#এখানে_আকাশটা_ভালবাসার
#লেখিকাঃ নয়নতারা নাতাশা
#পর্বঃ ২৮
.
সায়ান দেশের বাইরে গেছে প্রায় এক বছর হতে যাচ্ছে।
যেদিন বিকালে রিদিমা চিঠি পেয়েছিল সেদিন রাতেই সায়ান দেশ ছেড়েছিল।
পরিবারের সবাই অবাক হয়েছিল।
নওশি রীতিমতো রেগে গিয়েছিল।
“মা ভাইয়া এটা কি করে করতে পারল!!”
“আমি কিছুই বুঝছি না নাশু!”
“ভাবির ভাইয়াকে ভাল লাগেনি তাই গেছে, ভাইয়া বলছে ওর কষ্ট হচ্ছে তাই গেছে, ভাল খুব ভাল, মায়া কি তবে উড়ে এসেছে?
জন্ম দেওয়ার সময় মনে ছিল না কারোর?”
“কি যা তা বলছিস!” প্রতিবাদ করেন জাহরা।
“তুমি চুপ করো মা, ওরা কেন মায়ার কথা ভাবল না!
মায়ার খুব দরকার বাবা মাকে। ও বড় হচ্ছে, আর মেয়ে হিসেবে মায়া অনেক বুঝে, ওর তো বাবা মাকে একসাথে দেখতে ইচ্ছে করতেই পারে!
কি জবাব দেবে তোমার ছেলে? আমরা কি করে দাঁড়াবো মায়ার মুখের সামনে?
আমি কাল দুপুরেই জানতে পেরেছি ভাইয়া কোথাও যাচ্ছে।
আর কবে যাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে, কি করে আটকাবো এসব ভেবে দেখার সময় পর্যন্ত পেলাম না!”
একটানা কথা গুলো বলল নওশি।
রায়ান আর মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বলছিল নওশি।
“চুপ কর নাশু, এখন আর কোনো লাভ নেই কথা বলে” মৃদুস্বরে বলল রায়ান।
“তা তো লাভ নেই!”
রাগে গজগজ করতে লাগল নওশি।
কিছুই ভাল লাগছে না তার।
এই সময় সায়ান মায়াকে ছেড়ে এতদূরে চলে যাবে এটা নওশি ভাবতেও পারেনি।
“মায়া কোথায়?”
“স্কুলে” বলে ঘড়ি দেখেই আবার বলল
“৫ মিনিট পরেই ছুটি, ওকে নিয়ে আসি আমি” বলে চলে গেল রায়ান।
বাসার পাশেই আপাতত একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে যাওয়া আসা করছে মায়া।
বইবই করে পাগল করে দেয় আর নিজের মিসদের গল্প শোনাতে শোনাতে। সাড়ে চার বছর বয়স এখন।
বাবা চলে গেছে এটা এখনো জানেনা।
একটু বুঝে মা নেই, ডাকলেই মাকে পাওয়া যায়না।
বাবাকেও ডাকলে এই মূহুর্তে পাওয়া যাবেনা এটা মায়া বুঝেনি।
ছোট্ট মায়া, বিনা দোষে যে শাস্তি পাচ্ছিস বা পাবি তার জন্য ক্ষমা করিস এই সমাজটাকে।
এ তো ছিল এক বছর আগের কথা।
এখন মায়া স্কুলে যায়।
ভীষণ হাসিখুশি মেয়ে।
যেখানেই থাকে কথার ঝুরি নিয়ে বসে।
ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল মায়া।
এ যেন স্বর্গের পরি।
চিন্তাশক্তি বেশ সুন্দর মায়ার।
বাবার সাথে মাঝে মাঝেই কথা হয়।
মায়া জানে তার মা তার খোঁজ নেইনা।
কেউ তার মায়ের কথা বললেই চুপ করে থাকে। মাঝে মাঝে খুব মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে।
মায়া দেখেছে তাদের বান্ধবী অপ্সরা, সামিহার মারা কি সুন্দর করে ওদের কপালে চুমু খায়।
মাঝে মাঝে ওদের বাবারাও নিতে আসে।
তার শুধু ফুপি, চাচ্চু আর দাদু আসে।
