এখানে আকাশটা ভালোবাসার পর্ব ২৬

#এখানে_আকাশটা_ভালবাসার
#লেখিকাঃ নয়নতারা নাতাশা
#পর্বঃ ২৬
.
রিদিমাকে দেখে ফ্যাকাশে হয়ে গেল আরিফের মুখ।
“তুমি কখন এলে?” কাতর স্বরে প্রশ্ন করে আরিফ।

“এই তো এলাম।”
“ডাকনি যে!”
“এমনিই ডাকিনি। কাকে বলছিলে আমি লাকি তুমি লাকি? এসে শুনতে পেলাম।” হেসে বলল রিদিমা।
হাফ ছেড়ে বাঁচল আরিফ।
“আরে ফ্রেন্ডকে”
“ও আচ্ছা” খুশি হয় রিদিমা।
“আরিফ তুমি আমাকে বিয়ে করবে কবে?” আবার প্রশ্ন করে রিদিমা।
“আরে তোমার মত স্মার্ট মেয়ে এত বিয়ে বিয়ে করলে কি সেটা ভাল দেখায়? বিয়ে তো চলে যাচ্ছে না!”
একটু রূঢ় স্বরে জবাব দেয়। চমকে তাকায় রিদিমা। সেটা দেখে পরমূহুর্তেই আরিফ সামলে নেয় নিজেকে।
“আরে লক্ষ্মীটি আমি তো আছিই, বিজনেস টা আরেকটু গুছিয়ে নিই।”
“হুম”
রিদিমা আজকাল আরিফকে বড্ড বেশি ভালবেসে ফেলেছে। আরিফের প্রত্যেকটা কাজই ওর ভাল লাগে।
রিদিমা কখনো বোঝেনি আসল ভালবাসা কি!
আর যখন বুঝতে পারছে তখন পর্যন্ত তার জন্য সত্যিকারের ভালবাসা আছে কিনা সেটা যথেষ্টই সন্দেহের বিষয়!
চোখের দিকে তাকালে নাকি সত্যিকারের ভালবাসা বোঝা যায়!
হয়তো তাই আরিফ বুঝেছিল রিদিমা তাকে সত্যসত্যই ভালবাসে, এইজন্যই আরিফ অনেকবেশি খুশি হয়েছে।
সে চায় তার প্রতি রিদিমার ভালবাসা-মায়া আরো বাড়ুক।
যতটা ভালবাসা থাকলে তাকে ভুলে যাওয়া যায় না।
আর সেটাই হবে যেটা হওয়ার ছিল।
মানুষ যখন না বুঝে কাজ করে সেটা ভুল।
কিন্তু ভুল করে যখন বারবার ভুল করতেই থাকে সেটা হয়ে যায় অপরাধ।
ভুলের ক্ষমা পাওয়া যায়,
ক্ষমা না পেলেও মানসিক শান্তি পাওয়া যায়।
কিন্তু অপরাধ অপরাধই!
অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে।
জীবনের কোনো এক সময়, নয়তো জীবনের ওপারে গিয়ে।
.
বধূসাজে বসে আছে শাকিরা সাহরাফ নওশি।
এখনো বর আসেনি। সারাবাড়ি হইচই।
কিন্তু প্রানোচ্ছল নওশি চলে যাবে এ যেন নওশির পরিবারের কেউই মেনে নিতে পারছে না।
সে ছিল এ বাড়ির প্রাণ তা কারোর অগোচরে নেই।
একা থাকবে এটা রোশনি ভাবতেই পারছে না।
বিয়ের খুশি সবার মাঝেই আছে কিন্তু কোথায় যেন একটা সুর পড়ে গিয়েছে।
ঠিক কেন একটা বেসুরো ভাব!
রায়ান নওশির সামনে আসেনি একবারও।
সবাইকে পাশে পেয়ে নওশি রায়ানকে না পেয়ে ডেকে পাঠাল।
নিজেকে মনে মনে শক্ত করে মুখে হাসি টেনে এনে নওশির কাছে আসল রায়ান।
“ও আমার ছোট ভাইয়া….? আমাকে একটা চকলেট দিবি?”
