#কিছু_অধ্যায়
#লেখায়_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
#অন্তিম_পর্ব
‘ তোমার নাম কী?’
‘ তিন্নি।’
‘ সুন্দর নাম। তা এভাবে ঘুরেঘুরে কী দেখছো?’
‘ তোমাকে।’
‘ আমার মধ্যে কী আছে?’
’ বাহঃ রে! ভাইয়ের বউ হবে তাই বউ দেখছি।’
আমার কলিজায় মোচড় দিল। স্বপ্ন আর বাস্তবতা কত পার্থক্য। কল্পনায় এক আর বাস্তবে এক। আমি হতাশ হলাম। বললাম,‘ তোমার কেমন ভাই হয়?’
‘ মামাতো ভাই।’
‘ বেশ। ওদিকটায় যাবে আমার সাথে? এখানে বসে থাকতে কোমড় ব্যথা করছে।’
‘ কোনদিকে?’
‘ এত রাতে তো ছাদে যাওয়া যাবে না। তবে একটু ঘর বা ব্যালকনিতে ঘুরে আসি। একা তো আর যেতে পারবো না!’
আমার কথায় হাসিমুখে তিন্নি রাজী হল।
আমিও মাকে বলে উঠলাম।
তিন্নি ফিসফিসিয়ে বলল,’ তোমার ছাদে যেতে ইচ্ছে করে?’
‘ করলেই কী আর যাওয়া যাবে! এত রাতে গেলে পা আস্ত থাকবে না।’
‘ কেন থাকবে না?’
‘ তা তুমি বুঝবে না।’
আমাদের কথার মাঝে একটা আন্টি তিন্নিকে ডাকলো। বুঝাই যাচ্ছে ওর মা। ড্রয়িংরুমের পরে ডাইনিং রুম পেরিয়ে অন্যান্য রুমে যেতে হয়। এরজন্য তাদের সাথে দেখা হল। আন্টি বলল,’ দেখ তো তোর ভাইয়া এখনও কী করে? মানুষজন আসলো সবার সামনে এসে দু-চারটে কথা বলবে। কিন্তু তা নয় সে রুমে বসে বসে গেম খেলছে।’
তিন্নি মাথা নাড়লো। আন্টি মাথা নিচু করে টেবিল মুছছিল আর তিন্নির সাথে কথা বলছিল। আমায় খেয়াল করেননি। যখন কথা বলার শেষে মাথা জাগালো, আমাকে দেখেই খানিকটা অপ্রস্তুত হল। আমি সালাম বিনিময় করলাম। সে হেসে বলল,‘ তুমিও যাও তিন্নি সাথে। বাঁদরটার বাঁদরামি সামলাও একটু। জীবনে মানুষ হল না।’
আন্টির কথায় হেসে ফেললাম। রুমের সামনে যেতে যেতে ভাবলাম, সেই সার্ফেক্সেল বাঁদরটা এখনও বাঁদরামি করে? ভালো কবে হবে কে জানে!
রুমের দরজা ভেজানো ছিল। ভেতরে গিয়ে কারো উপস্থিতি পেলাম না। তিন্নি ঘুরঘুর করে আশেপাশে খুঁজতে থাকলো। আর আমি রুমে চোখ বুলালাম। বেশ গোছানো। আগের থেকে বড়ো হয়েছে বলে গোছানো হতে পারে। ছোটো সময়ে তো গোছানো ঘর এলোমেলো করে ফেলতো। আর আমাদের বাড়িতে গেলে তো কোনো কথাই ছিল না। গায়েপড়ে ঝগড়া করতো। ঝগড়ুটে ছেলেটা নিশ্চয়ই এখনও ঝগড়া করবে! আমি বিছানায় বসলাম। তিন্নি ব্যালকনিতে গিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলল,’ ভাবি! ভাইয়া এখানে আছে। তুমি আসো তো। বাঁদরের বাঁদরামিটা সামলাও। ইচ্ছেমতো বকে দিলেই হবে।’
তিন্নির কথাগুলো শুনে শব্দ করে হাসতে ইচ্ছে হল। আবার নিমিষেই নিভে গেলাম। কত সময়ের পার্থক্য ছিল। মনেরও বেশ পার্থক্য। আমি হাসফাস করতে লাগলাম। শুনতে পেলাম, ব্যালকনি থেকে ধমকের শব্দ আসলো। তিন্নিকে হয়তো ধমক দিল ওর বোকাবোকা কথা শুনে।
তিন্নি খিলখিল করে হাসছে। বাচ্চা মেয়ে তবুও ধমকে কাজ হল না। ওর মাথায় ততক্ষণে আন্টির বলা বাঁদরামি কথাগুলো জেঁকে আছে। ওর হাসির শব্দে আমারও খুব হাসি পেল।
ব্যালকনি থেকে রুমের দিকে কেউ আসছে। এসেই তাড়াতাড়ি করে শার্ট পড়া শুরু করলো। আমি না চাইতেও চোখ মানুষটির দিকেই গেল। থ হয়ে কিছুক্ষণ হা করেই রইলাম। অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে এই মুহূর্তে এখানে দেখলে যেমন অবস্থা হয় আমারও তেমনই হল। সে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে তিন্নিকে পরখ করলো। তিন্নি ব্যালকনিতেই ছিল। তাই সুযোগ পেয়ে বলেই ফেলল,’ এভাবে তাকিয়ে থাকে কেউ? লজ্জা পাচ্ছি কিন্তু অনেক।’
