ভালোবাসি প্রিয় পর্ব শেষ

#ভালোবাসি_প্রিয়
#শেষ_পর্ব
#সুলতানা_সিমা

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দিশা ফ্লোরে একটা বালিশ ছুঁড়ে মারল। অসয্য লাগছে তাঁর। ইচ্ছে করছে শাওনকে টাসিয়ে কয়েকটা থাপ্পড় দিতে। এতোই যখন তেজ তাহলে বিয়ে করলো কেন? শাওন রুমে এসে একবার ফ্লোরে তাকিয়ে আবার চলে গেলো বারান্দায়। দিশা এবার হাতের চুড়িগুলা সব খুলে ছুঁড়ে ফেলে ফ্লোরে। চুড়ি পরার ঝনঝন শব্দে শাওন রুমে আসে। দিশা কান্না করছে আর রাগে গিজগিজ করছে। শাওন চুড়িগুলা খুঁড়িয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো। এসে খাটে বসতেই দিশা ঝাড়ি দিয়ে বলল”

খবরদার এখানে শুবা তো। চুপচাপ গিয়ে ফ্লোরে ঘুমাও।” শাওন কিছু বলল না। সত্যি সত্যি চুপচাপ শুয়ে পরল ফ্লোরে। ঠান্ডার মাঝে এভাবে শুয়ায় শীত লাগলো তাঁর। কিন্তু কিছুই করার নাই। দিশার রাগ আরো বেড়ে গেলো। ভেবেছিলো এভাবে রাগ দেখালে শাওন এসে জড়িয়ে ধরে রাগ ভাঙাবে, কিন্তু সে তো উল্টো কাজ করলো। দিশা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ওয়াসরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে আসলো। শাওন শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে। রাগে দিশার কান্না চলে আসলো। রাগে গিজগিজ করে বলল ” বাড়ি গেলে আমি আর আসবো না। থাকুক যে যার ইচ্ছে মতো।” বলেই কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পরলো সে। দিশার কান্ডে শাওনের হাসি পাচ্ছে। দিশার ফ্যাসফ্যাসে কান্নার শব্দ শুনা যাচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে তাঁর। কিন্তু সে নড়বে না। দেখা যাক দিশা কতক্ষণ রেগে থাকতে পারে।

অনেক্ষণ ঘুমানোর জন্য চেষ্টা করেও যখন ঘুম পেলো না। তখন উঠে শাওনের পাশে এসে শুয়ে পরল। শাওন এতোক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলো। দিশা আসতেই কাৎ হয়ে অন্যদিকে ঘুরে শুইলো। দিশা শব্দ করে কাঁদতে লাগল। শাওন দিশার দিকে ঘুরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তারপর দিশাকে কোলে নিয়ে খাটে এনে রাখলো। কম্বলটা টেনে দুজনের গায়ে নিয়ে শুয়ে পরল। টান দিয়ে দিশাকে বুকে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”কেঁদো না কান্না থামাও। নয়তো মাইর দিবো। চুপচাপ ঘুমাও ভ্যাঁ ভ্যাঁ করলে দিহানকে ফোন দিয়ে বলব,তোর বোনকে নিয়ে যা এসে।”

দিশা শাওনের বুক থেকে মাথা তুলতে ছটফট করছে। শাওন কপালে চুমু এঁকে আহ্লাদী গলায় বলল, “এমন করনা বউ প্লিজ। আমি জানি তোমার খারাপ লাগছে কিন্তু বিশ্বাস করো আমি নিজেকে স্বাভাবিক কর‍তে পারছিনা। তোমার উপর আমার রাগ নেই দিশা। রাগ সব আম্মুর উপর। আমার খুব রাগ হচ্ছে উনার উপর। উনি তখন মেনে নিলে আমাদের আজ এমন দশা হতো না। আর আমাদের বাচ্চাটাও বেঁচে থাকতো।” দিশা কিছু বলল না। নিঃশব্দে কেঁদে গেলো। শাওন বলল,”কান্না থামাও। বললাম তো তোমার উপর কোনো রাগ নাই।
_কিন্তু তুমি তো বলেছিলে আমায় শাস্তি দিবে। পাঁচবছর বাচ্চা নিবেনা। আমার কাছে আসবে না।
_দূর পাগলী। ওটা তো এমনি বলছিলাম। তোমার থেকে দূরে থাকা কী সম্ভব বলো? খুব শীঘ্রই আমরা বাচ্চা নিবো। যেন এই বাচ্চার জন্য ওই বাচ্চা ভুলে যেতে পারি।” শাওন দিশার কপালে আবারও চুমু এঁকে দিলো। তারপর বলল,” কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা কেমন করেছো জানো? পেত্নীর মতো। এবার ঘুমাও নয়তো মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে।” শাওনের বুকে একটা চুমু এঁকে চোখ বন্ধ করে নিলো দিশা। তাঁর মায়ের উপর তো তাঁর নিজেরও খুব রাগ হয়। উনার ইগোর কারণে যে উনার সন্তানরা কষ্ট পায় সেটা কখনো উনি বুঝতে পারেন না।

