মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি পর্ব ৬

#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#Ipshita_Shikdar
#পর্বঃ৬
১৬।
গভীর ঘুমের মাঝে কারো ডাক বা কোনো আওয়াজ শুনা খুবই বিরক্তিকর ও রাগ বোধ হওয়ার মতো। ঠিক এমনটাই অনুভব হচ্ছে পক্ষীর। শায়িত অবস্থাতেই কল রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরে।

“কীরে ছেমড়ি, তুই কই? এদিকে যে বসু স্যার এসাইনমেন্ট দিয়ে দিয়েছে তা খবর আছে?”

আচমকা অপরপাশে থাকা মানুষটি থেকে এমন রাগান্বিত কণ্ঠে কথা শুনে ভড়কে যেয়ে উঠে বসে পক্ষী। খাণিক জোর গলাতেই বলে,

“কী! কী বলতাসোস এসব, বাবু!”

তার কথায় মেয়েদের মতোই ভেঙচি কাটে আদিয়ান। মা আদর করে ডাকতো বাবু বলে, কোনো এক অপরিকল্পিত ঘটনা বিষয়টি বন্ধুমহলের জানা হয়ে গেলে বেচারার ডাকনামই হয়ে গেল বাবু।

প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে সে বলে উঠে,

“তুই কী ঢাকা এসেছিস? আসলে আজকেই ক্যাম্পাসে আয়!”

“কিন্তু…”

“কোনো কিন্তু নয় এমনেই হাতে তোর সময় কম। এখন রাখি, আমি ক্লাসে যাচ্ছি।”

বলেই ফটাফট কল কেটে ক্লাসের দিকে এগিয়ে যায় সে।

পক্ষীর কোলাহলে ঘুম ভেঙে গিয়েছে আরিজেরও। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এই শ্যামবতী যুবতীর দিকে। বেশ বিরক্তবোধ করছে এমনেই তার ভুলে যাওয়ার সমস্যা তার উপর স্বীয় স্ত্রীর মুখে অন্যকারো জন্য প্রেমময় ডাক ‘বাবু’ কেমন যেন বেমানান লাগছে তার, মনে হচ্ছে এ যেন এক নিষিদ্ধ কাজ করে ফেলেছে পক্ষী।

সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতেই পক্ষীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়জগৎ থেকে খবর আসে তাকে কেউ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সামনে তথা বিছানার দিকে তাকাতেই দেখে আরিজ। নত দৃষ্টিতে আনমনেই বিড়বিড় করে বলে,

“লোকটার কী সমস্যা! বারবার এভাবে তাকিয়ে থেকে আমাকে বিব্রত করে কী মজা পায়, আল্লাহ জানে!”

ওয়াশরুমে যেয়ে মনে পড়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন বদলানো লাগবে কিন্তু আর তো নেই, তাছাড়া ধানমণ্ডির আশেপাশে কিছুই চিনে না সে। এই সময়ে নারীদের হরমোনাল ইমব্যালেন্স হওয়ার কারণ তাদের মাঝে প্রতিটি ক্রিয়ার অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াই পরিলক্ষিত হয়। পক্ষীর ক্ষেত্রেও বিপরীত কিছু হয়নি। এমনিতে সে সবার সামনে না দেখালেও লোকচক্ষুর আড়ালে খুবই ইমোশনাল এবং অল্পতেই নার্ভাস হয়ে যায়, তার উপর পূর্বের ঝড়ময় দিনগুলো আবার কোথায় দরকারী জিনিসটি পাবে সবকিছু ভেবেই হুহু করে কেঁদে দেয় সে।

“কলে কি পক্ষীর প্রেমিক ছিল? থাকতেই পারে আমার কী! কিন্তু…”

এসব অহেতুক ভাবনার ঘোর ভাঙে কান্নার শব্দে। চমকে উঠে বিছানা ছাড়ে সে। মনে মনে ভাবছে,

“কাঁদে কে?”

খাণিক বাদে নিজের প্রশ্নের উত্তর বুঝতে পারতেই আরেকদফা চমকে উঠে সে।

“এই মেয়েটার আবার কী হলো?”