চমকে তাকাল রায়ান, মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে নওশি।
ছোট বেলায় ঠিক এভাবে চকলেট চাইত নওশি।
আস্তে আস্তে নওশির পাশে গিয়ে বসল রায়ান।
নওশি প্রাণপণ চাইছে না কাঁদতে।
কিন্তু পারছে না।
“কেন এমন নিয়ম ভাইয়া?”
বলেই বসে থেকে রায়ানের হাঁটুর উপর মাথা রেখে কাঁদতে লাগল।
নিশিকা সেখানে বসে ছিল।
কান্না চাপতে না পেরে উঠে চলে গেল।
সায়ান রুমে ঢুকতে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
আর রায়ান… চুপচাপ বসে আছে নওশির মাথায় হাত রেখে।
থাকুক কিছুক্ষণ।
কয়েক মুহূর্ত পর সায়ান আস্তে আস্তে রুমে ঢুকল। চোখে পানি।
ইশারায় রায়ানকে বোঝালো কাঁদলে মাথা ধরবে নওশির।
তারপর আস্তে আস্তে পাশে এসে বসল।
“বাবু… ওঠ পাখি.. আর কাঁদিস না”
সায়ান নওশি উঠিয়ে চোখ মুছিয়ে দেয়।
“ভাইয়া তোদের ছেড়ে আমি থাকতে পারব না ভাইয়া!”
“ধূর পাগলি তুই কি একেবারে চলে যাচ্ছিস নাকি?”
এতক্ষণে কথা বলল রায়ান।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সায়ান।
“বাবু যখন মন চাইবে তুই আসবি”
“আমায় তোরা ভুলে যাবি না তো?”
“পাগলিটা…. আর কাঁদিস না”
এভাবেই দুইভাই স্বান্তনা দিতে থাকে বোনকে।
এটা বাস্তবতা। এখন নওশির জীবনের আরেক শুরু হচ্ছে।
আর এতদিন যাদের আপন বলে জেনেছে, কয়েক ঘন্টা পরই তাদের ছেড়ে সে হবে অন্য বাড়ির বউ। আপন করে নিতে হবে সেই মানুষগুলোকে।
এটাই নিয়ম।
.
এখন নওশি বিবাহিত। নিজের কাছেই কেমন যেন মনে হচ্ছে।
বসে আছে ঈশানের জন্য।
আসার সময় খুব কেঁদেছে। ঈশান চুপচাপ ছিল প্রথমদিকে।
পরে মুচকি হেসে বলেছে, “থাক আজ তোমার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কাজ নেই”
“আনতে গিয়েছিলেন কেন!” রাগ রাগ মুখ করে বলেছিল নওশি।
সে কাঁদছে আর ঈশান হাসছে।
উত্তর না দিয়ে মায়া মায়া কন্ঠে ঈশান বলেছিল,
“ইশ! কাজল লেপ্টে গিয়েছে, ছবি মনে হয় ভালো ওঠেনি”
হাসবে নাকি আরো কাঁদবে বুঝতে না পেরে নওশি গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল।
“গাড়ির গ্লাসে কাজল লেপ্টেছে কিনা বোঝা যাবে না”
“আমি কি দেখছি নাকি!” রাগ করে বলে নওশি। লোকটা তাকে রাগিয়েই যাচ্ছে।
“ভেবেছিলাম গাড়িতে আসতে আসতে বউয়ের সাথে কত গল্প করব! বউ আমাকে চিনতেই পারছে না, আল্লাহ আমি কই যাব!”
এবার কোনোরকমে হাসি চেপে মুচকি হেসে নওশি বলে
“কি বললেন?”
“বলছি না ভাবছি”
“কি?”
“গরু কিনতে যাব ঘাস কাটব তাই?”
হেসে ফেলে নওশি।
“মানে?”
“মানে তুমি সবসময়ই এমন হাসবে, কান্না তোমাকে মানায় না মায়াবতী। হাসবে সবসময়, ঠিক এমন হাসি!”
