#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ
পর্ব-১০
সূর্য পুতুলের রুমের সামনে এসে দেখে ভেতর আলো জ্বলে আছে।কিছু না ভেবেই দরজা নক করে, কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে আরো কয়েকবার নক করলো।আবারও কোনো সাড়া না পেয়ে সূর্য ভ্রু কুঁচকে ভাবতে শুরু করে ঘুমিয়ে গেছে মনে হয় কিন্তু বাতি জ্বালা কেন? কিছু একটা ভেবে দরজায় হাত রাখতেই বুঝতে পারে দরজা খোলা আছে। একটু ইতস্তত হয়ে রুমের ভেতরে পা বাড়ায় সূর্য।
ভেতরে এসে পুতুলকে দেখে পুরো বোল্ড হয়ে দাড়িয়ে আছে সূর্য।সারা বিছানায় বই ছড়ানো আর পুতুল সেই বইয়ের সমুদ্রের মাঝে একটা বই মুখের উপর রেখে আরেক টা জাপটে ধরে ঘুমচ্ছে। বিড়বিড় করে বলল,
– ” এই দ্বিতীয় বিদ্যাসাগর বই পড়েছে নাকি বইয়ের সাথে যুদ্ধ করেছে।”
ফোঁত করে একটা নিশ্বাস নিয়ে বইগুলো সব এক জায়গা করে রাখে সূর্য।তারপর পুতুলের মুখের উপর থেকে বইটা সরিয়ে জাপটে ধরা বইটা আলতো করে ছাড়িয়ে নেয়।পুতুল একটু নড়েচড়ে উঠতেই কালো টিশার্ট টা পেটের দিক থেকে অনেকটা সরে যায়।ফর্সা পেটে নাভির বা পাশে একটু উপরে কালো তিলটা দেখেই সূর্যের মাথা ঝিমঝিম করছে, বুক ধড়ফড় করা শুরু করে।দ্রুত চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস নেয় সূর্য, নাহ,,,,এখানে আসা একদম ঠিক হয়নি, একদম না। মনে মনে কথাটা জপে আবার চোখ মেলে তাকায় তিলটার দিকে।হাতটা কেমন নিসপিস করছে, সে কী একটু ছুয়ে দেবে তিলটা?? না না না,,,, সে কোনো ভাবেই এরকম কিছু করবে না ভেবেই ফটাফট পাশে থাকা ব্লাঙ্কেট টা নিয়ে পুতুলের গায়ে জড়িয়ে দেয়।তারপর কিছুক্ষণ পুতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ডান হাতের দুই আঙুলে চুমু দিয়ে আঙুল দুটো পুতুলের কপালে ছুয়ে দেয়।ফিসফিস করে বলল,
– ” আমার শহরের এক আকাশ ভালোবাসা তোমার জন্য রেখেছি পিচ্চি, শুধু তোমার ছুয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।”
তারপর বাতি নিভিয়ে শব্দহীন পায়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় সূর্য।
ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসে পুতুল,জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সাথে থরথর করে কাপছে। আজও একই স্বপ্ন দেখে ভয়ে কুলকুল করে ঘামছে পুতুল।আজ ছেলে টা জোর করে তাকে চুমু দিয়েছে কিন্তু ছেলে টার মুখটা দেখতে পায়নি।গায়ের ব্লাঙ্কেটটা খামচে ধরে গুটিশুটি মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে পুতুল।হালকা বাতাসে সাদা পর্দা গুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে।আর তারই ফাঁক গলিয়ে সকালের মৃদু আলো রুমে প্রবেশ করছে। পুতুলের হঠাৎই মনে হলো সে তো বাতি জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে ছিল।আশেপাশে তাকাতেই নিজের বইগুলো সুন্দর করে গোছানো দেখে আরো অবাক হয়।পরক্ষণেই মনে হলো হয়তো বড় আম্মু অথবা আব্বু এসেছিল তার রুমে।তাই আর মাথা না ঘামিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় পুতুল।
