মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি পর্ব ৪

#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#Ipshita_Shikdar
#পর্বঃ৪
১০।
বসার ঘরে বাড়ির নব বিবাহিতার মতো মাথায় ঘোমটা দিয়ে সোফায় বসে আছে পক্ষী। তার ঠিক সামনের সোফাগুলোতে বসে আছে একঝাঁক মদ্যবয়স্ক নারী, তারা পক্ষী নামক পণ্যটির গুণগত মান বিশ্লেষণে ব্যস্ত। কিন্তু সেসবে ধ্যান নেই যুবতীর, সে তো মনে মনে লক্ষাধিক বার শুকরিয়া আদায় করছে আল্লাহর নিকট।

আনমনেই বিড়বিড় করে একদফা বলে উঠে,

“ভাগ্যিস, আমির ভাই এসে পড়েছিল নাহলে আমি কোথায় যেয়ে উঠতাম!”

কিছুক্ষণ আগে,

নয়ন্তিনী বেগমের আদেশে এক যুবতী মেয়ে ডাকতে আসে পক্ষীকে। কথাবার্তার ভাবেই বুঝে মেয়েটা জামান পরিবারে গৃহকাজে কর্মরত এক নারী।

পক্ষী ছোটছোট পদচারণায় ড্রইংরুমে উপস্থিত হয়। চোখ উঠিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে মধ্যবয়স্ক এক নারী অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার পানে। বেশ কয়েক বছর পর দেখলেও এই দৃষ্টি দেখে বেশ চিনতে পেরেছে সে।

নয়ন্তিনী বেগম রাগী গলায় বলতে শুরু করেন,

“এই মেয়ে, তুমি কোন সাহসে আমার ছেলেকে বিয়ে করেছে! তোমার কী যোগ্যতা আছে আমার ছেলের পাশে দাঁড়ানোর! এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে বের হবে তুমি।”

বলেই তার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির সদরদরজায় নিয়ে আসে। পক্ষীর এক স্বভাব সে খুব বেশি ভয় পেয়ে গেলে কিংবা নার্ভাস হয়ে গেলে কিছু ভাবতে ও করতে পারে না, শুধু নিরব দর্শকের মতো সবটা দেখে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি মোটেও। সে স্তব্ধ হয়ে সবটা দেখছে। যেই মুহূর্তে তাকে বাড়ির বাহিরে ধাক্কা দিবে তখনই পুরুষালি কণ্ঠে কেউ বলে উঠে,

“এখানে হচ্ছেটা কী?”

সবাই ভ্রুজোড়া কুঁচকে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল লোকটি আর কেউ নয় আজমল জামানের বড় পুত্র আমির জামান। তাকে দেখে কিছুটা হচকচিয়ে যায় নয়ন্তিনী বেগম; কারণ বড় ছেলে মোটেও তার আদর্শে বড় হয়নি, বরং রূপে-গুণে-কাজে বাবার মতোই সে।

তিনি আমতা আমতা করে বলেন,

“এই মেয়েকে তার বাপের বাড়ি পাঠাচ্ছি। আমার ছেলের ঘরে থাকার কোনো ভাবেই যোগ্য না সে।”

শক্ত গলায় আমির বলে উঠে,

“ও কোথাও যাবে না। বাবা যেহেতু এনেছে, কিছু একটা ভেবেই বিয়ে করিয়েছে। তাছাড়া তোমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি নেই নাকি! এই ভরা দুপুরে তুমি ওকে কী ভেবে বের করছো, ওর বাড়ি কি এখানে! আমিনা, তুমি পক্ষীকে ঘরে নিয়ে যাও।”

আমিনা স্বামীর কথামতো পক্ষীকে আরিজের ঘরে নিয়ে যায়। নয়ন্তিনী বেগম কিছু একটা বলতে নিবে তখনই একঝাঁক মধ্যবয়স্ক নারী দরজায় আসে। তারা হাসিমুখেই বলে,

