#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#পর্বঃ৭
#Ipshita_Shikdar
প্রাইভেট কারের ড্রাইভিং সিটের পাশে বসেছে। খোলা জানালা হতে আগত শীতল বায়ুতে সিক্ত হচ্ছে শ্যামাঙ্গিনীর মুখশ্রী। তবে আরিজের সেসবে ধ্যান নেই। ক্যাম্পাসে পৌঁছে সা গাড়ি থামায় পক্ষী বেরিয়ে গেলে সেও বের হয়।
বিব্রতভাব ধরে নিচু গলায় বলে,
‘শুনো পক্ষী, কাউকে আমাদের বিয়ের কথা বোলো না। তুমি বুঝোই তো…”
তাকে শেষ করতে না দিয়েই পক্ষী মিষ্টি হেসে বলল,
“ডোন্ট ওয়ারি, আমি কাউকে বলবো না বিয়ের কথা। আপনি চিন্তামুক্ত হয়ে যেতে পারেন কোথায় যাবেন।”
“যেহেতু এসেছিই তাহলে তোমাকে ক্লাস পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।”
“হুম।”
কথা বলতে বলতেই আরিজ খেয়াল করলো একজন যুবক পুরুষ তার স্ত্রীকে একদৃষ্টিতে দেখছে। ব্যাপারটা তার ভালো লাগে না, তবুও নিঃশ্চুপ থাকে সে। এর মাঝেই পক্ষীর সমবয়সী চারজন ছেলেমেয়ে এসে একসাথেই চেঁচিয়ে বলে উঠে,
“পক্ষী!”
এই চারজন হলো আদিয়ান, সাইয়াম, রাইসা ও লতা। সবাই-ই হলো পক্ষীর কলেজ জীবন থেকে বন্ধু। বলা বাহুল্য, তারা পক্ষীর বিয়ের বিষয়টি জানে না।
বেশ কোলাহলময় পরিবেশ ক্যাম্পাসের, তা-ই এই চেঁচানোটাও খুব একটা আকর্ষণ করতে পারে না মানুষদের, সবাই সবার নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। ঢাকা শহরটাই এমন গোটা এক যান্ত্রিক সমাজের বিস্তার এখানে।
পক্ষী কানে হাত দিয়ে রাগান্বিত গলায় বলল,
“আস্তে! আস্তে! আমার কানের পোকা বের করে ফেলছিস তো। হুহ!”
আদিয়ান মেয়েদের মতো ভেঙচি কেটে বলে,
“ভাব দেখাইস না, এত সাল পর দেখে বন্ধুত্ব জেগে উঠেছিল। তুই তো শালার নিরামিষ। ”
“বাবু, আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে যেই কাজে এসেছিস সেই কাজে চল। মানে ক্লাস শুরু হবে এখন, সেখানে চল।”
রাইসা সন্দেহ প্রবণ গলায় প্রশ্ন করে,
“তা তো যাবোই। তার আগে বল এই ছেলেটা কে?”
পক্ষী ভেবেই পাচ্ছে না কী বলবে, আরিজও বেশ ইতস্তত বোধ করছে। আচমকাই পক্ষী বলে উঠে,
“কাজিন লাগে! কাজিন! দুঃসম্পর্কের কাজিন ভাই, বর্তমানে আমি তাদের বাড়িতেই থাকছি।”
তাদের কথোপকথনের মাঝেই একজন শেতাঙ্গ যুবক উপস্থিত হয় সেখানে, সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে। আরিজ দেখে এই যুবক আর কেউ নয় পক্ষীকে একদৃষ্টিতে দেখা যুবকটি। বেশ বিদঘুটে লাগলো বিষয়টা তার।
লোকটা বেশ স্পষ্ট ও শীতল কণ্ঠে বলল,
“কেমন আছো, পক্ষিণী?”
চলতে থাকলো তাদের কথোপকথন। কথাবার্তায় আরিজ বুঝতে পারলো ছেলেটি তথা আদনান পক্ষীর সিনিয়ার এবং তাদের সম্পর্কে সমীকরণও বেশ ভালো। আর দাঁড়ানোতে মন টানলো না তার, হনহন করে বেরিয়ে গেল। অকারণেই বেশ অভিমান হলো তার। মনে মনে ভাবলো,
“মেয়েটা একবার বিদায়ও দিল না!”
‘মানুষের হৃদয়টা এক অদ্ভুত সৃষ্টি উপরওয়ালার,
কখনো কারো বছরের প্রচেষ্টাতেও পোষ মানে না,
তো কারো পোষ কয়েক দিনেই মেনে ফেলে।’
২১।
“আসিয়ার আব্বু, বিয়ের তো দুইদিন হয়ে গেল জামাইরে দাওয়াত দিবা না?”
