এক মুঠো গোলাপ
sinin tasnim sara
২-৩
২
___
আমাদের সারপ্রাইজিং প্রোগ্রাম শেষ হলো সন্ধ্যার একটু পর । সাকসেসফুলী আভাকে সারপ্রাইজড করতে পেরেছি আমরা । সবচাইতে বেশি অবাক হয়েছে সাজিদ কে প্রপোজ করতে দেখে । সাজিদ আর আভা মূলত দু’জন দু’জন কে পছন্দ করতো সেই স্কুল লাইফ থেকে কিন্তু বন্ধুত্ব ভেঙে যাবে এই ভয়ে কেউ আগায়নি । ব্যাপারটা প্রথমে আমার চোখে পড়েছিল , জেরিনের সাথে ডিসকাস করে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে সেটিং করিয়ে দিলাম ওদের । কেউ তো ভালোবাসা টা পাক!
সবাই তৈরি হয়েছে চলে যাবে বলে কিন্তু আভা আমাকে কিছুতেই ছাড়লো না , রাত্রিবেলাটা তার বাসায় থাকতেই হবে ।
কি আর করার , থেকে গেলাম ।
সবাইকে বিদায় দিয়ে ভাবলাম বাপিকে কল করে জানিয়ে দেয়া উচিৎ , আভাদের বাসায় নেটওয়ার্ক খারাপ । গেইটের কাছটায় একটুখানি সিগন্যাল পাওয়া যায় তাই ফোন নিয়ে ওখানেই হাঁটাহাঁটি করছি আর বাপিকে কল দিচ্ছি কিন্তু ফোন তো অফ। সম্ভবত নামাজে গিয়েছে , একটু বিরক্ত লাগলো । মায়ের সাথে আমার ঝগড়া চলছে তাই তাকে তো কল করে জানাতে পারবো না আর আপুও নেটওয়ার্কের বাইরে । তার মানে একটা রাত বাইরে কাটাবো পরিবারের মানুষকে না জানিয়ে । ইন্টারেস্টিং!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাসার ভেতরে পা বাড়ালাম । সিঁড়ি ঘরের কাছটায় আসতেই নিদ্র সাহেবের সাথে দেখা , তর্জনীতে চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে । তাকে দেখে একটু সাইড হয়ে দাঁড়ালাম , ছেলেটা চোখের সামনে আসলেই এক মুহুর্ত নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে থাকে কেনো আজব!
সে আমাকে পাশ কাটিয়ে নেমে যেতে যেতে আবার ফিরে তাকালো ।
— এক্সকিউজ মি?
— হু
— তোমার নাম কি?
— সুপ্ত । শুচিস্মিতা কবির সুপ্ত ।
— কিসে পড়ো?
— ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে ।
— এখনো ইন্টার’ই দাওনি তাতেই প্রেম-ভালোবাসার দিকে এত ঝোঁক?
— স্যরি । বুঝলাম না
আমার কথায় বক্র হাসি ফুটিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে সামনে ধরলো সে । স্ক্রিনে একটা ভিডিও প্লে হচ্ছে , চোখ ছোট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার আত্মার পানি শুকিয়ে গেলো । মিনমিনে স্বরে প্রশ্ন করলাম_
— এটা ভিডিও করেছেন কেনো ভাইয়া?
— তুমি যেচে পড়ে আমার বোনের লাইফ নষ্ট করছো আমি সেটার প্রুফ রাখবো না?
— লাইফ নষ্ট করছি?
— এত কম বয়সে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া মানেই তো লাইফ নষ্ট । দু’দিন বাদে আভার যদি সম্পর্ক ভেঙে যায় ও যদি সুইসাইড করতে যায় তা’হলে আমি তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিবো
— প্রেমের সম্পর্কে জড়ালে লাইফ নষ্ট হবে কেনো? লাভ ইজ প্যারাডাইস৷
— তাই নাকি? কম বয়সে ভালোবাসা’র এত জ্ঞান!
— জ্ঞান নয় । সবাই জানে এই পৃথিবীতে ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু জয় করা সম্ভব ।
— ভালোবাসা বলে কিছু নেই । জীবনটাকে তোমরা যতটা সহজ ভাবো ততটাও সহজ নয় । যাক গে তুমি ছোট , তোমার সাথে এসব ডিসকাশন মানায় না । তবে তুমি যা করেছো তা ঠিক করোনি । আভার কোনো ক্ষতি হলে আমি ভাই হিসেবে তোমায় ছেড়ে কথা বলবো না ।
— আমিও আভার ফ্রেন্ড । নিশ্চয়ই জেনে বুঝে ওর ক্ষতি আমি করবো না, তাছাড়াও দে লাভ ইচ আদার । বিষয়টা এত কমপ্লিকেটেড করার তো কারণ দেখছি না ।
— এখন তো কিছুই বুঝবে না । সময় আসুক বুঝে যাবে
ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে গেলো নিদ্র । মেজাজ চটাং করে খারাপ হয়ে গেলো আমার । অসভ্য ছেলে কোথাকার , আমাকে বলে আমি আভার লাইফ নষ্ট করছি! অদ্ভুত
___
ড্রেসিং টেবিলের সামনে কাঠের টুল টায় বসে চুল আঁচড়াচ্ছে আভা তার সাথে গুনগুন করে গান গাইছে, “বন্দে মায়া লাগাইছে ,পিরিতি শিখাইছে
দেওয়ানা বানাইছে রে..”
