#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৯
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
অর্কের কথাটা কেমন যেন বিশ্রী লাগলো। বিয়ের উপহার বলতে তার দেওয়া উপহার নয়, বিনয়ের দেওয়া উপহারের কথা বলছে প্রভা। তার নিজের স্বামীর সামনে আগের স্বামীর উপহারের কথা বলাটা কী মানানসই?
অর্ক সে পায়েল পরালো না। উঠে দাঁড়ালো। বলল, “যেয়ে এইবার দেখিয়ে আসো।”
“কিন্তু এখনো কয়েকটা আছে।”
অর্ক কাঠখোট্টা কন্ঠে বলল, “গয়না পরে দেখাতে বলেছে। বলে নি সবগুলো পরে দেখাতে হবে। যা পরিয়েছি তাই অনেক।”
বলেই অর্ক চলে গেল।
.
.
ঝিনুক বাসায় এসে আরামে বিছানায় বসলো। গত কয়দিন ধরে তার যে খাটুনি হচ্ছে তা কম কিসের। তার মনে হচ্ছে এত ঝামেলার পরও মানুষ বিয়ে কেন করে? আর তার বিয়েতো এমন এক মহান মানুষের সাথে হয়েছে যাকে সে দুইচোখে সহ্য করতে পারে না। ঝিনুক চোখ বন্ধ করে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে শুরু করল।
হঠাৎ করে তার মনে হলো তা পাশে কেউ শুয়ে আছে। চোখ খুলে পাশে তাকাতেই দেখে সৈকত। মুহূর্তে লাফ দিয়ে উঠলো সে। কান থেকে হেডফোন খুলে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এইখানে কেন এসেছ?”
সৈকত এক গাল হাসি নিয়ে বলল, “মাই ডিয়ার ওয়াইফ আপনি হয়তো ভুলে গেছেন যে এইটা আমার রুম।”
“তোমার সাথে ঝগড়া করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি তাই যাচ্ছি আমি। থাক নিজের রুম নিয়ে। ফাজিল একটা।”
ঝিনুক উঠে যেতে নিলেই সৈকত তার হাত ধরে এক টান দিল। ঝিনুক যেয়ে পড়ল তার বাহুডোরে। ঝিনুক বিরক্তি নিয়ে উঠতে নিলেই সৈকত দুইহাত দিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে ধরল। ঝিনুক ঝাঁজালো গলায় বলল, “কি ফাইজলামি করছ আবার। ছাড় তো।”
“উফফ মাই ডিয়ার ওয়াইফ। গতকাল আপনার জন্য আমি ঘুমাতে পারি নি। তাই এখন ঘুমাব।”
“তো ঘুমাও না মরে যাও আমার কিছু আসে যায় না। আমাকে ছাড় তো।”
“আমার তো কোলবালিশ ছাড়া ঘুম হয় না। আর কোলবালিশটা বিনুর জন্য নিয়ে গেছে। তুমি কোলবালিশের রিপলেশমেন্ট।”
ঝিনুক রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “নিজের বউকে কেউ এইভাবে বলে?”
“মানে তুমি মেনে নিয়েছ যে তুমি আমার বউ।”
ঝিনুককে আবারও কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। হুমকির সুরে বলল, “এখন ছাড়, নাহয় তোমার সব কর্মকাণ্ড আমি বাহিরে যেয়ে বলে দিব।”
“তুমি যে বাসায় মিথ্যা বলে আমার সাথে পালিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলে সেটাও?”
ঝিনুক চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইল সৈকতের দিকে। তারপর অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী চাই?”
