#ভালোবাসি_প্রিয় #পর্ব_৪৫ #সুলতানা_সিমা
ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে অরিন। দিহানকে ফোন দিবে নাকি দিবেনা এটা ভাবতে ভাবতে দু’ঘন্টা পার করে দিছে। দিহানের দেয়া মেসেজটা পড়ে মনের ভেতর অস্থিরতা চলছে। দিশা কেমন আছে এখন, জ্ঞান ফিরেছে কিনা, সুস্থ আছে কিনা, জানতে মন আঁকুপাঁকু করছে। কিন্তু দিহানকে ফোন দিতে দ্বিধাবোধ করছে। দিশা কখনোই অরিনের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি তাই দিশার উপর রাগ থাকার মানেই হয়না। অরিন দিহানকে ফোন দিলো কিন্তু ফোন বন্ধ। অরিন ফোন রেখে শুয়ে পড়লো। দু’ঘন্টা হলো সে বাসায় এসেছে। দিহানের কথা খুব মনে পড়ছে। সকালে নাকি কিছুই খায়নি। না খেয়ে চলে গেছে। তানভী বলেছে দিহান এখান থেকে গিয়েছে সকাল ১০টায়। অরিনের ফোনে দিহানের মেসেজ এসেছে ১০:৩৮। তাহলে তো দিহান না খেয়েই দেশে চলে গেছে। এখন রাত ১০টা বাজে। সারাদিনে কী কিছু খেয়েছে দিহান? অরিনের কলিজা বার বার মুচড় দিয়ে উঠছে। একটুপরে অরিনের ফোন বেজে উঠল। তৎক্ষণাৎ ফোন হাতে নিলো অরিন। রিংটোন শুনে তাঁর মনে আগে দিহানের নাম উঠেছে। ফোন রিসিভ করে দেখলো সত্যি সত্যিই ওপাশ থেকে দিহানের গলা শুনা যাচ্ছে । দিহানের গলা শুনে অরিনের মনে শান্তি ফিরে আসলো। ভালোবাসা যে আগের মতোই রয়ে গেছে। তাইতো দিহানের জন্য এতো কাঁদে মন। _হ্যালো! কথা বলনা কেন?” দিহানের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে অরিনের। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল” _হুম বলুন। _সরি বউ সারাদিন অনেক ঝামেলায় ছিলাম তাই ফোন দিতে পারিনি। কেমন আছো। _হুম। _হুম কী? _ভালো। _আমার প্রিন্সেস কেমন আছে? _ভালো। _আর আমার বউ? _দিশা আপু কেমন আছেন? _ভালো আছে। খাইছো? _জ্বি। আপনি? _হ্যাঁ খাবো। নীলদের বাসায় এসেছিলাম। একটু বাইরে আসলাম তোমার সাথে কথা বলবো বলে। তোমাকে কিছু বলতে চাই বউ। _আমার ঘুম পাচ্ছে রাখছি। _এইইইই রাখবা না প্লিজ। কথাগুলা ইম্পর্টেন্ট। _ওকে। তারাতাড়ি বলুন। _শাওন মনে হয় দিশাকে ভালোবাসে। আর দিশাও মনে হয় শাওনের জন্য এইকাজ করছে। আমি চাইছিলাম ওদের বিয়ে দিতে। তুমি কী বলো? _আপনার বোন আপনি কার কাছে বিয়ে দিবেন, না দিবেন সেটা আপনি জানেন, আমি কী বলবো। _আমার বোন বুঝি তোমার কিছু না? ভুল করলে আমরা করেছি আমার বোনরা তো করেনি। ওঁর উপর কিসের রাগ তোমার? আমার বোন বলে? দিহানের এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজে পায়নি অরিন। সত্যিই তো। দিশার উপর কিসের রাগ করছে সে? সেই কালো রাতে তো ছিলো দিশার গায়ে হলুদ। সেদিন তো শুধু সে তাঁর বন্ধুর মতো বোন ইশিকে হারায়নি। সেদিন তাঁর বিয়েও ভেঙে গেছিলো। একটা মেয়ে বিয়েতে রাজি থাকুক বা না থাকুক, কখনোই চায়না বিয়ে ভাঙ্গার মতো কলঙ্ক তাঁর গায়ে লাগুক। ওইদিন দিশা লাল বেনারসি পড়ে বসে থাকার বধলে ইশি সাদা