নায়লা দেওয়ানের কথায় বিদ্রূপাত্মক হাসি ফুটে উঠে আসলাম দেওয়ানের মুখশ্রীতে। হাতের খবরের কাগজটা ভাজ করে রেখে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“সেদিন না কত কিছু বললে মেয়েটাকে? আজ আবার দরদ উতলিয়ে পড়ছে! মাঝেমধ্যে সন্দেহই হয় পক্ষী তোমার পেটের মেয়েই তো…!”
মধ্যবয়স্ক নারীটি শক্ত গলায় বলে,
“আমি কখনো ওর খারাপ চাইনি।”
“তাই তো ভালো ব্যবহারও কোনোদিন করোনি।”
অত্যন্ত তাচ্ছিল্য মাখা গলায় কথাটা বলেই বসার ঘর থেকে চলে যান তিনি। নায়লা দেওয়ান গোপণে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
প্রথম সন্তান যে নারীর কাছে কতোটা বিশেষ তা শুধু নারীই জানে। মাতৃত্বের প্রথম পূর্ণতা দানকারীই হয় প্রথম সন্তান। তবে প্রতিটি সম্পর্কেই তিক্ততা আসতে পারে, আর অতিরিক্ত তিক্ততার ফলেই পরিবর্তন হয় সম্পর্কের সমীকরণ।
আসলাম দেওয়ান নিজের ঘরে ঢুকে যেতেই তার কনিষ্ঠ কন্যা আসিয়া এসে বলে,
“মা, ঐ মেয়েটাকে আবার বাসায় আনতে চাচ্ছো কেন? যেখানে গেছে সেখানেই ভালো, বাসা থেকে আপদ…”
আর বলতে পারলো না, বরং মায়ের আকস্মাৎ ধমকে কেঁপে উঠলো সে নিজেও। নায়লা দেওয়ান চোখ রাঙিয়ে মেয়েকে বললেন,
“তুমি দিনদিন কিন্তু বড় বেশি বলো আশু। আদবকায়দা কি ভুলে গেছো, বড় বোন সে তোমার!”
বলে তিনি থমথমে মুখে সোফায় বসে রইলেন।
২২।
বসু স্যারের ক্লাস একটু পর চলছে, সবাই পড়াশোনা কম চাপা হাসাহাসি ও ফিসফিসানি বেশি করছে। পঞ্চাশ উর্ধ্ব বয়সী লোকটার ব্যক্তিত্বে কিছু অদ্ভুত বিষয়ই এসবের কারণ। যেমনঃ তিনি শীতল পরিবেশেও বারবার গরম বোধ করবেন, শুকনো মুখে অকারণেই টিশ্যু চালিয়ে বেশ ঘামিয়ে গেছে এমন একটা ভাব ধরবেন। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
তিনি ঘামিয়ে গোসল হয়ে গিয়েছেন এমন ভঙ্গিমায় বললেন,
“এত গরম পড়েছে না কী বলবো! ভার্সিটিতে একটা এসি থাকলে বেশ হতো, এখানে ক্লাস নেওয়ার চাইতে আমার ছোট কারটায় বসাই বেশি আরামদায়ক। ”
ক্লাসে প্রতিবার প্রথম আসা ছেলেটি ফটাফট সায় জানিয়ে বলে উঠলো,
“একদম ঠিক বলেছেন স্যার।”
তার কথা শুনে সবাই মুখ টিপে হাসা বাদ দিয়ে একটু শব্দ করেই হেসে ফেললো, শুধু পক্ষী বাদে। কারণ তার কাছে বসু স্যার আরেকটি পিতৃছায়ার মতো, বড় বেশি স্নেহ করে তাকে।
“সাইলেন্স!”
বলে চেঁচিয়ে থামিয়ে পুনরায় ক্লাস নিতে শুরু করলেন শিক্ষক মহাদয়। ক্লাস শেষে পক্ষীকে তার সাথে দেখা করতে বলে গেলেন।
নিজের ক্লাস ও অন্যান্য কাজ শেষ করে পক্ষী বসু স্যারের সাথে দেখা করতে যায়। দরজায় নক করে বলে উঠে,
“শুভ দুপুর, স্যার। আপনি আমায় ডেকেছিলেন।”
বসু স্যার হাসিমুখে কথাগুলো বলতেই পক্ষী উত্তেজিত হয়ে বলে,
“সত্যি স্যার! আমি…! বিশ্বাসই হচ্ছে না!”
