তখনও জানতাম না আমি আলিফ কোন সাধারণ মানুষ না।বলতে গেলে আচমকা ওর সাথে আমার পরিচয়।এক দিন সকাল বেলা ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাবা দাদুবাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠলো।আমি আর মা কিছুতেই বাবাকে না যাওয়ার জন্য মানাতে পারছিলাম না।বাবাকে অনেক বুঝালাম আবহাওয়া ভালো হলে যেন যায়।কিন্তু বাবা আমাদের কোন কথা না শুনে ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে বেরিয়ে পড়লো দাদুবাড়ির উদ্দেশ্যে।আমাদের দাদুবাড়ি প্রায় অজপাড়াগাঁ-ই ধরা যায়।দাদুবাড়ি যেতে হয় বড় একটা হাওর পেরিয়ে।তার উপর বন জঙ্গলে ঘেরা ।নৌকা দিয়েই গ্রামের মানুষ যাতায়াত করে।দাদুবাড়িতে আমাদের কেউই এখন থাকে না তাও বাবার অনেক টান দাদুবাড়ির জন্য।কিন্তু এভাবে ঝড়ের দিনে বাবা দাদুবাড়ি রওয়ানা দিবে সেটা আমাদের ভাবনার অতীত ছিল।যাই হোক বাবা বেরোনোর ঘন্টা কয়েক পরেই বাবার সাথে আর ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না।বার বার ট্রাই করেও বাবার ফোন সুইচটঅফ দেখাচ্ছিল।
মা তখন ভয়ে,চিন্তায় কাঁদতে লাগলেন।আমি কোন রকম মাকে সামলাচ্ছিলাম।নিজেও টেনশনে মনে হচ্ছিল অজ্ঞান হয়ে যাব।মাকে সামলানোর জন্য অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে মাকে সামলে ছিলাম।আমার ফুপুতো বোন চম্পা সেও আমাদের সাথেই থাকে, সে মাকে বার বার অনেক কিছু বুঝিয়ে সামলাচ্ছিল।
তারপর বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা বেলা বাবা বাসায় ফিরলো সাথে কয়েক জনকে নিয়ে।তাদের মধ্যে একজন অল্প বয়সী ছেলে অচেতন অবস্থায় ছিল।বাবা সাথের কয়েকজন লোককে নিয়ে ছেলেটাকে গেস্টরুমে শুয়ে দিলো।আর আমাকে বললো ডাক্তারকে ফোন করতে।বাবার শরিরও ঠিক নেই বুঝে ছিলাম আমি।দেরী না করে তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ফোন করলাম।ডাক্তার এসে ছেলেটার মাথায় ক্ষত জায়গায় বেন্ডেজ করে দিলেন আর মেডিসিন লিখে দিলেন।
আমি বাবার সাথে আসা বাকি কয়েকজন লোকের মুখে শুনলাম হাওরে নৌকা থেকে পড়ে বাবা ডুবে যাচ্ছিলেন। এই ছেলেটা কোথা থেকে এসে পানিতে ঝাপিয়ে পড়লো।তারপর বাবাকে পানি থেকে টেনে নৌকায় তুলে দিলো।কিন্তু স্রোতের টানে আর আর প্রচন্ড বাতাসে নোকার গোড়ালি এসে ছেলেটার মাথায় খুব বাজে ভাবে আঘাত করলো। সাথে সাথে তার মাথা ফেটে গেলো সে পানিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই এই কয়েকজন লোক তাকে টেনে নৌকায় তুলনেন কিন্তু সে ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে।ঝড়-জলের দিন গ্রাম্য এলাকায় ডাক্তারের কোন দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বুঝেই বাবা সোজা ওকে বাসায় নিয়ে এলো।বাবার সাথে আসা লোক গুলো এরপর চলে গেলো।মা খুব জোরাজোরি করলো কিছু খেয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু তাড়া রাত বাড়ার আগেই চলে যেতে চায়।
ডাক্তার আংকেল বাবাকেও দেখলেন।বাবার তেমন কিছু হয়নি ভয় পেয়ে প্রেশার একটু লো হয়েছে।ডাক্তার আংকেল ছেলেটার জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। আমি আর মা আর চম্পা রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে আছি ছেলেটার শিওরে। আর বাবা পাশেই সোফায় বসে আছে। ডাক্তার আংকেল ও বিছানার কাছে একটা চেয়ারে বসে বার বার ছেলেটার পাল্স দেখছিলেন।হঠাৎ জ্ঞান ফিরলো তার।সে চোখ খুলেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।আমি তাড়াতাড়ি করে ওকে সামনে থেকে দেখার জন্য ওর পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালাম।আর প্রথমবার আমি ওকে পরিস্কার দেখলাম।অসম্ভব সুন্দর দেখতে ছেলেটি।তার চোখ গুলো এতো সুন্দর যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।আমি চোখ নামিয়ে ভাবছিলাম এতো সুন্দর একটা ছেলের চোখ হয় কীভাবে।এত মায়া এর আগে আমি কোন ছেলের চেহারায় দেখিনি।এক মনে ভাবছিলাম হঠাৎ ছেলেটার কথা কানে যেতেই আমি বাস্তবে ফিরে এলাম।সে আস্তে আস্তে বলছে,আমি কোথায় আছি?