কাফন পড়ে ঘুমিয়ে ছিলো। এমন পরিস্থিতিতে তো দিশার অরিনের দিকে খেয়াল থাকার কথা ছিলোনা। তাহলে কেন তাঁর রাগ দিশার উপরে হবে? অরিন একটা দীর্ঘশাস চেপে নিয়ে বলল” _দিশা আপুর এখনো বিয়ে হয়নি? _উঁহু। ও বিয়ে করতে চায়না। আর আরেকটা কথা, জানো লুপাও বিয়ে করেনি। ও তো তোমার মতো ডক্টর হয়ে গেছে। আর জিহান ভাইয়ার একটা ছেলে। জানো একদম আমাদের মেয়ের মতোই কিউটের ডিব্বা। লারা লুপার নাম শুনেই অরিনের মনের দমে যাওয়া রাগটা জেগে ওঠল। রাগে বিছানা খামছে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করল। চোখ দুটো আগুন রূপ ধারন করেছে। চোখে ভেসে উঠল লুপার সেই বেইমানি প্রকাশ পাওয়ার দৃশ্য। মুখোশের আড়াল থেকে যখন লুপার মুখটা বেরিয়ে এসেছিলো। লারা যখন অরিনের হাতে পিস্তল তোলে দিয়েছে। সব ভেসে উঠছে চোখে। এতবড় ধোঁকা দিয়েছে লুপা আর লারা। এতো বড় ধোঁকা? কে বলেছে কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হয়না? ওঁরা তো মনে হচ্ছে খুব সুখে আছে। রাগে অরিনের মাথা ফেটে যাচ্ছে। _এই বউ কী হলো কথা বলছো না কেন? জানো বউ খুব মিস করছি তোমায়। কাল এই সময়টা তে আমরা কই ছিলাম মনে আছে? আমি কিন্তু আবার যাচ্ছি তোমার কাছে। _কেন আসছেন? আমাকে পোড়াতে? শান্তি হয়নি আপনার? আরো পোড়াতে চান? _এসব কী বলছো সোনা? একটা ভুল করেছি বলে আমার ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে গেলো? _সত্যি কারের ভালোবাসতে বুঝি জানেন আপনারা? আপনারা তো শুধু জানেন ধোঁকা দিতে। ধোঁকা। _ অরি প্লিজজজজ। আর কত রাগ থাকবে? আমি ভুল করেছি, শিকার করছি আমি। অরি তুমি পালিয়ে না গেলে দেখতে আমি তোমাকে আনতে গেছিলাম। _আপনার কথা শেষ হলে ফোন রাখতে পারেন। _বউ প্লিজ একটু বুঝো আমায়। আমি কী করতাম বলো? পাগল হয়ে গেছিলাম আমি। মাথা কাজ করছিলো না আমার। আমি পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো বউ আমি একটুও ভালো ছিলাম না। উপরওয়ালা আমাকে অনেক শাস্তি দিয়েছে। প্লিজ এবার তো ক্ষমা করে দাও। _কোন মুখে ক্ষমা চান। লজ্জা করেনা? আরে আমার তো ঘৃণা হয় আপনাকে। মানুষ রূপী অমানুষ গুলার বসবাস আপনার বাড়িতে। কষ্ট কাকে বলেন বুঝেন আপনারা? আপনাদের তো পাথরের মন। কারো কষ্টে আপনাদের মন কাঁদেনা। আরে শাস্তি কী বুঝবেন কীভাবে? শাস্তি বুঝতেন যদি আমার জায়গায় থাকতেন। কাউকে বিশ্বাস করে ধোঁকা খাওয়ার শাস্তি কেমন হয় তখন বুঝতেন। অরিনের কথায় কিছুক্ষণ চুপ থাকলো দিহান। তারপর ধরা গলায় বলল” _আমি আমার শাস্তি পেয়েছি অরি। তবুও যদি তোমার মনে হয় আমার আরও শাস্তি পাওয়া উচিত। তাহলে উপরওয়ালার কাছে শাস্তি সরূপ মৃত্যু চাইলাম আমি। রাখলাম। ভালো থেকো। দিহান ফোন রেখে দিলো। শেষের কথাগুলা বলেছে সে অনেক কষ্ট করে। যেন কথা গলা দিয়ে বের হচ্ছিলো না। অরিনের বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। এ কী