“হুম, তুমি মামনি। আ’ম সো প্রাউড অফ ইউ ডিয়ার।”
২৩।
আমির ও আরিজের বড় খালা নয়না এসেছে বাড়িতে। আচার-ব্যবহারে তিনি ছোটো বোনকেও ছাড়িয়ে যায়। আমিনা প্রায়শয়ই রাগে চৌচির হয়ে অগোচরেই উনাকে নিয়ে বলেন,
“মুখ তো নয় যেন গোটা এক করলার বিচি ভরা তরকারি!”
কলিংবেল বাজতেই আমিনা এসে সদরদরজা খুলে দেয়। পক্ষী সৌজন্যতার হাসি দিয়ে হলরুম পেরিয়ে নিজের ঘরে যাবে তখনই পিছন থেকে ডেকে উঠে একজন। সে তাকিয়ে দেখে সোফায় অনিন্দ্য সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবান নারী বসা, বয়স হবে বেশ। নারীটির সাথে নয়ন্তিনী বেগমও আছে।
সে আমতা আমতা করে বলে উঠে,
“জী, আমাকে বলছেন?”
নয়না নাকের পাটা ফুলিয়ে মুখ বিকৃত করে বললেন,
“তো আর কাকে ডাকবো! যতসব ঢং! এখানে আসো!”
তার বলার ভঙ্গিমা দেখে পক্ষী ভয় পেয়ে দ্রুত হেঁটে তার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। এর মাঝে আরিজও বাড়িতে প্রবেশ করে। নয়না তাকেও তার সামনে এসে দাঁড়ানোর আদেশ দেন।
পক্ষীকে ইঙ্গিত করে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এই মেয়েটাকেই কি আজমল এনেছে?”
নয়ন্তিনী বেগম কোনোরকম নিচু গলায় বললেন,
“হুম।”
নয়না ভ্রুজোড়া কুঁচকে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা নরনারীকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। মুখটা বিদঘুটে করে বলে,
“কোনোভাবেই যায় না এই মেয়ে আমাদের আরিজের সাথে। আমাদের ছেলে কোথায় পাঁচ ফুট আট, আর এই মেয়ে… আবার গায়ের রঙটাও ফর্সা না!”
কথাগুলো যেন একেকটা আস্ত ছুড়ি হয়ে হৃদমাঝে ক্ষতের সৃষ্টি করছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না মনে হচ্ছে সবার সামনেই অশ্রু বেরিয়ে আসবে। তাই কিছু না বলেই দ্রুতপায়ে হেঁটে বেডরুমের দিকে চলে যায়।
নয়না সেদিকে তাকিয়ে ভেঙচি কেটে বলেন,
“দেখছিস! দেখছিস! কেমন ভাব দেখিয়ে চলে গেল! এজন্যই বুড়োবুড়ি খাটো মেয়ে বাড়িতে না আনতে বলে গেছে, এরা স্বভাবগতই কুটনি হয়।”
২৪।
পক্ষী সদ্য কাপড় বদলে হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তখনই আরিজ আসে সেখানে। সে কিছুটা বিব্রতভাব নিয়ে বলে,
“তুমি কিছু মনে কোরো না খালামনির কথায়।”
পক্ষী দৃষ্টি আকাশপানে স্থির করে রেখেই বলে,
“ঠিক আছে, আমি কিছু মনে করিনি। তার বলাটা হয়তো একদম বেমানানও না।”
এবার যেন আরিজের মাঝ থেকে বিব্রতভাবটা গায়েব হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“একদম ঠিকই বলেছো। খালামনির এগুলো বলা ঠিকই আছে, সত্যিই তুমি আমার এমনকি আমার মতো যে কারো সাথে বড় বেমানান।”
আরও কিছু বলবে তখনই তার ফোনে প্রিয়ার কল আসে। সেও “এক্সকিউজ মি।” বলে বারান্দা থেকে চলে যায়।
অপরদিকে পক্ষী নিজের ফোনটায় বিদ্যমান প্রথমের দিকে তাকিয়ে ভাবে,
“দুজনই পুরুষ, সুদর্শনও বটে। কিন্তু মানসিকতায় পার্থক্য, একজন আমাকে তার পাওয়া শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি ভাবতো, তো আরেকজন আমাকে নিজের সমকক্ষই মানে না। আমি তো সেই জনকেই চেয়েছিলাম যে, আমার এতটুকু উচ্চতাতেও শান্তি খুঁজে পেতো আগলে রাখার; যে আমার এই চাপা রঙেও নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেতো।”
চলবে…