#সাহেব_বিবি_গোলাম
#নুশরাত_জেরিন
#পর্ব:৩
,
,
আমি তীক্ষ্ণ চোখে শুভর দিকে তাকালাম।সে আমায় হঠাৎ মায়াবতী কেনো বললো?এ নামে আমায় প্রিতম ডাকতো সবসময়।
কখনো সে আমার নাম অর্থাৎ পিহু বলে কখনো সম্মোধন করেনি।
কিন্তু অচেনা অজানা একটা ছেলে আমার এই নামে কিজন্যে ডাকলো?
তবে কি?
আমি কেঁপে উঠলাম খানিকটা।মনের ভেতর সন্দেহ উঁকি দিলো।পাশে বসা ছেলেটা কি কোনভাবে প্রিতম হতে পারে?
কিন্তু ছেলেটার নাম তো শুভ?
আমাকে তাকাতে দেখে শুভ বললো,
–আরে নজর লেগে যাবে তো আমার!
এভাবে দেখার কি আছে?আমি জানি আমি হ্যান্ডসাম।
ওয়েট ওয়েট বাই এনি চান্স, সত্যি সত্যি আমার প্রেমে পরে গেছো নাকি?
কথাটা বলেই সে গা জালানো হাসি দিলো।রাগে দুঃখে আমার শরীর জ্বলে উঠলো।
ছেলেটা আস্ত এক বজ্জাত। এমন বজ্জাত ছেলে আমি আমার বাপের জন্মে কখনো দেখিনি।
নিজের উপরই আমার রাগ হলো।আমি কিনা এই বজ্জাত ছেলেকে প্রিতম মনে করছিলাম?এ ছেলে কখনো প্রিতম হতেই পারেনা।আমার প্রিতম কখনো আমায় রাগায় না।
আমি মুখ ফুলিয়ে জবাব দিলাম,
—প্রেমে পরবো তাও আপনার উপর?কখনো না,মরে গেলেও না।মরার পর ভুত হয়ে ঘুরে বেড়ালেও না।
শুভ গা দুলিয়ে হেসে উঠলো।
আমি সেদিকে আর নজর দিলাম না।
মেজাজ ঠান্ডা করার জন্য জানালার দিকে তাকালাম।
বাইরে বৃষ্টির পরিমান কমে এসেছে।ঠান্ডা বাতাস বইছে এখন।শাড়ি পরিহিতা সত্বেও বেশ ঠান্ডা লাগছে আমার।কিন্তু কি আর করার?সাথে কোন চাদর নেই।
ব্যাগে সামান্য কিছু থ্রীপিস আছে।
আমি পরনের শাড়ির আচলটা টেনেটুনে গায়ে ভালোমতো জড়িয়ে নিলাম।
জানালায় মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।ক্লান্ত লাগছে খুব।
জিবনের এই টানাপোড়েনে চলা শুরু করার আগেই ক্লান্ত হয়ে পরেছি আমি,অথচ এখনো কতোটা পথ চলা বাকি!
ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে এসেছে আমি বুঝতেও পারিনি।
চোখ খুলতেই নাকে অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রান এসে বাড়ি খেলো।আমি নাক টেনে সে সুভাস নিলাম।বেশ মোহনীয় ঘ্রান।
শরীরও উষ্ণ লাগছে খুব।
চোখ ডলতে ডলতে চারপাশে তাকিয়েই ছিটকে সরে এলাম।
আমি এতক্ষণ শুভর কাধে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম?ওর হাত জাপটে ধরে?
চোখ বড়বড় করে শুভর দিকে তাকালাম।
কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে আমার এখন।
ঘুমালে আমার হুশ থাকেনা।
আমি প্রচুর ঘুমপাগলি মেয়ে।কিন্তু তাই বলে এখানে অচেনা এক ছেলের কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরবো?এটা কেমন ধরনের ব্যবহার?কি মনে করেছেন উনি?নিশ্চয় আমাকে গায়ে পরা বেলজ্জিত মেয়ে ভাবছেন।
আমার গায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম শুভর গায়ের জ্যাকেটটা জরানো।
আমি ভরকে গেলাম খুব।
আমি কি ঘুমের ঘোরে জ্যাকেটটাও কেড়ে নিয়েছি নাকি?
