পরিত্রাণ পর্ব ৮

#পরিত্রাণ
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৮

রুমু নিজের ঘরে খিল দিয়ে বসে আছে। রহমান, সুফিয়া বারবার করে দরজা ধাক্কানোর পরেও যখন খুললো না।
বাধ্য হয়ে ইউসুফ চৌধুরী নিজে গেলেন রুমুকে ডাকতে। অনিকের ভিডিও ফলাও করে গনমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। মন্ত্রীর ছেলের কুকীর্তি জনগণের সামনে তুলে ধরতে মুখিয়ে ছিলো গণমাধ্যম কর্মীরা। বাগে পেয়ে আর দেরী করলো না। সত্য মিথ্যা সব মিলিয়ে নানারকম অশ্লীল খবর প্রকাশ করা হচ্ছে। আসিফ ইকবাল মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছেন। ইউসুফ সাহেব নিজেও ভেঙ্গে পড়েছেন। এসবের মাঝে আর রুমুকে জড়িয়ে রাখার কোন কারণ তিনি খুঁজে পেলেন না। তাই আসিফ ইকবালের অনুরোধে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার পরদিনই জরুরী তলব করে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন।

এদিকে, আসিফ ইকবাল রাগে মুখ লাল করে বসে আছেন। অনিকের চুম্বনরত ভিডিও তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। তাঁর অফিসের ম্যানেজারের হাফিজ সাহেব রুমে এসে দেখিয়ে গেছেন। একঝলক দেখেই লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। অনিক মদখোর, বখাটে, উন্মাদ তবুও মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু যেই ছেলে পাবলিকে প্লেসে এতবড় ঘটনা ঘটায় করে তাকে কোনভাবেই ছাড় দেওয়া যায় না। বিষয়টা এখন তার মানসম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতকিছুর পরেও মেয়েকে এখান থেকে না নিয়ে গেলে সমাজের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না তিনি। বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে এতদিন সব সহ্য করেছিলেন। তার ফুলের মত মেয়েটাকে জেনেশুনে জাহান্নামে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছেন কি কষ্ট তার মেয়েকে ভোগ করতে হচ্ছে। আর একমুহূর্তও এই বাড়িতে নয়!

ইউসুফ সাহেব আওয়াজ দিতেই রুমু দরজা খুলে দিলো। ভেতরে ঢুকেই তিনি রুমুর মাথায় একটা হাত রেখে নরম গলায় বললেন,’তোমার বাবা, অনেক্ষন যাবত বসে আছে মা। তুমি জিনিসত্র গুছিয়ে নাও। তিনি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন।’

-‘আমি যাবো না, বাবা।’

-‘ছিঃ মা, তোমার বাবা রাগ করবেন। তিনি যখন নিতে এসেছেন তখন যাও। কিছুদিন থেকে নাহয় চলে এসো।’

-‘একবার গেলে বাবা আমাকে আর ফিরে আসতে দেবেন না।’

-‘সেই ভালো হবে। তুমি বরং তোমার বাবার সাথে ফিরে যাও। নতুন করে জীবন শুরু করো। অনিকটা তো বুঝলো না! আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথে থাকবে।’

রুমু অবাক হয়ে শ্বশুরমশাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলো! আজকে শুধু একটা ভিডিও দেখে সবাই রুমুর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে? তাকে চলে যেতে বলছে? যেই বাবা একদিন নিজে রুমুকে অনিকের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলো তিনিও আজ মেয়ের প্রতি সচেতন হয়ে গেলেন? শুধুমাত্র সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে? দুনিয়ায় সবাই এই ভিডিও দেখে অনিকের ওপর রুষ্ট হলেও রুমু হয় নি। অনিক তাকে ঠকায় নি! সে সত্যি বলেছে। তাঁর এই সরলসুন্দর সত্যিগুলোকে রুমু মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এদের সবাইকে কি করে বোঝাবে? যাকে নিয়ে এত মাতামাতি সে আসিফ ইকবালকে দেখেই কেটে পড়েছে। রুমু দৃঢ় কন্ঠে বললো,’আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না বাবা।’

-‘সেটা কি ঠিক হবে মা? না গেলে তোমার বাবা ভীষণ রেগে যাবেন। একটা মাতালের জন্য তোমার আপনজনদের সাথে বৈরিতা করা কিন্তু ঠিক হবে না। তারাই তো তোমার বিপদের আপদে পাশে দাঁড়াবে?’