আমি এলোমেলো দৃষ্টি নিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। সে হাসছে। হাসির শব্দ কানে এসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
কথার প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম,’ আপনি এখানে কী করছেন? তাও এই ভরা শীতের মধ্যে খালি গায়ে।’
সে খানিকটা হেসে হেসেই বলল,’ আমার ঘর আমি থাকতেই পারি। তবে আমার না হওয়া বউটা এখানে কী করছে? তাও একটা ছিঁচকে ইঁদুর নিয়ে আসা লাগলো? একা আসলে কী হত? দু-চারটে কথা তো বলা যেত আলাদা।’
সে কথাগুলো বলেই মাথার চুল টানতে লাগলো। আমি নিঃশ্বাস আঁটকে মরে যাব এমন অবস্থায় আছি৷ নিজেকে সামলে বললাম,’ ছিঁচকে ইঁদুর কাকে বললেন?’
সে ইশারায় তিন্নিকে দেখালো। মুখে বললে হয়তো কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেত।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,” আদ্রিয়ান সাহেব! আপনি তো ভীষণ সাংঘাতিক লোক। কতগুলো সত্য ধামাচাপা দিয়ে গেলেন?”
সে মিটমিট করে হাসছে। বলল,” একজনের তো ভালো লাগলো না। আটঘাট বাঁধছিল, পাত্রকে অনেক কথা শুনিয়ে দিবে। যেন বিয়েটা না হয়৷ এমনকি ফন্দিও আঁটলো, বয়ফ্রেন্ডের কথা বলবে। তাই আমিই বলে দিলাম। তাতে আমার কী দোষ?”
আমি গলা ঝাড়লাম। বললাম,” কে বলল আপনাকে?”
” আমি নিজের কানে শুনেছি। আপনি যখন বিড়বিড় করে সবকথা গুলো স্পষ্টভাবে শব্দ করে বলেছিলেন তখন আন্টির সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। আপনার কথা জিজ্ঞেস করায় আন্টি রুমের দিকে গেল। আমি তখন লাইনে ছিলাম। আপনি তো আবার কিছু মনেমনে বলতে পারেন না। শব্দ করে বলেই ভাবেন মনে মনে বলেছেন। তাই একটু চান্স নিলাম আপনার কথা দিয়েই। তা কেমন লাগলো?”
আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম তার কথায়। অকপটে ভাবে বললাম,’ খুব ভালো লাগছে। পরবর্তীর অপেক্ষায়।’
সে ঠোঁট কামড়ে হাসতে রইল। বলল,” এত রাগ নিয়ে থাকলে কিন্তু আমি কেঁদেকেটে এক করে ফেলব। ভয় লাগে তো।”
তার কথা শুনে হাসবো না-কি কাঁদবো গুলিয়ে ফেললাম। মানুষটা বেশ কৌশলে সবকিছু কীভাবে আড়াল করে গুছিয়ে ফেললো। পরিবার আর আমাকে খুব কায়দা করেই সামলালো। বুঝতেও পারলাম না।
আমার নিশ্চুপতা দেখে সে গলা খাঁকারি দিল। বলল,‘ বিয়েতে কি আপত্তি আছে? না হলে কিন্তু সত্যি সত্যিই গার্লফ্রেন্ড খুঁজতে হবে।’
আমি মাথা নাড়ালাম। যার অর্থ ‘না’। সে ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি রেখে বলল,’ দেখো, ইশারা কিন্তু বুঝি না। মুখে বলো। আর হ্যা, আমার কানেও সমস্যা আছে । একটু জোরে বলবা।’
তার কথা শুনে কপাল কুঁচকে তাকালাম। এই ক’দিন তাকে যেভাবে দেখছিলাম আর আজকে যেভাবে দেখছি বেশ পার্থক্য তার মধ্যে। এ ক’দিন বেশ শান্তশিষ্ট স্বভাবের লাগছিল৷ আর আজকে কথায় কথায় ফাজলামো। আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
সে হেসে হেসে বলল,
‘ আমার মধ্যে বোধহয় ছোটো সময়ের আত্না ভর করেছে। আসো না একটু ঝগড়া করি। এই তুমি রিমোটের জন্য এখনও পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করবে?’