“শুধু তোমাকে।” বুকটা কেঁপে উঠলো ঝিনুকের।সৈকতের সুরে এক ধরনের নেশা থাকে। যে নেশা মাতাল করার জন্য যথেষ্ট।
সৈকত এক হাত ঝিনুকের কোমর থেকে সরিয়ে তার চুলগুলো খুলে দিলো। ঝরঝরে ছড়িয়ে গেল তার কেশ। মিষ্টি সুরভী এসে লাগলো তার নাকে। সৈকত দীর্ঘশ্বাস নিশ্বাস নিয়ে সে চুলগুলোতে মুখ ডোবাল। আর বলল, “শুধু একটুখানি এমন মাতাল থাকতে দেও। তোমার নেশার সামনে পৃথিবীর সকল নেশা তুচ্ছ।”
ঝিনুক চোখ বন্ধ করে সৈকতের শার্টটা আঁকড়ে ধরল। ঘন নিশ্বাস ফেলে বলল, “দোহাই লাগে এমন অত্যাচার আর কর না।”
“একটু বুকের মাঝে ভরে রাখতেই তো চাইছি। এতটুকুতেও এত কেন বাঁধা।”
“ছেড়ে দেও। তোমার বুকে মাথা রেখে আগেও দহনই শুধু পেয়েছি।”
সৈকত ছাড়লো না। উল্টো আরও মিশিয়ে নিলো তার সাথে। বলল, “দুটি বছর তোমাকে নিজের করে পাই না আর এখন বলছ পেয়েও যেন যেতে দেই? একদম না।”
“অনেক জ্বালাচ্ছ।”
“তুমিও তো এত বছর ধরে জ্বালিয়েছ।”
“আমার কাছে আসার প্রয়োজন কী? মেয়েদের কমতি আছে না’কি?”
সৈকত মুখটা ঘুরিয়ে ঝিনুকের গালে আলতো করে চুমু খেয়ে আবারও কেশের মাঝে মুখ ডোবাল। তার চোখ বন্ধই ছিলো। বলল, “যে কেউ তো আর তুমি না।”
ঝিনুক আর কিছু বলল না। অবশ্য বলতে পারল না। তার চোখের কোণে থেকে শুধু জল গড়িয়ে পরল। সে জল সৈকতের কাঁধে এসে পরল। সৈকত সাথে সাথে মাথা তুলে নিলো। উঠে বসে ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “তুমি কাঁদছ কেন? সরি জান সরি আমি আর তোমার কাছে আসব না। শুধু কান্না কর না। এইতো আমি চলে যাচ্ছি।”
সৈকত যেতে নিলেই আচমকায় ঝিনুক তার গলা জড়িয়ে ধরলো। ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বলল, “তুমি আমার কাছে থাকলেও জ্বালা দূরে গেলেও জ্বালা। একবার তো দূরে চলেই গিয়েছিলে ফিরে এলে কেন আবার?” আবার সৈকতের গলা ছেড়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, “কেন এলে আবার ফিরে?”
“আমি আসি নি, নিয়তি ফিরিয়ে এনেছে।”
ঝিনুক চোখ খুলে তাকাল। চোখে চোখ পড়ল। ঝিনুক চাইছিল সে নেশাগ্রস্ত চোখ দুটোয় ডুবে যেতে। ডুবে গেলও। চোখ দুটো বন্ধ করে আবারও সৈকতের গলা জড়িয়ে ধরতেই দরজায় টোকা পরল। সাথে সাথে ঝিনুক পিছিয়ে যেয়ে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে গাল মুছে নিল।
সৈকত উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, “আবার কে আসছে আমার রোমেন্সের দুশমন। আর সময় পায় না মানুষগুলা, আমার রোমেন্সের সময়ই টপকায়তে হবে।”
দরজা খুলে মা’কে দেখে বলল, “আরে মা তুমি? আমি তোমাকেই মনে করছিলাম।”
কথাটা শুনেই ঝিনুক চমকে তাকালো সৈকতের দিকে। সৈকত আবারও বলল, “ঝিনুক তুমিও না বুঝে কী আবল তাবল বকছিলে। মা ও আসলে বুঝে নি যে তুমি, নাহলে তো বলতোই না যে মানুষ কেন যে রোমেন্সের মাঝে টপকায়।”
ঝিনুক হা হয়ে গেল কথা শুনে। উঠে দাঁড়িয়ে মা’য়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “আন্টি ও মিথ্যা কথা। আমি—-”
মা তাকে থামিয়ে বলল, “তোমার সাফাই দিতে হবে না মামনী। আমি জানি তো এই ছেলেটা কত দুষ্টু। কথাটা নিশ্চিত ওই বলেছে।”
মা সৈকতের কান মলা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক বলেছি না?”