-‘আপনার ছেলে কোন দোষ করে নি বাবা। বিনাদোষে আমি কেন তাঁকে শাস্তি দেবো? আপনি গিয়ে বাবাকে বলে দিন, আপনার ছেলে যেদিন সুস্থ হবে তাঁকে সাথে করেই আমি বাবার কাছে যাবো।’

রুমুর আত্মবিশ্বাস দেখে মুগ্ধ হলেন ইউসুফ সাহেব! উচ্ছ্বাসিত গলায় বললেন,’নিশ্চয়ই তুমি সফল হবে মা! আমি এক্ষুনি গিয়ে তোমার বাবাকে বলছি।’


আসিফ ইকবাল প্রথমে ভেবেছিলেন জীবদ্দশায় মেয়ের মুখোদর্শন করবেন না তিনি। এতবড় সুযোগ পেয়েও পায়ে ঠেলে দিলো। উলটো ঐ লম্পট দুশ্চরিত্রটার পক্ষ নিয়ে বাবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো! কিন্তু পিতৃস্নেহ বেশিক্ষণ মেয়ের ওপর রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। একদিন তিনিই তো সব জেনেশুনেই লম্পটটার কাছে মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এখন মেয়ে যদি অভিমানে দূরে সরে যেতে চায় তাহলে তো সেটা দোষের কিছু নয়। মেয়ে তো সেদিন সবকিছু উপেক্ষা করে বাবার কাছেই আশ্রয় চাইতে এসেছিলো কিন্তু তিনি নিজের হাতে তাঁর মেয়ের সর্বনাশ করেছেন। যতই এসব ভাবছিলেন ততই অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন মনে মনে।

ইউসুফ চৌধুরী লজ্জায় কারো কাছে মুখ দেখাতে পারছেন না। তাঁরই আড়ালে তার অধস্তন কর্মকর্তারা তাঁর বিপদে মজা নিচ্ছে। অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে গেটের দারোয়ান পর্যন্ত জানে অনিকের ঘটনা। টাকা পয়সা দিয়ে মেটানোর কোন রাস্তা নেই। ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি। তার সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে অনিক। রোজ রোজ তাকে মিডিয়ার লোকজনের জেরার সম্মুখে পড়তে হচ্ছে! বাধ্য হয়ে বাড়িতে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিলেন, মিডিয়া কর্মীদের কেউ কোনভাবেই যেন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে।

সন্ধ্যার দিকে ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়েছিলেন তিনি। রহমানকে বলে দিয়েছেন কেউ এলে যেন বলা হয় তিনি বাসায় নেই। কোন ফোন যেন রিসিভ করা না হয়। রুমু দরজার বাইরে থেকে নক করলো,’আসবো বাবা?’

-‘এসো মা।’

ইউসুফ চৌধুরী উঠে বসলেন। রুমু অসহায় পিতৃসম মানুষটির দিকে চেয়ে দেখলো তার চোখদুটো বিষণ্ণ। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। ইউসুফ সাহেব নরম গলায় বললেন,’কিছু বলবে মা?

-‘আপনার সাথে একটু কথা ছিলো?’

-‘বলো না!’

-‘কোন খোঁজ পেয়েছেন?’

ইউসুফ সাহেবের পুরোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বেলাল হোসেনের ইন্ধনেই হঠাৎ করে এতদিন বাদে অনিকের এসব ছবি, ভিডিও প্রকাশিত হয়। সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে ইউসুফ সাহেবকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তিনি কৌশলে কলকাঠি নেড়েছেন। বিশ্বস্ত মাধ্যমে খবরটা জানতে পেরেছেন ইউসুফ সাহেব। রুমুর প্রশ্নের জবাবে মলিন হাসলেন। বললেন,’খোঁজ পেয়েও বা লাভ কি মা? ওরা এখন মুখিয়ে আছে আমার রিয়েকশনের জন্য, আমি কিছু বললেই সুযোগ পেয়ে যাবে।’

রুমু আর্জি জানিয়ে বললো,’তাহলে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে বাবা!’

-‘কি বুদ্ধি?’