আমার কোনো জবাব না পেয়ে সে বলতেই লাগলো,
‘ এখনও কার্টুন দেখো? এই এখন থেকে কিন্তু খেলাধুলা দেখবা, নিউজ দেখবা। আমার ছেলেমেয়েগুলো যেন এমন না হয়। তখন কিন্তু তোমার সাথে এক হয়ে ঝগড়া করবে। আমি একা সবার সাথে পেরে উঠবো না ঝগড়াতে। আই অ্যাম আ গুড বয়। এত ঝগড়াঝাটি আমি পারি না।’ সে ফিচেল হাসলো।
তার কথাবার্তা গুলো শুনে কোনো উত্তর বা কথাই খুঁজে পেলাম না। এত বড়ো মানুষের এমন কথাবার্তা! যত্তসব৷ আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,‘ একটা সাহায্য করবেন?’
সে খুশি হয়ে বলল,’ অনুমতি লাগবে না। ঝটপট বলে ফেলবে।’
আমি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললাম,‘ আন্টি একটা বাঁদরকে খুঁজতে পাঠালো আপনার রুমে। একটু খুঁজে দিবেন? বাঁদরামিটা শেষ করতে হবে। আন্টির নির্দেশ। প্লিজ এতটুকু সাহায্য করলেই চলবে। বাকিটা আমার হাতে।’
আদ্রিয়ান থেমে গেল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,’ আমার কাজ আছে। পরে কথা হবে। এই ছিঁচকে ইঁদুর! ব্যালকনিতে কী করছিস? বিড়ালে নিয়ে যাবে ফুপ্পি টেরও পাবে না।’
তার এহেন কথায় আমি হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তিন্নি রেগেমেগে আসলো। বলল,’ ভাবি? তুমি কিছু বলো না কেন? আমি কিন্তু তোমার জামাইকে মেরে ফেলবো।’
তিন্নির কথায় হেসে ফেললাম। তাল মিলিয়ে বললাম,’ আমিও তোমার সাথে আছি।’
আদ্রিয়ান আমার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে তিন্নিকে ধমক দিল। তিন্নি মুখ ঝামটি মেরে চলে গেল। আমিও পিছুপিছু চললাম। আদ্রিয়ান নাম ধরে ডেকে বলল,’ জামাইর জন্য দয়ামায়া রেখো একটু। এভাবে মেরে ফেললে কিন্তু ভূত হয়ে জ্বালাবো।’
আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকানো মাত্রই দাঁত বের করে দিল। আমি কিছু বললাম না। এই ঝগড়ুটে জীবনেও যে ভালো হওয়ার নয় তা হারে হারে টের পেলাম। শুধুমাত্র ক্ষনিকের জন্য নিজেকে আলাদা রেখেছিল। আমার জীবনের তিন-চারটে দিনে। তখন তার ভাবগতি তো বুঝারই ক্ষমতা ছিল না। টেরও পেলাম না। ইনিই যে সেই ঝগড়ুটে। সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। শুধু রয়ে গেছে জীবন থেকে নেওয়া কিছু মুহূর্ত, কিছু অধ্যায়ে গচ্ছিত করে রাখতে হল।
রাতের খাওয়ার সময়ে ছেলেরা আলাদা খেল তারপরে মেয়েরা খেল। আমরা যখন খেতে বসলাম সে পানি খাওয়ার অজুহাত দিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসলো। অথচ ড্রয়িংরুমে, তার রুমে ফিল্টার আছে। এসেই বলা শুরু করলো,
‘ এখানে বাচ্চা আসলো কই থেকে?’
সবাই তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। আদ্রিয়ান ভাবলেশহীন ভাবে বলল,’ এই প্লেটটা কার। এটা তো নির্ঘাত বাচ্চাদের খাবার। ওর সামনে কেন?’