কিন্তু মা ও আসে না বাবা ও আসেনা।
মাঝে মাঝে বাবা মাকে ডাকতে ইচ্ছে করে।
একদিন দাদিমাকে বলেছিল তখন দাদিমার চোখে পানি দেখেছিল মায়া।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল দাদিমার দিকে।
তারপর থেকে আর কিছু বলে না মায়া।
মায়া প্রায়ই নওশির কাছে যায়।
কেউ কাউকে ছাড়া বেশিদিন থাকতে পারে না।
আবার নওশি পুরোপুরি ভাবে মায়াকে রাখতে পারে না কারণ
সাহরাফ, জাহরা, রায়ান বা রোশনি কেউই মায়াকে ছাড়া থাকতে পারে না।
সবার আদরের ছোট্ট মায়া মনি, মায়া সায়ান, রাফসানা সায়ান মায়া।
যেটুকু আদর মায়া পাচ্ছে না তার বদলে কয়েকগুণ বেশি আদরের সে।
কিন্তু অপূর্নতার খালি জায়গা পূরণ এতটাও সহজ নয়।
তা হয়তো মায়া পরে বুঝেছিল।
.
“এই শোনো?”
ঈশানের হাত চেপে ধরল নওশি।
একটু অবাক চোখে তাকাল ঈশান।
“বলো…”
“তুমি আমাকে সময় দাও না কেন?”
“আরে কে বলল সময় দেই না? ইজি হও তো?”
শক্ত হয়ে বসল নওশি। অনেক দিন ধরেই এই উত্তর শুনছে সে।
ভেবেছিল ঈশান নিজেই ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু তা হয়নি। আজ কিছু কথা সে বলবেই,
“বসো আমার কিছু কথা আছে”
“কি বলো” নরম সুরে বলে ঈশান।
নওশির সাথে সাধারণত খারাপ ব্যবহার করে না।
তবে পাত্তা দেয় কম। সেটাই হয়তো নওশিকে বেশি পীড়া দিচ্ছে।
“দেখো ঈশান, আমরা স্বামী-স্ত্রী, আমার উপর তোমার যতটা অধিকার আছে তোমার উপর আমারো”
“হুম”
“তুমি আমাকে সময় দাও না সেটা নয়, কিন্তু সবটাই নিজের ইচ্ছে মতো।
তোমার ভাল লাগলে তুমি অফিসে বসে আমাকে মেসেজ করো, না লাগলে করো না।
ইচ্ছে হলে আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাও নইলে না, ইচ্ছে হলে আমার সাথে সময় কাটাও নইলে না। এইগুলো আমি চেয়ে কখনো পাইনি।
কিন্তু বলো তা কেন হবে?”
“কিন্তু আমি তোমাকে সময় দেই না তা তো ঠিক না”
“মানছি, এই জন্যই তো বললাম তোমার ইচ্ছের উপর, মানুষ হিসেবে আমারো কিছু ইচ্ছে আছে,
এমন তো হতে পারে তোমার এখন যেটা ভাল লাগছে সেটা আমার তখন আমার ভাল লাগছে না। আমি যেমন মানিয়ে নিই তোমারও কি উচিত না?”
চুপ রইল ঈশান। নওশি ভুল কিছুই বলছে না
“দেখো, তোমার সাথে ঝামেলা করার কোনো প্রয়োজন নেই আমার, আমরা খুব হ্যাপি কাপল, আমি নিজেও তোমার কাছে খুশি, কিন্তু এইগুলো যদি তুমি একটু বুঝো, আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজেই বুঝবে”
“হুম”
“দেখো আমি চুপ করে থাকি তার মানে কিন্তু এই না যে আমি অবহেলার উত্তর জানিনা। জানি… কিন্তু আমি চাই তোমার ভুল গুলো তুমি বুঝো জানো”
চুপচাপ নওশির কথাগুলো শুনে গেল ঈশান।
কিছুই বলল না।
নওশি হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“এবার যাও”
ঈশান চলে গেল বেশ নির্লিপ্ত ভাবে।
নওশির বিশ্বাস ঈশান বুঝবে।
.