-‘আপনি সবাইকে বলে দিন আপনার ছেলের সাথে যেই মেয়েটা ছিলো সে আমি ছিলাম।’

ইউসুফ চৌধুরী জিভ কাটলেন। লজ্জিত মুখে বললেন,’ছি! ছি,মা! তাতে সম্মান কমবে বইকি বাড়বে না। তুমি আমার বাড়ির পুত্রবধূ। তোমার একটা সম্মান আছে। আমি জেনেশুনে আমার পুত্রবধূর সম্মান নষ্ট হতে দিতে পারি না।’

-‘তাহলে কি করবেন বাবা? ওরা তো আপনার ছেলের নামে উল্টোপাল্টা নিউজ ছড়িয়েই যাচ্ছে!’

ইউসুফ চৌধুরী হাসলেন। বললেন,’কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে মা, তারপর দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাজা খবর বাসি হতে বেশি সময় লাগে না। তাছাড়া অতীতে অনেকেই এমন স্ক্যান্ডালের স্বীকার হয়েছেন। বড়বড় নেতাকর্মীরাও। আমার তো ইয়াং ছেলে!’

ইউসুফ চৌধুরী হাসিমুখ দেখে রুমু বুক থেকে ভার নেমে গেলো। কিঞ্চিৎ ভরসাও পেলো সে। এদিকে ইউসুফ চৌধুরীও যেন মন খুলে কথা বলতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। শ্বশুর এবং বউমা একে ওপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। রুমু হাসিমুখেই বললো,’আমি আসি বাবা?’

ইউসুফ চৌধুরী মুচকি হেসে সম্মতি জানালেন। রুমু বেরিয়ে গেলে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে প্রার্থনা করলেন,’হে খোদা, আমার সমস্ত ভালো কাজের বিনিময়ে হলেও তুমি এই মেয়েটির মনের সব দুঃখ দূর করে দাও। আমার অনিকের মনে ওর জন্য জায়গা করে দাও। ওদেরকে তুমি সুখি করো খোদা। খুব সুখি করো!’


সন্ধ্যার দিকে অনিক বাসায় ফিরলো। রুমুকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে। যাওয়ার সময় আসিফ ইকবালের সাথে দেখা হয়েছিলো তাঁর। অনিক সালাম করতেই তিনি পা সরিয়ে ধমকে উঠে বললেন,’আমার মেয়ের সর্বনাশ করে আমাকে সালাম করতে হবে না। নিজের কাজে যাও।’ তখনই অনিক মোটামুটি ধারণা করে নিয়েছিলো রুমুকে তিনি জোর করে হলেও নিয়ে যাবেন। এবং তিনি জোর করলে রুমু না করতে পারবে না। কিন্তু রুমুকে দেখে খানিকটা বিপাকে পড়ে গেলো! আসার সময় হাতে করে একবোতল ওয়াইন নিয়ে এসেছিলো সে। ভেবেছিলো রুমু চলে গেছে। ভেতরটা খালি খালি লাগছিলো। তাই বেশকয়েকদিন বাদে আজকে একটুখানি নেশা করবে ভেবে এনেছিলো। যদিও সে মনে প্রাণে নিজেকে বোঝাতে চাইছে তাঁর এই খালি খালি লাগাটা কোনমতেই ভালোবাসা নয়! অনেকদিন একসঙ্গে থাকার ফলে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে রুমু তাই একটু খারাপ লাগছিলো! কিন্তু ভেতরে ঢুকেই রুমুকে দেখে তার ভেতরে আনন্দ, স্বস্তি, ভালোলাগাটুকু তাকে পুনরায় চিন্তায় ফেলে দিলো। রুমুকে দেখে কেন খুশি লাগছে তাঁর! তাঁর তো বিরক্ত হওয়ার কথা ছিলো! মস্তিষ্ক বারবার সতর্ক করে বললো,’লক্ষণ ভালো নয় অনিক! সাবধান!’ নিজেকে সামলে নিলো সে। কিঞ্চিৎ ঠাট্টাসুরে বললো,’তুমি যাও নি?’

-‘দেখতেই তো পাচ্ছো?’রুমুর দৃষ্টি অনিকের হাতের প্যাকেটটার দিকে।

খুব সন্তর্পণে আলমারি খুলে বোতলটা লুকিয়ে রাখতে চাইলো অনিক। কিন্তু রুমু খাটের ওপর থেকেই তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে! চোখ ছোটোছোটো করে বললো,’তোমার হাতে কিসের প্যাকেট!’

-‘অফিসের ফাইল!’

