টে চোখ মেলে আশেপাশে থাকাতেই খেয়াল করলো, বুকের উপর ঘাপটি মেরে বেড়ালের বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে রয়েছে কেউ। চোখ জোড়া ঝাপসা লাগছে। দ্রুত উঠতে গিয়েই মাথা ঝিম ধরে এলো; কাল রাতের হয়তো একটু বেশি হুইস্কি খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। কোনোমতে চোখ খুলে দেখলো মেয়েটি আর কেউ না বরং তার কাগজের স্ত্রী ধারা। একে মাথা প্রচুর ব্যাথা করছে উপরে বুকের উপর ধারাকে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। রাগে গা রি রি করছে। এক মূহুর্ত দেরি না করে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো তাকে। ঘুমের মধ্যে আচমকা ধাক্কা খাওয়ায় তাল সামলাতে না পারায় খাট থেকে নিচে পরে গেলো ধারা। ধারার শরীরের অবস্থা দেখে আরোও মেজাজ বিগড়ে গেলো রিত্তের। এলোমেলো শাড়ি, ব্লাউজের হুক খোলা, বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে তড়িৎ গতিতে ধারার কাছে যায় সে, হাত টেনে দাঁড় করিয়ে আলমারির সাথে ঠেসে ধরে। এতো জোরে ধরায় ব্যাথায় কুকড়ে উঠে ধারা। অসহায় দৃষ্টিতে রিত্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে রিত্ত,
– বলেছিলাম তো আমার আশেপাশে দশ হাতের মধ্যে যেনো তোকে না দেখি, তারপরও বেহায়ার মতো কেনো আমার কাছে আছিস। লজ্জা করে না? এতো শরীরের চাহিদা তোর? শরীরের চাহিদা যদি না মিটাতে পারিস তো যা না পতিতালয়ে। দরজা তো খুলেই রেখেছি। যেই দেখেছিস কাল আমার হুস নেই অমনি আমার কাছে শরীর ঘেষাতে এসে পড়েছিস তাই না?
– আ…আমি কিছু করি নি, তুমিই তো………
– চুপ, একদম চুপ, আরেকটা শব্দ শুনলে জানে মেরে ফেলবো।
ধারার মুখ চেপে ধরে রাগে রি রি করতে করতে বললো রিত্ত। এবার নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারলো না ধারা। চোখের পানি ছেড়ে দিলো। হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। একে মেজাজ খারাপ উপরে ধারার কান্না দেখে যেনো জ্যন্ত কবর দিতে ইচ্ছা করছে তাকে রিত্তের। এক রকম ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পরলো সে। আর ধারা সেখানেই বসে পড়লো। নড়ার শক্তিটুকু নেয় তার। এমন কেনো লোকটা একবার ও কি বুঝতে পারে না তাকে যে পাগলের মতো ভালোবাসে ধারা।