কন্ঠ তো নয় যেন মধু।আমি ভাবছি ছেলেটা দেখতে যেমন সুন্দর গলার স্বরটাও অনেক বেশি সুন্দর নিশ্চই গান গাইতে পারে।বাবা এগিয়ে এসে ছেলেটার সাথে কথা বলতে শুরু করলো। উৎকন্ঠা নিয়েই বাবা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো,এখন কেমন লাগছে বাবা?তুমি আমার বাসায় আছো।চিন্তার কোন কারণ নেই এখানে তোমার কোন অসুবিধা হবে না তুমি সুস্থ হলেই ফিরে যাবে কিন্তু যতদিন সুস্থ না হও আমার বাসায় আমি তোমার চিকিৎসা করানো এবং যত্ন নিতে চাই।
বাবার কথায় ছেলেটি চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে বললো,আমি কোথায় ফিরে যাব?
বাবা একটু অবাক হয়ে ডাক্তার আংকেলের দিকে
তাকালো তারপর ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,তোমার বাড়ি কোথায় বাবা?কোথা থেকে এসে তুমি এভাবে ঝাপিয়ে পড়ে আমাকে এতো বড় সাহায্য করলে?
ছেলেটা এবার অসহায় ভাবে বললো,আমি কাকে সাহায্য করলাম আপনাকে আমি চিনিই না।আর আমার বাড়ি কোথায়।আমার তো কিছু মনে পড়ছে না। আমি কোথা থেকে এলাম এখানে।ছেলেটা উত্তেজিত হয়ে পড়লো। ডাক্তার আংকেল সাথে সাথে একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।তারপর আমাদের বললেন ওর মাথায় খুব বাজে ভাবে আঘাত পাওয়ার কারণে ওর সম্ভবত মেমরি লস হয়েছে।এটা টেম্পোরারিও হতে পারে আবার লং টাইমের জন্যও হতে পারে ওর কিছু টেস্ট করতে হবে তখন বলা যাবে।
বাবার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ পড়লো।ডাক্তার আংকেল বুঝিয়ে বললেন ছেলেটিকে হসপিটালে এডমিট করতে।আমার কাছে ব্যপারটা কেমন নাটকীয় মনে হলো।এরকমও হয় নাকি! বাস্তবে কারোর স্মৃতি শক্তি হারিয়ে যায়।যাই হোক বাবা ছেলেটাকে নিয়ে হসপিটালে গেল।মাকেও সাথে নিয়ে গেল।বাসায় আমি আর চম্পা। রহিমা খালাও কাজ শেষ করে নিজের বাসায় চলে গেছে।এতবড় বাসায় এই ঝড় বৃষ্টির দিনে চম্পা আর আমি বেশ গুটিসুটি মেরে আমার রুমে শুয়ে আছি।আমরা একটা বিষয়ে গল্প করছিলাম।হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে চম্পা বললো,একটা জিনিস খেয়াল করেছিস ইরা?
-কি?
-ওই ছেলেটার পিঠের মধ্যখানে একটা দাগ।সম্ভব জন্মদাগ।
-হুম ।তো কি হয়েছে? জন্মদাগ থাকতেই পারে তুই এতোকিছু খেয়াল করেছিস কীভাবে?
-যখন ভেজা শার্ট খুলে মামি ছেলেটার গা,মাথা মুছে দিচ্ছিলেন তখন খেয়াল করলাম আর খেয়াল করার যথেষ্ট কারণ ছিল তাই খেয়াল করেছি।
আমি একটু নড়েচড়ে বললাম,
-কি কারণ বলতো?
চম্পার চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ দেখলাম।কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা চিন্তা করলো তারপর ঢুক গিলে বললো, ইরা ওই ছেলেটির পিঠের দাগটির মতো তোর ঘাড়ের নিচেও একটা দাগ আছে।
-মানে?