— আচ্ছা সুপ্ত আমি কি দেখতে খুব সুন্দর? আবারো অর্ধেক গান রেখে আমার দিকে ঘুরে বসলো । ওর প্রশ্নের ধরণে এবার ভীষণ বিরক্ত হলাম আমি । আমাদের ব্যাচে সবচাইতে সুন্দরী মেয়েটা আভা , এটা সে নিজেও জানে তবুও বারবার জিজ্ঞেস করছে কেনো আমাকে?
বিরক্তমাখা গলায় আমি খসখস করে বললাম_
— নাহ্ , পৃথিবীর সবচাইতে কুৎসিত মেয়েটা হলো তুই । হইছে?
— তুই আমাকে এভাবে বলতে পারলি?
— এই পর্যন্ত ৩৬ বার জিজ্ঞেস করেছিস একই কথা তা’হলে আর কীভাবে বলা উচিৎ আমার?
— রেগে যাচ্ছিস কেনো? আচ্ছা রাগ রাগ সমস্যা নেই । রাগলে তোর গাল আর নাক টুকটুকে লাল হয়ে যায় তখন তোকে আরো সেক্সি লাগে ।
— চুপ কর অসভ্য মেয়ে ।
— চুপ করবো কেনো , সত্যি কথা বলতে দোষ কোথায় ।
— তোর এসব অসভ্য মার্কা সত্যি কথা আমার সামনে বলতে আসবি না ।
— তা’হলে কার সামনে বলবো? সাজিদের সামনে , ও তো একটা কলাগাছ । ওর সাথে এসব রসের আলাপ জমবে না ।
— জমবে না তো প্রপোজাল আ্যাকসেপ্ট করলি কেনো?
— কি জানি , ভীমরতিতে ধরেছিল বোধহয় ।
— তা’হলে ব্রেকাপ করে দে ।
— বালাইষাট , কি সব বলছিস ।
— যার সাথে রসের আলাপ জমবে না তার সাথে সম্পর্ক রাখবি কেনো?
— আরেহ্ মানে… আচ্ছা আমার কথা ছাড় তোর কথা বল । আমরা তো সব পটাপট মিঙ্গেল হয়ে যাচ্ছি তুই কবে হবি হুমম!
— আমার কপাল অতটাও ভালো নয় রে ।
জোরপূর্বক হাসি টেনে বললাম আমি । আভাও এবার সিরিয়াস হলো । আমার হাত ওর দু হাতের মুঠোয় নিয়ে আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে বলল_
— আর কতদিন খুঁজবি তাকে বল তো?
— কই খুঁজি না তো ।
— দ্যাখ আমরা তোর ফ্রেন্ড । আমরা কিন্তু বুঝি সব ।
— সে এরকম টা না করলেও পারতো রে ।
কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে রইলো আমার , আর কিছু বলতেই পারলাম না । আভা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল_
— শোন সে চলে গিয়েছে ভালোই হয়েছে সবচাইতে বেশি ভালো কি হয়েছে জানিস? তোদের সম্পর্কটা শুরুই হয়নি তার পূর্বেই বিচ্ছেদ হয়েছে । সম্পর্ক রানিং অবস্থায় যদি এই সত্যিগুলো সামনে আসতো তখন হয়তো ঝামেলা বেশি হয়ে যেত । আর তুই তো ওকে ভালোও বাসিস না ।
— হুম কিন্তু ও আমার অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল এজন্য ভুলতে পারিনা । হয়তোবা সময়ের সাথে সাথে ভুলে যাবো কিন্তু এখন যেই কষ্টটা হয় এটা কাউকে বোঝানোর মত না ।
— এভাবে ভেঙে পড়িস না স্যুপ । উই উইল অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ
আমার গলা জড়িয়ে ধরলো আভা । ওর কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে পুরাতন স্মৃতিতে অবগাহন করলাম । যার কথা বলা হচ্ছে সে হলো প্রিয়। আমাদের ক্যামেস্ট্রি স্যারের একমাত্র ছেলে । এসএসসি পরীক্ষা শেষে অবসর দু মাসের গ্যাপে বন্ধুদের সাথে ফিজিক্স ক্যামেস্ট্রি শুরু করেছিলাম সরকারি কলেজের দুজন টিচারের কাছে । তাদের মধ্যে ক্যামেস্ট্রি স্যারের নাম পরিতোষ । কলেজের পাশেই একটা দোতলা বাসায় উনি ভাড়া থাকেন । বন্ধুরা প্রাইভেট শুরু করবার দু সপ্তাহ পেরিয়ে আমি যোগ হই যার ফলে স্যারের নাম অবধি জানা ছিলো না আমার । পড়াশোনার ব্যাপারে উদাসীনতার কারণে আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেসও করিনি একটাদিন ।
যাহোক সপ্তাহে তিনদিন সকাল সাড়ে সাতটায় স্যার পড়াতেন । অত সকালে আমার ঘুমই ভাঙতো না । মায়ের বকুনি খেয়ে অর্ধেক টাইম পেরিয়ে ঢুলুঢুলু অবস্থায় পৌঁছুতাম স্যারের বাসায় ।