চমকে ঈশানের দিকে প্রথমবারের মতো একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল নওশি।
পরমুহূর্তে খেয়াল করল। ভিতরে সেই খারাপ লাগা ভাবটা থাকলেও এই মানুষটার পাশে থাকতে ভালোই লাগছে।
মায়ের কাছে শুনেছে বিয়ের পর নাকি মায়া জন্মায়, তাই হয়তো।
“মিস সরি মিসেস ঈশান… আসব?”
লজ্জা পেয়ে কোনো উত্তর দিলো না নওশি।
“মায়াবতী আমার ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই, অন্যরুমে আজ কেউ আমায় জায়গা দেবে না। তাই আপাতত আমার রুম সরি তোমার রুমে আসতে পারি?”
“স্বচ্ছন্দে…” কোনোমতে হাসি চাপল নওশি।
মানুষটা বড্ড বেশি হাসায়।
“যাক, অর্ধাঙ্গিনীর অনুমতি পেলাম”
আস্তে আস্তে নওশির পাশে এসে ঈশান বলল,
“তুমি কি জানো তোমার চোখের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না?”
মুখ নিচু করল নওশি।
ঈশানের খুব হাসি পেল। মেয়েটা লজ্জা পেয়েছে।
ঈশান চোখ ফেরাতে পারছে না। এত্ত মায়া মায়া চেহারা।
শ্যামলা বর্ণের নওশি, চোখ দুটো কখনো শান্ত কখনো চঞ্চল। নওশি হাসলে নওশির চোখও হাসে।
আজ এগুলো খুব ভাল করে খেয়াল করেছে ঈশান। আচ্ছা আগে তো কোনো মেয়েকে দেখে এমন অনুভূতি আসেনি!
তবে এটাই কি ভালবাসা? শিহরণ জাগে ঈশানের।
কিছুক্ষণ পর দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
“তুমি আগে চলে যাবে নাকি আমি?”
“চলে যাব মানে?” অবাক হলো নওশি।
“যাক কথা বলাতে পারলাম, চলে যাবে মানে ওয়াশরুমে যাবে চেঞ্জ হয়ে ফ্রেশ হতে”
নওশি হেসে ফেলল।
“আপনি যান”
“আপনি আমাকে তুমিতে কখন আনবেন?”
“বিবেচ্য বিষয়” মুখ টিপে হাসল নওশি।
“ইশ এবার দেখি কথা বের হচ্ছে”
লজ্জায় মাথা নিচু করল নওশি।
ঈশান উঠে ফ্রেশ হয়ে আসল।
তারপর নওশি।
মহান আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে আগামীদিনের জন্য ভাল কিছু প্রার্থনা করে নওশি আর ঈশান শুরু করে নতুন দিনের… আগামীর পথচলার… পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটা সম্পর্ক।
.
নওশি যাওয়ার সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল মায়াকে। নইলে অসুবিধা হতো। কিছুতেই আটকে রাখা যেত না।
ঈতিশা অবশ্য অনেকবার নিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু কেউই রাজি হয়নি।
প্রথমবার মায়া কে পাঠিয়ে ঝামেলা করার ইচ্ছে হয়নি কারোর।
নওশি চলে যাওয়ার পর বাড়ির পরিস্থিতি কেমন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সবাই প্রায় চলে গিয়েছে নওশি যাওয়ার পরপরই।
চুপচাপ সবাই।
রাতে কোনো রকম খেয়েই শুয়ে পড়েছে সবাই।
সায়ান কেবল সবার অগোচরে তার কানাডা যাওয়ার কাগজপত্র রেডি করছে। সাত দিন পরেই তার ফ্লাইট।
অফিসের কাজে একবছরের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে সায়ান।
রিদিমার স্মৃতি আর মায়ার কান্না মাখা মুখ তার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না।
আর কিছুতেই স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে পারছে না।
মায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না।
অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও সে রিদিমার থেকে অনেক দূরে যেতে চায়।
কাউকে জানাবে না সায়ান।
অফিসের এই ট্রেনিংয়ে তার না গেলেও হতো, কিন্তু সায়ান নিজের ঠিক করেছে নিজেই যাবে। শুধু যাওয়ার আগে কাউকে জানাবে না।
‘চিঠি লিখতে হবে কয়েকটা…’ নিজের মনেই বলল সায়ান।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here