“মা ব্যাথা পাচ্ছি তো।”
মা সৈকতের কান ছেড়ে বাক্সগুলো বিছানায় রেখে বলল, “ঝিনুক এখান থেকে একটা বাছাই কর।”
“আন্টি এইসবের প্রয়োজন নেই।”
“প্রভার মতো কর না তো। মেয়েটা তো নিতেই চাইছিল না। একটা বাছাই কর, মা’য়ের আদেশ এইটা।”
ঝিনুক দ্বিধায় পরে বলল, “মা আপনি করে দিন।”
তখনই সৈকত একটা কুনদনের সাদা ও সোনালী সেট উঠিয়ে বলল, “এইটা ঝিনুকের উপর ভালো লাগবে। এটা সাথে লাল, নীল, কমলা আসলে যে কোনো রঙের ড্রেসেই ওকে মানায়।” চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “কালোর উপর সোনালী রঙের কাজ,” চোখ খুলে বাকিটা বলল, “এর উপর এই সেট। একদম পরীর মতো লাগবে।”
এই ছেলেটা কি তাকে লজ্জায় ফালাতে ভালোবাসে? একটু আগে এক কান্ড করল আবার এখন। মা বলল, “ঠিকাছে, তুই ঝিনুককে এইটা পরিয়ে দাদিমাকে দেয়। আর দাদিমা’কে যেয়ে দুইজনে একসাথে দেখিয়ে আয়।”
“তুমি থাক আমার সমস্যা নেই।”
ঝিনুক বিরক্ত নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আন্টি আজ একটু খারাপ লাগছে আরেকদিন পরিয়ে দেখাই?”
সৈকত বলল, “আজব তো পরাব তো আমি। তোমার সমস্যা কী?”
সৈকতের কথা যেন কারও কানেই গেল না। মা উঠে বলল, “ঠিকাছে তুমি আরাম কর। আমি মা’কে বলে দেই।”
মা যেতেই সৈকত বলল, “সমস্যা কী? আমি পরিয়ে দিতাম।”
ঝিনুক হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “মাই ডিয়ার হাসবেন্ড আপনার মতলব কী আমি ভালো মতো জানি। খবরদার কালকে আমাদের বাসায় যেয়ে এইসব লুইচ্চামি কররা না, নাইলে মাথা ফাটায় দিব।”
বলেই ঝিনুক প্রভাকে খুঁজতে যেতে নিলো। আবার একবার ফিরে তাকালো সৈকতের দিকে। বলল, “দয়া করে অতীত আমার সামনে আর এনে রেখ না আর। আমি বহু কষ্টে সে স্মৃতিগুলোর ভবন থেকে বেরিয়ে এসেছি। সে স্মৃতি ভবনে আর যেতে চাই না।”
চলে গেল ঝিনুক।
রাতে বৌভাতে অনুষ্ঠানের পর ফেরার জন্য দুই জোড়াকে নিয়ে যাওয়া হলো বাবার বাড়িতে৷ সকালে আসার কথা হলেও প্রভার বাবা মেয়ের শশুড়বাড়িতে রাত থাকবে না বিধায় রাতেই এসে পরলো। সেখানে কোনো মেহমান নেই বলেই চলে। ঝিনুক তার খালুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ না। আর মেয়ের দ্বিতীয় বিয়েতে লোকেকে কথা বলার সুযোগ করে দিবে এমনটা প্রভার মা চাইতেন না। তাই বিয়েতে অনেক কম মানুষ এসেছিল আর এর মধ্যে প্রায় সবাই চলে গেছে। শুধু প্রভা ও ঝিনুকের মামার পরিবার ছিলো।
রাত তখন বারোটা বাজে। ঝিনুক ও প্রভা গল্প করছিল প্রভার মা’য়ের সাথে। তখনই গিটারের শব্দ কানে এলো ঝিনুকের। সাথে তার চিরচেনা এক গানের সুর কানে ভেসে উঠলো,
বেখেয়ালি দিনগুলো আজ ফিরে পেতে চাই,
চাই না যে আর কিছু শুধু তোকে চাই,
আমার….. মনের ধারে শুধু তোকে তোকে চাই,
এই মন পাড়ায় আর জায়গা নাই,
শুধু তোকে চাই, শুধু তোকে চাই।
এই মন পাড়ায় আর জায়গা নাই,
শুধু তোকে চাই, শুধু তোকে যে চাই।
ও হো হো হো…..ও হো হো হো….