কয়েকদিন যেতেই আমার মনে হতে লাগলো কেউ আমাকে ফলো করে, কিন্তু ধরতে পারিনা কে।
বন্ধুদের সাথে ডিসকাস করি কিন্তু তারা এমন কিছু লক্ষ্য করেনি বলে গায়েই মাখেনা । এদিকে আমার মস্তিষ্কে বসে যায় ব্যাপারটা । আমি বেশ সতর্ক হয়ে চলাফেরা শুরু করি । আমার সতর্ক হবার পরপরই মানুষটা গা ছাড়া স্বভাবের হয়ে যায় , যেচে পড়ে ধরা দিতে আসে ।
তাকে হাতে নাতে ধরার পরেও বন্ধুরা বিশ্বাস করতে চায়না কারণ আমি মুসলিম সে হিন্দু । সে জেনেবুঝে একটা মুসলিম মেয়েকে কেনো পছন্দ করবে? বলা বাহুল্য আমিও সেদিনই জানতে পারি আমি যার কাছে নিয়মিত পড়তে আসি উনি সনাতন ধর্মাবলম্বী বিলং করেন । এটা জানার পর প্রিয়’র ওপর রাগ হয় , না জেনে সে কেনো আমার পিছু নেয় । তার কিছু আচরণ যে আমাকেও মুগ্ধ করে ফেলেছে অলরেডি । এই ব্যাপারটাই মানতে নারাজ ছিলাম আমি ।
একদিন সরাসরিই তাকে জিজ্ঞেস করি সে কেনো আমার পিছু করে?
সে মাথা নিচু করে বলে , আই থিংক আই আ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ ।
তার উত্তরে আমি অবাক হইনা কারণ একটা ছেলে নিশ্চয়ই অযথা আমার পিছু করবে না ।
আমি স্বাভাবিক কণ্ঠেই পাল্টা প্রশ্ন করি_
— আপনি কি জানেন আমি একজন মুসলিমা ।
সেও বিশেষ অবাক হয়না ।
— আমি জানতাম ।
— আপনি জেনে বুঝে আমাকে ভালোবাসেন?
— হু । ধর্ম কি ভালোবাসা আটকাতে পারে!
— সমাজ আটকাতে পারে । আমরা চাইলেই যাকে তাকে ভালোবাসতে পারিনা । আমাদের মধ্যেকার এই ব্যবধানটা অন্য এক পর্যায়ের ।
— তুমি শুধু একবার বলো সুপ্ত । আমি লড়বো সবার বিরুদ্ধে ।
— বিষয়টা এতটাও সহজ নয় প্রিয় দা ।
— প্লিজ সুপ্ত এভাবে বোলো না ।
— থিংক প্রাক্টিক্যালি । এভাবে হয়না আসলে ।
এরপর আমাদের অনেক বাকবিতণ্ডা হয় । পরিশেষে হার মানতে হয় তাকে । আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে সে প্রশ্ন করে_
— তুমি তা’হলে আমার হবেই না?
তার টলমল চোখ দেখে আমার ভেতরটা ভেঙে আসতে চায় । কান্না আটকে শুকনো একটা ঢোক গিলে বলি “উঁহু । যা হবার নয় তা নিয়ে..”
আমায় কথা শেষ করতে না দিয়েই সে পিছু ঘুরে যায় । নাক টেনে গলার স্বরটা গম্ভীর করার চেষ্টা করে বলে,
–” ভালোবাসা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে হয়না সুপ্ত । মনে রেখো এই প্রিয় আজীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে , আজীবন”
আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না প্রিয় । আমার মনটা ব্যাকুল হয়ে যায় তাকে একটাবার জড়িয়ে ধরবার জন্য কিন্তু এ যে অসম্ভব ।
এরপর থেকে আজ অবধি প্রিয়’র ছায়াটাও দেখিনি আমি । মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব অসহায় লাগে , প্রিয়কে এক পলক দেখার জন্য চোখে তৃষ্ণা জাগে কিন্তু পারিনা । সেই পথ যে নিজ হাতে বন্ধ করে দিয়েছি আমি । হয়তোবা তাকে এক পলক দেখার আশা আর কোনোদিন পূরণ হবে না , কোনোদিন না ।
— কি রে কোন খেয়ালে হারালি?
আভার ডাকে হুঁশ ফেরে আমার । চোখের কোলে আসা পানিটা তর্জনী চেপে মুছে মাথা নেড়ে বলি _
— কিছু না ।
আভা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে_
— কাঁদিস না । ভুলে যা এসব ।
— হু ।
— আচ্ছা মা বললো তুই নাকি নিদ্র ভাইয়ার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছিলি তাকে । কেনো রে আমার ভাই কে বুঝি পছন্দ হয়ে গেলো হুউউ..