লজ্জায় মাথা নুয়ে জ্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলাম সামনে।
শুভ তখন আড়মোড়া ভাঙছিলো।হয়তো তারও চোখ লেগে এসেছিলো।আমি ছিটকে সরে আসায় হয়তো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেছে।
সে আমার হাতের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো,আবার আমার মুখের দিকে তাকালো।
বাঁকা হেসে জ্যাকেটটা নিতে নিতে বললো,
—এমনিতেই যে ভয়ংকর দেখতে, লজ্জা পেলে তো আরও ভয়ংকর লাগে।
পেত্নির ঠাকুমা!
আমি ফট করে তার চোখের দিকে তাকালাম।ভালো ঘুম হওয়ায় যে ঠান্ডা ঠান্ডা মেজাজ নিয়ে বসেছিলাম তা হুট করে গরম হয়ে গেলো।
আমি তেড়ে গিয়ে বললাম,
—কিহ?আমি পেত্নির ঠাকুমা?
—তোমাকে কখন বললাম?
আমি জোরের সাথে বললাম,
—বলেছেন।
—উহু,বলিনি।
—না না,আলবাত বলেছেন।
শুভ দুষ্টু হেসে বললো,
—তোমায় বলেছি,একথার প্রমান কি?
আমি চুপ হয়ে গেলাম।একথার প্রমান আমি কোথায় পাবো?কেবলমাত্র বললো তো।কিন্তু অস্বীকার করছে কিভাবে?আমি অবাক হলাম খুব।কি পরিমান শয়তান ছেলেরে বাবা,চোখেমুখে মিথ্যা কথা বলে?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে শুভ আবার বললো,
—বলেছি তার প্রমান দাও।
আমিও দমবার পাত্রি নই।বললাম,
—আমি নিজে তার প্রমান।নিজের কানে শুনেছি আমি।চোখে দেখেছি।
এরচেয়ে বড় প্রমান আর কি হতে পারে?
শুভ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো।বিরবির করে বললো,
—অনেকসময় চোখে দেখা, কানে শোনা কথাও ভুল হতে পারে।
হতেই পারে।
আমি ব্যাপারটা আর ঘাটলাম না।
কিছুক্ষণ বাদে বাস থেমে গেলো।এখন রাত হয়ে এসেছে।হঠাৎ বাস থামায় আমি চমকে উঠলাম।
চারপাশে তাকিয়ে দেখি অনেকেই বাস থেকে নামছে।কিন্তু কেনো?
আমি গলা বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা চালালাম।
শুভ বলে উঠলো,
—গলা লম্বা হয়ে বকের মতো হয়ে যাবে তো!
আমি কপাল কুঁচকলাম। কথাটা কি আমায় বললো?আবার সোজা হয়ে ভদ্র মেয়ের মতো বসে রইলাম।
হঠাৎ বাস থামার কারন আমার মাথায় ঢুকছে না কিছু।
তাছাড়া জায়গাটা কোথায় তাও বুঝতে পারছিনা।ঘুটঘুটে অন্ধকার বাইরে।
হঠাৎ শুভ উঠে দাড়ালো।আমিও দাড়িয়ে পরলাম।
মিনমিন করে বললাম,
—শুনছেন?
শুভ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।
আমি বললাম,
—কোথায় যাচ্ছেন?
শুভ চোখ ছোট করলো।বললো,
—ব্যাপারটা কি বলোতো?
আমি ফ্যাকাসে হেসে বললাম,
—না মানে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
—বলো?
—বাস হঠাৎ এখানে থামলো কেনো?এটা কোন জায়গা?সবাই বাস থেকে নেমে কোথায় যাচ্ছে? আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
শুভ মাথায় হাত দিয়ে আবার সিটের ওপর বসলো।বললো,
—এটা তোমার একটা প্রশ্ন?