বিড়বিড় করে বলে দরজায় টোকা দেয় সে। চেঁচিয়ে বলে উঠে,

“পক্ষী, কী হয়েছে? বের হও ওয়াশরুম থেকে…”

সে বলতে বলতেই পক্ষী দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। তার বাঁকা চুলগুলো সামনে এসে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে, চুলের ফাঁকেফাঁকে লাল হয়ে উঠা চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে। আরিজ বেশ ভয় পেয়ে যায় অকারণেই। কিন্তু সে বারবার জিজ্ঞেস করলেও পক্ষী উত্তর দেয় না। সেও অস্বস্তিতে কারণ লোকটাকে এ বিষয়ে বলার মতো মানসিকতা তার নেই।

শেষমুহূর্ত বেশে রেগে যেয়ে নাক ফুলিয়ে যুবক বলে উঠে,

“এই মেয়ে! বলবা কী হয়েছে!”

তার চোখ রাঙানো ও রাগী কথায় পক্ষী জ্ঞানশূন্য হয়ে সুড়সুড় করে সবটা বলে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

আরিজও কী বলবো ভেবে পাচ্ছে না। কিছু একটা ভেবে বলল,

“ভাবির কাছে যাও, উনার কাছে চাও। কারণ এই সকালে কোনো ফার্মাসিও খুলেনি। আর আমাদের পাশের ঘরটাই ভাইয়া-ভাবির।”

“আসলে… আসলে আমি কীভাবে… এক কাজ করেন না, আপনি চান!”

কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দেয় পক্ষী। আরিজও পুনরায় নাক ফুলিয়ে বলে উঠে,,

“স্টুপিড! যাও ভাবির কাছে।”

১৭।
সদ্য গোসল করে বের হয়েছে আমিনা, স্বামী তার তখনো ঘুমে ব্যস্ত। আয়নার মাঝে বিছানায় এলিয়ে থাকা পুরুষটিকে দেখেই বারবার তৃপ্তিময় হাসি দিচ্ছে সে। লোকটাকে বড় বেশিই ভালোবাসে সে। বিয়ের এত বছর পরও বাচ্চার মুখ দেখেনি তারা, এ নিয়ে পাড়াপড়শি শোরগোল হলেও বাড়িতে কেউ টুঁশব্দ অবধি করে না।

আপনমনেই কথাগুলো ভেবে নিজের লালচে চুলগুলো মুছতে ব্যস্ত ছিল তখনই দরজায় করাঘাতের আওয়াজ পায়। একবার আমিরের দিকে তাকিয়ে দ্রুত দরজা খুলতে এগিয়ে যায় সে, স্বামীর ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে আবার।

পক্ষীকে দেখে ভ্রুজোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

“তুমি…?”

পক্ষী শুকনো ঢোক গিলে একটু সময় নিয়ে মিনমিনে সুরে সবটা বলতেই আমিনার মুখভঙ্গির পরিবর্তন হয়। কিছু না বলেই দরজাটা আলতো করে চাপিয়ে ভিতরে চলে যায় সে। ব্যাপারটাতে পক্ষী ভেবেই নেয় নারীটি তাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক নয়।

ভারমুখে সেখান থেকে চলে যাবে তার পূর্বেই আমিনা পিছন থেকে বলে উঠে,

“এই নেও… আর এই যে এক্সট্রা একটা নতুন প্যাকেট ছিল আমার কাছে, তুমি নিয়ে যাও।”

মুখশ্রীতে তৃপ্তিময় হাসি ফুটে উঠে পক্ষীর। আমিনা মুগ্ধ চোখে দেখে তা।

“চাপা হাসিতে কাউকে এত সুন্দর লাগে!”

কথাগুলো হৃদমাঝে আওড়াতে আওড়াতেই নিজ কাজে চলে যায় সে। বহু কাজ তার, সকাল সাড়ে সাতটা বাজার আগেই আমিরের কোট, শার্ট, প্যান্ট ইস্ত্রি করে ওয়ালেট ও যাবতীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র সহ গুছিয়ে রেখে যেতে হবে। তারপর আবার নয়টার মধ্যে নাস্তা তৈরি।

১৮।
সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গিয়েছে নয়ন্তিনী বেগমের। ছেলের রাত্রিতে চিন্তায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে, মাথাটা তাই বড় বেশি ভার হয়ে আছে। সে জানে আমিনার নিচে নামতে বহু দেরি তাই নিজেই রান্নাঘরে পা দিয়েছে রান্না করার জন্য।

রান্নাঘরের কাছে আসতেই দেখেন ছোট্ট পুতুলের মতো গাউন পড়া যুবতী একচুলোয় বিদ্যমান উষ্ণ পানিতে পরম মনযোগে চায়ের পাতি দিচ্ছে। আবার টুকটুক করে হেঁটে আরেক চুলোতে বসানো সবজিতে দেওয়ার জন্য গোলমরিচের গুড়া নিচ্ছে। আপনমনে রান্নায় ব্যস্ত থাকা নারীটির মুখশ্রী চিনতে না পারলেও বুঝতে দেরি হয় না তার।

“এই মেয়ে, তুমি রান্নাঘরে কী করছো?”