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_১০
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
বেখেয়ালি দিনগুলো আজ ফিরে পেতে চাই,
চাই না যে আর কিছু শুধু তোকে চাই,
আমার….. মনের ধারে শুধু তোকে তোকে চাই,
এই মন পাড়ায় আর জায়গা নাই,
শুধু তোকে চাই, শুধু তোকে চাই।
এই মন পাড়ায় আর জায়গা নাই,
শুধু তোকে চাই, শুধু তোকে যে চাই।
ও হো হো হো…..ও হো হো হো…
দিনের শেষ প্রহরে তোমাকে চাই,
আকাশ মেঘলা হয় যদি তোমায় যেন পাই,
ও আমার স্বপ্নবিলাসী আমায়——
হঠাৎ করে কেউ হাত থেকে গিটার নিয়ে গেল।সৈকত মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে ঝিনুক। সৈকতের পাশে বসা বিনু বলল, “ছোট মা তুমি গিটার নিয়ে নিলে কেন?”
ঝিনুক রাগান্বিত দৃষ্টিতে সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “এত রাতে গান বাজনা করছ কেন?”
বিনু বলল, “ছোট মা আমি আর অদিন চাচ্চুকে বলেছি যেন আমাদের গান শুন।”
ঝিনুকের রাগ বর্ষণ হলো তাদের উপরও, “এইটা কোনো সময় গান শোনার। যাও যেয়ে ঘুমাও।”
অদিন আহ্লাদী করে বলল, “কিন্তু খালামণি—-”
“চুপ করে যেয়ে ঘুমাও। যাও বলছি।”
বিনু অদিনকে সৈকতের কোল থেকে নামিয়ে বলল, “চল চল ছোট মা’য়ের মেজাজ খারাপ। পরে মাইর খাব দুজনে।”
বিনু অদিনকে নিয়ে বের হওয়ার পর ঝিনুক যেয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো আর সৈকতের সামনে এসে বলল, “কী সমস্যা তোমার? ইচ্ছা করে কেন এইসব করছ?”
“আমি কী করলাম?”
“খবরদার আমার সামনে নাটক করবে না। এই গান তুমি ইচ্ছা করে গাইছিলে যেন আমার নিজের অতীতের কথা মনে পড়ে আবার। মনে পড়ে যায় যে তুমি আমার আর তোমার ভালোবাসার ভিত্তিতে এই গান লিখেছিলে। যেই ভালোবাসাটাই ছলনা ছিলো কেবলমাত্র।”
সৈকত গিটারটা বিছানায় রেখে বলল, “ছলনা? ছলনা না, বিশ্বাসের অভাব ছিল কেবলমাত্র।”
“বিশ্বাসের কথা তোমার মুখে মানায় না।” বলে ঝিনুক যেতে নিলেই সৈকত ঝিনুকের হাত ধরে নিলো। আর বলল, “তোমার বিশ্বাস হোক বা না হোক। তোমার প্রতিক্রিয়া দেখে আমি নিশ্চিত যে তুমি আমায় আজও ভালোবাসো।”
ঝিনুক কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। তার চোখে পানি এসে পরলো। রাগে না কষ্টে সে নিজেও বুঝতে পারছিলো না। গিটারটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমার ভালোবাসারও এই অবস্থা করেছি আমি। সেই ভালোবাসা এখন আর নেই।”
“আজ সকালে কে জানি আমাকে এইভাবে জড়িয়ে প্রেমালাপ করছিল।” সৈকত ঝিনুককে জড়িয়ে ধরে বলল। ঝিনুক তাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। বলল, “কাছে আসার চেষ্টা করলে খুন কইরা ফেলব। লুইচ্চা একটা।”
ঝিনুক মাটিতে লাথি মেরে যেতে নিলেই সৈকত বিছানায় বসে বলল, “এইটা তোমার প্রিয় ভাইয়ের গিটার ছিলো না? তোমার খালু আগামীকাল তোমার ক্লাস নিবে। রেডি থেকো ডার্লিং।”
ঝিনুক সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। পিছনে ফিরে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো। চিকন সুরে বলল, “আমাকে আগে বল নি কেন? খালু আমার কানের খুন করে দিবে কাল।”
সৈকত বেখেয়ালি ভাবেই বলল, “আমার কী তোমার, তোমার ভাইয়ের আর খালুর ব্যাপার।”
“ভাইয়ার নামও আছে। পরিশ ভাইয়া।”
“পরিশ হোক বা খবিস আমার কিছু আসে যায় না। ওই শালার নাম দিয়ে আমি কী করব?”