কথাটার ভেতর টিটকারি ছিলো।আমি বেশ বুঝতে পারলাম।মুখ ফুলিয়ে বললাম,
—থাক বলতে হবেনা আপনাকে।
শুভ আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে হাসলো।
বললো,
—এখানে একটু বিরতি দিয়েছে।যার যার টয়লেটে যাওয়া দরকার অথবা খাবার খাওয়া দরকার তারা এখানে নেমে সব সারতে পারবে।
একটু থেমে বললো,
—তোমার কি ক্ষিদে পেয়েছে?
আমি জোরে জোরে মাথা নাড়লাম।আমার ক্ষিদে পেয়েছে মানে কি?প্রচুর ক্ষিদে পেয়েছে।
আমার মাথা নাড়ানো দেখে শুভ বললো,
—তাহলে চলো আমার সাথে,পাশেই একটা খাবার হোটেল আছে।আমিও যাচ্ছি সেখানেই।
তুমিও চলো।
আমি উঠে দাড়িয়ে আবার বসে পরলাম।চেনা নেই জানা নেই হুট করে একটা ছেলেকে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে?তাও এতো রাতে?কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে?যদি ক্ষতি করে কোনো?
আমার মনোভাব হয়তে সে বুঝতে পারলো।
আমার দিকে ঝুকে এসে বললো,
—ভয় পাচ্ছো?
আমি শুকনো ঢোক গিললাম। ছেলেটা মনের কথাও বুঝতে পারে নাকি?
শুভ আরোও খানিকটা এগিয়ে এলো।এবার তার চোখদুটোর দিকে সরাসরি তাকালাম আমি।কাছ থেকে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার।কি গভীর চোখ!
আমার ভাবনার মাঝেই সে বলে উঠলো,
—আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই।আর যাই হোক আমার টেস্ট ওতোটাও খারাপ নয়!
কথাটা বলেই সে হাটা শুরু করলো।একটু পিছনে ফিরে বললো,
—ইচ্ছে হলে আসতে পারো।
আমি চোখমুখ কুঁচকে তার পিছুপিছু বাস থেকে নামলাম।
ছেলেটার কি পরিমান সাহস?আমাকে অপমান করলো?
আমি কি এতোটাই খারাপ?
কিন্তু প্রিতম?সে তো বলতো আমি তার দেখা সবচেয়ে মায়াবতী মেয়ে।
যাকে দেখলেই বুক দুরদুর করে ওঠে।
চোখে মুগ্ধতা নামে।
যার কথা ভাবতে শুরু করলে আর কোনকিছু মাথায়ই থাকেনা।
আগের কথা আমার খুব করে মনে পরলো।প্রিতম পরপর কিছুদিন মেসেজ দেওয়ার পর আমি রিপ্লাই দিয়েছিলাম।বলেছিলাম,
—কে আপনি?
মেসেজটা প্রায় সাথে সাথেই সিন হয়েছিলো।রিপ্লাই ও এসেছিলো কয়েক সেকেন্ডের ভেতর।সে লিখেছিলো,
—আমার হৃদ হরণ করে এখন আমাকেই চিনতে পারছোনা মায়াবতী?
আমি অবাক হয়ে তাকে লিখেছিলাম,
—আমি হৃদয় হরণ করেছি আপনার?আপনাকে তো আমি চিনিও না।
সে তার কিছুক্ষণ বাদেই উত্তর দিয়েছিলো,
—আমার মনের মাঝে যার বাস সে আমায় চেনেনা?কথাটা মানা যায়?আর যদি নাও চেনো তো এখন চিনে নাও।দোষের কি আছে?
কথাটা ভাবতেই আমি মুচকি হাসলাম।
প্রিতম,আমার ভালবাসার নাম।
কিন্তু কিকরে তার সাথে যোগাযোগ করবো আমি?কিভাবে দেখা হবে আমাদের? যদি কখনো আর দেখা না হয়?খুজে না পাই?
আমার বুক কেঁপে উঠলো।
এমনটা হলে আমি বাঁচবোনা,একেবারেই বাঁচবোনা।
,
,
চলবে…..