আজ ঈশান সারাদিন শুধু নওশির কথাই ভেবেছে।
আসলেই নওশি ঠিক বলেছে।
একটা চাপা অহমিকা বোধ ছিল, সেটা ধরতে পেরেছে সে।
ঈশান ভেবেছিল বেশি পাত্তা দিলে নওশি মাথায় উঠবে।
তাই নিজের ইচ্ছে গুলোই চাপিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু নওশিকে কখনো তার পরিবারের উপর খারাপ আচরণ করতে দেখেনি।
তার মা মারিয়াকে দেখলে কখনো মনেই হয়নি নওশির তার বউমা।
চিরাচরিত বউ শাশুড়ির ঝামেলার সাথে পরিচিত হতে হয়নি ঈশানকে।
ঈতিশা আর নওশিকে দেখেও মনে হয়নি তারা ননদ ভাবি।
ঈশান ঈতিশার কাছে শুনেছে কখনো যদি তার মায়ের সাথে নওশির অমিল হয় বা কোনো ঝামেলা হয় নওশি আগেই ক্ষমা, যদি ভুলটা মায়ের থাকে তবুও।
প্রত্যেকের ভাবনা গুলো একটু দেখা যাক নওশিকে নিয়ে,
ঈশানের মা মারিয়া বুঝেছেন খুঁজে খুঁজে একটা হীরে এনেছেন তারা।
নওশি ভুল করেনা এমন নয়।
কিন্তু নওশির মুখে বড় কথা শোনা যায়নি।
ঈশানের সাথে ঝামেলা হয় কিনা এ নিয়ে একবার প্রশ্ন করেছিলেন নওশিকে।
নওশি হেসেছিল।
“হবে না কেন আম্মু! আপনাদের হত না?”
“হুম হতো তো, আমি তো বুঝতে পারিনা তাই বললাম”
শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল নওশি।
মারিয়া ভেবেছিলেন বউমা কিছু লুকাচ্ছে, উত্তরটা পছন্দ হয়নি তার। পরে ছেলের কাছে প্রশ্ন করে যে উত্তর পেয়েছিলেন তাতে তার আধুনিক বউ সম্পর্কে ধারণা পালটে গিয়েছিল।
ঈশান বলেছিল, “হুম হয়, তবে ও নিজেদের ঝগড়া ঘরের বাইরে টেনে আনতে পছন্দ করে না, তাই ব্যাপারটা আমাদের মাঝেই থাকে, আর ঠিকও হয়ে যায়”
এভাবেই ভালো খারাপ মিলিয়েই নওশির উপর অনেক খুশি মারিয়া।
ঈতিশাও খুশি। মাঝে মাঝে ভাবির গুণ গুলো দেখে তার হিংসেই হয়।
“ভাবি তুমি এত গুণবতী কেন!”
প্রশ্নটা প্রায়ই করে নওশিকে।
উত্তরে প্রতিবার নওশি চোখ বড় বড় করে বলে, “তাই নাকি?”
তারপর হেসে বলে, “তুমিও গুণবতী মিস ঈতিশা”
ইরফান সাহেব বা ঈশানির কাছেও নওশি পছন্দের পাত্রী।
নওশি এই পরিবারটাকে আপন করে নিয়েছে নিজের সাধ্যমতো।
মাঝে মাঝে কিছু কিছু বিষয় খারাপ লাগে না সেটা নয়, কিন্তু সেটা নওশি মেনে নেয়।
নিজেও ভুল করে বসে সেটাও তাদের কাছে মত হয়ে অনুতপ্ত হয়।
এভাবেই চলে যাচ্ছে নওশির সংসার।
.