ঝিনুক সৈকতের মুখের সামনে আঙুল তুলে বলল, “এই আমার ভাইয়াকে গালি দিবা না।”
“আজব তো আমি গালি কোথায় দিলাম? সে তোমার ভাই, তুমি আমার বউ, সে তো আমার শালাই হলো।”
ঝিনুক বিরক্তি নিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।
.
.
অর্ক রুমে ডুকে দেখল প্রভা কাপড় গোছাচ্ছে। অর্ক জিজ্ঞেস করল, “অদিন আজ আমাদের সাথে ঘুমাবে না?”
“মা ওকে নিজের কাছে রাখছে।”
“তোমার বাবার সাথে কথা বললাম। উনি বিনয়ের পরিবারের কথা বলছিলো,” প্রভা কাজ থামিয়ে দিল। অর্ক বলল, ” অথচ সে জানেই না তার মেয়েরই সব দোষ।”
প্রভা কিছু না বলে কাপড়গুলো আলমারিতে রেখে দিলো। আর একটি বিছনার চাদর বের করে নিচে বিছিয়ে নিল। অর্ক কঠিন কন্ঠে বলল, “তোমাকে এক কথা বারবার কেন বলা লাগে? বিছানায় ঘুমাও, নাহয় পরে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
“আপনি আমাকে শাস্তি দিতে চান আমার চিন্তাও করেন যে ঠান্ডা লেগে যাবে?” প্রভা অর্কের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “দুটো তো একসাথে অসম্ভব। ”
“যা বলেছি তা কর।”
“ঘুমে আমি নড়াচড়া করি তাই যদি ভুলে আপনার কাছে চলে যাই এইজন্য।”
অর্ক প্রভার কাছে এসে তার বাহু আঁকড়ে ধরে আলমারি ঠেকিয়ে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমি যখনই মাথা ঠান্ডা রাখতে চাই তখনই তুমি কেন এইসব কথা বলে আমার মেজাজ আরও গরম করে দেও কেন? তোমার শাস্তি আমি না আইন দিবে। আমি একবার বলেছি উপরে ঘুমাবে তো এমনই হবে। আমার সামনে এমন ঢঙ করতে আসবে না। সম্পর্ক যে কারণেই হোক না কেন আমি তোমার স্বামী এই কথা মনে রাখবে। আমার ছোঁয়ায় তুমি অপবিত্র হয়ে যাবে না।”
অর্ক যেয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। প্রভাও কিছুক্ষণ পর এসে বিছনায় শুয়ে পরলো। অর্ককে সে কোনো কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না।
সকাল সকাল হঠাৎ কিছু শব্দে অর্কের ঘুম ভেঙে যায়। চোখে খুলে সে দেখল যে প্রভা তার রুম থেকে বের হচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল ৫.৩৬ বাজে। সে বুঝতে পারছে না এত সকালে সে কোথায় যাচ্ছে। অর্ক উঠে তার পিছনে গেল। অর্ক দেখল প্রভা তাদের ছাদের উপর যাচ্ছে। ছাদে উঠে দেখে প্রভা তাদের ছাদের কোণের এক ছোট বদ্ধ জলাশয়ের পাশের সিঁড়িতে বসেছে। ছাদের বর্ডার পর্যন্ত চারকোণা ছোট পুকুর। এবং তাতে সিঁড়ি নামানো। সে পুকুরের মতো জায়গায় কিছু নকল শাপলা রাখা যা ভাসছে।
প্রভা সিঁড়িতে বসে তার চুলগুলো খুলে দিলো। যে চুল তার কোমর ছাড়িয়ে সিঁড়ি বয়ে গেছে। প্রভা সবসময়ই তার চুল খোঁপা করে রাখে। তার চুল এত ঘন, এত লম্বা, এত সুন্দর অর্ক জানতো। প্রভা সে জলে হাত বুলিয়ে এক হাসি দিলো। সকালের কাঁচা সোনালী রোদ্দুরে তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এর উপর হলুদ রঙের সুতির শাড়িতে তাকে দেখে মনে হচ্ছে বসন্ত চলে আসছে। আর তাকে লাগছে বসন্তিকা।
অর্ক এগিয়ে যেয়ে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ালো। প্রভা বোধহয় আভাস পেল কারও আসার। সে অর্ককে দেখেই উঠে দাঁড়ালো। মাথা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এইখানে—-কিছু লাগবে কী?”