__________________________

নিয়ম অনুযায়ী দুইদিন পরে দুজামাই আসে শান্তি নীড়। কাল সকালেই সবাই এসে উঠেছে শান্তি নীড়। দিহানের বাবা উঠতে চাননি কারণ দিহান উঠেনি তাই। কিন্তু দিহানের রিকুয়েষ্টের জন্য উঠতে হলো। দিহান তাঁর বাবাকে বলেছে শাওন যতই আমাদের পরিবারের বিষয়ে জানে ওর পরিবার জানেনা। তাই সবাই এক সাথে থাকো দিশার জেনো কারো থেকে কথা শুনতে না হয়, নিজের বাপের বাড়ি নিয়ে।

নীল আর শাওন এসে আগে দিহানকে খুঁজলো। যখন জানলো দিহান বাড়িতে উঠেনি তখন তাদের মুখ কালো হয়ে যায়। দুজনই দিহানকে অনেকগুলা কল দেয় কিন্তু দিহান ধরেনা। একসময় দিহানের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। নীলের আর শাওনের রাগ হয় দিহানের ব্যবহারে, কিন্তু নিজেদের দমিয়ে নেয় তারা। দুজনের সাথেই তাদের রিলেটিভের কেউ না কেউ আছে। এসব শুনে যাওয়া অবশ্যই তাদের জন্য লজ্জার ব্যাপার।

লারা আর দিয়া মিলে কিচেনের সব কাজ সামলাচ্ছে। রুহান একটু পর পর কিচেনে আসছে, আর দিয়ার সাথে চোখাচোখি করে যাচ্ছে। লারা অবশ্য এখনো কিছুই টের পায়নি। দিয়া বেচিনে সবজি ধুচ্ছে,লারা মাছ ভাজতেছে। রুহান কিচেনে আসলো। এসে লারাকে বলল,”কী করেন ভাবী?” লারা বলল,”এই নিয়ে ১৩বার।
_কী তেরো বার?
_তুমি আসলে আর এই কথাটাই জিজ্ঞেস করলে।
_কী করবো সময় কাটছে নাতো, তাই বার বার আসছি।
_নতুন দুইটা দুলাভাই পেলে। যাও না তাদের সাথে গল্প করো।
_সারাজীবন বড় ভাইয়ের মতো দেখেছি, সম্মান করেছি, এখন দুলাভাই ডাকি কেমনে? আর মজা বা করবো কেমনে?
_তাও ঠিক বলেছো।,” রুহান দিয়ার দিকে তাকাচ্ছে দিয়া তাঁর মতোই কাজ করে যাচ্ছে। তাঁর চোখ এদিকে নাই। রুহান নাইফটা হাতে নিয়ে খুব সাবধানে নিচে ফেলে দিলো।

_ভাবী নাইফ পরে গেছে এটা তুলো।” রুহানের কথা নিচে তাকালো লারা। নাইফ টা নেওয়ার জন্য উবু হতেই রুহান দিয়ার গালে একটা কিস করে চলে গেলো। লারা নাইফটা তুলে দেখে রুহান নাই চলে গেছে। দিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল দিয়া মিটিমিটি হাসছে। লারা জিজ্ঞেস করলো,”কী ব্যাপার হাসছো কেন?” দিয়া না সূচক মাথা নাড়িয়ে কাজে মন দিলো। লারা বোকার মতো তাকিয়ে তাকলো।

একটু পরে শুরু হলো খাওয়ানো। নীল শাওন তাড়া দিচ্ছে চলে যাওয়ার জন্য। আজ তাঁরা থাকবে না। রুহান আর দিয়া মিলে সার্ভ করলো। খেয়ে ধেয়েই বিদায় নিতে উঠে পরে লাগলো নীল আর শাওন। লুপা নীলকে রুমে নিয়ে যায় গিয়ে বলে,”আজ থাকিনা প্লিজ। দুদিন থেকেছি আপনাদের এখানে।” লুপার কথা শুনে শব্দ করে হাসলো নীল। তারপর বলল,”এখন তো দুদিন নয় সারাজীবন থাকতেই হবে।” লুপা কেঁদে দিলো। নীল লুপার চোখের পানি মুছে বলল,”কেঁদো না বউটা। যে বাড়িতে দিহান নেই সে বাড়িতে আমরা থাকতে পারবো না। যতদিন দিহান বাড়িতে উঠবে না ততদিন এবাড়িতে আসবো ঠিকি, কিন্তু থাকবো না।” নীল লুপাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,কেঁদো না একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য। তাই তারাতাড়ি চলো।
_কী সারপ্রাইজ?
_বললে কী আর সারপ্রাইজ হয়?” লুপা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। পরে বলল”
_আপনি থাকেন না আমি থাকি প্লিজ।
_উঁহু। আমার বউকে রেখে আমি যাবো না।
“লুপা কিছুই বলল না। নীল লুপার মাথায় চুমু খেয়ে বলল, ” ভালোবাসি পাগলী।
_আমিও।” বলেই লুপা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নীলকে।