রুমুর সন্দেহ গেলো না। অনিকের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, মিথ্যে বলছে সে। তাই আন্দাজের ওপর ঢিল ছুঁড়ে দিলো,’তুমি আবার বাড়িতে মদ এনেছো তাই? দেখি আলমারির চাবি দাও, আমি দেখবো।’

অনিক নিরুত্তর! লুকিয়ে চুরিয়ে কোনকালেই মদ খেতে হয় নি তাকে। তাই মিথ্যে বলারও প্রয়োজন হয় নি। কিন্তু রুমুর পাল্লায় পড়ে যাও একটু বললো কিন্তু এক্সপ্রেশন ঠিক রাখতে পারলো না। মুখটা করুণ হয়ে গেলো তাঁর। সে শতভাগ নিশ্চিত রুমু এখন বোতলটা ভাংবে। চাবি না দিলে নতুন তালবাহানা শুরু করে দেবে। ধার করে টাকা নিয়ে বোতলটা কিনেছিলো সে। রুমুর জন্যেও মায়া হচ্ছে, বোতলের জন্যেও হচ্ছে। রুমু ফিরে এসেছে, তাই বোতলের জন্য একটু বেশি হচ্ছে। বাইরে থেকেই খেয়ে আসা উচিৎ ছিলো। মনে মনে নিজের ওপর রাগ হলো। কেন সে এমন ভুল করলো! রুমুর হাতে আলমারির চাবিটা ধরিয়ে দিয়ে হনহন করে ফ্রেশ হতে ঢুকে গেলো সে। তাঁর অপ্রত্যাশিত আত্মসমর্পণে রুমু অবাক হলো! পরোক্ষনেই ব্যপারটা বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। তারপর, পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ মেজাজ খারাপ করে বললো,’তোমার যন্ত্রনায় বনবাসে চলে যেতে মন চায়।

অনিক নিজের ওপর রাগ সামলাতে না পেরে রুমুর সাথে মেয়েলি ঝগড়া শুরু করে দিলো। তাঁর এত সাধের বোতল আবার ভাঙ্গা পড়বে অথচ সে কিছুই করতে পারবে না। রুমুর কথার জবাবে সেও ওয়াশরুম থেকে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’ তো যাও না? কে তোমাকে ধরে রেখেছে? তোমার বাবা তো নিতে এসেছিলো, গেলে না কেন? কেন এখানে পড়ে আছো?’

হুট করেই অনিকের বলা কথাগুলো আত্মসম্মানের লেগে গেলো রুমুর! যদিও হাসি ঠাট্টারচ্ছলে অনিকের মুখে এসব কথা আগেও শুনেছে সে কিন্তু তখন এতটা গায়ে লাগে নি! কিন্তু আজ হঠাৎ লেগে গেলো। হয়ত অনিকের কাছে তাঁর এক্সপেকটেশন বেড়ে গেছে বলেই এমন হয়েছে। হঠাৎ করেই চোখে পানি চলে এলো রুমুর। যার জন্য সে নিজের বাবার কথার বাইরে গেছে,সবার সাথে প্রতিবাদ করেছে, সে তাকে চলে যেতে বললো? সত্যিই কি রুমুর থাকা না থাকাতে অনিকের কিছু যায় আসে না?

অনিকের বলা কথা গুলোর কোন প্রতিউত্তর শোনা গেলো না। পুরো ঘর সাড়াশব্দহীন! অনিক ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলো রুমু ঘরে নেই! ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লো সে। মিনিটদশেক বাদে তার জন্য কফি নিয়ে ঘরে ঢুকলো রুমু।

কফির মগটা নেওয়ার সময় রুমুর মুখের দিকে চোখ পড়তেই অনিক অবাক হলো! এ কি? রুমু কাঁদছে? সে কি অনিকের কথায় কষ্ট পেয়েছে?

মুখ ফিরিয়ে নিলো অনিক। কাঁদুক! ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে একটা! ভেবেছে কান্নাকাটি করে অনিককে দুর্বল করে দেবে! অনেক হয়েছে আর না! ইচ্ছে করে কান্নার নাটক করছে! দেখেও না দেখার ভান করে রুমুর কান্নায় গা করলো না সে।

রাতে ঘুমানোর সময় রুমু নিঃশব্দে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। অভিমানে বুকটা ফেটে যাচ্ছে ! অনিকের কাছে তাঁর সামান্যতম মূল্যও নেই! প্রায় নিঃশব্দে, নিরবে চোখের পানি ফেলছিলো সে।

অনিক ঘুমায় নি! রুমুর খুব ধীরেধীরে নাক টানারশব্দ কানে আসছে তাঁর! রুমু কি এখনো কাঁদছে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো! বড্ড বেশি অবহেলা হয়ে গেলো কি! ইশ! কাঁদছে যে!
অস্থির হয়ে উঠে বসলো সে। বাতি জ্বালাতেই রুমুর ঘুমের ভান ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তাঁর চোখের পাতা ঘনঘন নড়ছে। অনিক একদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে হেসে ফেললো। কিন্তু বেশিক্ষণ অভিনয় চালিয়ে যেতে পারলো না রুমু। উঠে বসে গম্ভীর গলায় বললো,’বাতি জ্বালিয়ে বসে আছো কেন?’