-তোর ঘাড়ের নিচে একটা দাগ আছে না?মামি যে সব সময় বলে জন্মদাগ। একদম তারার মতো দেখতে সে জন্যই তো তোর নাম সাইয়ারা রাখা হলো মানে তারকা।
ওই ছেলের পিঠে ঠিক একই রকম একটা তারা।
চম্পার কথা শুনে এক মুহুর্তের জন্য আমি অবাক হলাম কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো জন্মদাগের মিল থাকতেই পারে।পৃথিবীতে এমন শত শত মানুষ আছে হয়তো যাদের জন্মদাগ মিলে যায় এটা সেরকম অবাক করা ব্যপার না।তার উপর চম্পা সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে ভয়ের চোটে কি দেখেছে হয়তো অন্য রকম একটা দাগকে ওর কাছে আমার জন্মদাগের মতো মনে হয়েছে।
চম্পার ডাকে আমি ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এলাম।বলছে,কি ভাবছিস তুই? নিশ্চয়ই ব্যপারটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছিস না?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, -হুম তেমন গুরুত্বপূর্ণ না এটা।
চম্পা বিরক্ত হয়ে বললো,-জানতাম তোর কাছে আমার কোন কথাই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না।
ওর কথা শুনে আমি হাসলাম এই মেয়েকে রাগানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ওর যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সেটাতে গুরুত্ব না দেয়া।যাই হোক হঠাৎ আমার কি যেন মাথায় এলো চম্পাকে বললাম, গেস্ট রুমে যাবি?
-গেস্ট রুমে কেন?
-এমনিই চল একটু দেখে আসি।
চম্পা আর মানা করলো না আমার সাথে যেতে রাজি হয়ে গেল।দুজনেই পাশাপাশি হেটে গেস্টরুমের সামনে গিয়ে দাড়ালাম।ঝড়ের গতি মনে হয় আরও বেড়ে যাচ্ছে। গেস্টরুমের সাথেই বেলকনি থাকায় বাতাসের ঝাপটায় আমি কেঁপে কেঁপে উঠলাম।চম্পা তাড়াতাড়ি করে বেলকনির দরজা আটকে দিতে গেল।আমি গেস্টরুমে ঢুকলাম মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাকে এসে লাগলো।
যে সে ঘ্রাণ না পুরোই মাতাল করা একটা ঘ্রাণ। কয়েক মিনিটের জন্য আমি একটা ঘুরের মধ্যে চলে গেলাম।আমার ঘাড়ের নিচে জন্মদাগটায় আচমকা ব্যথা লাগলো। মনে হচ্ছে কেউ সুই ফুটিয়ে দিয়েছে।
ঘরের বাতি জ্বলছিল না সারা ঘর অন্ধকার কিন্তু সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই।চম্পা ঘরে ঢুকেই বাতি জ্বালালো।সাথে সাথে ঘ্রাণটা তীব্র থেকে হালকা হয়ে যাচ্ছিল।ব্যাথাও হালকা হচ্ছিল আমি নিজের অজান্তে চম্পাকে ঝাপটে ধরে প্রশ্ন করলাম,মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পাচ্ছিলি চম্পা?
চম্পা কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর কিছু একটা চিন্তা করে বললো,- হ্যাঁ পাচ্ছি।সম্ভবত ওই ছেলেটা ভালো কোন পারফিউম ব্যবহার করে সেটার ঘ্রাণ এখনও রয়ে গেছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, চম্পা এতো ঝড় বৃষ্টির দমকা হাওয়ার মাঝে পারফিউমের ঘ্রাণ এখনও থাকবে?তাছাড়া আগে তো পাইনি।ঘরে ঢুকে যতটা তীব্র ঘ্রাণ পেয়েছিলাম এখন সেটা পাচ্ছি না।
– থাকতেও তো পারে, অথবা আসেপাশে কোথাও ফুল গাছ আছে সেখান থেকেই ঘ্রাণ আসছে।
-আর এই ঘরে ঢুকতেই আমার ঘাড়ের দাগটার কাছে প্রচন্ড ব্যথা লাগছে কেন বলতো।আগে তো কখনও এখানটায় ব্যথা লাগেনি।
আমার কথা শুনে চম্পা আবারও আমার দিকে এ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।কি যেন ভাবছে খুব মন দিয়ে।তারপর দ্রুত বলা শুরু করলো,
-আরে ধুর জন্মদাগে ব্যথা কেন করবে এমনিই মনে হয় ঘাড়ে ব্যথা করছে তুই চল তো, ঘরে চল।
চম্পা নিজের কথা শেষ করে আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই টেনে নিয়ে এলো।ওর এমন অদ্ভুত আচরণে আমি সত্যি অবাক হয়ে গেলাম।কিছুক্ষণ পর বাবা ফোন করে বললো তারা আজকের রাতটা হসপিটালেই কোন রকম কাটিয়ে দিবে। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাসায় আসতে পারছে না তাছাড়া অচেনা ছেলেটার কখন কি লাগে একা রেখে আসবেও বা কীভাবে।
আমি আর চম্পা খাওয়াদাওয়া শেষ করে দুজনেই এক রুমে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সেই রাতে আমি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম।
চলবে…
★প্রেতপুরুষ
লিখা: উম্মেহানি মিম