“শুনলাম, ছোট ছেলেকে নাকি বিয়ে করিয়েছেন… আমাদের তো আর খবর দিলেন না, তাই আমরাই এসে পড়লাম বউ দেখতে।”

মেহমানদের আগমনে নয়ন্তিনী বেগম সৌজন্যতা রক্ষার্থে আর কিছুই করতে বলতে বা করতে পারে না। বরং, দাঁতে দাঁত চেপে একজন কাজের লোককে বলে উঠেন,

“যাও, আমিনাকে বলো পক্ষীকে তৈরি করে এখানে আনতে। কারণ মেহমান নতুন বউ দেখতে এসেছে।”

বর্তমানে,

পক্ষীর দিকে ভস্মীকরণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার শাশুরি, কিন্তু যুবতী তো নত মাথায় নিজ ধ্যানেই ব্যস্ত। তার ভাবনার ঘোর ভাঙে একজনে তিক্ত বাণী শুনে।

“বউ তো ভালোই, তবে আমাদের আরিজের সাথে কিন্তু একদম মানায় না।”

“হুম, তা ঠিক বলেছেন ভাবি। নয়ন্তিনী ভাবি, আরিজের জন্য তো আমার মেয়ের কথা বলেছিলাম কিন্তু আপনি হাইটটা ৫ ফুট দেখে… এখন তো দেখি আপনার পুত্রবধূ ৫ ফুটও হবে কিনা সন্দেহ।”

বলেই নারীটি সহ অন্যান্য প্রতিবেশি নারীরা হাসতে লাগলো। এত বিদ্রূপাত্মক কথাবার্তা শুনে পক্ষীর চোখজোড়া টলমল করে উঠে, কিন্তু ঠোঁট কামড়ে অশ্রু আটকানোর প্রচেষ্টায় ব্যস্ত সে।

বিড়বিড় করে বলে উঠে,

“আল্লাহ, ধৈর্য্য দাও।”

অস্পষ্টভাবে কথাটা শুনতে পেয়ে পাশে বসা একজন বৃদ্ধা জিজ্ঞেসু গলায় বলেন,

“কী বলো ছোটো বউ, বুঝতে পারিনি।”

বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বলে সে কিছুই বলিনি। বৃদ্ধা কিছু একটা বুঝতে পারতেই গম্ভীর গলায় বলেন,

“জাকিয়া, তোমার মেয়ের মূল সমস্যা তার উচ্চতা না বুঝলে। তার চরিত্রের আবার ঠিক নেই। এই তো শুনলাম কোন ছেলের সাথে নাকি চারদিন কক্সবাজার কাটিয়ে এসেছে। তাই তার সাথে তো আমার নাতবৌয়ের তুলনা তো দিয়োই না। ”

পক্ষী বুঝতে পারে যে এই বৃদ্ধাটি আর কেউ না, তার দাদী শাশুরি। তিনি আবার বলে উঠেন,

“অনেক দেখাদেখি হয়েছে, এবার বউ ঘরে যাও।”

পক্ষী বেশ স্বস্তি পেল কথাটি শুনে। ছোটছোট পায়ে আরিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলো।

১১।
সেই সকালে লেকের ধারে প্রিয়ার মাথাটা বুকে ঠেঁকিয়ে বসেছিল আরিজ, আর এখন মধ্য দুপুর। যুবতী চোখজোড়া হতে বয়ে যাওয়া অশ্রুতে সিক্ত হয়ে আছে টিশার্ট, তবুও সেই ভেজা স্থান থেকে মাথা উঠানোর আগ্রহ নেই।

আরিজ মৃদু গলায় বলে উঠে,

“দুপুর হয়ে গিয়েছে, প্রিয় পাখি। এখন উঠো, এত কান্না করলে মাথা ব্যথা করবে।”

উত্তরে প্রিয়া কঠোরভাবে বলল,

“আগে তো দিন থেকে রাত পর্যন্ত বুকে মাথা রাখলেও কিছু বলতে না, আজ হঠাৎ… একরাতেই এতোটাই পক্ষীর হয়ে গেলে।”

কথাটা শেষ করতেই ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপমাখা হাসি ফুটে উঠলো। প্রশ্নটাতে আরিজও হতভম্ভ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো,

“সত্যিই তো, আগে তো প্রিয়াকে বুকে নিলে কখনো কোনো জড়তা কাজ করেনি। আজ তাহলে এত অস্বস্তিবোধ হচ্ছে কেন?”