শাওনের কথা শুনে দিশার রাগ হলো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ”
_ভাইয়াকে আমি বার বার বলেছি আসার জন্য তবুও এলোনা। বাবা এই নিয়ে শতবার ফোন দিছে তবুও শুধু বলে আসবে না। আর তুমি বলছো ভাইয়া নাই তাই তুমি থাকতে পারবে না?
_দিশা বুঝার চেষ্টা করো। তুমি জানো আমরা বেস্টফ্রেন্ড। এখন দিহান নাই দেখেও কীভাবে থাকবো বলো? দিহান যেদিন আসবে এবাড়িতে, সেদিন তোমাকে একমাসের জন্য দিবো। হ্যাপি?” দিয়া কেঁদেই যাচ্ছে। শাওন চোখের পানি মুছে কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো। বুকে জড়িয়ে নিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল,”আমার সোনাটাকে আজ একটা সারপ্রাইজ দিবো।”
_লাগবে না সারপ্রাইজ। ভাইয়া আমায় একটুও ভালোবাসেনা। যদি বাসতো তাহলে একবার হলেও আসতো বাড়িতে।” শাওন হাসলো কিছুই বলল না। দিশা আবারও বললো,”একটা বার তো ফোন দিতে পারতো তাইনা?
_কেঁদো না সোনা কষ্ট হচ্ছে খুব।
_কচু হচ্ছে।
_সত্যি কষ্ট হচ্ছে পাগলী। ভালোবাসি যে আমার পাগলীটাকে।
_যেন আমি বাসিনা।
_বাসো তো আমার থেকে বেশি না।” দিশা শাওনের পেটে চিমটি দিলো। শাওন আউচ বলে উঠে হেসে দিশাকে আবার জড়িয়ে ধরলো।

বিদায় নিয়ে সবাই বেরিয়ে আসলো শান্তি নীড় থেকে। সুমনা চৌধুরী বার বার শাওনকে বলেছেন থাকার জন্য, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাঁদের কাজ আছে বলে চলে আসলো দুজন। শাওন নীল দুজন যার যার বউ নিয়ে যার যার গাড়িতে উঠে গেলো। শাওন নীলের সাথে আসা রিলেটিভ আলাদা গাড়িতে উঠলো।

সারা রাস্তা দিশা আর লুপা কেঁদে গেলো। গাড়ি থামলে লুপা গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে চারদিকে তাকালো। এ কোথায় এসেছে তাঁরা। জিজ্ঞাসুক চোখে নীলের দিকে তাকালো। নীল মৃদু হাসলো। শাওন আর দিশার গাড়ি এসে থামলো। শাওনদের গাড়ি দেখে লুপা আরো অবাক হলো। শাওন গাড়ি থেকে নেমে দিশাকে দরজা খুলে দিলো। দিশা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। শাওন কোলে তুলে নামিয়ে দাঁড় করালো। পিংক সুমিংপুলের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে এলো দিশার। এই অদ্ভুত সুমিংপুলটা তো তাঁর ভাইয়ের তৈরি। সামনে তাকিয়ে তাঁর ভাইয়ের বাসা দেখে খুশিতে মুখ ঝলমলে উঠলো। কণ্ঠে আনন্দের ঢেউ নিয়ে বলল,”ভাইয়ার বাসা।” দিশার মুখে ভাইয়ার বাসা শুনে অবাক হলো লুপা। বিস্ময় চোখে নীলের দিকে তাকালো। নীল এবারও শুধু হাসলো।

দিহান এগিয়ে আসছে দেখে দিশার মুখের হাসি বিলিন হয়ে গেলো। রাগে গাড়িতে উঠতে গেলে দিহান ভেজা গলায় বলে উঠে, “ভাইয়ের উপর রাগ করেছিস তাইনা?” দিশা দাঁড়িয়ে গেল। দিহান বলল,”কিরে লুপা। তোদের কাছে আমি পঁচে গেছি?” দিশা চোখের পানি মুছে দিহানের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। তারপর দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো দিহানকে। ধরেই ডুকরে কেঁদে উঠে সে। দিহান এক হাতে দিশাকে জড়িয়ে রেখে অন্যহাত বাড়িয়ে লুপাকে ডাক দিলো। লুপাও দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো দিহানকে। তিন ভাই বোন কান্না করে যাচ্ছে। শাওন আর নীলের চোখেও পানি চলে আসলো। প্রিয় মানুষগুলোর খুশি দেখে কে না খুশি হয়?

বোনদের নিয়ে বাসার ভেতর ঢুকলো এসে দিহান। দিশাকে দেখেই অজনি ফুপিন এসেছে বলে দৌঁড়ে এসে কোলে উঠলো। দিশার প্রতি অজনির এমন টান দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয় অরিন। কয়দিন হলো সে দিয়া-দিশাকে চিনে, তবুও তাঁর ফুপিদের জন্য তাঁর এতো টান। সত্যি বলতে যার সাথে রক্তের সম্পর্ক আছে তাঁর জন্য তো টান থাকবেই। লুপা অরিনকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করলো। অরিন তাকে ক্ষমা করে দিলেও সে নিজেকে আজও ক্ষমা করে দিতে পারেনি।