সূর্যকে বাবা তার দুই কন্যার পৌঁছে দেওয়া ও নিয়ে আসার দায়িত্ব দিয়েছে।সেও খুশি খুশি পৌঁছে দিতে এসেছে, কিন্তু বেশ রাগী রাগী ফেস করে রেখেছে।কারণ বাবার দুই কন্যা পিছন সিটে বসে তাকে ড্রাইভার বানিয়েছে।টুকটুকি কোনভাবেই পুতুলকে সামনে বসতে দেয়নি আর নিজেও আসেনি। তাই সূর্য রাগী ফেস করে রেখেছে, আর মিরর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুতুলের দিকে তাকাচ্ছে। গাড়ি থামতেই ছন্দ আর পুতুল নেমে দাড়ায়।
ছন্দ গ্লাসে টোকা দিতেই সূর্য গ্লাসটা নামিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
-” কী চাই? ”
ছন্দ কিছু না বলে ভাইয়ের গালে পট করে একটা হামি দিয়ে বলল,
-” রাগ করে না ভাইয়া,কেমন? টাটা।”
বলেই পুতুলের হাত ধরে গেইটের ভেতর চলে যায়।সূর্য বোনের কাজে মৃদু হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
শ্রেয়া মেডিকেল ফোর্সের একজন উচ্চপদস্থ আর্মি তার বর্তমান পোস্টিং চট্টগ্রাম শহরে।কল্লোলের ছুটি হওয়ায় পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল। বাবা আর্মির কর্ণেল হওয়ায় ছুটি পেতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু সে একদিন থেকেই চলে যাচ্ছে,কারণ কল্লোল তার কাছে মিথ্যা বলেছে।
শ্রেয়া রাগে গজগজ করতে করতে রেল স্টেশনে ঢুকছে আর কল্লোল তার পিছু পিছু ছুটছে।
-” শ্রেয়া! ও শ্রেয়া! আমার ডক্টর পাখি প্লিজ রাগ করে না।”
কিন্তু শ্রেয়ার থামার কোনো নাম নেই। কল্লোল উপায় না পেয়ে শ্রেয়ার সামনে গিয়ে কান ধরে ওঠবস করতে করতে বলল,
-” ডক্টর পাখি, আমার ভুল হয়ে গেছে। আই সোয়ার আর জীবনেও মিথ্যা বলবো না। তুমি যা বলবে তাই শুনবো, প্লিজ রাগ করো না।”
কল্লোলের কাজে আশেপাশের লোকজন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রেয়া রেগে কটমট করে বলল,
-” একদম নাটক করবে না, সামনে থেকে সরো।”
বলে কল্লোলকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেনে উঠে বসে।কল্লোল ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত অনেক কায়কুয় করেও শ্রেয়াকে থামাতে না পেরে হতাশ হয়ে স্টেশনের বেঞ্চে বসে পড়ে।
ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরে ফোন টা বাজতেই কল্লোল দ্রুত ফোন টা বের করে।ভেবেছিল শ্রেয়া ফোন দিয়েছে। কিন্তু না তার কলিজার বিষ ফোঁড়া ফোন করেছে, দেখেই রাগটা দপ করে জ্বলে উঠে।ফোন টা রিসিভ করেই বলা শুরু করে,
-” শালা,*****। মজা নিতে ফোন করেছিস। ****, অভিশাপ দিলাম পুতুল যেন শ্রেয়ার থেকেও ভয়ংকর রকমের জ্বালানি দেয় তোকে। শালা, *****………”
বলে একটু দম নেয় কল্লোল।সূর্য এতক্ষণ ফোনটা কান থেকে একটু দুরে রেখেছিল।ফোনের ভেতর থেকে আওয়াজ না আসায় সূর্য ফোন টা কানে নিয়ে বলল,
-” দোস্ত একটু পানি খেয়ে বলতো স্টেশনের কোন দিকে আছিস তুই? আসলে এতো ভিড়ে খুঁজে পাচ্ছি না তোকে।”
সূর্যের কথায় কল্লোল আরো জ্বলে উঠে।
-” শালা তোরা দুজন মিলে যুক্তি করে আমাকে এভাবে প্যারা দিচ্ছিস তাইনা?? জাস্ট ওয়েট, আমারও টাইম আসবে তোদেরকে যদি নাকে দড়ি দিয়ে না ঘুরিয়েছি তো আমার নামও কল্লোল মাহমুদ নই।” বলেই খট করে ফোন টা কেটে দেয় কল্লোল।
ফোন কাটার কয়েক সেকেন্ড পরেই কল্লোলের সামনে এক বোতল পানি ধরে দাঁত কেলিয়ে দাঁড়ায় সূর্য। এমনিতেই রেগে আছে তার উপর সূর্যের ক্লোজআপ মার্কা হাসি দেখে রাগ তরতর করে মাথায় উঠে যায় কল্লোলের।পানির বোতল নিয়েই সূর্যকে দুমদাম করে মার শুরু করে। সূর্য তাড়াতাড়ি কল্লোলকে পিছন থেকে জাপটে ধরে বলল,