— ধুরর কি যা-তা বলিস । ঐ আ্যারোগেন্ট , অসভ্য ছেলেকে আমি পছন্দ করবো ছ্যাহ ।
— হায় হায় আমার অত্ত সুন্দর ভাইটা কে তুই অসভ্য বানিয়ে দিলি!
— তা নয় তো কি । জানিস সে কি করেছে?
— কি করেছে?
— সে তো.. এতটুকু বলে থেমে গেলাম আমি । নাহ্ আভাকে বলা যাবেনা পরে ফ্যামিলির ভয়ে রিলেশন ভেঙে দিতে পারে ।
কথা কাটিয়ে বললাম_
— অনেক অসভ্যতামী করেছে । আমাকে ইগনোরও করেছে জানিস! তখন প্রোগ্রামে আমি একবার কেকের বাটি নিয়ে গেলাম অথচ সে নিলোই না আমার থেকে , জুস এগিয়ে দিলাম তাও নিলো না । আকড়ু ছেলে কোথাকার ।
— আয়হায় বলিস কি । আমাদের ডালিমকুমারী কে এভাবে ইগনোর করলো সে । নাহ্ একদমই ভালো করেনি ।
— হুহ্ ঢং ।
মুখ বাঁকিয়ে বললাম আমি । আমার মুখ বাঁকানো দেখে হা হা করে হেসে উঠলো আভা ।
— তুই আসা মাত্রই ঝগড়া! ইন্টারেস্টিং তো । এটা জানিস ঝগড়া কিন্তু প্রেমের সূচনা ।
— ঐ গোমড়ামুখোর সাথে কে প্রেম করবে ছিঃ ছিঃ ।
— তোদের কিন্তু মানাবে বেশ ।
— চুপ অসভ্য । হাসবি না একদম , দাঁত ভেঙে দিবো কিন্তু ।
— আচ্ছা আচ্ছা হাসবো না ।
হাসবো না বলেও মুখে হাত দিয়ে গা দুলিয়ে হাসছে আভা । এবার বিরক্ত লাগছে আমার । চোখ গরম করে ওকে থামাতে চেষ্টা করছি , এতে ওর হাসি আরো বাড়ছে ।
আসলে পাগল হয়ে গিয়েছে মেয়েটা । ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ফোনটা হাতে করে ব্যালকোনিতে চলে আসলাম । আমি বেরিয়ে আসার পর ওর হাসির আওয়াজ আরো বেড়ে গেলো । আশ্চর্য্য একটা মেয়ে এত হাসে কীভাবে!
আর ভাবতে ইচ্ছে করলো না এসব নিয়ে । সব উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে গ্রীলের ফাঁক দিয়ে সুবিশাল আকাশটার দিকে তাকালাম । আজ আকাশে কোনো চাঁদ নেই কেবল ছোট ছোট তারা ।
দু’টো তারা একটু বেশীই জ্বলজ্বল করছে মনে হচ্ছে । তারা দু’টোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে হলো এখন বড় আপু আমাকে কল করবে । হয়তোবা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ।
ভাবনাচিন্তা সুদূরপ্রসারী হবার পূর্বেই হাতে থাকা ফোনটা বেঁজে উঠল । একগাল হেসে রিসিভ করলাম আমি । ওপাশ থেকে আপু মিষ্টি গলায় প্রশ্ন করলো_
— হাসছিস কেনো?
— কে বললো আমি হাসছি ।
— অবশ্যই হাসছিস তুই । বারোটা দাঁত বের করে হাসছিস ।
— তাই নাকি? কে বললো তোকে যে আমি হাসলে বারোটা দাঁত দেখা যায় ।
— কাউকে বলতে হবেনা । আমি গুণে দেখেছি । তুই সবসময় হি করে হাসিস যার ফলে তোর দু পাটি দাঁতের মধ্যে সামনের ৬ টা করে দাঁত স্পষ্ট দেখা যায় ।
— আচ্ছা তাই!
— জ্বী তাই । আচ্ছা এখন হাসি থামা । বল কেমন আছিস?
— ভালোই আছি । তোর কি খবর!
— আমি বিরিশিরি এসেছি এবার । প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনমুগ্ধকর ।
— তার মানে তোর মন ভালো আছে?
— হু ।
— কবে আসবি?
— জানিনা । হুট করে চলে আসবো ।
— এবার কার সাথে গিয়েছিস রে?
— তৌহিদের সাথে ।
— তৌহিদ ভাই কই?