দিশা লুপা অনেক খুশি। এমন সারপ্রাইজ পাবে কল্পনাও করেনি তাঁরা। শাওন আর নীল আজ এখানে থাকবে। দিহান কিছুতেই তাদের যেতে দিবেনা। দিহান সবাইকে কফি এনে দিলো। কফি খেয়ে সবাই অনেক্ষণ বসে গল্প করলো। নীল শাওন দিহান একটু বাইরে গেলো ঘুরতে। লুপা দিশা অরিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে গিয়ে গল্প করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে লুপা অরিনকে বলল”
_অরিন আমায় সত্যি ক্ষমা করে দিয়েছিস তো?” লুপার কথায় অরিন হাসলো। তারপর বলল,”যে ভুল করে নিজের ভুল বুঝতে পারে সে কখনো অপরাধী হতে পারেনা লুপা। মানুষ বলতেই ভুল। ভুল করে যে অনুতপ্ত হয় সেই হচ্ছে আসল মানুষ। তুই যা করেছিস রাগ আর জেদের বশে করেছিস। আমার মায়ের স্মৃতি আমার মেয়ের জীবন সব কিছু আমার হাতে তুলে দিয়েছিস। এসবের বিনিময়ে যদি তোকে ক্ষমা না করি, তাহলে আমি মানুষই নই।” লুপা কেঁদে দিলো। অরিনকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,”উপরওয়ালা কী আমাকে ক্ষমা করবে রে।
_কেনো নয়রে? উনি তো গাফফার। রাহমানুর রাহিম।
_উনি যেমন ক্ষমাশীল, তেমনি উনি ন্যায়বিচারক। আল কাহহার। কঠিন শাস্তিদাতা। উনি তো এতো বড় অন্যায় মেনে নিবেন না।
_লুপা স্বয়ং উনিই বলে দিয়েছেন, উনার প্রিয় ব্যক্তি হচ্ছে তওবাকারী। তুই উনার কাছে ক্ষমা চাইলে উনি ঠিকি ক্ষমা করে দিবেন। মানুষের থেকে ক্ষমা পাওয়া তো কঠিন রে,উনি তো ক্ষমা করতে ভালোবাসেন।

দিশা অবাক হয়ে শুধু অরিনকে দেখলো। এরকম একটা লক্ষী মেয়ে কিনা শ্বশুর বাড়ির সবার কাছে থাকার ভাগ্য পেলোনা। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে রাখলো দিশা।

রাত আটটায় বাসায় আসে দিহান নীল শাওন। সবাই উপরে আসে। অরিন লুপা দিশা গল্প করছিলো। দিহান নীল শাওন এসে সোফায় বসে। দিহান ভাবলো সবার জন্য একটু চা করে আনবে। চা আনতে কিচেনে গিয়ে দেখলো মাছ মাংস ভিজিয়ে রাখা আছে এখনো রান্না হয়নি। দিহান হাসলো। মেয়েরা যে গল্পের ঝুরি নিয়ে বসলে আশেপাশে হুস থাকেনা এটা সারাজীবন শুনেই এসেছে, আজ স্বচোক্ষে দেখলো। চা বানিয়ে রুমে নিয়ে যেতেই অরিন বলল,”আপনি এসব করছেন কেন? আমি করে নিতাম।” দিহান কিছু বলল না। শুধু হাসলো। নীলের ইচ্ছে হলো এটা বলতে যে, তুই কাজ করে তোর বোনদের দেখাচ্ছিস, তোর বোনরা এবার আমাদের দিয়ে কাজ করাবে। কিন্তু বলল না নীল। যতই হোক লুপা দিশা দিহানের বোন, এভাবে লজ্জা দিয়ে কী লাভ।

সবাইকে চা দিয়ে দিহান বলল, তাঁর একটা কল এসেছে সে কথা বলে আসছে,বলে সে কিচেনে এসে কুকিং এপ্রোন পরে নিলো। সবকিছু রান্না করে দিহান রুমে গিয়ে দেখলো সবাই ফোনে লুডু খেলছে। দিহান বুঝে গেলো এতোক্ষণে তাঁর ডাক পড়লো না কেন। অজনি অরিনের ঘা ঘেঁষে বসে ছিলো। দিহান অজনিকে কোলে করে নিয়ে আসলো। অরিন জিজ্ঞেস করেছে “কই যান, দিহান বলেছে “আছি ড্রয়িং রুমে। অজনিকে এনে ভাত খাওয়াতে লাগলো দিহান। তখনই তাঁর ফোন বেজে উঠল। দিহানের বাবা ফোন দিছেন। ফোন ধরে দিহান সালাম দিলো,

_আসসালামু আলাইকুম।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম। দিহান আজ এতোগুলা ফোন দিলাম। দিশা শাওন নীল সবাই ফোন দিলো, তুই আসতে পারতি। তুই আসবি না যখন আমাকে জোর করে বাড়িতে উঠালি কেন?

