#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#পর্বঃ৩
#Ipshita_Shikdar
৮।
“শোনো মেয়ে, তুমি আমাকে খারাপ ভাবতে পারো। তবে কথাটা তোমার ভালোর জন্যই বলছি, আম্মা আজ বাড়ি ফিরবে একটু সাজগোজ করে গুছিয়ে থেকো। আম্মা কেমন মানুষ তোমার অজানা নয়।”
শক্ত গলায় কথাগুলো বলেই আমিনা ঘর ত্যাগ করে। পক্ষীর বুক অজানা ভয়ে কেঁপে উঠেছে বড় জায়ের কথা শুনে। মনে পড়ে যায় তিনেক বছর আগে পাশের বাড়ির নিমৃত কাকির মেয়ের বিয়ের কথা। বিছানার চাদর হাত খামচে ধরে সেদিনের স্মৃতির ঘোরে চলে যায়।
অতিত,
পক্ষীর অনেক ইচ্ছে আসিয়ার বিয়েতে শাড়ি পড়ার, কিন্তু নিজের তো নেই। তাই বেশ খুশিমনেই মায়ের কাছে যেয়ে আবদার করার ন্যায়ই বলে উঠে,
“মা, তোমার ঐ লাল শাড়িটা আমায় দিবে? আমারও খুব ইচ্ছে করছে আজ নীতির মতো শাড়ি পড়ার।”
তার মা আর বোন এই কথাটা শুনে এমন প্রতিক্রিয়া দেখালো যেন খুব বড় পাপ করে ফেলেছে কথাটা শুনে। নায়লা দেওয়ান রাগী গলায় বললেন,
“তুই আমাকে শান্তি দিবি না বলে ভেবে রেখেছিস নাকি? তোর এই চার ফুট আটের শরীরে কেমন বিদঘুটে লাগবে জানিস না! দেখ, একটা সেলওয়ার-কামিজ পড় ভালো দেখাবে লম্বা লম্বা লাগবে। তবে ঢোলা পায়জামা পড়িস না, আরও খাটো লাগবে নাহলে।”
তার বোন নীতিও বলে উঠলো,
“জানিস ফেসবুকে একটা মিম দেখলাম। লিখা ছিল, খাটো মেয়েদের লাল শাড়ি পড়লে ঠিক গ্যাস সিলিন্ডার লাগে।”
কথাটা বলতেই তার মা-বোন একসাথে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো। হয়তো একটু খেয়াল করকেই দেখিতে পারতো সামনে বসে থাকা ফ্যাঁকাসে মুখশ্রীতে বসে থাকা মেয়েটির চোখজোড়ায় লজ্জা, অপমানে পানি এসে পড়েছে।
যুবতীর প্রাণোচ্ছল মনটা মুহূর্তেই বিষিয়ে গেল। চুপচাপ উঠে চলে গেল সেখান থেকে। এসব কিছুই ব্যথিত চোখে দেখলেন আসলাম দেওয়ান। কিছু না ভেবেই বাড়ির সদরদরজা পেরিয়ে বাহিরে চলে গেলেন।
“পক্ষী মা, কী করছিস? আসবো…?”
মেয়ের দরজায় টোকা দিয়ে মিষ্টি গলায় বললেন।
কিন্তু তার আদরে কন্যা তো তখন মায়ের কথা মোতাবেক বিষন্ন মুখশ্রীতে জানালার ধারে বসে কাঁদতে ব্যস্ত। তার আওয়াজ পেতেই তাড়াতাড়ি চোখমুখ ওড়নায় মুছে দরজা খুলে দেয়।
ম্লান হেসে বলে,
“কিছু করছি না তো বাবা। এই তৈরি হয়ে অপেক্ষ করছি বিয়েবাড়িতে যাওয়ার…”
“এ আবার কোনো পোশাক হল নাকি বিয়েতে যাওয়ার। যা, এই শাড়িটা পড়ে আয়। ”
বলেই মেয়ের হাতে শপিং ব্যাগ ধরিয়ে ঠেলে বাথরুমের দিকে পাঠিয়ে দেয়। শাড়ি পড়ে এসে দেখে বাবা তার ঘরে নেই, সেই ফাঁকে বারবার নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগে। ক্লাস ফাইভ-ফোরে থাকতে বেশ কয়েকবার কিছু নাটকে শাড়ি পড়ায় তার খুব একটা অসুবিধে হয়নি কুচি করার মুহূর্ত ছাড়া।