নিশিকার ছেলে হয়েছে,
নাহিয়ান জারিফ।
দুই মাস বয়স।
নিশিকার মতোই দেখতে।
জয় যেদিন প্রথম দেখল তাদের সন্তানকে, সে বিশ্বাস করতে পারছিল না সে বাবা হয়েছে।
আনন্দের দুইচোখে পানি পড়েছে তার।
নিশিকার এত উজ্জ্বল হাসি আগে কখনো দেখেছে কিনা মনে করতে পারেনি জয়।
দুইজনেরই এখন সময় কাটে নাহিয়ানকে
নিয়ে।
আর এক মাস পর জয় চলে যাবে ৩ মাসের জন্য।
তারপর আবার আসবে তিন মাস থেকে নিশিকা আর নাহিয়ানকে নিয়ে চলে যাবে, এমনটাই পরিকল্পনা ওদের।
আগে থেকেই সব কিছু ঠিক করে রেখেছে জয়।
এখন নিশিকার পাশে জয়ের পাশাপাশি সবাইকে প্রয়োজন।
তাই এই ব্যবস্থা, যদিও ছেলে আর বউকে ছেড়ে যেতে জয়ের কি হবে সেটা বলা বাহুল্য।
.
রিদিমা, সফল ব্যবসায়ীদের মাঝে একজন।
“সাহরাফ-জাহরা” কোম্পানিকে টেক্কা দিতে না পারলেও প্রায়ই পাশাপাশি অবস্থান রিদিমার।
প্রশ্ন হলো সেদিনের চিঠি পেয়ে কি রিদিমা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল?
না, রিদিমা আপন গতিতে নিজের ব্যবসা সামলেছে।
যাকে প্রয়োজন ভেবেছে মিশেছে তার সাথেই, কিন্তু এবার সাবধান ছিল।
কারোর মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেনি।
দিন শেষে নিজের ছেলেমেয়ে দুটোর কথা মনে হলেও পাত্তা দেয়নি।
কিছুদিন আগে বিয়ে করে আরেক লোককে যিনি এক বাচ্চার বাবা।
লোকটা একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মালিক। আতিক ইসলাম।
রিদিমা যে কি করে এই টাকাওয়ালা মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে তা রিদিমাই জানে!
লোকটার স্ত্রী মারা গেছে,
রিদিমাকে মোটামুটি ভাল মনে হওয়াতে বিয়ে করেছিল।
কারণ আগের মতো ঔদ্ধত্য আচরণ অনেকটাই কমে গেছে রিদিমার।
লোকটার ছেলের বয়স বারো।
আসিফ,
ভীষণ জেদি আর একরোখা।
ছেলেটা পাত্তা দেয় না রিদিমাকে।
রিদিমা অনেকবার চেষ্টা করে মায়া আর অনিককে তার মাঝে খোঁজার জন্য।
কিন্তু লাভ হয়নি।
একদিন রিদিমা আদর দিয়ে বলতে গিয়েছিল,
“বাবা আমি তোমার মা তুমি এমন করে কেন কথা বলো! আমাকে মা বলো?”
উত্তরে ছেলেটা বলেছিল,
“ইয়্যু আর নট মাই মাদার, ইয়্যু আর মাই স্টেপ মাদার, ডোন্ট ফরগেট দিস!”
অবাক হয়ে গিয়েছিল সেদিন রিদিমা।
তাই আর কথা বাড়ায়নি ছেলেটার সাথে।
সারাদিন অফিস করে,
তার হাসব্যান্ডেও অফিস করে আর তারপর রাতে ঘুম।
একই রকম দিন।
আসিফের ব্যাপারে রিদিমা আতিক কে বলতে গেলে আতিক বাঁধা দিয়ে বলে,
“ওকে বিরক্ত করো না, থাকুক ওর মতো”
“আমি ওর মা হতে চাওয়াটা আমার বিরক্ত করা! ওর আচরণ যে ভাল নয়!”