_আম্মু কী একবারও একটা ফোন দিয়েছে বাবা?” গম্ভীর গলায় কথাটা বলল দিহান। তার বাবা কিছুই বললেন না। হয়তো উনার কিছুই বলার নাই। দিহান আবার বলল,”
_ একটা ফোন দিলে কী এমন হয়ে যেতো? উনি আমার বাচ্চা মেরে দিতে চাইছিলেন। আমি এই বিষয়ে রেগে আছি একবারও কী আমাকে ফোন দিয়ে সরি বলছে? বুঝলাম উনি মা,সন্তানকে সরি বলবেন কীভাবে তাই লজ্জা করছে। নিজের ভুল তো শিকার করবে তাইনা? বাবা মনে আছে? আম্মু আমাকে কত কথা শুনিয়েছিলো শুধু অরিনকে ডাক্তার নিয়ে যাবো বলছিলাম বলে। আচ্ছা বাবা আমি কী পারতাম না, তোমাদের মা জানিয়ে ডাক্তার নিয়ে যেতে। এভাবে তো সবাই নেয়। আমি কেন তোমাদের বলছিলাম? কারণ আমি তোমাদের সম্মান করি। আম্মু পারতো বাবা আমাকে একটাবার কল দিতে। আমার তো মনে হয়না আম্মু আমার শূন্যতা অনুভব করছে। যদি করতো তাহলে একটা ফোন অবশ্যই দিতো আমায়।

দিহানের বাবা কোনো জবাব দিলেন না। উনার কাছে কোনো জবাব নেই। অনেকবার বলেছেন একটা ফোন দিয়ে ছেলেকে আসতে বলো ছেলে রেগে আছে,কিন্তু উনি শুনলেন না। বার বার শুধু বললেন,”এতো মানুষ কল দিয়ে আসতে বলে তবুও হয়না। আমি আবার কল দিবো কেন। সে তাঁর মেয়েকে আমার কোলে নিতে দেয়না,তাহলে আমাকে সে কিসের মা ভাবলো। যে আমাকে মা ভাবেনা তাকে আমি কেন কল দিবো।”

দিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,”আমি সব ভুলে যেতাম বাবা, যদি আম্মু অরিনকে বুকে টেনে নিতেন। ওর মা নেই, যদি আম্মু ওর মায়ের ছায়া হতেন তাহলে আমি সব ভুলে যেতাম। কিন্তু আমার আম্মু তো আমাকেই সন্তান বলতে নারাজ। সমাজ বলবে আমি বউ পেয়ে মা ছেড়ে দিছি। কিন্তু আমার মা কী করে না করে সেটা শুধু আমার জানা। সব সময় সন্তানের দিকে কেন আঙুল উঠবে বাবা। সন্তান কী করলো না করলো সেটাই লোক দেখে। কিন্তু বাবা মা কী করে সেটা কেন চোখে পরেনা কারো। সব সময় সন্তানদের কেন বুঝতে হবে। বাবা কেন বুঝবেনা সন্তানদের। তুমি মাঝে মাঝে এসে আমার বাসায় থেকে যেও বাবা। অজনিকে নিয়ে খেলা করে কোলে নিয়ে যেও। তবুও কখনো আমাকে যেতে বলোনা। আমি যেতে পারবো না।

_আমিও তোকে আর আসতে বলবো না দিহান। দেখি কতদিন তোর মা এই ইগো নিয়ে থাকে।আমি নিজেই তোর কাছে যাবো। আমার লিটল এঞ্জেলকে নিয়ে আমি খেলা করে আসবো।
_হুম। আর হ্যাঁ বাবা,দিয়া কিন্তু আমার কাছে থাকবে। কাল দিয়াকে নিয়ে আইসো।
_আচ্ছা। যাবো নে। ভালো থাক রাখছি।
_নিজের খেয়াল রেখো বাবা। সাথে আম্মুরও।

বলেই ফোন কেটে দিলো দিহান। অজনির দিকে তাকিয়ে দেখলো অজনি ফ্যালফ্যাল চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। অজনির কপালে চুমু খেয়ে দিহান বলল,”দিদুনের কাছে যাবা?” অজনি না সূচক মাথা নাড়াল। দিহান হেসে বলল,”চিনো দিদুন কে?” অজনি আবারও না জানায়। দিহান বুক ছিঁড়ে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,”কাল তোমার দাদুন আসবে।” অজনি বলল,”পাপা দাদুন কে?” দিহানের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। যে বয়সে বাচ্চারা দাদা দাদীর সাথে খেলে। সে বয়সে এসেও তাঁর মেয়ে এটা জানেনা তাঁর দাদা কে। দিহান মৃদু হেসে বলল, “কাল আসলে দেখে নিবা।”

অজনিকে খাইয়ে রুমে নিয়ে গেলো দিহান। নীলরা এখনো খেলছে। দিহান বলল,”কিরে শুধু খেললেই হবে? ১০:৩০ বাজে, খাবিনা?” দিহানের কথা শুনে অরিন চোখ বড় বড় করে তাকালো। রান্নার কথা তো সে ভুলেই গেছে। শুকনো একটা ঢোক গিলে বললো”দ দ দ দশটা ত্রিশ?” দিহান বলল,”হুম কেনো?” অরিন কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে লুপাকে বলল,”তোরা থাক বইন, আমি আসছি।” বলেই অরিন দৌঁড়ে রুম থেকে বের হলো। দিহানও আসছি বলে অরিনের পিছু পিছু গেলো।