বলল দিহান। অরিনের অভিমান দিহানের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে না তো? দিহান তো তাঁর ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। তাহলে কেন অরিন বার বার ফিরিয়ে দিচ্ছে। দিহান তো যা করেছে না বুঝে করেছে। লুপা,লারা দিহানের মা যা করেছে তাঁরা জেনে শুনে করেছে। ক্ষমার অযোগ্য তো হলো এরা। দিহান নয়। তাহলে কেন সে দিহানকে আরও শাস্তি দিচ্ছে। দিহানকে শাস্তি দিয়ে তো সে নিজেও অনেক কষ্ট পাচ্ছে। অরিন দিহানকে ফোন দিলো। কিন্তু দিহানের ফোন বন্ধ। মাত্রই তো কথা হলো। একেরপর এক ফোন দিচ্ছে অরিন, বার বার বন্ধ বলছে। তবুও অরিন ফোন দিয়ে যাচ্ছে। ফোন দিতে দিতে একসময় ডুকরে কেঁদে উঠল অরিন। দিহান যেন উল্টা পাল্টা কিছু না করে এটাই দোয়া করছে। _______________________________________ দিশাকে নিয়ে বাসায় এসেছেন অনেক্ষণ হলো। সেই যে দিহান হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেছিলো আর আসেনি। একবার শুধু দিশাকে ফোন দিকে কথা বলে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে ফোন রেখে দিছে। সুমনা চৌধুরী দিহানকে ফোন দিলেন। ফোন বন্ধ বলছে। নীলকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন দিহান কই। নীল জানালো বাইরে গেছে এখনো ফিরেনি। সুমনা চৌধুরীর রাগ হলো। হঠাৎ করে কী এমন হলো দিহানের। কী এমন কারণ যে দিহান উনার সাথে কথা বলছে না। দিশাকে খাওয়ানোর পর অষুধ খাইয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন তিনি। সকালে তো বাসায় আসবে তখন জিজ্ঞেস করে নিবেন। শাওন বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। ধোঁয়া সব দল বেধে বেধে উড়ে যাচ্ছে। কষ্টগুলাও যদি সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে উড়িয়ে দেওয়া যেতো। তাহলে পৃথীবির সব থেকে সুখী ব্যক্তিটি হতো সিগারেট খোর। প্রতিটি অলিতে-গলিতে থাকতো সিগারেটের ধোঁয়ার ছড়াছড়ি। কারণ মানুষ যে থাকতো তখন কষ্ট উড়াতে ব্যস্ত। দু মগ কফি নিয়ে এসে শাওনের পাশে দাঁড়ালো নীল। _আর কয়টা খাবি? এবার থাম।” নীলের কথায় একটা টান দিয়ে সিগারেট ফেলে দিলো শাওন। বুকটা পোড়ে যাচ্ছে তাঁর। দিশার উপর যতই রাগ থাকুক দিশার প্রতি ভালোবাসা তো কমে যায়নি তাঁর। দিশাকে অন্যকারো হতে দিবেনা সে। তাঁর রক্তের সাথে দিশা মিশে গেছে। কিছুতেই দিশাকে ছেড়ে দিতে পারবে না। শাওনের ছোট ভাই বিয়ে করে ফেলছে শাওন আজও বিয়ে করছে না তাঁর একটাই কারণ, তা হলো দিশা। আজ প্রস্তুতি নিয়েছে দিহানকে বলে দিবে সে আর দিশা একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। কিন্তু দিহান তো এখনো বাসায় আসছে না। কফির মগ হাতে নিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে শাওন বলল” দিহানকে ফোন দিছিলি? _ফোন বন্ধ বলছে। আছে হয়তো কোথাও চলে আসবে অস্থির হস না। _দিহান কী এটা