. #মেঘের_বিপরীতে
পর্ব: ১+২
তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো নন্দিতা। খুব পাতলা এবং ফিনফিনে একটি শাড়ি পড়েছে সে। এ ধরনের পোশাক যে কোনো ছেলেকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করে। বিবাহিত হলে পবিত্র ভালোবাসার আহ্বান করে আর অবিবাহিত হলে নিষিদ্ধ ভালোবাসার। রেহাল এখনো ঘুমুচ্ছে। হঠাৎ দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেলো নন্দিতার মাথায়। পা টিপে টিপে রেহালের কাছে গিয়ে চুলের পানি ছিটিয়ে দিলো মুখে।
রেহাল জাগনা পেয়ে গেলো। উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে বললো,
“কি হচ্ছে কি এসব? সমস্যা কি তোমার?”
নন্দিতা থতমত খেয়ে গেলো।
“না কিছু না। আমি তো এমনিই মজা করছিলাম।”
“ধুর! দিলে তো ঘুমটা নষ্ট করে। সারাদিন অফিস থাকি। রাত জেগে কাজ করতে হয়। বাসায় বসে বসে করো কি তুমি? এসব আজাইরা ফন্দি আঁটো?”
নন্দিতার চোখ ভিজে উঠলো। সে মাথা নিচু করে বললো,
“সর্যি।”
“সংসারটাকে নরক বানিয়ে ফেলছে” বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে উলটো ঘুরে আবার গভীর নিদ্রাদেশে হারিয়ে গেলো রেহাল। নন্দিতা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের প্রতিচ্ছবি ঝাপসা, অস্পষ্ট। সে চোখের পানি মুছলো না। ভেজা চোখে আকাশ দেখতে ইচ্ছে করছে তার। বারান্দায় গিয়ে তোয়ালে শুকাতে দিলো। শরৎের আকাশ। নীলের স্নিগ্ধতা মিশে আছে সর্বস্ব। পশ্চিমে কিছু সাদা মেঘের আনাগোনা। সূর্যটা এখনো পূর্বেই রয়ে গেছে। তাই রোদের তীব্রতা কম। নন্দিতা বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়ালো। রেহাল আগে এরকম ছিলোনা। ভিজে চুলের পানি তার মুখে ছিটিয়ে দিলে সে একটুও রাগ করতো না। উলটো নন্দিতার হাত ধরে টেনে তার বুকে জায়গা করে দিতো। মানুষ যখন বদলায় খুব দ্রুত বদলায়। তাই চেনা মানুষটাকে খুব অচেনা লাগতে শুরু করে। নন্দিতা চোখ মুছে ঘরে চলে এলো।
এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো রেহাল এর। নয়টা ত্রিশ বাজে। তার মেজাজ এখনো কিছুটা গরম। একটানা ঘুম না হলে রেহালের মন, মেজাজ কোনোটাই ভালো থাকে না। আজকাল নন্দিতার জ্বালাতন খুব বেড়ে গিয়েছে। বাচ্চাদের মতো সব কাজ কারবার। তবে তখন উচ্চস্বরে কথা বলায় রেহালের এখন খারাপ লাগছে। মেয়েটার পাগলামি গুলোই একটা সময় খুব ভালো লাগতো তার। এখন আর লাগে না। কেনো লাগে না তার নিজেরও জানা নেই। অফিসে তার নতুন পিএ আসার কথা আজ। হিসেব মতো মেয়েটা ৮ টার মধ্যেই চলে এসেছে। প্রথম দিন বসের সম্পর্কে মেয়েটার ধারনা কি হতে পারে?
বস কামচোরা? নাকি অলস? নাকি সময়ানুবর্তীতা মেনে চলতে পারে না?
সে যাই হোক। রেহাল আড়মোড়া ভেংগে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমের দিকে গেলো। আয়নায় নিজেকে অনেকক্ষণ ভরে দেখলো। ফ্রেশ হলো, শাওয়ার ছেড়ে দীর্ঘক্ষণ পানির নিচে দাঁড়িয়ে রইলো। তার সকল ক্লান্তি, অবসাদ পানির সাথে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
নন্দিতা টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছে। রেহালকে ছাড়া সে খাবে না। রেহাল ক্যাজুয়াল পোশাকে ডাইনিং এ ঢুকলো।
“কি ব্যাপার, অফিস যাবে না?”
চেয়ার টেনে বসতে বসতে রেহাল উত্তর দিলো,
“না।”
“কিছু হয়েছে?”
“শরীরটা ভালো লাগছে না, তাই যাবো না।” দাও খাবার দাও।
নন্দিতা চুপ করে প্লেট এ খাবার বেড়ে দিতে লাগলো। বেলা রুটি আর আলু ভাজি। নন্দিতা আগে রুটি বেলতে জানতো না। বিয়ের পর শিখে নিয়েছে। রেহালের ভীষণ পচ্ছন্দ।
এক টুকরো রুটির মাঝে ভাজি পুরে মুখে নিয়ে রেহাল বললো,
“আলুভাজি মজা হয়েছে।”
নন্দিতা হাসলো। রেহালের মন ভালো হয়ে গেলো। মেয়েটার হাসি এখনো তার মন খারাপের ওষুধ।
“আমি কটা দিন বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো?”