অরিন কিচেনে এসে দেখলো সব রান্না করা হয়ে গেছে। অবাক হয়ে তাকালো। স্পষ্ট স্বরে বলল,”রান্না করলো কে?” দিহান অরিনের পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,”ভূউউউউউত,” অরিন কেঁপে ওঠে। তাঁর পেটের উপর দিহানের পেচিয়ে রাখা হাতে হালকা চাপড় দিয়ে বলল,”উফফফফ ভয় পাইয়ে দিছিলেন।” দিহান অরিনের ঘাড়ে চুমে খেয়ে বলে, “স্বামী থাকতে কিসের ভয়? যতদিন দিহান থাকবে তোমার কোনো ভয় নেই পাগলী।
_হুম জানি। এসব আপনি রান্না করেছেন?
_তো কী করতাম? আমার বউটা যে খেলছিলো।
_ইশ। সারাজীবন এভাবে থাকবেন তো?
_ভুল একবার করেছি বলে বার বার করবো নাকি বউ?” অরিনের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে দুজন খাবার নিতে লাগলো। অরিন সব নিয়ে নিয়ে দিলো, দিহান টেবিলে নিয়ে রাখলো। তারপর একসাথে খেতে বসলো সবাই।

সকাল হতেই নীল আর শাওন চলে গেলো। সাথে তাদের সাথে বেড়িয়ে গেলো দিহানও। অফিসে কাজ আছে কিছু। দুপুরের দিকে আসলেন দিহানের বাবা দিয়াকে নিয়ে। অজনি প্রথমে তাঁর দাদুর কোলে যেতে চায়নি। তারপর যখন গেলো তখন আর আসতে চায়নি। নাতনিকে কান্না করে রেখে যেতে হলো উনাকে। একদিনেই এতটা মিশে গেছে উনার সাথে অবাক হলেন তিনি। মনে মনে যে দাদা দাদীর অভাবে ভোগে, সেটা বুঝতে কষ্ট হলোনা উনার।

______________________________________________

দেখতে দেখতে কেঁটে যায় ছ’মাস। এই ছ’মাসে দিহানের মা একবারও দিহানকে যেতে ফোন দেননি। একবার উনি অসুস্থ শুনে দিহান আর থাকতে পারলো না। যতই হোক তাঁর মা হন উনি। অরিনকে নিয়ে সে শান্তি নীড় যায়। দিহান তাঁর মাকে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে উনি দিহানের সাথে কথা বললেন নি। না অরিনের সাথে কথা বলেন। অজনিকে কোলে নিতে চাইলে অরিন দেয়না। উনি তখন বেডে পরে থেকেই অরিনকে অনেক কথা শুনান। সেদিন দিহান অরিনকে নিয়ে কিছু না খেয়েই চলে আসে। সে তো সব রাগ অভিমান ভুলে অরিনকে নিয়ে চলে আসছিলো, তবুও এতো কথা কেন শুনালেন তিনি?

সেদিনের পর থেকে দিহান আর শান্তি নীড় যায়নি। দিহানের বাবা দুদিন পর পর আসেন এসে অজনিকে নিয়ে সারাদিন ঘুরাঘুরি করেন। দিয়াও তাঁর ভাইয়ের সাথে যে বেড়িয়ে আসছিলো আর যায়নি শান্তি নীড়। বিয়ের পর থেকে এই ছ’মাস দিশা লুপাকে নিয়ে শাওন আর নীল এক রাতও থাকেনি গিয়ে শান্তি নীড়। দু-এক ঘন্টার জন্যে যায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসে খেয়েদেয়ে চলে আসে। একেবারেই যেতো না তাঁরা। শুধু লোকসমাজে চলতে হয় বলেই যায়।

দিশা দু মাসের প্রেগন্যান্ট লুপা একমাসের। এদিকে অরিনও প্রেগন্যান্ট পাঁচমাসের। চারদিকে খুশি আর খুশি। অরিনের প্রেগন্যান্টের খবর শুনে দিহানের বাবা খুশিতে দিহানের মাকে জানান, তিনি আবার দাদু হবেন। খবরটা শুনে দিহানের মা গম্ভীর গলায় বলেন,”তো আমি কী করবো? বাচ্চা পয়দা করতেই তো আলাদা হয়েছে।” কথাটা শুনে হানিফ চৌধুরী সেদিন সুমনাকে পর পর দুটো থাপ্পড় দিয়েছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে এসে ছাড়াছাড়ি করলে মানুষ হাসবে। মানুষ উনার সন্তানদের নিয়ে তামশা করবে নয়তো উনি এই ডাইনি মহিলাকে ছেড়েই দিতেন।

ভাঙা জিনিস জোড়া লাগানো গেলেও সেটা ভাঙা জিনিস হিসাবে চিহ্নিত থেকে যায়। দিহানদের পরিবার ছ’বছর আলাদা থেকেছে এখন আবার এক সাথে থাকা যেন তেমন ভালো লাগেনা কারো। চাকরির কারণে জিহানকে ঢাকায় থাকতে হয়। তাঁর বাবা মাকেও সে সাথে নিয়ে গেছে। বৃদ্ধ বাবা-মা, কে উনাদের সেবা করবেন? শান্তি নীড় থেকে রুহানের কলেজ অনেক দূর পরে যায়, তাই তাদেরকে আবার আগের বাসায় উঠতে হলো। একা শান্তি নীড়ে থাকবেন কেমনে হানিফ চৌধুরী আর সুমনা চৌধুরী, তাই এক সময় উনারাও আগের বাসায় উঠেন গিয়ে। দিহান অবশ্য বেহায়ার মতো দুদিন নিতে এসেছে তাঁর বাবা মাকে, কিন্তু সুমনা যাবেন না। উনি বলেন দিহান নাকি লোক দেখাতে আসছে। দিহানরা তাদের সাথে থাকেনা, তো কেন উনি তাদের সাথে থাকবেন। শুধু তাই নয়। উনি এটাও বলেন, অরি৷ উনার সন্তানদের তাবিজ করে নিজের কথায় নাচাচ্ছে। নয়তো উনার সন্তানরা উনার কথায় উঠতো বসতো।