— ঘুমায় ।
— এই অসময়ে ঘুম ।
আমার প্রশ্নের জবাব দিলো না আপু । কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল_
— একটা ভয়ংকর সংবাদ জানাবো তোকে ।
ওর কথা শুনে ফোনটা কেটে দিলাম । আমি জানি কি সংবাদ শোনাতে চায় ও । শী ইজ নট ভার্জিন এনিমোর ।
খারাপ লাগছে আমার । তৌহিদ ভাইয়ের সাথে ব্রেকাপ করে দিবে এবার । তৌহিদ ভাই ভালো মানুষ , আপুকে ভীষণ ভালোবাসে । আমি জানি আপুও তাকে ভীষণ ভালোবাসে কিন্তু আফসোস তারা এক হতে পারবে না ।
ব্যালকনির ডিভানে গা এলিয়ে দিলাম আমি ।
আচ্ছা এই সমাজের ভয়ে কতগুলো জুটি এভাবে ভেঙে গেলো?
আমরা দু বোন কি কখনোই ভালোবাসাটাকে আপন করে পাবো না? আমাদের ভাগ্য এত খারাপ কেনো?
এক মুঠো গোলাপ
৩
__
আমি সাধারণত নিজেকে যেরকমটা দেখানোর চেষ্টা করি তেমন কিন্তু নই। সকলের সামনে একটা ম্যাচিওর ,প্রাক্টিক্যাল মেয়ে হলেও ভেতরে ভেতরে সবচাইতে ইমোশনাল এবং ইমম্যাচিওর আহ্লাদি মেয়েটা হয়তো আমি ওহ্ হ্যাঁ তার সাথে যুক্ত করতে পারেন ভালোবাসার কাঙ্গাল । ভালোবাসার এই কাঙ্গালপনা শিখেছি আমার বড় আপুর কাছে ।
আজ তা’হলে বড় আপুর গল্প শোনাই । আমার বড় আপুর নাম রুবাইয়া কবির রাফনিদ । আমার চাইতে গুনে গুনে দশ বছরের বড় । গ্রাজুয়েশন শেষ করে বাসায় বসে আছে , জব টব করার কোনো আগ্রহ তার মধ্যে দেখা যায় না আর না সে বিয়েতে ইন্টারেস্টেড । বাপি-মায়ের একটাই চিন্তা ওর ফিউচার নিয়ে যদিওবা আমাদের টাকা পয়সার কোনো কমতি নেই , বাপির যা সম্পত্তি আছে তা দিয়ে আমরা দু বোন আরাম করে এক জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো । কিন্তু মেয়ে বড় হলে চিন্তাটা শুধু টাকা পয়সাতে সীমাবদ্ধ থাকে না , হাজারটা চিন্তার মধ্যে সবচাইতে বড় হলো বিয়েশাদী করিয়ে সংসার সাজিয়ে দেয়া । আমার আপু সংসার বিমুখ , তার স্বপ্ন সে একজন ট্রাভেলার হবে । খুব কম বয়স থেকে ও ট্রাভেলিং শুরু করেছো । বাংলাদেশের পঞ্চাশ টা জেলা তার দেখা শেষ বাকি আর চৌদ্দটা জেলা দেখা হয়ে গেলে বিদেশে পাড়ি দেয়ার চিন্তাভাবনা ।
এখানে প্রশ্ন হলো এত টাকা ও কোথায় পায়? আপু যে জব করেনা কথাটা পুরোটা সত্য নয় । জব অবশ্যই করে কিন্তু আর পাঁচটা গ্রাজুয়েটের মত কর্পোরেট লাইনে নয় । সে আউটসোর্সিং করে অর্থ উপার্জন করে । ইচ্ছা স্বাধীন কাজ তার , কখনো সারারাত জাগতে হয় কখনোবা সারাদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে থাকে । আপুর অদ্ভুত জীবনাচরণ আরো কারো পছন্দ হোক না হোক আমার ভীষণ ভালো লাগে ।
এর পেছনে দু’টো কারণ বলা যেতে পারে ১.আমি আমার বাপি-মায়ের নিজের মেয়ে নই । একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে আপু আমাকে ময়লার স্তুপে পড়ে থাকতে দেখে কিছু না ভেবেই বাসায় নিয়ে আসে । ও বাসায় ঢোকার ঠিক পাঁচ মিনিট পর সারা দেশে এক যোগে ভারী বর্ষণ শুরু হয় । হয়তোবা সেদিন বৃষ্টিতে ভিজেই আমার ছোট্ট প্রাণটা পৃথিবী থেকে বিদায় নিতো । কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত আমি বেঁচে আছি । ফেরেশতা হয়ে আপু না আসলে সুপ্ত নামক অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে থাকতো না । আমি আপুকে আমার মায়ের স্থান দিয়েছি । আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি গর্ভধারিণী’র চাইতে প্রাণ রক্ষাকারীনির মর্যাদা সবচাইতে বেশি ।
এবং দ্বিতীয় কারণ.. দ্বিতীয় কারণটা আজ গোপন থাক ।
— এ্যাই সুপ্ত কি লিখছিস বল তো তখন থেকে?
আভার কণ্ঠ পেয়ে ঝট করে ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেললাম । আমার জীবনের ভয়ংকর রকমের সত্যিগুলো এই ডায়েরির পাতায় লিপিবদ্ধ , আমি চাই না কেউ কখনো এসব সত্যের মুখোমুখি হোক ।
— সুপ্ত বারবার কই হারাচ্ছিস বল তো?