আচমকা গাম্ভীর্যপূর্ণ কথাগুলো শুনে পক্ষী চমকে উঠায় চামচটি হাত ফসকে নিচে পড়ে যায়। যার দরুণ সে আরও বেশি নার্ভাস হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, ক্ষুধার তাড়নায় রান্নাঘরে এসেছিল সে, এসে দেখে কুইক ফুডের মাঝে তথা পাউরুটি বা জ্যাম এসবের কিছুই নেই। মন খারাপ করে বেরিয়ে যাবে তখনই দেখে রান্নাঘরের একসাইডে বাস্কেটে সবজি রাখা, সকালেই হয়তো কাজের লোক দিয়ে গিয়েছে। একটু খোঁজ করতেই রুটিব বানানোর সরঞ্জামাদিও পেয়ে যায়। সবমিলিয়েই রান্নার প্রয়াশ তার।

বর্তমানে হাতে হাত ঘষতে ঘষতে আমতা আমতা করে সে উত্তরে বলে,

“আমি… আমি… নাস্তা বানাতে এসেছিলাম।”

থেমে হুট করেই বলে উঠে,

“আপনি বসেন, চা দিচ্ছি আমি। ”

না করতে যেয়ে থেমে যান নয়ন্তিনী,কাজ করার দিকে বড়োই অলসতা তার। তাই সব বিষয় পিছনে রেখে ক্ষীণ গলায় বলেন,

“হুম, আরিজ আর আমিরকেও দিয়ে এসো।”

“আচ্ছা, আন্টি।”

এই কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় নয়ন্তিনী বেগমের। যতোই তিনি মেনে না নেক, প্রকৃত অর্থে তো পুত্রবধূই হয় সম্পর্কে।

আর অবাককর হলেও সত্য কেন যেন বাঙালি শাশুরিরা পুত্রবধূর মুখ থেকে মা বোধক সম্বোধন ছাড়া আর কোনো সম্বোধন মেনে নিতে পারে না।

কিছু বলতে যেয়েও থেমে যান তিনি। পক্ষী একে একে সবাইকেই চা দিয়ে আসে, চায়ের স্বাদটা সবারই খুব ভালো লাগলেও প্রসংশাটা শুধুমাত্র আমিরের মুখ থেকে শোনা যায়।

নয়ন্তিনী বেগমও মনে মনে বলেন,

“মেয়ে খাটো হলে কী হবে, গুনের আছে! কিন্তু বলা যাবে না কিছু। বলা তা যায় না, আবার বানর হয়ে মাথায় চড়ে বসলে…”

আরিজ ভাবে,

“বেশ ভালো চা বানায় তো মেয়ে, একদম রিফ্রেশিং। রোজ রোজ বানালেই হলো…”

সবাই নিচে নেমে দেখে নাস্তা বাড়া টেবিলে আর পক্ষী টেবিলের এককোণে বসে খুব তাড়াহুড়োয় খাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় আমিনা, আবার খুশিও হয় তার কাজে ভাগ নেওয়ার কেউ আসায়। কিছু না বলেই সবাই বসে খেতে শুরু করে।

“বাহ! পক্ষী তোমার সবজি তো অনেক মজাদার। তা এত তাড়াহুড়োয় খাচ্ছো কেন?”

“আসলে আমার ভার্সিটিতে যেতে হবে ইমারজেন্সি। আবার বাস পাবো না তাই….”

বলেই আবার খাওয়ায় ধ্যান দেয় সে। কিছু একটা ভেবেই আমির বলে উঠে,

“ওকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসিস আরিজ। আর এ বিষয়ে আমি আর কিছু শুনতে চাই না।”

তীব্র বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো গলাধঃকরণ করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়ে যায় সে।

চলবে…

খুব একটা ভালো হয়নি আজকের পর্ব আমি জানি। গ্যাপ থাকায় মাথা গোলায় গেছে, কিছু আসছিল না মাথায়। ফলাফলস্বরূপ এটুকো লিখতেও গিয়েছে অনেক সময়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here