দিহান সেদিনের পর আর আনতে যায়নি। অনেক তো চেষ্টা করলো সব ঠিক করার, তবুও যখন যেই সেই থাকে,তাহলে আর কী লাভ এসব করে। লুপা অরিন এখন একই হসপিটালে কাজ করে।

দিয়ার সাথে রুহানের বিয়েটা ঠিক করে রাখছে দিহান। অরিনের একটাই কিথা দিয়ার বিয়ে রুহানের সাথে হবে। কিন্তু দিহানের শর্ত হলো দিয়াকে রুহানকে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ততদিন দুজন দুজনের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে না। শর্তে রুহান আর দিয়া রাজি হয়। দুজনের মনোযোগ এখন লেখাপড়ার দিকে। দিহানের বাসায় সবাই আসা যাওয়া করে। জিহান ছুটি পেলেই দিহানের বাসায় আসে। রুহানের পরিবারও আসে, শুধু রুহান আসতে পারেনা। সে বিয়ের পড়েই আসবে।

দেখতে দেখতে অরিনের ডেলিভারির সময় চলে আসলো।
একদিন সন্ধ্যার দিকে অরিন দিয়া বসে গল্প করছিলো। হঠাৎ করে অরিনের পেটে খুব পেইন হলো। পেটে হাত দিয়ে আহহহ বলে চোখমুখ খিঁচে বসলো। দিয়া হন্তদন্ত হয়ে বলল,”ভাবী কী হয়েছে? তোমার শরীর খারাপ নাকি?” অরিন না সূচক মাথা নাড়াল। দিয়া ফোন হাতে নিয়ে তৎক্ষণাৎ দিহানকে ফোন দিয়ে বলল অরিনের শরীর খারাপ। অরিন বাধা দেয় ফোন দিতে দিয়া শুনেনি।

কল দেওয়ার বিশ মিনিটের মাথায় দিহান বাসায় আসে। কীভাবে যে এসেছে আল্লাহ জানেন। রুমে ঢুকে দেখে অরিন শুয়ে আছে। দিহানের চোখ মুখ শুকিয়ে আছে। হন্তদন্ত হয়ে অরিনকে বলে,”বউ খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার?” অরিন কিছুই বলল না। তাঁর চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। দিহান অরিনকে কোলে নিয়ে গাড়িতে তুললো। সারারাস্তা দোয়া ইউনুস পড়ে হসপিটাল গেলো। দিশা আর লুপাকে অরিনের খবরটা জানিয়ে দিলো দিয়া।

হসপিটাল গিয়ে দেখলো লুপা তাদের আগেই হসপিটালে পৌঁছে গেছে। লুপা এখন পাঁচমাসের প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় ও সে এতো তারাতাড়ি এখামে পৌঁছে গেছে। অরিনকে সিজারে নেওয়া হবে। দিহান অরিনের হাত ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। অরিনের হাতে চুমু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার?” অরিন দিহানের হাত নিয়ে চুমু খেয়ে বলল,”আমি বাঁচবো তো?
_কিচ্ছু হবে না সোনা আমি আছি তো। সব ঠিক হয়ে যাবে।

দিহান অরিনের কপালে চুমু খায়। অরিনকে নিয়ে যাওয়া হয় সিজারে। দিহান কেঁদেই যাচ্ছে। নীল বার বার স্বান্তনা দিচ্ছে দিহান শুনছে না। দিশা আর শাওন এসে পৌঁছে গেলো। লুপা অরিনের সিজার করছে। দিহান অজু পড়ে এসে নামাজ পড়তে লাগলো। দিয়া তাঁর মায়ের কাছে কল দিয়ে বলল অরিনের কথাটা। উনি বললেন। “তুই এসব বলছিস কেন আমায়? অরিন কী মরে গেছে? সে বলতে পারে নাই?” দিয়া রাগ করে ফোন রেখে দিলো। এই অবস্থায়ও উনি অরিনের দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

কাঁদতে কাঁদতে দিহানের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।অজনিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে সে। বাবার কান্না দেখে অজনিও নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। অনেক্ষণ পরে দিহানের কলিজায় পানি এলো অরিনের খবর শুনে। লুপা এসে আগে অরিনের খবর দিলো। দিয়া লুপাকে বলল,”আপু বেবি কী ছেলে,নাকি মেয়ে?” লুপা হেসে বলল,”দুটোই। ”
_কিইইইইই। মানে টুইন বেবি?
_হুম।

দু’জন নার্স বেবি দুটোকে নিয়ে আসলো। একটা দিশার কোলে আরেকটা দিয়ার কোলে দিলো। দিহানের মন ছটফট করছে অরিনের জন্য। দিহানের বাবা চলে আসলেন। এসে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”বউমা কেমন আছে? বউমা সুস্থ আছে তো?” লুওয়া চিন্তা না করতে বলল,”অরিন ঠিক আছে।