পরক্ষণেই ভাবলো,

“না, না, এসব আমার দুর্ভাবনা মাত্র। প্রিয় তো আমার রাজ্যের একমাত্র রাণী।”

“কী হলো? কী এত ভাবছো? ভাবনার বিষয়টা কী পক্ষী নাকি? অবশ্য হবেই না কেন! আমিই না হলাম তোমার আকাশের ভাসমান মেঘ, কাল ছিলাম আজ নেই। হয়তো আগামীকাল চিরতরেই নেই হয়ে যাবো।”

তার আবেগি কথার মাঝেই আরিজ ধমকে উঠে বলল,

” এই মেয়ে কী বলছোটা কী! যতসব অদ্ভুত ভাবনা! কষ্ট তো তুমি একা পাওনি আমিও পেয়েছি। শোনো, পক্ষীর সাথে আমার কিছুই হওয়ার নয়। সে এক দুঃস্বপ্ন বৈকি আর কিছুই না, যা খুব দ্রুতোই শেষ হতে চলেছে। ”

ভ্রুজোড়া কুঁচকে প্রিয়া জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আরিজ মৃদু হেসে বলে,

“চাকরি তো আর নেই এখন, পুরোপুরি বাবার উপর নির্ভর করছি এখন। আবার ডিভোর্সও এত তাড়াতাড়ি ফাইল করা যাবে না। নতুন একটা বিজনেস শুরু করেছি, মোটামোটি একটু সেটেল আর সঠিক সময় এসে পড়লেই পক্ষীকে মুক্ত করে দিব।”

চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে রূপসী নারীটির। গলা জড়িয়ে বলে,

“সত্যি! আমার আরিজ, শুধুই আমার।”

সেই সাথে মনে মনে বলে,

“আমাকে ক্ষমা করবি পক্ষী। কিন্তু এগুলো তো আমারই ছিল, তুই-ই হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসলি। তুই তো জানিস না, পাঁচ বছরের প্রেমের মায়াই কত আর দু’বছর পরিবারের সাথে যুদ্ধ করে তার জন্য অপেক্ষা করার কষ্টই বা কত! তোকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসি, তবে এতোটা বিসর্জনের যার জন্য দিলাম তাকে কারো হাতে তুলে দেওয়ার মতো দয়ালু আমি নইরে। কিন্তু আমার ওয়াদা, তালাকের পরে দূর থেকে তোকে আগলে রাখবো আমি। ”

১২।
পক্ষীর পেটের অসম্ভব যন্ত্রণায় চোখজোড়ায় অশ্রু জমে যাচ্ছে। একে তো কালরাতের না খাওয়া, তার উপর এখন শুরু হয়েছে নারী জীবনের অনিবার্য ঘটনা তথা মাসিক। যদিও কাঙ্ক্ষিত তারিখ আরও দিন তিনেক পরে ছিল, তবে বর্তমানে হওয়াটা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অস্বাভাবিক কিছু না।

পেট চেপে ধরে বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে সে, একবার এদিক হয়ে ঘুরছে তো আরেকবার ওদিক। তাতেও যেন শান্তি নেই, খুব তৃষ্ণা পাচ্ছে কিন্তু ঘরে থাকা বোতলে একফোঁটা পানি নেই। ঘরের বাহিরে যেতে বেশ অস্বস্তি লাগলেও আর সহ্য করতে না পেরে উঠে দাঁড়ায়।

এলোমেলো পায়ে দরজার সামনে আসতেই দেখা পায় আরিজের। কোনো এক ঘোরেই সে বিড়বিড় করে বলে উঠে,

“এই পাতালপুরীর রাক্ষসের সাথেও এখন দেখা হওয়ার ছিল!”