— নাহ্ কোথাও না । বল কি বলবি?
— মা খেতে ডাকছে। প্রাইভেটেও তো যেতে হবে ।
— আরেহ্ ভুলে গিয়েছি তুই যা আমি একদম রেডি হয়ে নিচে নামছি ।
— পাক্কা?
— হুমম
— ওকে আয় তা’হলে ।
আভা চলে যাওয়া মাত্র চট করে ডায়েরিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম । এখন ফ্রেশ হওয়া দরকার , প্রাইভেটের আগে বাসায় ঢুকবো একবার । হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে তো আর প্রাইভেটে যাওয়া যায়না ।
চোখেমুখে পানি দেয়ার সময় মনে পড়লো পুরো একটা রাত বাইরে কাটিয়েছি আর বাপি একটা কল অবধি দেয়নি ,ভেরি ব্যাড । অভিমান জমে গেল মনে , বাসায় গিয়ে একটা কথাও বলবো না হুহ্ ।
আয়নার সামনে কিছুক্ষণ মুখ বাঁকা বাঁকি করে তারপর বেরুলাম ।
___
আভাদের ডাইনিং স্পেসটা বিশাল সেই সাথে ডাইনিং টেবিলও । রাউন্ড করে ষোলো টা চেয়ার সাজিয়ে রাখা । এদের বাড়িতে লোকসংখ্যা কম , এতবড় ডাইনিং টেবিল দিয়ে করে টা কি? যাক গে যা করার করুক আমার তা’তে কি!
উল্টোপাল্টা চিন্তা ছেড়ে টেবিলটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম । আপাতত আভা আর নিদ্র সাহেব বসে খাচ্ছে বাকিরা কই? ওহ্ বেলা এগারোটা বাজে , আঙ্কেল নিশ্চয়ই কাজে গিয়েছে । আমার মত নবাবী জীবন-যাপন কে ই বা করবে! একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আভার পাশের চেয়ারটা টেনে বসলাম । চোরা চোখে নিদ্র সাহেবকে একবার দেখে নিতে ভুললাম না, এই অদ্ভুত লোকটার সাথে বসে খেতে হবে ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল । নাহ্ মেজাজ খারাপ করা যাবেনা , খাওয়ার সময় কোনো উল্টোপাল্টা বিষয় নিয়ে মন মেজাজ খারাপ করতে নেই নইলে ক্ষুধা চলে যায় । এবং আমি চাইনা আমার খাবারের রুচি চলে যাক তাই বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলাম ।
আমায় দেখে আন্টি খাবারের ডিশগুলো নিয়ে একপ্রকার ছুটে আসলো । প্লেট সামনে দেয়ার এক সেকেন্ডের মাথায় খাবারে ভরপুর৷ খাবারের আইটেম দেখে আমার হেঁচকি উঠে গেলো । আভা চোখ সরু করে বলল_
— কি রে খাবার না খেতেই হেঁচকি দেওয়া শুরু ।
— আন্টি যত খাবার দিয়েছে এগুলো এক মাসেও তো শেষ করা পসিবল নয় আমার দ্বারা ।
অসহায় ভাবে হেসে বললাম আমি । আন্টি কথা কেড়ে নিয়ে বলল_
— ওমা কতগুলো খাবার দিলাম হ্যাঁ? মাত্র এই কয়টা খাবার দেখেই নাক সিটকোচ্ছিস । খাস না জন্য তো এমন ঢেঁড়স মার্কা চেহারা হয়েছে তোর । দাঁড়া তো তোর আম্মুর সাথে দেখা হোক , মেয়ের খাবারের প্রতি এত অনীহা তৈরি হলো কেনো জিজ্ঞেস করতে হবে ।
আন্টির কথায় আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম । বরাবরই আমার প্রতি আন্টির সোহাগ একটু বেশি কিন্তু আজ অতিরিক্ত হয়ে গেল । ওনার কথা মোটেও সত্য নয় আমি একজন পাক্কা ফুড লাভার এবং খাবারের প্রতি আমার এতই ভালোবাসা যে সারাদিন এটাওটা চলতেই থাকে । ইনফ্যাক্ট আমার পড়ার টেবিলের ওপর একটা কন্টেইনার সবসময় রাখা থাকে যেখানে বিস্কিট চানাচুর কিংবা চকলেট ভরা । খেতে খেতেই আমার ওজন ষাটের ঘর পেরিয়েছে । এতটা ওজন হওয়া সত্বেও আন্টির সোহাগ আমাকে ঢেঁড়স বানিয়ে দিয়েছে । ইন্টারেস্টিং ।
চিন্তার সুতো কাটলো কারো চাপা হাসির শব্দে । চোখ তুলে দেখলাম আমার অপজিটে নিদ্র সাহেব মুখে রুটি পুরতে পুরতে ঠোঁট চেপে হাসছে । তার হাসির কারণ যে আন্টির মিছেমিছি কমপ্লিমেন্ট সেটা বুঝতে আমার এক সেকেন্ড সময় লাগলো না ।
দারুণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম আমি । প্লেটে হাত দিতেই ইচ্ছে করছে না এবার ।
আমার অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে দিতে সে বিড়বিড় করে মজার ছলে বললো_”আহ্ ঢেঁড়সের কি রূপ!”