সিঁদুরিয়া রঙা স্বল্প সূক্ষ্ম কাতান, নিজেকে রাণীর ন্যায় লাগছে এই শাড়ি পড়ে। দু’হাত ভর্তি লাল চুড়ি, চোখজোড়ায় বেশ যত্ন করে কাজ, ঠোঁটে অল্প একটু গোলাপি রঙ চড়িয়ে নিল। চুলগুলো কাঠি থেকে ছাড়িয়ে বাধাহীন করে দিল। সাজগোজ শেষ করে নিজেকে বারবার আয়নায় দেখতে লাগলো।
‘পুরুষদের ভাবনা বাঙালি রমণীরা লোকসভার দৃষ্টি আকর্ষণে কিংবা অন্যান্য নারীদের ঈর্ষা অনুভব করাতে রূপের বাহার সাজায়। তারা তো জানেই না অধিকাংশ রমণীই নিজের রূপ আয়নায় দেখিয়ে নিজেকেই মুগ্ধ করতে ব্যস্ত হওয়ার জন্যই এত খাটুনি দেয়। ‘
এসব কিছুর মাঝেই নায়লা দেওয়ান চেঁচিয়ে ডাকলেন পক্ষীকে ঐ বাড়ি যাওয়ার জন্য। পক্ষীও সবসময়কার ন্যায় শাড়ির কুচি ধরে ছুটে গেল।
পক্ষীর দিকে তাকাতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার মা ও বোনে। নায়লা দেওয়ান তেঁতে উঠে বললেন,
“তোকে না শাড়ি পড়তে না করলাম তারপরও তুই পড়লি! বেজাত মেয়ে কোথাকার! ”
“আমি বলেছি পড়তে, কোনো সমস্যা? তোমার মতো আধবুড়ি যখন পড়তে পারে, আমার মেয়ের পড়তে কোন সমস্যাই দেখছি না।”
ভরাট গলায় কথাগুলো বলে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন আসলাম দেওয়ান। এই কথা শুনে পক্ষীর মা মনে মনে বেশ রেগে গেলেও মুখে কিছু বললেন না। বরং হনহন করে বাড়ি থেকে বের হয়ে ভাড়া করা টেক্সিতে চেপে বসলেন। নীতিরও একই কাজ।
তারা যেতেই মধ্যবয়স্ক পুরুষটি খেয়াল করলেন একজোড়া চোখ তার পানে ছলছল চাহনিতে তাকিয়ে আছে। তিনি ইশারায় আত্মস্থ করে মেয়েকে গাড়িতে নিয়ে বসালেন।
অনুষ্ঠানে ঢুকতেই পরিচিত সবাই কথা বলতে এসে পড়েন দেওয়ান পরিবারের সাথে। কথোপকথনের একপর্যায়ে সবার খেয়াল করলো তাকে।
“বাহ! পক্ষী তোমায় তো দেখতে একদম অপ্সরী লাগছে। খালি হাইটটা আরেকটু লং হলেই শাড়িটা আরও ভালো লাগতো তোমার গায়ে। এক্সারসাইজ করতে পারো না?”
মহিলাটির হাসি হাসি মুখে বলা যত্নশীল ধরনের কথাটিও যেন তীর হয়ে বিধে পক্ষীর বুকে। মনে মনে ভাবে,
“আচ্ছা, তারা কি বোঝে তাদের এমন যত্ন কিংবা ভালোবাসা আমার সহ্য করার মতো নয়। বরং, বেশ কষ্টদায়ক! কেন করে এমনটা!”
আরেকজন বলে উঠেন,
“ঠিকই বলেছেন আপা। পরে তো তোমাকে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে। একটু খাবারদাবার বাড়াও আর স্কিপিং করো। নাহলে ভালো বর পাবে না।”
এমন সব উক্তি তার নিত্যদিনের উক্তি, তবুও সে মানিয়ে নিতে পারে না। বরং, রবিন্দ্রনাথের তৈরি সুভা চরিত্রের মতো তারও মনে হয়,’ দুনিয়া আমাকে ভুলিলেই বাঁচি’।
ধীরেধীরে তাকে নিয়ে করা আলাপ-আলোচনার আসর শেষ হয়। সেও আপনমনে বিয়ে বাড়িতে চলাফেরা করে, কখনো বা দুয়েকটা ছবি তুলে নিজের।
___
“সিঁদুর লাল শাড়ি পড়া মেয়েটিকে দেখেছেন? সেটাই আসলাম ভাইয়ের মেয়ে। কি মিষ্টি মুখখানা!”