“কেনো আমার সাথে থাকতে কি খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?”
“এমন কথা কেনো বলছো? আমি খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি জানো? এই কংক্রিটের বিল্ডিং এ আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। গ্রাম থেকে ঘুরে আসলে একটু ভালো লাগতো। কতদিন নৌকায় চড়ি না! ঘুড়ি উড়াই না! শেষ কবে চড়ুই ভাতি খেয়েছিলাম সেটাও ভুলে গেছি।”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে শেষ করলো নন্দিতা।
“হুঁ। আচ্ছা ঠিকাছে। আগামীকাল আমি তোমাকে দিয়ে আসবো।”
“সত্যি?”
“হুম। আরেকটু ভাজি দাও তো।”
নন্দিতা চেয়ার ছেড়ে উঠলো। বাটি হাতে নিয়ে রেহালের প্লেটে ভাজি বেড়ে দিতে দিতে বললো,
“তুমিও তাহলে আমার সাথে কয়েকটাদিন থেকে আসতে? মা বাবা অনেক খুশি হতেন।”
“অফিস থেকে ছুটি পাবো না।”
নন্দিতা জানে রেহাল মিথ্যা বলছে। বিয়ের চার বছরের মাথায় একবারও রেহাল শশুড়বাড়ি যায়নি। কেনো যায় নি, নন্দিতা নিজেও জানে না। নন্দিতা নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো। রেহাল বললো,
” বিকালে বের হবে?”
” কোথায়?”
” আশেপাশে কোথাও যাবো, ঘুরবো।”
নন্দিতা কোনো উত্তর দিলো না। অবাক হয়ে রেহালের দিকে তাঁকিয়ে রইলো।
“কি যাবে না?”
নন্দিতা বললো,
“যাবো।”
“তোমার হালকা আকাশি রঙের একটা শাড়ি আছে না?”
নন্দিতা মাথা ঝাঁকালো।
“সেটা পড়বে কেমন? সাদা ব্লাউজ দিয়ে।”
” আচ্ছা।”
নন্দিতা নিঃশব্দে খাচ্ছে। রেহাল খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আঁড়চোখে তাকে দেখছে। সে জানে ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাবটি নন্দিতার কাছে অপ্রত্যাশিত। মানুষ যখন অপ্রত্যাশিত ভাবে কিছু পায় তখন তার যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারে।
(চলবে…)
#মেঘের_বিপরীতে (২)
সব মেয়েরা শাড়ি সামলাতে জানে না। তবে নন্দিতা সেসকল মেয়েদের গোত্রের নয়।
সে খুব পরিপাটি করে শাড়ি পড়তেও জানে, খুব সুন্দর করে শাড়ি সামলাতেও জানে। ভার্সিটির মেয়েরা যখন ওয়েস্টার্ন আর সাধারণ সালোয়ার কামিজে সাচ্ছন্দ্য বোধ করতো তখন নন্দিতাকে খুঁজে পাওয়া যেতো কোনো এক রঙের জর্জেট শাড়িতে। কখনো খোলা চুলে কখনো বা মাঝারি আকারের খোঁপায়। রেহাল আর নন্দিতা রিক্সায় পাশাপাশি বসে আছে। নন্দিতার চুলগুলো খোলা, বাতাসে উড়ছে আর বারবার রেহালের মুখে বাড়ি খাচ্ছে। রেহালের যে তাতে খারাপ লাগছে তা নয়। তবুও সে নন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” চুলটা বেঁধে ফেলো।”
নন্দিতা বললো,
” আমি তো চুল বাঁধার কিছু সাথে করে আনি নি!”
” খোঁপা করতে কিছু লাগে নাকি?”
নন্দিতা চাপা স্বরে বললো,
” খোলা চুলে কি খারাপ লাগছে?”
” না, তবুও খোঁপা করো।”
নন্দিতা আর কথা বাড়ালো না। চুল পেঁচিয়ে খোঁপা করে নিলো।
” এখন ঠিক আছে?”
“হুঁ”
“রেহাল?”
” বলো।”
“আমরা অনেকদিন পর একসাথে রিকশায় ঘুরছি তাই না?”
রেহাল মাথা ঝাঁকালো।
” শেষ কবে রিক্সায় ঘুরেছিলাম তোমার মনে আছে?”
নন্দিতা জানে রেহালের মনে নেই। এসব বিষয় ছেলেরা মনে রাখে না। মনে রাখতে চাইলেও কাজের চাপ আর ব্যস্ততা মনে রাখতে দেয় না। রেহালের উত্তর নন্দিতা জানে। তবুও জিজ্ঞেস করলো।
“না, মনে নেই। শেষ কবে ঘুরেছিলাম?”