অস্বস্তি বদলে গেলো রাগে । এই লোকটার সাথে কি আমার জন্মের শত্রুতা? দেখা হয়েছে থেকে পিছে লেগেছে কেনো! ওহ্ সে ভাবে আমি তার কেকের টাকা রিটার্ন করবো না ।
নিজের মত চিপ ভাবে নাকি সবাইকে! বাসায় গিয়ে নেই , জাস্ট পৌঁছেই দিয়ে দিবো হুহ্ ।
— কি রে নিদ্র রুটি নে? প্লেট তো খালি ।
— নাহ্ বড়ম্মু আমার পেট ভরে গিয়েছে ।
— সে কি তুই তো কিছু খেলিই না ।
— আরে খেয়েছি । বেশি খেলে আবার গেস্টের খাবার কম পড়ে যাবে ।
কথাটা আমাকে ইঙ্গিত করে বলেছে বুঝতে পেরে আমি গরম চোখে তাকালাম তার দিকে । সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লো , আমায় দেখে ফের একটা চাপা হাসি দিয়ে পানির গ্লাস নিয়ে চলে গেলো ।
আসলেই একটা বেয়াদব , অসভ্য-উন্মাদ ছেলে ।
__
কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার পর হামি দিতে দিতে ঘরে পৌঁছুলাম । সবটা গোছানো শেষ এখন একটু রেস্ট নিয়ে বেরুনোর পালা । আভা ততক্ষণে রেডি হয়ে নিক , আমি বরং ফোন চাপাচাপি করি ।
বিছানার কোণ থেকে ব্যাগটা টেনে নিতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো , একি আমার ব্যাগের জিপটা খোলা কেনো? ভেতরে তো ডায়েরি টাও নেই ।
কে নিলো আমার ডায়েরি । তড়াং করে উঠে খুঁজতে শুরু করলাম ডায়েরি টা । পুরো ঘর আতিপাতি করে খুঁজে হঠাৎ মনে পড়লো নিদ্র কে তখন এই ঘরের দিকেই আসতে দেখেছি তার মানে কি সে?
ওড়না টা টেনে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে । ওনারা থাকে দোতলায় । কিছু না ভেবেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম । অনেক্ষণ থেকে কলিংবেল বাজাচ্ছি কিন্তু কেউ খোলে না , দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে দেখা গেলো তালা দেয়া ।
তা’হলে কি সে ছাদে?
এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম । দরজায় পা দিতেই দেখি চিলেকোঠার ঘরের সামনে ভাঙা পিলারটার ওপর বসে মনযোগ দিয়ে সে ডায়েরি টা পড়ছে । পায়ের রক্ত যেন মাথায় উঠে গেলো আমার । ছুটে গেলাম তার সামনে , ডায়েরি টা টেনে নিবো ঐ মুহুর্তে আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেললো সে ।
রাগে হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে বললাম_
— কোন সাহসে আমার ডায়েরি নিয়েছেন আপনি? ম্যানারলেস ছেলে কোথাকার ।
— ডায়েরি নিতে আবার সাহস লাগে নাকি! চোখের সামনে দেখেছি নিয়ে নিয়েছি ।
— এক্ষুনি আমার ডায়েরি ফেরত দিন ।
— উঁহু দিবো না । প্রুফ কি এই ডায়েরি তোমার?
— মানেহ্ কি আমি বলছি আমার ডায়েরি, এখানে আবার প্রুফের কি আছে ।
— কই তোমার নাম তো লেখা নেই ডায়েরি তে ।
— খবরদার ফাজলামি করবেন না । আমার ডায়েরি ফেরত দিন আমাকে ।
— আরে এটা যখন তোমার নয় ই তা’হলে ফেরত দিবো কেনো তোমাকে? আমি তো এটা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিয়েছি ।
— মিথ্যে আপনি আমার ব্যাগ থেকে বের করে নিয়েছেন ডায়েরি ।
— নেভার এভার । আমি কি চোর নাকি যে বের করে নিবো! তুমি দেখেছো আমাকে ডায়েরি বের করতে?
— দেখুন কথা প্যাঁচাবেন না । এমনিতেই কারো পারমিশন ছাড়া তার ডায়েরি পড়া ক্রাইম । আপনি তো সেই ক্রাইম করেছেনই আবার তর্কও করছেন।
— কথা তো তুমি প্যাঁচাচ্ছো । আমি বলছি প্রুফ দাও আমি তোমাকে ডায়েরি ব্যাক করে দিবো ।
অসভ্য ছেলেটার কথা শুনে রাগে দুঃখে আমার কান্না পেয়ে গেলো । ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললাম_
— এরকম করছেন কেনো? প্লিজ দিন না আমার ডায়েরি টা ।
আমার কান্না দেখে ভড়কে গেলো ছেলেটা । হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে আসলো । অপ্রস্তুত ভাবে বললো_
— আচ্ছা আচ্ছা কাঁদছো কেনো তুমি? দিচ্ছি তো ।
আমি হাত বাড়িয়ে নিতে গেলাম সে চট করে সামনে থেকে সরিয়ে নিলো ।
— একটা শর্ত আছে ।
— কি শর্ত?