“লেখাপড়াতে তো ভালো, সবই ভালো, সবার সাথেই ভাল ব্যবহার করে,
ভেবেছিলাম তোমাকে ভালভাবে নেবে, কিন্তু নিচ্ছে না,
ধৈর্য্য ধর।”
উত্তর শুনে রাগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে যায় রিদিমার।
কিন্তু কিছু বলে না নিজেকে শান্ত করে।
আজকাল কথা বাড়াতে বড় ক্লান্তি লাগে রিদিমার।
.
আজ নওশির শ্বশুরশাশুড়ি আর ঈতিশা গিয়েছে ঈশানিদের বাসায়।
কাল যাবে নওশি আর ঈশান।
নওশি বসে আছে বারান্দায়, কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে দেখে ঈশান।
এত তাড়াতাড়ি আসে না ঈশান।
একটু দেরি হয়।
বিকেলে ভার্সিটি থেকে ফিরে হাত ধরে টানতে টানতে নওশিকে রুমে নিয়ে যায় ঈশান।
“কি হলো?”
“চোখ বন্ধ করো”
“কেন?”
“করো না প্লিজ!………”
“ওকে”
নওশিকে রেখে আবার দরজার কাছে যায় ঈশান।
নওশি বুঝতে পারছে না কি হল ঈশানের। এমনটা তো কখনো করেনি ঈশান।
“আই অ্যাম সরি মায়াবতী”
চোখ খুলে অবাক হয়ে যায় নওশি।
ঈশান একগাদা ফুল আর চকলেট নিয়ে তার সামনে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।
খুব খুশি হলো নওশি।
এমনটাই ভাবতো সে। দেরি হলেও বুঝেছে ঈশান।
এটাই অনেক।
ভালবাসা সবসময়ই ভালবাসা।
প্রকাশ পাল্টাতে পারে কিন্তু সেটা ভালবাসাই।
ভীষণ খুশি হয়ে ফুল গুলো নিয়ে বলে,
“অনেক অনেক থ্যাংকস ঈশান, ভালবাসি”
“ভালবাসি আমিও”
ঈশান উঠে দাঁড়ায়।
ঈশান খুব খুশি নওশি এত সহজে সবকিছু ভুলে যাবে এটা বুঝতে পারেনি সে।
ভেবেছিল আরো কাঠখড় পোড়াতে হবে।
বিকালটা গল্প করে কাটিয়ে দেয় নওশির সাথে।
অনেকদিন পরে ঈশানেরও খুব ভালো লাগছে।
নওশির হাসি দেখে মনে হচ্ছে অনেক বেশি খুশি সে।
সন্ধ্যায় নামায পড়ে এসে কলিংবেল দিতে গিয়ে ঈশান দেখে তাদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা।
কিছুটা অবাক হয়ে ভিতরে গিয়ে নওশিকে ডাক দেয়।
কিন্তু নওশি ডাক শুনে না।
আস্তে আস্তে ঈশান নিজের ঘরের দিকে যায়।
দেখে সেখানে কয়েকটা মোমবাতি জ্বলতে।
আর তার মাঝখানে পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেওয়া একটা চিঠি,
কাছে গিয়ে চিঠিটা তুলে নেয় ঈশান।
“আচ্ছা আমাদের যে অতিথিটা পৃথিবীতে আসছে সে কি ছেলে হবে নাকি মেয়ে? তোমার কি মনে হয়?”
বিস্ময়ে আনন্দে নির্বাক হয়ে যায় ঈশান।
মেয়েটাকে সারপ্রাইজ গার্ল বলে ডাকে ঈশান।
সারপ্রাইজ দিতে ওস্তাদ।
হঠাৎ তার মনে হল তার জন্মদিন তার মনে ছিল।
নওশি রাত এগারোটার পর থেকে অনেক ছলচাতুরি করে জাগিয়ে রেখেছিল তাকে।
সারাদিন ক্লান্ত থেকে সাধারণত সাড়ে দশটার পরই ঘুমিয়ে পড়ে ঈশান।
সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিল নওশি তাকে জাগিয়ে রেখেছিল, উইশ করেছিল।
অনেক ছোট ছোট ভালবাসার অনুভূতি উপহার দিয়েছিল।
এসব ভাবতে ভাবতে আবার হাতের চিঠির দিকে তাকিয়ে ডাকতে থাকে,
“মায়াবতী…!”