“কেন আমি আসতে পারি না?”
“পারবেন না কেন? অবশ্যই পারবেন। আমি চা বানিয়ে আনছি আপনার জন্য।”
প্রভা যেতে নিলেই অর্ক বলল, “আমি তো তোমাকে বলি নি যে আমি চা খাব। বসো এইখানেই।”
প্রভা আদেশ মেনে বসে পরলো। অর্ক বসলো অপরদিকে। পুকুরটা দেখে বলল, “এইটা কবে বানিয়েছে? আমি আগে দেখি নি।”
প্রভা ইতস্তত করে বলল, “ঝিনুক বানিয়েছে। মানে ওর ইচ্ছায় বানানো হয়েছে। হয়েছে বছর চারেক।”
“তুমি কী অবাক সাথেই এইভাবে কথা বল না’কি আমি বিশেষ।”
প্রভা উওর দিলো না। অর্ক আবারও জিজ্ঞেস করল, “তুমি রাতে ঘুমালে দেরি করে আজ এত সকালে উঠে গেলে?”
“আমি প্রতিদিন ফজরের আযানের সময় উঠে পড়ি। অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“এতক্ষণ ঘুমালে হয়ে যায়?”
“অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।”
“তুমি সেলোয়ার-কামিজ পর না। সমসময় শাড়িতে দেখি।”
প্রভা জলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “বিয়ের পর বিনয়ের মা বলেছিল ঘরের বউদের শাড়ি পরা উচিত। সাথে বিনয়ের অনেক পছন্দ ছিলো আমায় শাড়িতে—-”
বলতে বলতেই থেকে গেল। চোখ তুলে একপলক অর্কের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো।
অর্ক প্রভার কথা শুনে তার পায়ের নুপুরের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, “তুমি আজও বিনয়কে ভালোবাসো?”
প্রভা উওর দিলো না। অর্ক একটু কেশে বলল, “আজ নিজের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা করে নিও। আমরা আগামীকাল সন্ধ্যাতেই রওনা দিব।”
“আমার কোনো বন্ধু নেই।”
অর্ক বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “বান্ধবী নেই? স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটিতে বান্ধবী ছিল না?”
“স্কুল, কলেজে বান্ধবী ছিলো কয়জন। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। আর যোগাযোগ না থাকায় তারা কোথায় আমি জানি না। আর ভার্সিটিতে তো কখনো পড়ি নি। ভার্সিটিতে থাকবে কীভাবে?”
অর্ক চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। তাকে চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। সে বলল, “কিন্তু বিনয় তো বলেছিল তুমি এদিকের কোনো ভার্সিটিতে পড়।”
“ওহ।”
“ওহ মানে? বল ও কেন বলেছে এবং তুমি ভার্সিটিতে পড় না মানে কি?”
প্রভা অর্কের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলল, “আমি কিছু বললে কী আপনি বিশ্বাস করবেন? করবেন না। তাহলে শুধু শুধু বলে লাভ কী বলুন।”
অর্ক কিছুক্ষণ প্রভার দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর উঠে পড়লো। বাহিরে যেতে নিলেই তার চোখ যেয়ে আটকালো হলুদ রঙের টগর ফুলের দিকে। সে ফুলটিরকে একপলক তাকিয়ে আবার তাকালো প্রভার দিকে। গাছটির দিকে যেয়ে দুটো টগর ফুল ছিঁড়ে নিলো। প্রভার কাছে গেল। প্রভার পাশে বসে ফুলগুলো তার কানের কাছে গুঁজে দিল।
প্রভা কারও ছোঁয়া পেতেই চমকে উঠে পাশে তাকালো। অর্ক তার দিকে চুলে ফুল গুঁজে দেয়৷ চোখে চোখ পড়লো। হলো প্রথম শুভ দৃষ্টি মিলন।
চলবে……
[