ভাব্বে আমি তাঁকে ঠকিয়েছি? _এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? কিছু হবেনা। টেনশন নিস না। কিছু বলল না শাওন। কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটল। নিরবতা ভেঙে নীল বলল” _শাওন আম্মুকে একটু বুঝাবি? _কোন ব্যাপারে? _আমি শামুকে বিয়ে করতে পারবো না রে। আমি লুপাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে ওকে পাবোনা এটা ভাবলে। _তুই লুপাকে ভালোবাসিস? “কিছুটা অবাক হয়ে বলল শাওন। নীল ব্যথিত গলায় বলল” _শুধু ভালোবাসি না রে। অনেক বেশি ভালোবাসি। কিন্তু আম্মুর অতীত আমায় দূর্বল করে দেয়। পারিনা আম্মুকে কষ্ট দেওয়ার মতো কিছু বলতে। _হুম চিন্তা করবি না। আমি এখনি আন্টির সাথে কথা বলে আসছি। _এখনি? _হুম। একটা রাত পার হওয়া মানে তোর বিয়ের একটা দিন এগিয়ে আসা। শাওন নীলের মায়ের রুমে এসে বসলো। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিলেন। শাওনকে দেখে বইটা রেখে চশমাটা খুলে বইয়ের উপর রাখলেন। তারপর মিষ্টি করে শাওনকে বললেন “এখন মন চাইলো আন্টির রুমে আসতে? _সরি আন্টি। আপনার রুম আর নীলের রুম কী, সব কিছু তো আপনারই। _হা হা হা তাই। আচ্ছা, তোমার মাকে কিন্তু বিয়ে দুদিন আগে আনবো গিয়ে না করবা না। _আন্টি কিছু কথা ছিলো। _হুম বলো অনুমতি চাইছো কেন? _আন্টি। আসলে,,,,,নীল এ বিয়ে করতে চায়না। _জানি। এটাও জানি নীল কেন করতে চায়না। আমি নীলকে বুঝিয়েছি ও বুঝেছে। শামু মেয়েটা খুব ভালো। আমার বিশ্বাস নীল শামুকে না মেনে থাকতে পারবে না। _মেনে নেওয়া আর আপন করে নেওয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য আছে আন্টি। মেনে নেওয়া যতটা সহজ কাউকে আপন করে নেওয়া ততটা সহজ নয়। _নীল আমার ছেলে বাবা। আমি নীলকে খুব ভালো করে চিনি। আমার বিশ্বাস নীল আর যাই করুন তাঁর মায়ের পছন্দকে ছুঁড়ে ফেলবে না। দেখো বাবা নীল এমন একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিলো, যে মেয়ে তাঁর পরিবারের সাথে বেইমানি করেছে, তাঁর পরিবারের সম্মান নিয়ে খেলেছে। এই মেয়েটাকে আমি কেন? কোনো মাও তাঁর ছেলের জন্য এ মেয়েকে বিয়ে নিতে রাজি হবেনা। সন্তান ভুল কাউকে বেছে নিলে, বাবা মায়ের কাজ হলো সে থেকে তাঁর সন্তানকে ফিরিয়ে আনা। আমি খুশি হবো বাবা এ নিয়ে তুমি কিছু না বললে।” শাওনের গলায় এসে সব গুছানো কথা এলোমেলো হয়ে গেলো। কী বলবে কীভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। বুক ছেঁড়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে আসলো ওখান থেকে। নীল দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কিছু শুনেছে। বুক ভারি হয়ে আসছে তাঁর। ইচ্ছে করছে এখন গিয়ে উনাকে কিছু বলতে কিন্তু না,যা বলার সকালে বলবে। উনি রাজি হলে হবেন না হলে নাই। লুপাকে যদি পায়না তাহলে তাঁর জীবনে আর কারই স্থান হবে না।
চলবে……।