কিছুক্ষণ পরে অরিনের জ্ঞান ফেরার পরে দিহান দৌঁড়ে গেলো কেবিনে। অরিনকে দেখেই কেঁদে উঠে সে। অরিনের চোখে মুখে অসংখ্য চুমু দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল, “খুব কষ্ট হয়েছে তোমার তাইনা? ভয় পাচ্ছিলাম সোনা।” অরিন হাসলো। দিহান বলল,”জানো আমাদের টুইন বেবি হইছে।”
_সত্যিইইই? কই আমার বাচ্চারা?
_আছে তুমি একটু রেষ্ট নাও পাগলী।
_উঁহু। ওদের না দেখলে আমি শান্তি পাবো না।”

দিহান গিয়ে নিয়ে আসলো বাচ্চা দুটোকে। এতোক্ষণের সব কষ্ট মূহুর্তেই বিলিন হয়ে গেলো। বাচ্চাদের কপালে চুমু খেলো অরিন। একে একে সবাই এসে তাকে দেখে গেলো। লারা ফোন দিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলো আর বলল,কাল তাঁরা আসছে। অরিনের সৎ মাও আসলেন এসে দেখলেন অরিনকে। রাত ১২টা বাজলে দিশাকে লুপাকে চলে যেতে বলে দিহান। এই অবস্থায় এখানে থাকলে ক্ষতি হবে। দিহানের বাবাকে দিয়ে দিয়াকেও বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। অজনিকে তাঁদের সাথে নিয়ে যায়। অজনি তো অনেক খুশি তাঁকে দুইটা পুতুল বোন আর পুতুল ভাই পেয়েছে দেখে।

সবাই চলে যাওয়ার পরে দিহান অরিনকে কপালে চুমু এঁকে দেয়। তারপর বলে,”কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিলো।
_কেন?
_স্ত্রীকে সিজারে নেওয়ার বেদনা পুরুষ ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারেনা।” অরিন মৃদু হাসলো। দিহান বলল,” সরি বউ। আমাকে বিয়ে করে তুমি কিছুই পেলেনা। একটা মেয়ের জীবিনে তার স্বশুর বাড়ি নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। আর আমি তোমার এমন কোনো স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি।
_কে বলেছে আপনাকে এটা? একটা মেয়ের জীবনে স্বশুর বাড়ি নিয়ে স্বপ্ন থাকে ঠিকি কিন্তু সে স্বপ্নটা থাকে স্বামীকে কেন্দ্র করে। আমার আপনি আছেন,আর কী লাগে বলুন?
_আম্মু যে তোমায় অনেক অবহেলা করে।
_একটা নারীর জীবনে সে থেকে বড় হলো তাঁর স্বামী। যদি স্বামী ভালো না বাসে। তাহলে শ্বশুরবাড়ির কারো ভালোবাসায় সুখ আসেনা। একটা মেয়ের সুখী হওয়ার জন্য স্বামীর ভালোবাসার থেকে বেশি কিছু লাগেনা।মানুষ জীবনে সবদিক দিয়ে সুখী হয়না। তেমনি আমারও একটা কষ্ট থাকবে আমার শাশুড়ী নিয়ে। আপনার মা বলে হয়তো আমি উনাকে ক্ষমা করে দিতাম। কিন্তু উনি যা করেছেন এতোদিনে। উনি আর ক্ষমা পাবেননা আমার কাছে। তবে আপনাকে বাধা দিবোনা আমি। আপনি আপনার মায়ের কাছে যেতে চাইলে যাবেন আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি অথবা আমার সন্তানকে কখনো উনার সামনেও যেতে বলবেন না।

অরিনের কথার উপর দিহান কিছু বলতে পারলোনা। তার মাকে নিয়ে তার লজ্জা লাগছে। আবার কষ্টে বুকটাও ফেটে যাচ্ছে। দিহানের চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। এটা তার মায়ের অবহেলার জল। অরিন নিচু হতে বলল। দিহান নিচু হলে কপালে চুমু খায় সে। তারপর বলে,”আল্লাহ্ আপনাকে দুটো মেয়ে দিয়েছেন। দুটো জান্নাত দুটো মা দিয়েছেন। আপনার মতো সুখী মানুষ কাঁদলে যে মানায় না।” দিহান হাসলো। তারপর বলল,”আম্মুর এতো অবহেলা সয্য করেও আমার সাথে থাকো কেন?” অরিন বলল”ভালোবাসি প্রিয়। তাইতো দূরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারিনা। খুব ভালোবাসি যে আপনায়।” অরিনের হাতে চুমু খেয়ে দিহান বলল,”আমিও খুব ভালোবাসি তোমায় পাগলী। তুমি দূরে গেলে যে আমি মরেই যাবো।

সমাপ্ত❤

নাইস,অসাধারণ সুপার তো অনেক বললেন। গল্প পড়ে মন্তব্য না করে তো অনেক গেলেন। আজ অন্তত একটা গঠন মূলক মন্তব্য করে জানাবেন কেমন হয়েছে। আর সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ এত্ত এত্ত ভালোবাসা দিয়ে আমায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য।❤

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here