হাসতে হাসতে বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসে নওশি।
শাড়ি পরে হালকা সেজেছে নওশি।
ঈশানের কাছে অপরূপ লাগছে এই মূহুর্তে তাকে।
“সত্যিই আমি কি বাবা হবো?”
নওশির হাত চেপে ধরে ঈশান।
“আমি মা হবো” দুষ্টু হাসে নওশি।
“নওশি আমি সরি অনেক ভুল করে ফেলেছি তোমার উপর। নওশি তুমি জানোনা আমি কতটা খুশি! আই লাভ ইউ মায়াবতী”
একটানা কথা গুলো বলতে থাকে ঈশান।
মুচকি হাসে নওশি।
এই মূহুর্তে নওশির মনে হচ্ছে জীবনটা অনেক বেশি সুন্দর।
জীবনের এর থেকে বেশি আর কি দরকার হয়।
.
সায়ান আজ পুরোপুরি এক বছর পর দেশে ফিরছে।
সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা নিয়ে আছে মায়া।
বাবা আসবে বাবা আসবে বলে সারা বাড়ি মাথায় করে তুলেছে।
সায়ান সেদিন বাড়ি থেকে যাওয়ার কয়েকমাস পরেই নিজের ভুল বুঝেছিল।
সেটা নওশি বুঝিয়ে দিয়েছিল।
মায়াকে তার দরকার এটা আগে এতটা বুঝেনি সায়ান।
বুঝেছে কয়েকমাস পরে।
তখন ফিরে আসতে চাইলে নওশি বলেছিল,
“গিয়েছই যখন বাকি তিন/চার মাস নিজের কাজটা মিটিয়ে এসো। আর নিজেকে পরিবর্তন করে এসো, আমি আমার আগের ভাইকে চাই”
নওশির কথাতে কি ছিল সায়ান জানেনা।
কিন্তু নিজেকে একেবারে পরিবর্তন করে ফেলেছে সে।
মায়া ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না সে।
মায়াকে ছবিতে আর ভিডিও কলে দেখে অবাক হয়ে যায় সায়ান মাঝে মাঝে।
কি সুন্দর তার মেয়েটা।
এই মেয়েকে ফেলে সে এসেছে!
নিজেকেই ধিক্কার দেয় সায়ান।
আজ ফিরবে বলে খুব খুশি লাগছে তার।
মেয়ের জন্য অনেক খেলনা, বই আর চকলেট নিয়েছে। সবার জন্যই অনেক গিফট নিয়েছে সে। নিশিকার ছেলেকে দেখবে, সবাইকে দেখবে।
কতদিন পর মেয়েটাকে দেখবে।
সব ভাবনা এখন মায়াকে নিয়ে।
এয়ারপোর্টে নামার পর সব ফর্মালিটিজের পর বাইরে আসতেই মায়া দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বাবাকে।
সায়ান কোলে নেয়।
আর অবাক হয়ে দেখতে থাকে তার মেয়ে কে।
চোখের কোণে চিকচিক করে উঠে।
এ অশ্রু হয়তো মা হারা মেয়েকে দেখে,
এ অশ্রু হয়তো মেয়েকে পরিপূর্ণতা না দিতে পারার জন্য
এ অশ্রু হয়তো মেয়ের প্রতি অন্যায় করার জন্য।
“বাবা, কাঁদছ কেন?”
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করে মায়া।
“না তো মা মনি” চোখের পানি মুছে ফেলে সায়ান।
আস্তে আস্তে সবাই এগিয়ে আসে সায়ানের দিকে।
এতদিনের যে চাপা একটা কষ্ট আর এই মূহুর্তে ফিরে পাওয়ার আনন্দ সবার চোখেমুখে ছড়িয়ে আছে তা না দেখলে হয়তো বোঝা যাবে না…!
.
(চলবে)