-” দোস্ত তোর জন্য সারপ্রাইজ এনেছি, আগে সারপ্রাইজ টা দেখ তারপর ইচ্ছে মতো মারিস।”
কে শোনে কার কথা কল্লোল নিজেকে ছাড়িয়ে আবার মার শুরু করে। দুজন স্টেশনের বেঞ্চে পড়ে বাচ্চাদের মতো মারপিট করছে আর লোকজন অবাক চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে স্টেশন মাস্টার দুজন গার্ডকে নিয়ে ওদের সামনে আসতেই দুজন ভদ্র বাচ্চাদের মতো মারপিট বন্ধ করে বেঞ্চে বসে থাকে।স্টেশন মাস্টার কিছু বলবে তার আগেই দুজন একসাথে কাঁধ ধরে ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলল,
-” একচুয়ালি আঙ্কেল উই আর জাস্ট কিডিং, নাথিং সিরিয়াস।” বলেই দুজনেই দাঁত কেলিয়ে হাসি দেয়।
স্টেশন মাস্টার তার চশমার ফাঁক দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে উল্টো দিকে হাটতে হাটতে বলল,
-” রিডিকিউলাস জেনারেশন।”
স্টেশন মাস্টার যেতেই কল্লোল ফট করে উঠে দাড়ায়। সূর্য পড়ে থাকা বোতালটা তুলে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বোতলটা কল্লোলের দিকে এগিয়ে ধরে।কল্লোল রাগী চোখে সূর্যর দিকে তাকিয়ে বোতল নিয়ে ঢকঢক করে বাকি পানিটুকু খেয়ে নেয়।সূর্য পকেট থেকে একটা টিকেট বের করে কল্লোলের হাতে গুঁজে বলল,
– ” পনেরো মিনিট পরেই আসবে।ট্রেন থেকে নেমে সোজা শ্রেয়ার বাসায় যাবি। বাসার সামনে রোদে টানা দশ মিনিট দাড়িয়ে থাকবি বারো মিনিট পরেই দেখবি শ্রেয়া হুড়মুড় করে দোতলা থেকে নামছে।”
সূর্যের কথা শুনে কল্লোল হেসে দুম করে সূর্যর নাকে একটা পাঞ্চ দিয়ে বলল,
-” শালা আগে বলিসনি কেন?”
টিফিনে লাইব্রেরিতে এসেছে পুতুল।কিন্তু বইয়ের দিকে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে।কারণ তিতিয়া তার কানের কাছে সকাল থেকে মাছির মতো ভনভন করছে। না পেরে বিরক্ত হয়ে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে মাঠে ইট সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চে যেয়ে বসে পুতুল।তিতিয়াও পিছু পিছু যেয়ে তার পাশে বসে বলল,
-” এই পুতুল বলো না কালকের ঐ হ্যান্ডসাম ছেলে টা কে?”
পুতুল ভীষণ বিরক্তি নিয়ে তিতিয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবছে স্টুপিড মেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলেটা কে জেনে কী করবি? শরবতে গুলিয়ে খাবি? কিন্তু মুখে বলল,
-” আমার বড় আব্বুর ছেলে?”
তিতিয়া অবাক হয়ে বলল,” মানে? ”
-” মানে আবার কী, ছেলেটা আমার বড় আব্বুর ছেলে?”
পুতুলের কেন যেন তিতিয়াকে খুব অসহ্য লাগছে, বার বার সূর্যকে হ্যান্ডসাম বলাতে রাগও হচ্ছে।অসভ্য মেয়ে হোক হ্যান্ডসাম তোর কী তাতে, বেয়াদব মেয়ে তুই কেন কেপ্টেন কে হ্যান্ডসাম বলবি?
তিতিয়া কিছুক্ষণ মাথা চুলকিয়ে ভেবে হেসে বলল,
-” ও মাই আল্লাহ, ওই হ্যান্ডসাম ছেলেটা তোমার ভাইয়া।এই জন্যই তোমাদের চেহারায় অনেক মিল আছে তাইনা?”
তিতিয়ার কথায় পুতুল রেগে বলল,
-” না, উনি মোটেও আমার ভাইয়া নন।উনি আমার বড় আব্বুর ছেলে, তাছাড়া আর কিছুই নন।”
বলেই উঠে গটগট করে হেটে ক্লাস রুমে চলে যায়।আর তিতিয়া পুতুলের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে ভাবছে কি হলো ব্যাপারটা!!
চলবে
হ্যাপি রিডিং😒