-‘আলমারির বোতলটা কি ফেলে দিয়েছো? খুব ঝোঁক উঠেছে!জাস্ট দুই পেগ নেবো।’

রাগে রুমুর মুখ লাল হয়ে গেলো। কারজন্য এতকিছু করছে সে! অনিকের কাছে তো রুমুর অনুভূতির বিন্দুমাত্রও দাম নেই। হতাশা, রাগে, অভিমানে অনিকের প্রশ্নের জবাবে চুপ করে রইলো সে। চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে!

অনিক উঠে আলমারি থেকে বোতল বের করলো। রুমু অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রুমুর রাগের সুযোগ নিয়ে অনিক আবার নেশা করতে বসছে! বেচারি না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে,অনিক অকস্মাৎ বোতলটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’এই যে আর খাবো না। তোমাকে দিয়ে দিয়েছি, নাও ধরো। এক্ষুনি ফেলে দাও। বেশি রাগ হলে এটা দিয়ে আমার বাড়ি মারো কিন্তু মুডটা ঠিক করো প্লিজ! এভাবে কান্নাকাটি করো না! তুমিও ঝগড়া করেছো, আমিও করেছি। তাই মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে, সরি।’

রুমু নিঃশব্দে অনিকের মুখ পানে চেয়ে রইলো! সে কি স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি? অনিক? সত্যিই অনুতপ্ত চেহারা অনিকের! অনিক তাঁকে সরি বলছে! ইশস! রুমুর যে কি খুশি লাগছে! ভদ্রমাতালটা সরি বলতে শিখে গেছে! অত্যাধিক খুশিতে শব্দ করে হেসে ফেললো সে। তাঁর হাসি দেখে অনিকও হাসলো। আলমারি বন্ধ করে বিছানায় রুমুর পাশে বসে বললো,’মদ খেতে দেবে না ভালো কথা। কিন্তু একদিনে যদি অভ্যাস বদলে দিতে চাও তবে সেটা তো আমার জন্য জুলুম হয়ে গেলো? আমার দিকটাও তো একটু বুঝতে হবে?’

-‘হোক। এমনিতেই মদ খেয়ে খেয়ে নিজের ওপর অনেক জুলুম করেছো তুমি। আরেকটু জুলুম করলে কিচ্ছু হবে না।’

অনিক হাসলো। রুমুর একটা হাত ধরে টেনে ওকে নিজের সামনে বসিয়ে বললো,’মাতালরা যে মদ ছাড়া থাকতে পারে না, সেটা জানো?’

-‘জানি। কিন্তু তুমি পারবে? তুমি হচ্ছো ভদ্র মাতাল।’

অনিক শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠে বললো,’কি বললে? ভদ্র মাতাল? বাহ,সুন্দর তো!’

-‘হ্যাঁ। একেবারে সন্ন্যাসী ধরনের ভদ্র মাতাল! কারণ মাতালদের মদ ছাড়াও আরো অনেক কিছুর নেশা থাকে। তোমার তো সেসব কিছুই নেই!

-‘যেমন?’

-‘যেমন মেয়ে মানুষের নেশা, টাকার নেশা,প্রেমের নেশা, খুনের নেশা, চুরির নেশা, আরো অনেক ধরনের নেশা। তোমার তো কেবল মদের নেশা!’

অনিক যেন ছোট একটা বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করছে তেমনি কিঞ্চিৎ আদরের সুরে প্রশ্ন করলো,’তাই আমি ভদ্র মাতাল?’

-‘হ্যাঁ।’

অনিক সম্মতিসূচক মাথা দোলালো। মুচকি হেসে বললো,’বেশ ভালো! মাতালদের সম্পর্কে তোমার জ্ঞান দেখে খুশি হলাম। মাতালের যোগ্য বউ তুমি!’
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here