নিমৃত বানুর কথা শুনে ভেঙচি কাটে নয়ন্তিনী বেগম। রুক্ষভাবে বলেন,
“মিষ্টি মুখ হলে আর কি! উচ্চতা দেখেছিস? ৫ ফুট হবে কিনা সন্দেহ, তার উপর চাপা গায়ের রং, যাকে বলে শ্যামাঙ্গ। কে বিয়ে করবে এমন মেয়ে? আজকাল মেয়েলোক কালা হলেও লম্বা খুঁজে, জানিসনে মা খাটো হলে বাচ্চাও খাটো হয়।”
নিমৃত বানুর ননদ রণিকাও সায় জানিয়ে বললেন,
“তা তো বটেই। বুড়োবুড়ির কথাই তো আছে, খাটো মাইয়া সংসারে অশান্তি বয়ে আনে, স্বভাবগতই কুটনি হয়। এগুলো সব গর্ভের দোষ! মা-ই মনে হয় হওয়ার সময় তেমন যত্ন নেয়নি, তা নাহলে…”
আড়াল থেকে এসব শুনে নায়লা দেওয়ান রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজের মেয়ের কাছে যান। মেয়েটা তার গর্ভের কলঙ্ক বটে। যেয়ে দেখে পক্ষী নিজের এক বান্ধুবীর সাথে আড্ডা দিচ্ছে। কিছু না ভেবেই তাকে টেনে নিয়ে যায় কমিউনিটি সেন্টারের এক কোণায় যেখানে মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে।
শাসিয়ে বলেন,
“কী ভেবেছিস, এই শাড়িতে তোকে ঐশরিয়া লাগছে! না, পুরাই ডেরাম দেখা যাচ্ছে। তোর জন্য আজ আজমল ভাইয়ের বউ নয়ন্তিনী আর নিমৃতের ননদ কতগুলো কথা বলল। তোর লাজলজ্জা কী নেই! অন্যকেউ হলে তো এমন অবস্থায় নিজের ঘর থেকেও কখনো পা ফেলতো না। আর তুই…! বেলাজা মেয়েলোক একটা! কী বলেছে শুনবি? নে শোন! তোকে শুনানোর জন্যই রেকর্ডিং করে নিয়ে এসেছি, যদি তারপরও একটু লাজ হয়!”
কথাগুলো শেষ করেই তিনি ফোনে সেভ করা ভয়েসটা অন করে ফোন পক্ষীর হাতে ধরিয়ে দেয়। একবার রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে হনহন করে বের হয়ে যায় সেখান থেকে। সেদিন পুরো এক ঘণ্টার রাস্তা একাকি হেঁটে পাড়ি দিয়েছিল। ঐদিনের পর সে কোনোদিন কোনো প্রকার অনুষ্ঠানে যায়নি।
বর্তমানে
অতিতের কথাগুলো ভাবতেই সে আপনমনেই ভেবে উঠে,
“যেই মানুষটা আমাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। সে নিশ্চিত আমাকে ছেলের বউ রূপে দেখলে আস্ত রাখবে না।”
এর মাঝেই আরেকদফা আগমন হয় বড় জায়ের। তার হাতে বেশ সুন্দর একটি সফ্্ট সিল্কের শাড়ি, ক্রিম জমিনে ফুলের ডিজাইন করা। সে তো বেশ অবাক এটা নিয়ে ঘরে আসতে দেখে।
“এই শাড়ি পড়ে নিয়ো, আর চুলগুলো স্ট্রেইট করে, একটু স্মার্ট হয়ে থেকো। আর হ্যাঁ এটা করছি বলে আকাশকুসুম ভেবো না আবার। দেবরটা আমার বড়োই সুন্দর তাই নিজের জন্য পছন্দও করেছিল একদম মানানসই মেয়ে, কিন্তু আব্বা তোমার মতো মেয়ে গলায় ঝুলিয়ে দিল। বেচারা আমার ভাইটা নিজের পছন্দের মানুষটাকে পেলো না! শুধুমাত্র মেয়ে হিসেবে তোমায় সাহায্য করেছি, কারণ আম্মার কথা সাপের ফণা হতেও বিষাক্ত। ”
অন্যদিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলে শাড়িটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। পক্ষী অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে থাকে নারীটির দিকে। আপন মনেই বলে উঠে,
“মুখের বচন খারাপ হলেও নারীটি আসলে মনের থেকে খারাপ নয়, তবে আমাকে এখানে মেনে নিতে বেশ অপ্রস্তুত সে। ”
৯।
বাহির থেকে নারীর কণ্ঠে বেশ চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে, পক্ষীর মন কেন যেন কুডাকছে। তার মন বলছে, এই নারী কণ্ঠটি তার শাশুড়ির। শতশত কথাবার্তার মাঝে দুটি বাক্য শুনেই তার কলিজায় কামড় দিয়ে উঠে। তা হল,
“ঐ মেয়ের কোনো প্রকার যোগ্যতাই নেই আমার ছেলের পাশে দাঁড়ানোর। আজই ঐ মেয়েকে এই বাড়ি থেকে বের করব!”
“এই ঠিকানা হারালে কোথায় ঠাঁই হবে আমার? এই ভরা দুপুরে একা মেয়ে হয়ে কোথায় যাবো! আচ্ছা, আজ যদি এ বাড়ি থেকে বের হয়ে বেঁচেও যাই আমার সম্মানটা কি আদৌ ঠিক থাকবে?”
পক্ষীর এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর কী আছে! এই জীবনের কোনো নিশ্চয়তা আছে! যার হাতে তার জীবন নামক পুষ্প বাগান দায় তুলে দিয়েছিল, সে তো অন্য বাগানের মালি হয়ে বসে আছে।
চলবে…