— ডায়েরি ফেরত দিবো তার পরিবর্তে আমাকে একজনের আ্যাড্রেস এনে দিতে হবে ।
— কার আ্যাড্রেস বলুন? আমি এনে দিবো পাক্কা প্রমিস ।
— সত্যি তো?
— মা কসম । প্লিজ আমাকে ডায়েরি টা দিন?
— এই নাও । অতঃপর উনি আমাকে আমার ডায়েরি ফেরত দিয়ে দিলেন ।
হাতে পাওয়া মাত্র ডায়েরি বুকে চেপে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম আমি ।
আমার ব্যক্তিগত জিনিসে কেউ হাত দিক একদমই পছন্দ নয় আমার । আমার জীবনের সিক্রেট শুধু আমি জানবো আর কেউ নয় ,কেউ নয়..
— হয়েছে এত কাঁদছো কেনো হু? কান্না থামাও । আমি কিন্তু পুরোটা পড়িনি ইনফ্যাক্ট মাত্র একটা পেইজ পড়েছি তখনই এসে গেছো তুমি ।
— সত্যি তো বেশি পড়েন নি?
— আরে তিন সত্যি । শুধু মাত্র ৪ টা লাইন পড়তে পেরেছি । তোমার পুরো নাম শুচিস্মিতা কবির সুপ্ত । সুপ্ত নামটা তোমার ভীষণ পছন্দের কারণ তোমার বড় আপু আদর করে এই নাম দিয়েছে ।
পরে যেন কি..
— কি হয় হোক । আপনাকে জানতে হবে না ।
ওনার থেকে দু কদম পিছিয়ে চোখের পানিটা মুছে নিলাম আমি । নিদ্র চোখ ছোট ছোট করে বলল_
— বাপ রে এক সেকেন্ডে রঙ পাল্টে গেলো চোখ মুখের । তবে মনে রেখো আমার কাজটা কিন্তু করে দিতে হবে ।
— আমি বাধ্য নই ।
— মায়ের কসম দিয়েছো তুমি ।
এবার কিছুটা দমে গেলাম । আমতা আমতা করে বললাম_
— ওকে ফাইন কবে এনে দিতে হবে?
— এক সপ্তাহের মধ্যেই ।
— আচ্ছা এনে দিবো । আভাকে দিয়ে রাখবেন ডিটেইলস আমি খুঁজে দেবো ।
— আভাকে দেয়ার হলে তোমায় বললাম কেনো?
— আচ্ছা আমাকেই দিন ।
— তোমার ফোন নাম্বার দাও । টেক্সট করে দিবো ।
— আমি অপরিচিত কাউকে ফোন নাম্বার দিই না ।
— শোনো অত ভাব নিও না আমি বখাটে কোনো ছেলে নই যে তোমার নাম্বার নিয়ে ডিস্টার্ব করবো ।
— হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি তো বিশাল সাম্রাজ্যের ডালিমকুমার ।
— কথা না পেঁচিয়ে ফোন নাম্বার দাও ।
— আচ্ছা লিখুন
নাম্বারটা দিয়ে চলে আসতে নিলাম অমনি সে আমার ওড়না টেনে ধরলো ।
— এই যে ঘুমন্ত হাসি প্রমিসের কথা ভুলো না যেন ।
— আমি কাউকে প্রমিস করলে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ভুলি না ।
— একটু আগেই তো ভুলে গেলা ।
তার কথার আর কোনো জবাব না দিয়ে ওড়না টেনে ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে চলে এলাম আমি ।
সাহস কত! আমার ওড়না টেনে ধরে । অসভ্য , উন্মাদ ছেলে কোথাকার ।
বিড়বিড় করে বকতে বকতে সিঁড়ি বেয়ে নামছি আমি । ওপাশ থেকে সে চেঁচিয়ে বলছে_ এ্যাই ঘুমন্ত হাসি , কাঁকড়ার স্যুপ কথার খেলাফ হলে কিন্তু উঠিয়ে নিয়ে আসবো তোমায় বলে দিলাম ।
আমি আর তার কথায় কান দিলাম না । ডায়েরি টা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম । ভাগ্যিস এক পৃষ্ঠাই পড়তে পেরেছে শুধু । দোষ আমারই , বাথরুমে গেলেও যেন আমার ডায়েরি সাথে নেয়া চাই । নাহ্ এবার থেকে আর এমন ভুল করা যাবে না । বাসায় গিয়ে লকারে ঢুকিয়ে রাখতে হবে এটা নইলে কার না কার হাতে পড়ে যায় ।
চলবে