” আমারো মনে নেই।”
নন্দিতার সব মনে আছে। সেদিন ছিলো শুক্রবার। জুলাই মাসের পাঁচ তারিখ। রাতে কাসুন্দি রেঁস্তোরায় ডিনার সেড়ে নন্দিতা বায়না করে বসে সে রিকশায় ঘুরবে। রেহাল প্রথমে আপত্তি করলেও পরে রাজি হয়ে যায়। সে রাতে তারা প্রায় দেড় ঘন্টার মতো রিকশায় ঘুরেছে। কিন্তু নন্দিতার এখন এসব কথা রেহালকে বলতে ইচ্ছে করছে না।
ধানমন্ডি লেকের সামনে এসে রিকশা থামলো। রেহাল ভাড়া মিটিয়ে দিলো। গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখের সামনে একজন ফুল বিক্রেতা পড়লো। রেহাল নন্দিতার হাত ধরে সেদিকেই এগোতে লাগলো। ফুল বিক্রেতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“চাচা, জারবেরা কত করে?”
বিক্রেতা ভাঙ্গা গলায় জবাব দিলো,
” দশ টাকা পিস।”
” তিনটা টাটকা দেখে জারবেরা দেন।”
রেহালের আচরণ নন্দিতাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলছে। সে চাপা কন্ঠে বললো,
” জারবেরা দিয়ে কি হবে?”
রেহাল উত্তর দিলো না। ফুল তিনটে নিয়ে নন্দিতার খোঁপায় একটার পর একটা গুঁজে দিতে লাগলো। নন্দিতা দেখলো লেকে উপস্থিত সবাই তাদের দিকে তাঁকিয়ে আছে। লজ্জা পেয়ে সে বললো,
” কি করছো, রেহাল? সবাই দেখছে।”
” ইললিগাল কোনো কাজ তো করছি না। নিজের বউয়ের খোঁপায় ফুল লাগিয়ে দিচ্ছি।”
” তবুও।”
ফুলগুলো খোঁপায় লাগিয়ে দিয়ে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে রেহাল বিক্রেতাকে বললো,
” এই যে চাচা, আপনার ত্রিশ টাকা।”
এরপর নন্দিতার দিকে তাঁকিয়ে বললো,
“তোমাকে সুন্দর লাগছে।”
নন্দিতা অপ্রস্তত হয়ে গেলো। বিষয়টা বুঝতে পেরে রেহাল এগিয়ে এসে পুনরায় নন্দিতার হাত ধরলো। নিচু কন্ঠে বললো,
” চলো হাঁটি। ”
তারা একসাথে হাঁটতে লাগলো। হেঁটে হেঁটে ব্রিজের ওপর গেলো। ঠান্ডা বাতাস। ঈশান কোণে এক টুকরো মেঘ জমেছে। নন্দিতার আকাশেও অভিমানের মেঘ জমে। সেই মেঘের ওজন যখন বাটখারা পেরিয়ে যায় তখন কান্না হয়ে ঝরে পড়ে। ব্রিজের হাওয়া চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে করতে নন্দিতা বললো,
“রেহাল, তোমার কখনো দ্বিতীয় বিয়ে করতে ইচ্ছা করে না?”
“না, কেনো?”
“প্রথম স্ত্রীর মত থাকলে ছেলেরা দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে।”
রেহাল বললো, “হুঁ পারে।”
“তাহলে তুমি কেনো করছো না?”
“আমি তোমাকে নিয়ে সুখী, নন্দিতা।”
” সত্যি?”
“হুঁ, সত্যি।”
“কোনো ক্ষোভ নেই?”
“না।”
“তুমি বলতে চাইছো এই বিয়ে নিয়ে তোমার কোনো আফসোস নেই?”
” না, নেই। কেনো বলো তো?”
” এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”
রেহাল ব্রিজের রেলিং এ হাত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মানুষের নিস্তব্ধতা অনেক লুকোনো কথার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। নন্দিতা জানে রেহালের “না” এর পেছনে হাজারো দীর্ঘশ্বাস জড়িয়ে আছে। প্রতিটি শব্দে লুকিয়ে আছে হতাশা আর হাহাকার।
নন্দিতা মনের অজান্তেই হেসে উঠলো। রেহাল অবাক হয়ে বললো,
” হাসছো কেনো?”
নন্দিতা রহস্যময় হাসি ঠোঁটের কোণে রেখে উত্তর দিলো, “এমনি।”
রেহাল প্রসঙ্গ পালটে বললো,
“কিছু খাবে তুমি?”
“কোল্ড কফি।”
” তাহলে চলি সামনে এগোই। ”
নন্দিতা মাথা নাড়লো। শাড়ির আঁচল মাজার ওপর দিয়ে পেঁচিয়ে আরেক হাত দিয়ে ধরে রেহালের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে লাগলো।
( চলবে…)
লিখাঃ #Atia_Adiba