কিছুটা অস্পষ্ট হলেও কাছাকাছি থাকায় বেশ ভালোই শুনতে পায় আরিজ। যুবকের তো রাগে, নাক-কান উষ্ণ হয়ে আসছে। অপরদিকে পেটের যন্ত্রণায় পুনরায় বৃদ্ধ গাছের ন্যায় বেঁকিয়ে পড়ে সে।

কিন্তু যুবক এতসবে ধ্যান না দিয়েই শ্যামাঙ্গ নারীটির দু’কাঁধ খামচে ধরে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠে,

“কী বললা মেয়ে? আমি রাক্ষস! রাক্ষসী তো তুমি, আমার জীবনটাকে ধ্বংস করে ফেলেছো। শুধু মানুষের সুখ ভক্ষণকারী রাক্ষসী নয়, একটা লোভী মেয়েও বটে। নাহলে কেউ তার হবু স্বামীর মৃত্যুর দিন অন্যকাউকে বিয়ে করতে পারে! যতসব স্বার্থান্বেষী মেয়েলোক কোথাকার!”

একদিকে অসহ্যকর যন্ত্রণা, তার উপর এমন তিরস্কার। আজ কিছুটা নিজের বৈশিষ্ট্যবিহীন কাজই করে ফেলে সে, নিজের রাগের প্রকাশ করে সে। রাগী চোখে চেঁচিয়ে বলে,

“চুপ করুন! একদম চুপ!”

এভাবে চেঁচানোতে তার দেহের কষ্ট হলেও মনের কষ্টের চাইতে কমই। পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয় দরজা ধরে। বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,

“কী বললেন, আমি রাক্ষুসী! আপনার সুখ ভক্ষণ করেছি! আমার জন্য কিছুই হয়নি, বরং আপনার জন্য আমার জীবন নষ্ট। জানেন, কত বছর পর একটু সুখের মুখ দেখেছিলাম কিন্তু ছোঁয়ার আগেই হারিয়ে ফেলেছি। কার জন্য এসব? শুধুমাত্রই আপনার জন্য! আপনার প্রেমিকাকে আমি তো কিছুই করিনি। আপনি তো খুন করেছেন আমার…

আর বলতে পারলো না ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল। ফোঁপাতে ফোঁপাতেই পুনরায় বলতে লাগলো,

“আর আমি কী ইচ্ছে করে আপনার গলায় ঝুলিয়ে চলেছি! আপনি কী বুঝবেন প্রেমিকের মৃত্যুর দিন বাপ-মায়ের গালিগালাজ, অপমান, জীবন দেওয়ার কথা বলে জবরদস্তি করে বিয়ের পিঁঢ়িতে বসিয়ে দেওয়া নারীর কষ্ট! আর আমার যদি কোনো যাওয়ার জায়গা থাকতো না বিয়ের আগেই চলে যেতাম।”

পক্ষীর কথা শুনে আরিজ তো স্তব্ধ। কারণ এই নারীটির দিকটি তো সে কখনো ভেবেই দেখেনি। শূণ্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ক্রন্দনরত পক্ষীর দিকে তাকিয়ে ব্যালকনির দিকে চলে যায়।

মানবজাতির বোধহয় বৈশিষ্ট্যই এমন, তারা প্রতিটি অঘটনের জন্য কাউকে না কাউকে দোষী করতে চায়, আর কাউকে না পেলে ভাগ্যরেখাকে দোষী করে ফেলে।

পক্ষী ও আরিজের ক্ষেত্রেও বিপরীত কিছু ঘটেনি। তারা নিজেদের সাথে ঘটা সকল অঘটনের জন্য একে অপরকে দায়ী করে বসে আছে। অথচ, পরিস্থিতিটাই দায়ী ছিল কিনা…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here