বলতে বলতে পোলাও উঠিয়ে দিল। আমি বিরক্তিমাখা চোখ নিয়ে তাকালাম।
সে দাঁত বের করে হেসে বলল,’ মেহমান দের আপ্যায়ন করতে হয়। সেসব জানো না কিছুই! আমি গুড বয়। তা তো জানোই সবাই। সে হিসেবে দায়িত্ব আছে না!’
এতগুলো মানুষের সামনে কিছু বলতে পারলাম না। তিন্নি ছোটো মানুষ। এত ভার দার রেখে তো কিছু বলবে না। তাই সবার সামনেই বলে দিল,’ বারবার ভাবির সামনে এসে গুড বয় গুড বয় কেন করছো? আর আপ্যায়ন তো একজনেরই করছো। তাহলে দায়িত্ববান কীভাবে হলে?’
আদ্রিয়ান ঢকঢক করে পানি গিলে তিন্নিকে ধমকে বলল,’ দেব এক চড়।’
তিন্নি মুখ ভেঙিয়ে খাওয়ায় মনোযোগী হল।
তাসবিহা বলল,’ এতকিছু ঘটে গেল অথচ আমি আজকেই সকালে জানতে পারলাম। তাই তো বলি ভাইয়াকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসার কথা বললেই ভদ্রভাবে রাজি হয়ে যেত কেন? আগে বললে কী হত? আমার বান্ধবীই তো ছিল। সম্পর্কটা আরও ভালো হত।’
আদ্রিয়ান মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। অর্থাৎ তাসবিহার ইমোশনাল কথাবার্তা তার গায়ে লাগেনি। কান অবধিই যায়নি।
আমি কোনোভাবে খেলাম। তাসবিহা কাছে ছিল বিধায় ওর প্লেটে কিছু উঠিয়ে দিলাম। ইশারায় বললাম,’ ভাবি তো! একটু সাহায্য কর না। ‘
তাসবিহা চোখ গরম করে তাকাল।
বাসায় ফেরার সময়ে আদ্রিয়ান পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাদের সাথে নামলো। এগিয়ে দেওয়ার জন্য কয়েকজন গেট অবধি এসেছে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক বাদেও নতুন একটা সম্পর্ক হতে চলল এ পরিবারের সাথে। সেজন্য নতুন বউকে তো এগিয়ে দিবেই।
আদ্রিয়ান আর আমি কিছুটা সামনে ছিলাম। ও ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ আমি কত ভালো দেখছো? আর কত প্রমাণ দিতে হবে বল তো? বাসা অবধি পৌঁছে দিয়ে আসবো। আর তুমি কী করেছিলে? গেট অবধি এসে একটু উঁকিঝুঁকি। ভালোভাবে বিদায়ও জানালে না সেদিন।’
আমি চকিতে তাকালাম। সে দাঁত বের করে হেসে দিল। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,’ আপনার এত ভালো ভালো গুণ দেখে আমি পাগল হয়ে যাব। ইশ, কত গুণ তার!’
সে হেসে বলল,’ পাগলামিটা আমায় ঘিরে থাকলেই হল।’
আমি মৃদু হাসলাম। সে বলল,
‘ সেদিন কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম। আজ বলবে কি?’
‘ জি, বলেন। উত্তর জানলে অবশ্যই বলব।’
‘ প্রেমে পড়েছ কি?’
‘ কই না তো! শুধু কল্পনায়ও একজনকে ভাবতে শুরু করেছিলাম।’
‘ প্রেমে না পড়লে কেন ভাববে? মগের মুল্লুক না-কি!’
‘ তা তো জানি না। তবে লোকটা ঝগড়ুটে বটে।’
‘ ঝগড়ুটের বউ হয়ে থাকতে পারবে?’
‘ তা পারবো অবশ্য। বাঁদরামিটা ছাড়িয়ে নিলেই হবে।’
‘ কীভাবে?’
‘ যেভাবে কিছু মুহূর্ত উপহার দিয়েছিল। আমি না হয় তেমন একজন প্রেমিকা হব। তখন এমনিতেই ঝগড়ুটের বাঁদরামি ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ কিশোরী মনের পরিবর্তন হয়ে গেল?’
‘ না হয়ে উপায় আছে!’
‘ সেদিন না দেখতে গেলে বোধহয় জীবনের বড়ো কোনো ভুল করতাম অথবা আফসোস।’
‘ কেন?’
‘ না হলে যে বানোয়াট গল্পটা শুনতাম না আর তাকেও উল্টো শোনাতে পারতাম না। তাহলে কি সেই মুহূর্তগুলো আসতো? আমার বউ তো না দেখেই বলে যাচ্ছিল, ঝগড়ুটে ছেলেটাকে বিয়ে করবো না। অথচ সেই ঝগড়ুটের জন্যই মন খারাপ ছিল তার।’
আমি অপ্রতিভ হয়ে হাসলাম। সে পিছু ফিরে তাকাল। সাথে আমিও। আম্মু আব্বু বেশ দূরে আছে। তাদের সাথে আংকেল আন্টি আর ফুফুরাও আছেন। কীসব বলছে কে জানে! বাড়িতেও কত কথাবার্তা বলল আবার রাস্তাতেও শুরু করলো। গাড়ির পথটা এলো কতক্ষণ হল। তবুও তাদের পা চলছে না। অথচ আমরা কত আগেই চলে এসেছি।
আদ্রিয়ান তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে আমাকে বলল,’ কী ভাবছো এত, ভাবুনীর আম্মু?’
আমি চকিতে তাকাই। সে ফিচেল হাসলো। আমি আশেপাশে তাকিয়ে বললাম,’ ভাবুনীটা কে? আর এখানে তো কেউ নেই। তাহলে ওর আম্মুকে ডাকলেন কেন?’
আদ্রিয়ান শব্দ করে হাসলো। বলল,’ সারাক্ষণ কে ভাবছে? আমার পাশে যার অস্তিত্ব তাকেই বলেছিলাম বোধহয়।’
‘ তা বুঝলাম। কিন্তু এই ভাবুনীটা কে?’
সে নাক চুলকিয়ে হেসে বলল,’ এত এত ভাবতে থাকলে আমার মেয়েটাও বোধহয় এমন হবে। ভাবছি ওর নাম ভাবুনীই রাখবো। আদুরে নাম।’
আমি অপ্রতিভ হয়ে অন্যদিকে তাকাই। মা-বাবা কাছে আসলো ততক্ষণে। আদ্রিয়ানও দায়িত্ব নিল পৌঁছে দেওয়ার। রাত তো কম হল না। এজন্যই এত দায়িত্ব তার। সবার সামনে বলেছিল, এত রাতে আসতে নাকি অসুবিধে হবে আমাদের। এরজন্য সে দায়িত্ব নিয়েছে পৌঁছে দেওয়ার। আন্টিও খুশি হল ছেলের গুণে। অথচ আমাকে একা পেয়ে বলল, আমার না হওয়া বউ আর শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য তো এতটুকু করতেই পারি। আমি যে গুড বয় তা তো প্রমাণ করতে হবে।
তার এই গুড বয়, গুড বয় বস্তায় ভরে রাখতে ইচ্ছে করে। এত কী আছে? বারবার কথায় কথায় বলে।
বাড়ির সামনে আসার পরে বাবা-মা যখন ভেতরে গেল। তখন সুযোগ বুঝে সে বলেই ফেলল,’ বিয়েটা যে কেন হল না! তাহলে এখন শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে যেতে হত?’
আমি কিছুটা নিভে গেলাম। লোকটা পারেও বটে। মানুষকে নিমিষেই লজ্জায় ফেলে দিতে পারে। তবে সে হাসলো। হাসি-হাসি মুখ করে তাকিয়ে ছিল। আমি তাকানো মাত্রই চোখ ঘুরিয়ে ফেললো।
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। আজ সেই ঝগড়ুটে ছেলেটা আমার বর। অবশ্য গুড বয়ও বলা যায়। কারণ সে তো কথায় কথায়ই নিজেকে এমনটা দাবি করে। অবশ্য সে এমনই। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তাঁর। অসাধারণ মানুষ আমার জীবনে। আমার নতুন অধ্যায়ের।
এই নতুন অধ্যায়ের প্রথম শুরুই হল কবিতা দিয়ে। তার কবিতা। শুধুমাত্র আমার জন্যই। আর আমাকে ঘিরেই ছিল। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। মানুষটির জ্বলজ্বল চোখের মণি দিয়ে আমার মুখপানে তাকিয়ে সে আবৃত্তি করেছিল।
আমার কবিতা হবে?
তবে ছন্দ মেলাবো।
আমার রচনা হবে?
বর্ণনা করবো।
আমার উপন্যাস হবে?
প্রিয় চরিত্রে সাজাবো।
আমার প্রেমিকা হবে?
খুব ভালোবাসবো।
আমার রাণী হবে?
আমার রাজত্ব দিয়ে দেব।
আর একটু ভালোবাসবে?
আমার আমিটাকেই দিয়ে দেব।
#সমাপ্ত