ছয় মাস হয়েছে এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে ধারা, এক রকম হুট করেই রিত্তের সাথে বিয়েটা হয়েছে তার। রিত্তের মা সুভাসিনী বেগম অনেকটা জোর করেই রিত্তের সাথে ধারার বিয়েটা দেন। দেনাপাওনা না মেটানোর কারণে ধারার বিয়ের আসর থেকে বর বিয়ে ভেঙে চলে যায়। একমাত্র ভাইয়ের মেয়ের সাথে এতো বড় অন্যায় কিভাবে মেনে নিবেন তিনি। সুভাসিনী বেগমের ভাই সেলিম সাহেব গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার। মেয়েটি অসম্ভব সুন্দরী বলে তাকে ছোট বয়সেই বিয়ের ব্যাবস্থা করেন তিনি। আর খুব শিক্ষিত একটা ছেলে পাওয়াতে তিনি আর অমত করেন নি; উপরে মেম্বারের বখাটে ছেলেটা তো আছেই। মেয়েটা শান্তিতে কলেজেও যেতে পারতো না। ছেলেপক্ষের প্রথমে দাবি ছিলো একটা মোটর বাইক; কিন্তু ধীরে ধীরে তা বাড়তে বাড়তে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। দেনা পাওনার চাপে যখন সেলিম সাহেব কুপোকাত তখন সুভাসিনী বেগম সিদ্ধান্ত নেন ধারাকে নিজের ঘরেই আনবেন বউ করে। রাজ্জাক সাহেবের মৃত্যুর পর থকে সুভাসিনী বেগম রিত্তের বাবা-মার দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। তাই ছেলের বিয়ের মতো সিদ্ধান্তও তিনি একা একা নিয়ে ফেললেন; তিনি জানেন ধারার চেয়ে ভালো মেয়ে রিত্ত খুজে পাবে না। আর কি ওই অবস্থায় রিত্তের সাথে ধারার বিয়েটা সেরে ফেলেন তিনি। রিত্তের সম্মতির একবার পরোয়া করেন নি তিনি। তার কাছে তো ধারার সম্মান বাঁচানোটা বেশী জরুরি হয়ে পড়েছিলো তখন। ধারার কাছে এই বিয়েটা যেনো সবকিছু; তখন থেকেই রিত্তকে মনে মনে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নেয় সে। কিন্তু রিত্তের এমন দায়সারা ভাব যেনো কিছুতেই তার মাথায় ঢুকে না। এই ছয়মাস এক রকম দূরে দূরে থেকেই কাটিয়েছে সে। ধারা ভেবেছিলো হয়তো মামাতো বোনকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কাল রাতে তো নিজ থেকে কাছে ডেকে নিয়েছিলো। তাহলে সকালে কেনো আবার এমন রূঢ় আচরণ করছে সে। আচ্ছা, তার কি ধারাকে একদম ই পছন্দ নয়?
সকাল ৯টা,
সুভাসিনী বেগম আর রিত্ত মুখোমুখি বসা ডাইনিং টেবিলে। এখন আর সুভাসিনী বেগমের সাথে না পারতে কথা বলে না রিত্ত। মায়ের উপর চাপা ক্ষোভ তার থেকেই গেছে। একটা অজপাড়াগায়ের অল্প শিক্ষিত আনকালচারড খ্যাত মেয়েকে কি বুঝে নিজের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন তিনি, হোক তার ভাইয়ের মেয়ে। রিত্তর মনে যে অন্য কারোর বাস তা তো অজানা নয় তার; তাহলে কেনো এই অন্যায়টা করলেন তিনি। চুপচাপ নিজের মতো খাচ্ছিলো, ঠিক তখনই খোড়াতে খোড়াতে ডাইনিং টেবিলে এসে হাজির হয় ধারা। চোখ মুখ ভীষণ ফুলে রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর কেঁদেছে মেয়েটা। ধারার চোখ মুখ দেখেই সুভাসিনী বেগম আঁচ করতে পারছেন তার গুণধর পুত্র এই কাজ করেছেন।
– ধারা মা, এভাবে খুড়িয়ে হাটছিস কেনো রে ?
খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন সুভাসিনী বেগম। আমতা আমতা করে পরক্ষণে উত্তর দেয় ধারা,
– বাথরুমে পরে গেসিলাম ফুপু।
ধারার কথা খুব যে তার বিশ্বাস হলো তা কিন্তু নয়। কিন্তু তবুও ধীর গলায় বললেন,
– দেখে চলবি তো নাকি? রিত্ত মেয়েটাকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাস তো।
– আমার মিটিং আছে মা, ঘরে বসে ড্রাইভার হিসেবে মানুষকে এখান সেখান নিয়ে যাওয়ার ঠেকা যায় নি আমার। যদি তোমার ইচ্ছে হয় তুমি নিয়ে যেতে পারো। আসছি
বলেই রিত্ত সেখান থেকে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়লো। পেশায় আর্কিটেক্ট সে; এসব ফালতু মেয়ের জন্য এক মিনিট সময় তার নেই। ধারা কিছুতেই বুঝে পায় না লোকটা তাকে এতো ঘৃণা করে কেনো! সে যে একদম অশিক্ষিত তাও নয়। এবার ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে সে; সেলিম সাহেব বিয়ের সিদ্ধান্ত না নিলে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যেত সে। এই ছয়মাস শুধু অংক মিলিয়ে মিলিয়ে কাটিয়েছে সে। সুভাসিনী বেগম ছেলেকে বুঝাতে বুঝাতে ক্লান্ত, জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়েতে কারোর জোর নেই। ধারার ভাগ্যে সে এবং তার ভাগ্যে ধারাই রয়েছে। কিন্তু রিত্তের জিদের কাছে তাকে হার মানতেই হচ্ছে।
দুপুর ২টা,
খাওয়া দাওয়া শেষে সুভাসিনী বেগমের রুমে বসে পা টিপে দিচ্ছে ধারা তার। ফুপুর সাথে তার সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুত্বের; এই ছয়মাস মায়ের প্রতিরুপ দেখেছে ফুপুর মাঝে। সারাদিন ফুপুর চারপাশেই কাটে তার। এই বাড়িতে মনেই হয় না সে অন্য কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু সমস্যা একটাই; তা হলো রিত্ত। রিত্তকে বুঝতে পারে না সে।
– পায়ের ব্যাথাটা কি কমেছে?
হুট করেই বলে উঠেন সুভাসিনী বেগম। মুচকি হেসে বলে ধারা,
– এখন একদম ই নেই; তুমি একদম ভেবো না তো ফুপু।
– রিত্তকে ফোন দিয়েছিলি?
– দিয়েছিলাম, ব্যাস্ত ব্যাস্ত বলছে। থাক না, সত্যি ব্যস্ত হয়তো।
– আচ্ছা, তুই খুশি তো?
– এটা কেনো বলছো ফুপু?
– রিত্ত তোকে এখনো মেনে নেয় নি তাই না?
– ……………
– আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে, শোন।
রাত ৯টা,
আজ বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে রিত্তের, উপর থেকে কাজের চাপে খাওয়া দাওয়া শিখে উঠেছে। এখন রুমে যেয়ে গা এলিয়ে দিতে পারলে যেনো শান্তি। রুমে ঢুকতেই দেখলো পুরো রুম গোলাপে গোলাপে সাজানো। রুমের এই অবস্থা দেখে মেজাজ আর ঠিক রাখতে পারলো না রিত্ত। জোরে জোরে ধারাকে ডাক দিলে যখন কোনো সারা পায় না, তখন রুম থেকে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় সে। হুট করে পেছন থেকে কেউ একজন জরিয়ে ধরে তাকে। না ফিরেই বুঝতে পারে এই কাজ কার। হাত টা শক্ত করে ধরে টান দিয়ে সামনে আনে তাকে। ধারার পরণে তখন লাল একটি জর্জেটের শাড়ি, খুব সুন্দর করে সেজেছে মেয়েটি। চোখে গাঢ় করে কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। ঢেউ খেলানো চুল গুলো ছেড়ে দিয়েছে। প্রথমে দেখে রিত্ত ও চোখ ফিরাতে পারছিলো না, কিন্তু পর মূহুর্তে যখন মনে পড়লো সামনে থাকা মেয়েটা ধারা তখন রাগ যেনো আর কাবু করতে পারলো না। ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ছুড়ে মারলো তাকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– আজ তোর শরীরের সব জ্বালা যদি আমি না মিটাই তবে আমার নাম রিত্ত না।
যে চোখে ভালোবাসাকে কল্পনা করেছিলো সেই চোখ আজ হিংস্রতায় ঘিরা। বেল্টটা খুলেই……………………
চলবে
#কাগজের_তুমি_আমি
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি