কৃষ্ণচূড়ার রং লাল পর্ব ৩৯+৪০

কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৩৯.🎈
@হাফসা আলম
_____________________
রিঝের মতে বিয়ে হবে দ্রুত।সহজে এর কাজ শেষ হবে।কোনো হৈচৈ নেই।বাচ্চাদের কান্নার,চিৎকারের শব্দ নেই।মেয়েদের গল্পের আসর হবে না।শুধু ছেলে এবং মেয়ের মতের প্রয়োজন।তারপর সোজা বিয়ে করার জন্যে কাজি অফিসে বা কোর্টে।এই যে এতো আয়োজন শুধু শুধু।এসবের কোন মানে নেই তার কাছে।সে সব সময় সাদামাটা জীবন পছন্দ করে।গুরুত্ব দিয়ে জিনিস দেখছিলো সে।রামিম ছুঁটে আসে।হাপাঁতে হাঁপাতে বলে,’ রিঝ তুই এখানে কি করছ??’
রিঝ একবার চোখ ফিরিয়ে তাকায়।কিছু বলে না।রামিম রেগে যায়।ঝাঁঝাল গলায় বললো,’ তুই এটা একদম ভাল করিসনি।আন্টি খেপে গিয়ে গালে চড় বসিয়ে দিয়েছে।’
সামনে একজন গেস্ট দাড়িয়ে ছিল।রিঝ তার থেকে বিদায় নিয়ে রামিমের বরাবর তাকায়।কিছুই হয়নি একটা ভাব নিয়ে বললো,’ এমন হাঁপাচ্ছিস কেনো?’
রামিম আরো খেঁপে তাকায়।রিঝ হেঁসে বললো,’ তোর মুখটা এমন হয়ে আছে কেন?হিমেল কি চলে এসেছে??না কি আসমাই চলে গেছে বিয়ে করতে।’
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে রামিম বললো,’ রিঝ এটা সিরিয়াস কিন্তু।আকাশকে আন্টি সবার সামনে চড় বসিয়ে দিয়েছে।তোর জন্য শুধু তোর জন্য থাপ্পড়টা খেয়েছে।বন্ধুত্বে এমনটা তো ছিল না কোন কালেই।’
‘ হয়েছে, কাল শিখাতে আসবি না।শুধু চড় কেন ওরে তো লাথি মারা উঁচিত।একটা বিয়ে করে সখ মিটেনি?যে আবার বিয়ে করতে যাচ্ছে।’
রামিম অবাক হয়ে বললো,’ আবার বিয়ে মানে?’
জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না রিঝ।সোজা হেঁটে ভিরের কাছে গেলো।আসমা কিছু বলতে চাইল।রিঝ শুনল না।আকাশের মায়ের কাছে দাঁড়াল।তিনি তখন কান্নায় দুনিয়া ভাসিয়ে দেওয়ার মত অবস্থা।আকাশের বাবা থামাতে ব্যস্ত।আর আকাশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ছোট খাটো একটা ভীর জমে গেছে।বিয়ের জন্য বেশির ভাগ মানুষ পাশের বাড়িতে চলে গেছে।তাই বাড়ি ফাঁকা ফাঁকা।কিন্তু এদের হট্টগোল দেখে কিছু মানুষ ছুঁটে এসেছে দেখার জন্য।রিঝ গলা পরিষ্কার করে ডাকে,’ আন্টি!’
জবাব না পেয়ে একটু জোড়ে বলল,’ আন্টি থামুন এবার।’
আকাশের মা তীর্যক চোখে একবার তাকালের রিঝের দিকে।মিসেস আয়শা রহমান পাশেই ছিলেন।তিনিও থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে।কিছুক্ষণ থেমে আবার কান্না জুড়ে দিলেন আকাশের মা।রিঝ একটু শব্দ করেই বলল,’ সবাই নিজের কাজে যেতে পারেন।আর আপনারা ভেতরে আসুন।ঘরে কথা হবে।বাহিরে সিনক্রিয়েট করার মানে হয় না।আকাশ তুই আর রূমাশ্রীও চল।’
আকাশ মাথা নিচু করে রিঝের পিছনে পিছনে হাঁটছে।ফিঁসফিঁস করে বললো,’ দোস্ত আমি তো বলে দিতাম।তুই এই বিয়েতে বলতে গেলি কেনো?’
‘ কখন বলতি দ্বিতীয় বিয়ের পরে?’
‘ ব্যাপারটা তেমন না।’
‘ কেমন বুঝতে চাই না।’
বিশাল রুমটা খালি।মানুষ বলতে কেউ ছিল না।রিঝ আগে ঢুকে তারপর বাকিরা।মিসেস আয়শাকে দেখে রিঝ বললো,’ আম্মু তুমি যাও।আমি সামলে নিবো।’
আকাশ বসে বামেরসোফায়।আর তার বাবা মা বসে সামনে।রূমাশ্রী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আসমার পাশে।রামিম মাত্র ঢুকে।রিঝ স্বাভাবিক হয়ে বললো,’ দেখুন আন্টি আপনাকে আমি এসব বলেছি যাতে করে আকাশ আর বিয়ে না করে।একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে তো লাভ নেই।’
আকাশের মা রেগে যায়।কান্নায় জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠ বাড়িয়ে বললেন,’ তুমি বুঝবে না।বাবা মাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে।এটা মোটেও উঁচিত কাজ করেনি।তুমি তো বাবা মায়ের সব কথা শুনে চল তাই বুঝবে না।’
রিঝ ঈষৎ হাসলো।ভুলটা তো ইচ্ছে করে হয়নি।জোর করে হয়েছে।এটা ভুলও না।কিভাবে বুঝাবে সবাইকে ভাবে রিঝ।কয়েক মিনিট নিরব থেকে বললো,’ আপনারা কি মনে করেন?জন্ম দিয়েছেন,লালনপালন করেছেন তাই বলে তাদের জীবনের সব সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিবেন?এটা উঁচিত নয় আন্টি।আপনি যখন আপনার ছেলেকে প্রশ্ন করবেন,তোমার কোন পছন্দ আছে কি না?তখন যদি সে উত্তরে না বলে সেটা আলাদা কথা।অধিকারটা তৈরি হবে তখন।কিন্তু সুযোগ দিতে তো হবে।আচ্ছা বুঝিয়ে বলছি।উঠে যাবেন না।’
রিঝ হাঁটু ভেঙ্গে বসে আকাশের মায়ের হাঁটুর কাছে।কোমল ভাবে হাতটা ধরে।শান্ত শীতল কন্ঠে বললো,’ ধরেন আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে দোকানে গেলেন।তখন আপনি অবশ্যয় আগে প্রশ্ন করেন তোর কিছু পছন্দ হয়েছে?বা তোর কোন শার্ট পছন্দ হয়েছে?প্রশ্নটা কি করেছেন আন্টি??’
সবাই রিঝের দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে।মিসেস মরিয়মের মুখটা সাদা হয়ে যায়।ফ্যাকাশে কন্ঠে বললেন,’ জামা পছন্দ করার সাথে আজকের এই এতো বড় কাহিনীর কি সম্পর্ক??আর আমার ছেলে আমাকে না বলে বিয়ে করে নিয়েছে।মানে বুঝতে পারছ তুমি??’
একটা ছোট শ্বাস নিয়ে নিজের জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে নিলো সে।তারপর আবার বললো,’ আছে সম্পর্ক।আগে উত্তর দেওয়া হোক।’
‘ হুম করেছি।’
‘ এটাই বুঝাতে চাইছি আন্টি।একটা সামান্য জামা কিনতে যার পছন্দের গুরুত্ব আপনার কাছে এত বেশি তার জীবন সঙ্গীর গুরুত্বও নিশ্চুই আছে?’
মিসেস মরিয়ম চুপ করে গেল।রামিম মনে মনে বাহবা দিল।রিঝের এই বুঝাতে পারার অসীম ক্ষমতাকে টেক্কা দেওয়ার মত কেউ নেই।তার চোখে পড়েছে বলে তো মনে পড়ছে না।আসমাকেও যদি বুঝিয়ে দেওয়া যেত! একটা দীর্ঘ অশান্ত শ্বাস বেরিয়ে আসে তার।আসমা রামিমকে পিছন থেকে ফিসফিস করে বললো,’ দোস্ত রিঝ কাম সারাই দিছে।’
রামিম পিছনে ফিরে।গরম চোখে তাকায়।কেন তাকালো?সে নিজেই জানে না।আসমা তো আরো জানে না।আকাশ মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রতিক্রিয়া বুঝতে চাইছে।মুখটা ফ্যাকাশে করে তিনি বললেন,’ তবুও ওর তো আমাকে একটু বলা উঁচিত ছিল।’
পা গুলো মেলে বসে রিঝ।হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বলে,’ এবার এসেছেন লাইনে।কথা হচ্ছে ওদের বিয়ে সাধারণ ছিলো না বা একে অপরকে পছন্দ করে হয়নি।জোর করে হয়েছে।’
কথাটা কানে যেতেই মিসেস মরিয়ম আঁতকে উঠেন।রাগে ফঁস ফঁস করে নিশ্বান ফেলে।মুহিত সাহেবও গেলেন খেঁপে।চেঁচিয়ে বললেন,’ আমার ছেলেকে জোড় করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে??তাও মতের বিরুদ্ধে??এতো বড় সাহস??এই মেয়ে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম ভেবেছি আমার ছেলে পছন্দ করে বিয়ে করেছে।এখন তো দেখছি জোর করে আমার ছেলের ঘাড়ে চেপেছো।’
‘ আঙ্কেল প্লিজ থামুন।’ খুব জোড়ে চিৎকার করল রিঝ।মিস্টার মুহিত একটু কেঁপে উঠলেন।আয়েশা রহমার বুঝলেন ছেলে রেগে গেছে।এই ছেলে রাগলে সর্বনাশ!তিনি পাশে এসে ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বললেন,’ বাবু রাগ করছ কেন?এটা খুব খারাপ একটা সময় তাদের জন্য।তাই রেগে যাচ্ছে।তুই রাগিস না।’
রিঝ মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে সবাইকে সব খুলে বললো।প্রথম থেকে।শুধু নিজেদের বিয়ে লুকিয়ে।কারণ রামিম আর আসমা নিশেষ করছে সব বলতে না।কথা শেষ করে রিঝ কাঁচের টেবিল থেকে জল নিয়ে খেয়ে বললো,’ এবার বুঝলে তো কারো দোষ নেই।দুজনেই পরিস্থিতির শিকার।আমি যখন শুনলাম আকাশের বিয়ে হচ্ছে।তাও আবার।ব্যাপারটা ভাল লাগলো না।কারণ যে মেয়েটি এসেছে তার কোন দোষ ছিল না।আকাশ আগে কাউকে পছন্দও করত না।বন্ধু তাই সব জানি।ভেবে চিন্তে দেখলাম,সে চাইলেই রূমাশ্রীর সাথে জীবন সাজাতে পারে।শুধু আপনাদের অনুমতির প্রয়োজন।তাছাড়া সব ঠিক।যদি এমন হতো যে আকাশের অন্য পছন্দ আছে তখন সব অন্যরকম হতো।কিন্তু এখানে সব গোঁছানো জিনিস।তাই এলোমেলো ভালো লাগে না।সেই জন্য আমি আপনাকে বলেছি।আকাশ আপনাদের অনুমতি চাওয়ার সময় বা সুযোগ পায়নি।পেলে অবশ্যয় সে কাজে লাগাত।ছেলেটা আপনাদের।আমার চেয়েও বেশি আপনারা চিনেন।কতটুকু ভাল জানেন।একটা মেয়েকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া উঁচিত নয়।তার উপরে যদি সে হয় নিজের বউ।তাহলে তো তাকে যত্ন করে রত্নেন মত রাখা উঁচিত।বাকিটা আপনাদের উপরে।’
দরজার কাছে এসে কিছুক্ষণ আগেই দাঁড়িয়ে ছিলো তুতুল।খুব গুরুত্বপূর্ন্য কাজে সে এসেছে।জুতো চুরির কাজ!আনাসের খুব সখের বিয়ের জুতো তুতুল খুব সাবধানে সরিয়ে নিয়েছে।এর বিনিময়ে সে টাকা আদায় করবে।অবশ্য সে একা না।তার সাথে অনেক মেয়ে।চাচাতো,খালাতো,মামাতো,কত বোন যে আবিষ্কার হয় বিয়েতে বলার বাহিরে।গমগমে গুমুট ধরা পরিবেশ দেখে সে আর ভিতরে প্রবেশ করেনি।দাঁড়িয়ে সবার কাহিনী দেখছে।রিঝ উঠে যায়।আকাশ বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চায়।রূমাশ্রী নিজের চাচাদের কাজের জন্য খুবই লজ্জিত।মিসেস মরিয়ম এখনো মুখ ফুলিয়ে আছেন।কিন্তু কিছু বলছেন না।আকাশকে মাফ করে দিয়েছেন।একটা মাত্র ছেলে।আদরের ভালবাসার ছেলে।কিন্তু রূমাশ্রীকে ক্ষমা করেছে? বা মেনে নিয়েছে কি না কিছু বুঝলো না কেউ।

তুতুলকে চোখ উল্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজের চোখ আরো ছোট করে বললো,’ তুমি এখানে কি করছ??কি চাই??’
প্রথমে চমকাল।পরে নিজেকে সামলে নিয়ে তুতুল আশেপাশে তাকাল।দেখলো মেয়ে সব গায়েব।রিঝের ভয়ে সবকটা পালিয়েছে।বেয়াদপ সবকটা।তুতুল পরে বিপদে।রিঝ এখন তাকিয়ে আছে।তুতুল আমতা আমতা করে বললো,’ এই যে এটা দিতে এসেছি।’
একটা ঝুড়ি।ফলের,ফুলের।রিঝ সন্দেহান চোখে ঝুড়ির দিকে হাত বাড়াতেই তুতুল টেনে সরিয়ে নেয়।বলে,’ এটা ধরে কাজ নেই।আমাকে সাহায্য করুন।চলুন আমার সাথে।’
বাড়ি খালি খালি হয়ে যায়।তুতুল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে প্রশ্ন করে,’ আচ্ছা এতক্ষণ কি হয়েছিলো??’
‘ তুমি জেনে কি করবে??আর এই বিশ্রী বেগুনি রঙ্গের ড্রেস কেন পড়েছো??তুমি জানো না আমি বেগুনি পছন্দ করি না।’
‘ জানি তো।পছন্দ করেন না তো কি হয়েছে।আমার তো ভাল লাগে।’
‘ পছন্দ গুলো এখন পাল্টে ফেলো।বউ তুমি আমার।’ রিঝের কন্ঠে কাঠিন্য ভাব প্রকাশ পায়।তুতুল তড়িৎ করে বললো,’ আস্তে বলুন।’
‘ আস্তে বলার মত কাজ তো করিনি।বিয়ে করেছি।এটা খারাপ কি?’
‘ আহ্ চুপ থাকুন।’
স্টোর রুমে অনেক জিনিস।ভাঙ্গা জিনিস পত্র।মাকড়সার জাল।ধূলোবালি।কেউ সাধারণত আসে না।তুতুল কেন আসল বুঝতে পারলো না রিঝ।সে দরজার কাছে এসেই থেমে গেল।বললো,’ তুমি এখানে কেন এসেছো??’
তুতুল অনেক কিন্তা করে কথা বানায়।বলে,’ আম্মু বলেছে এই ঝুড়ি আপনাদের স্টোর রুমে রাখতে।’
‘ ফলের ঝুড়ি স্টোর রুমে রাখতে বলেছে??পাগল তুমি??না আমাকে পাগল মনে হচ্ছে?’ কড়া ধমকে তুতুল ভয় পেয়ে যায়।স্টোর রুম গাঢ় অন্ধকার।দেখতেই ভূতুরে ভূতুরে লাগে।উপরে লম্বা তাক।তুতুল চুপ করে তাকের দিকে তাকিয়ে আছে।ভাবছে কিভাবে রাখবে।এতো লম্বা তো সে না।তাহলে কিভাবে কি?রিঝ ভাবছে বকা খেয়ে চুপ করে গেছে।নিজেকে সামলে সে বললো,’ কি করতে এসেছো সজা বলো।নিচে যেতে হবে।’
তুতুল একটু নরম হলো।খুব আবেগী স্বরে বললো,’ একটা সাহায্য করবেন??’
রিঝ তো ভারী অবাক।এটা কি হলো?এতো সুন্দর কন্ঠ তার নিজের বউয়ের??আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো,’ তুমি ঠিক আছো?’
‘ আরে সাহায্য করলে বলেন তা না হলে রামিম ভাইয়াকে ডাকি।’
‘ থাপ্পড় খাবে।বলো কি করতে হবে।’
‘ বেশি কিছু না শুধু এই ঝুড়ি উপরে তুলে দেন।’কোনো কিছু চিন্তাভাবনা না করেই রিঝ ঝুড়িটা উপরে তুলে দেয়।পাশ ফিরে দেখে তুতুল নেই।এই একটু সময়ে কোথায় গেল?চারপাশে চোখ দৌড়ে দেখল কেউ নেই।তুতুল গায়েব!
______________________
আনাসের আনন্দ,খুশি ধরছে না।উপচে উপচে পড়ছে।তার ঠোঁট জুড়ে শুধু হাসি আর হাসি।যেকোনো কথায় সে হাসছে।কারো হাঁটা দেয়েও তার হাসি পাচ্ছে।চারপাশের সবকিছু এতো রঙ্গিন কেনো মনে হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে।জিসান বিরক্ত হয়ে বললো,’ এতো হাসার কি আছে?’
বিনিময়ে আনাস আবার হাসে।প্রেমের বিয়ের আনন্দ বোধ হয় এমনই হয়!
বিয়ে শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।কাছাকাছি বাড়ি হওয়ার শর্তেই মনে হয় সব দেরিতে দেরিতে হচ্ছে।ব্যাপারাটায় বড্ড বিরক্ত আনাস।রুচিকার দেখা এখনো মিললো না তার।কিছুক্ষণ পর পর উঁকি দিতে হচ্ছে ভেতরের দিকে।কি অদ্ভুত নিজের বউকে দেখতেও এতো পরিশ্রম করতে হচ্ছে।পৃথিবীর সব মানুষ বড্ড নিষ্ঠুর!বেশ অনেকক্ষণ পরে রুচিকাকে নিয়ে আসা হয় স্টেজে।আনাস লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে।আবার মনে মনে ভাবে,শালা যখন লুকিয়ে দেখার যুগ ছিল তখন তো ড্যাব ড্যাব করে দেখতিস।আর এখন তো সবার সামনে যখন যেভাবে খুশি দেখতে পারছ।তাহলে এতো কাহিনী কিসের।দেখ ব্যাটা!নিজের কথায় নিজেই হাসলো।রুচিকা লাজুক চোখে একবার পাশ ফিরে তাকায়।তারপর ফিসফিসিয়ে কানের কাছে এসে বললো,’ তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।’
একটা চাপা উত্তেজনায় আনাসের বুক কাঁপছিল।কথাটা শুনে তার খুব ভালো লাগছে।প্রিয়মানুষের মুখের সব কথাই প্রিয় হয়।এটাই তো প্রিয়র জাদু!

নামার সময় মনে পরে জুতো নেই।আনাস চারপাশে চোখ বুলায়।নাহ।আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।সে আবার চেয়ারে বসে।রিঝ এগিয়ে এসে বললো,’ এখন কি ঘরজামাই থাকার ইচ্ছে তোর??’
চাপা কন্ঠে আনাস বললো,’ আরে না ভাই।আমার জুতো নেই।যাবো কিভাবে।এমনেই আমার তাড়া সবার থেকে বেশি।বুঝসনা।’
আনাস চোখ মারলো।রিঝ বিরক্ত হয়ে বললো,’ তোর ছোট ভাই আমি।একটু তো লজ্জা কর।’
‘ আসেনা।’
‘ কি আসেনা??’
‘ লজ্জা।’ আনাস দাঁত বের করে হাসলো।রিঝ চারপাশে খুঁজে দেখলো।একটা পর্যায়ে না পেয়ে সবাইকে প্রশ্ন করা শুরু করলো।বাড়িময় একটা হৈচৈ পড়ে গেলো।নতুন জামাইয়ের জুতো চুরি গেছে!এই স্নোগান ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।আনাসই নিজের জুতোর সন্ধান দিয়ে বললো,’ জুতো আমার শালিকারা চুরি করেছে।লুচি তোমার বোনেরা যে চোর আগে বলবে না?সাবধানে রাখতাম।’
রুচিকা রেগে বাম হাতের কনুই দিয়ে ধাক্কা দেয় পেটে।তুতুল রাগ দেখিয়ে বললো,’ ভাইয়া একদম চোর বলবে না।তা হলে তোমার বউকে এই বাড়ি থেকেই যেতে দিবো না।’
‘ কি চাই বলিয়া দেও শালিকারা।বউ আমার চাই।আর জুতোও। খুব পছন্দের তো।ভবিষ্যতে ছেলের বিয়েতে আর জুতো কিনতে দিবো না।শুধু শুধু টাকা নষ্ট।এটা দিয়েই চালিয়ে দিবো।তাই খুব প্রয়োজন।তা না হলে খালি পায়েই দৌড় দিতাম।বাসা তো এখানেই।’
‘ বেশি কিছু না বিশ হাজার দিলেই ছেড়ে দিবো।’
আনাস একপাশে কাত হয়ে পড়ে।চিৎকার করে বলে উঠে,’ ইয়া মাবুদ।এতো!!’
তর্কের একটা ঝড় বয়ে যায়।রিঝ বলেছিলো জুতো বাসা থেকে একটা এনে দিবে।কিন্তু আনাসের এক কথা সে এই জুতো ছাড়া যাবে না।অন্যদিকে টাকাও সে দিবে না।রুচিকা রেগে আস্তে করে বললো,’ কিপটামি ছাড়বে না তুমি তাই তো?’
‘ কিপটামির কি দেখলা তুমি?’
‘ আমার বোনেদের সাথেও কিপটামি??ছিঃ।টাকা দিয়ে দেও তাড়াতাড়ি।’
‘ টাকা কি গাছে ধরে।বলছি তো একশো দুইশো চাইলে দিতামই।এর বেশি নাই।’
‘ হাড় কিপ্টা।’
এবার রুচিকাও জেকে বসে।সে যাবে না।টাকা না দিলে।তুতুলের আম্মু তার পিছনে এসে বললো,’ জুতো দিয়ে দেও।টাকা আমি দিবো।’
‘ আম্মু তুমি মাঝে পড়ো কেনো?যাও তো।টাকা তো ভাইয়ার কাছ থেকেই নিবো।’
কথা কাটাকাটির মাঝে রিঝের মনে পড়ে জুতো!সে তো তাদেরই বাসায়।তুতুল যে ঝুড়ি দিয়েছিলো সেই ঝুড়িতেই!তুতুলের দিকে তাকায়।তুতুলও তার দিকেই তাকিয়ে আছে।হালকা বাঁকা হাসতেই তুতুল বুঝতে পারে উনি বুঝে গেছে।রিঝ দৌড় দেওয়ার আগেই তুতুল গাউনের নিচের লম্বা অংশ তুলে দেয় এক দৌড়।কেউ কিছু বুঝলো না।সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে দুজনের দৌড়ের দিকে।তুতুল হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,’ ভাইয়া আগেই বলছি ভালো হবে না কিন্তু।’
‘ কি ভালো হবে না?আমার ভাইয়ের জুতো চুরি করে আমার বাসায়ই রেখে এসেছো??কি বুদ্ধি ভাবা যায়।এসব বুদ্ধি কোথায় লুকিয়ে রাখো?’
‘ দেখুন জুতোটা কিন্তু আমার।টাকা না দিলে জুতো দিবো না।শেষ কথা।’
‘ তুমি তো লাগই পাও না।জুতো নিবে কিভাবে।আগে আমার সমান হও তারপরে কথা বলতে আসবে হুহ।’
স্টোর রুমের মাকড়সার জাল তুতুলের কোঁকড়া তুলে জড়িয়ে পড়ে।গায়ে লাগে ধূলোবালি।লম্বা তাকের কাছে আসতেই সে দেখলো সত্যি অনেক উঁচু।ভাঙ্গা চেয়ার রাখে তাকের সামনে।তারপর কাঁশতে কাঁশতে উঠে দাঁড়ায়।বালি উড়ছে চারপাশে।ঝুড়িতে হাত রাখতেই চেয়ার মটমট করে ভেঙ্গে পড়ে।তুতুল পড়েই যাচ্ছিলো।রিঝ দু হাতে কোমড় পেঁচিয়ে উঠায়।দীর্ঘ হাসিতে ফেটে পড়ে।অন্ধকার,ধূলোবালির ঘরময় সে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।তুতুলের চোখ বন্ধ ছিলো।সে তো ভেবেছে পড়ে যাবেই।ঠোঁটজোড়া কানের কাছে লাগিয়ে রিঝ বললো,’বাহ্ তোমার কোমড় তো খুব পাতলা মিশ্রণ।’
তুতুল চমকে উঠে।দুটি চোখের পাতা দ্রুত খোলে।অন্ধকারেই দেখা যাচ্ছে দুটি চোখ।হাসি।লোকটা হাসে একদম মুগ্ধ করার মত।হাতের ঝুড়ি উপর থেকে ছেড়ে দিতেই ফুল ফল সব গায়ে পড়ে।একটা আপেল পড়ে নিজের কাঁধে।ব্যথায় একটা শব্দ করেই বললো,’ ফুল রাখলেই পারতে।ফল রাখতে কে বলেছে ইডিয়েট।’
‘ ঝুড়িটায় এগুলো আগে থেকেই ছিলো।আমি কিছু আলাদা করে রাখিনি।এবার নিচে নামিয়ে রাখুন আমি যাবো।’
‘ এতো তাড়া কিসের!’
রিঝ তুতুলের গলার পাশ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেয়।গলার রগ নড়ে উঠে।কেমন যেন করে তাকায়।আরো কাছে টেনে নেয়।ফিসফিসিয়ে নিচু কন্ঠে বলে,’ ভয় পাচ্ছো?’
তুতুল অপ্রতিভ হয়ে উঠেছে।লজ্জায়,আড়ষ্টতায় সারা শরীর তীব্র গরমে ঘামছে।রিঝ হাতের বাঁধন শক্ত করে।অনুভব করতে পারছে তুতুল কাঁপছে।বুকে হাতুড়ি পিটা হচ্ছে।রিঝ একটু শব্দ করেই হাসলো।লাল গালে ঠান্ডা হাতটা রেখে মিনমিনে গলায় বললো,’ আমি একটু চুমু খাই?’
এটি যেন প্রশ্ন নয়।বজ্রপাতের মত কোনো শব্দ।ভয়ংকর শুনতে।তুতুলের গলা শুকিয়ে কাঠ।কাঁপা কাঁপা গলায় সে বললো,’ কি সস সব বব বলছেন?ছাড়ুন।আ আমি যাবো।’
রিঝ খুব উপভোগ করছে।তার হাতের বাঁধনে ছটফট করছে একটি পাখি।তার উত্তেজনায় লাল হয়ে আসা একটা গাল তার হাতে।ছোট একটা শরীর।শক্তি দিয়ে ছাড়াতে চাইছে তার বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন থেকে।একটা কোমল ঠান্ডা ঠোঁটের স্পর্শ লাল গরম গালে পড়তেই আঁতকে উঠে তুতুল।পায়ের পাতা কেমন যেন শিরশির করে উঠে।সে যেন দাঁড়াতে পারছে না।খুব কষ্টে নিজেকে সামলে বললো,’ কে যেন আছে।’
রিঝ কিঞ্চিত হেঁসে আবার একটা ছোঁয়া বসিয়ে দেয় আর একটা গালে।তুতুল বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!গলায় কথা আঁটকে আছে।রিঝ গলার এক পাশে হাতের কোমল স্পর্শ আঁকতে আঁকতে বললো,’ মানুষের একটা নীতি আমার ভালো লাগে না।প্রশ্ন করো কি নীতি?’
কথা বলতেই ভুলে গেছে তুতুল।প্রশ্ন কিভাবে করবে।রিঝ পাতলা সরু কোমড়ে হালকা চাপ প্রয়োগ করতেই সম্বিৎ ফিরে তার।তীক্ষ্ন চোখে তাকায়।ক্ষীন গলায় বললো,’ কেউ এসে যাবে ছাড়ুন।’
‘ এই যে এই নীতিটাই আমার পছন্দ না।’
‘ কিসের নীতি?এখানে নীতি পেয়েছেন কোথায়?ছাড়ুন।’
লজ্জায়,উত্তেজনায় তুতুলের ইচ্ছে করছে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে।সে যেমন কথায় কথায় কাঁদতে পারে তেমন করেই কেনো সেন্সলেস হয়ে পড়তে পারে না?ইশ্ যদি পারতো।তাহলে এই লজ্জাজনক পরিবেশকে ছাপিয়ে সে সামনের মানুষটার বুকে লুটিয়ে পড়তো।রিঝ জানালো,’ মানুষের নীতি বড় বিচিত্র।আমার সাথে খুব কম মিলে।হয় তো আমি মানুষ না।’
রিঝের এমন উদ্ভট কথায় তুতুল ফিক করে হেসে দিলো।ভয় ভয় অনুভুতি এখন হচ্ছে না।রিঝ ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিলো।অন্ধকারে তুতুলের চোখে পড়লো না।রিঝ প্রশ্ন করে,’ হাসলে কেনো?’
তুতুল ভেবে ভেবে বললো,’ এমনেই হেসেছি।আপনি ছাড়ুন।জুতো না পেয়ে ভাইয়া যদি চলে আসে??তাহলে আমি লস খাবো।’
‘ আর তোমাকে ছেড়ে দিলে তো আমার হৃদয়ে বড় লোকসান হয়ে যাবে।’ তুতুল আবার অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।রিঝ হাসে।আবার বলে,’ মারামারি জিনিসটা খারাপ।এই কাজটা করা উঁচিত লুকিয়ে।অবশ্যই খারাপ কাজ লুকিয়ে রাখার মত।কিন্তু মানুষ কি করে?মারামারি করে সবার সামনে।রাস্তাঘাটে,পাড়ায়,মহল্লায় যেখানে সেখানে।একে অপরকে মেরে হাত পা ভেঙ্গে দেয়।ফাটিয়ে দেয় মাথা।অথচ দেখ স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা হচ্ছে পবিত্র জিনিস।সেই ভালবাসা দেখায় লুকিয়ে।বন্ধ দরজার আড়ালে।এসব ফালতু নীতি আমি মানতে পারছি না।তাই কেউ দেখলেও আমার কিছু যায় আসে না।বুঝলে বউ।’
‘ বউ’কথাটা কানে যেতেই কানজোড়া গরম লাল হয়ে উঠে।যেন ধোয়া বের হচ্ছে।তুতুল লজ্জামাখা হাসি দেয়।রিঝের চোখের আড়াঁলে রয়ে যায় সে হাসি।হঠাৎ রিঝ সুর পাল্টে বললো,’ জুতো তো দেওয়া যাবে না বউ।’
‘ কেনো দেওয়া যাবে না?’
রিঝ এক হাতে কোমড় জড়িয়ে বাকি হাতে নেয় জুতো।তুতুল হাত বাড়িয়ে নিতে চায়।লাফালাফি ঝাপাঝাপি সব করে কিন্তু হাতের নাগালে পাচ্ছে না।একটা সময় ক্লান্ত হয়ে সে বললো,’ প্লিজ রিঝ ভাই আমি তো আপনার বউ।বউয়ের ক্ষতি করা তো উঁচিত না।জুতো দিয়ে দেন।’
‘ ওরে আমার ভালবাসার বউরে…কত মিষ্টি সুর তোমার।’
রিঝ হাসতে লাগলো।তুতুল ঠোঁটজোড়া উল্টে নিলো।রিঝ আবার বললো,’ শর্ত আছে।’
চোখমুখ উজ্জ্বল করে তুতুল বললো,’ রাজি।বলেন দ্রুত।সবাই অপেক্ষা করছে।’
‘ রাজি! না শুনেই?গুড।’
‘ হেয়ালি না করে বলুন।’
‘ আমার রিটার্ন চাই।’
‘ মানে?’ অবাক হয়ে বললো তুতুল।
‘ এই যে পর পর দুটো চুমু দিয়েছি।আমারও তো প্রাপ্য আছে।’
তুতুলের লজ্জায় মরিমরি অবস্থা।সে আর কিছু বলতে পারলো না।রিঝ বললো,’ কি হলো?কথা কানে আসছে না কেনো?’
তুতুল নিশ্চুপ।মাথা নতজানু করে রেখেছে।
‘ জুতো চাই না??’
‘ চাই।’
‘ তো অপেক্ষা কিসের।দেও।’
‘ সত্যি সত্যি দিবো?’
‘ মিথ্যা হতে যাবে কেনো?’
তুতুল ভয়ে ভয়ে বললো,’ আমি পারবো না।’
‘ এতে না পারার কি আছে?ভাইয়া ডাকলেই তো আমি তোমার ভাইয়া না।আমি কি তা তো জানাই আছে।দ্রুত।’
তুতুল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,’ আচ্ছা ডান গালে দিবো।’
রিঝ ভারী আশ্চর্য হয়ে বললো,’ গালে চেয়েছে কে?’
‘ মানে?’
‘ গালে হবে না।’
রিঝ হাসছে।শব্দ বিহিন সেই হাসি তুতুল ধরতে পারে।মুখটা কাছে এগিয়ে নেয়।রিঝ হতচকিয়ে যায়।সত্যি দিবে ভেবে আগ্রহে চেয়ে থাকে।তুতুল চেঁচিয়ে উঠে,’ কাকিআম্মু!
রিঝ ভড়কে যায়।দুটি হাত হালকা হতেই সে জুতো কেঁড়ে নিয়ে দেয় এক দৌড়।রিঝ কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তারপর আপন মনে হাসে।পিছনে ছুঁটতে ছুঁটতে বলে,’ প্রতারক একটা।দাঁড়াও।’

নিচে নেমে আসতে আসতেই দেখে রিঝদের বাসার কাজের মেয়েটা খুব চিন্তিত হয়ে ঘরের দিকে দৌড়ে আসছে।তুতুল দ্রুত কাছে যায়।প্রশ্ন করে,’ কি হয়েছে??’
মেয়েটা উত্তেজিত গলায় বললো,’ নতুন ভাবীর ছোড বইন আছে না??কি যেনো নাম??’
‘ আরোহি। তুতুল বললো।
‘ হ হ হেই মাইয়া ছুরি দিয়া নিজের হাতের রগ কাইডা হালাইছে।এহন অবস্থা খারাপ।খালাম্মা ভাইজানরে ডাকতে কইছে।হাসপাতালে নিছে।খালাম্মাও যাইবো।’
রিঝ উপর থেকেই শুনতে পেলো।তুতুলের চোখে কটোর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।রিঝ কয়েক পা কাছে আসে।আবার প্রশ্ন করে।শুনে।তুতুলের হাত থেকে পরে যায় জুতো।মুখের উপরে দুটি হাত রেখে সে আঁতকে উঠা কন্ঠে উচ্চারণ করে,’ আরোহি সুইসাইড এটেন্ড করেছে!!
রিঝ নিজেও বিস্মিত।কম বয়সি মেয়ে গুলো কি পাগল?হতেই পারে।এই মেয়ের মাথায় প্রবলেম আছে সে জানে।কিন্তু এতো বেশি জানতো না।কি থেকে কি হয়েছে যে সুইসাইড করতে চলে গেছে।কিছুই বুঝতে পারল না সে।তুতুল দৌড়ে বাড়ির বাহিরে চলে যায়।রিঝ থামতে বলে।কিন্তু সে শুনে না।রিঝ নিজের রুমে যায় চাবি খুঁজতে।
কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৪০.🎈
@হাফসা আলম
_____________________
হসপিটালে বউ বেশে দাঁড়িয়ে আছে রুচিকা।তার ছোট বোনটা।ভাবতেই বুকের সব গুলো হাড়ে ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার।দুজনের মাঝে ঝগড়ার সম্পর্ক থাকলেও ভালোবাসাও ছিল অনেক।এই কাজটা কেনো করলো সে বুঝতে পারছে না।বিয়ের মতো আনন্দে শোকের ছাঁয়া এসে পড়েছে।ডাক্তার এসে বলেছে এখন ভালো আছে।দেখা করতে পারবে।রুচিকার বিদায়ের সময় আলভী ছুঁটে এসে বলেছিল আরোহি সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।হাতে রক্ত!ধারালো ছুরি!সুইসাইড করতে চেয়েছে।সবাই ছুঁটে যায়।দেখে,সে পড়ে আছে বিছানার উপরে।নীল চাদরে রক্তের ছড়াছড়ি।দ্রুত হসপিটালে নিয়ে আসা হয়।রিঝ,আয়েশা,তুতুল আসে এক সাথে।কেবিনে ঢুকে দেখে আরোহি কাঁদছে।রুচিকা পাশে বসা।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সে প্রশ্ন করছে,’ কি হয়েছে আমাকে বল।শুনি।কেনো এমন করতে গেলি বোন আমার??’
আরোহি কথা বলে না।রিঝ তুতুলের পাশে দাঁড়ায়।তুতুল নিচু স্বরে বললো,’ কেনো এমন করেছে বলতে পারেন??’
‘ সবটা সময় জুড়ে আমি তোমার সাথে ছিলাম।আমি কিভাবে জানবো?’
আরোহি কারো সাথে কথা বললো না।সে কাঁদছে।ফুঁফানোর শব্দে রুমটা ভয়ংকর ভাবে কম্পিত হচ্ছে।কিছুক্ষণ সবাই নিরব থেকে আরোহির দিকে তাকিয়ে রইলো।হঠাৎ কি যেন হলো।আরোহি চেঁচিয়ে উঠে বললো,’ তুতুল তুই যা আমার সামনে থেকে।’
সবাই চমকে উঠে পিছনে একবার তুতুলের দিকে,আবার আরোহীর দিকে তাকালো।রিঝ কঠিন চোখে পর্যবেক্ষণ করছে সব।সে বুঝতে চাইছে এমন ব্যবহারের কারণ কি?তুতুল এগিয়ে এসে কিছু বলতে চাইলো।তার আগেই আরোহী আরো চিৎকার করে বললো,’ তুই অনেক খারাপ আপু।এতো খারাপ আমার জানা ছিলো না।আমার পছন্দ করা ছেলেকেই কেনো??তোর জন্যে কি ছেলের অভাব পড়েছে?ইয়াজ ভাইয়া তো ফিরে এসেছে।উনার সাথে প্রেম কর।যত খুশি কর।আমার জন কেনো তোর চাই?সামনে থাকে যা তো।তোরে দেখলেই গায়ে আগুন জ্বলে।’
আমিনা নিজের ভাইয়ের দিকে তাকালো।কয়েক সেকেন্ড তিনি তাকিয়ে দেখলো।তার ভাই কিছু বলছে না দেখে রেগে বললেন,’ ভাইজান আপনি কিছু বলছেন না কেনো??এসব কি বলছে আরোহী?ওর সমস্যা কোথায়?আমার মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলার অধিকার কোথায় পেয়েছে ও?প্রথমত এতো বড় একটা কাজ করেছে।তারপরে আবার তুতুলের সাথে বাজে ব্যবহার করছে?মাথায় সমস্যা আছে না কি?ছোট বলে সব ছাড় দিবেন নাকি?’
আরোহীর বাবা বোনকে টেনে নিয়ে যায় পাশে।ফিসফিস করে বলে,’ দেখ মেয়ের কিছু একটা হয়েছে।তাই এসব বলছে।সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেনো?তুই তো জানছ তোর ভাইজি কেমন।এসব বলার মেয়ে ও না।বড় কিছু হয়েছে।তাই এমন করছে।কিন্তু তুতুলের সাথে কি হলো বুঝতে পারছি না।’
‘ দেখো ভাইয়া আমি এসব বুঝি না।আরোহী আমারও মেয়ের মতো।সুইসাইড কেনো করতে চেয়েছে তা জানি না।ধরলাম কিছু বড় হয়েছে।কিন্তু এসবের মাঝে আমার মেয়েকে কেনো টানছে?আশ্চুর্য!’
মিসেস আমিনা বেশ উঁচু গলায় কথা গুলো বলেছে।তুতুল ঘামছে।শুধু শুধু।কোনো কারণ ছাড়া!আরোহী পাগলের মতো এক গাল হেঁসে বললো,’ তুই নিজেই বলেদে আপু।তুই কি করেছিস?’
তুতুল বিস্মিত কন্ঠে বললো,’ আমি কি করেছি??’
‘ সাধু সাজতে হবে না।তুই যতটা ভোলা সাজতে চাচ্ছিস ততটা ভোলা তুই নস।তুই কেনো আমার পছন্দের ছেলের গলায় ঝুলতে চাচ্ছিস??কেনো??’
আনাস প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললো,’ পছন্দ পছন্দ বাদ দিয়ে বলবে কে তোমার সেই পছন্দের ছেলে??যার জন্য মরতে চলে এসেছো??’
আরোহী ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে বললো,’ রিঝ!সেই আমার পছন্দের ছেলে।কবে থেকে যে তাকে পছন্দ করি বলে বুঝাতে পারবো না।তুতুল আপুকে কালকে বলেছি উনাকে বলতে আমার মনের কথা।কিন্তু সে আমার কথা না বলে স্টোর রুমে বসে বসে প্রেম করছিলো।ছিঃ।’
শেষ কথাটা সবার কানেই খুব বাজে শুনালো।রিঝ হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো।চোখ বন্ধ করে দাঁতে চাপলো দাঁত।তুতুল এক পলক তাকিয়ে দেখলো।কিছু বললো না।মাথা নিচু করে রইলো শুধু।অবাধ্য কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার চোখ বেয়ে।সাথে সাথে উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে নিলো সেই নোনা জল।আরোহী আরো অনেক কিছু বলে।কিভাবে রিঝেদের বাসায় যায়।দেখে তারা এক সাথে।খুব রসিয়ে রসিয়ে সময় নিয়ে সে কথাগুলো বলে।যোগ করে অনেক অজানা,অঘঠিত আজেবাজে কথা।তাকে এখন অসুস্থ মনে হচ্ছে না।খুব সুস্থ ভাবেই বলছে।যেনো অন্যের চরিত্র নিয়ে কথা বলার মত মজার কাজ এই পৃথিবীতে আর নেই।কথা শেষ করে সে যখন নিজের জন্য আফসোস করতে শুরু করলো ঠিক তখন আয়েশা রহমান মুখ খুলো।তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে আরোহীর বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ এ আপনাদের ছোট মেয়ে??বড় মেয়েও কি এমনই??’
রুচিকার আত্না কেঁপে উঠে।বোনের বোকামির জন্য নিজের ভালোবাসা না বলিদিতে হয়।আনাসের হাতের বাহু শক্ত করে ধরে।আনাস খুব রেগে যায়।তার ভাইয়ের সম্পর্কে এসব বলার সাহস হয় কিভাবে?সে কি মেয়েবাজ না কি?রুচিকার দিকে খুবি কাঠিন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে।আরোহীর বাবা মা তুতুলের দিকে এমন ভাবে তাকালো যেনো সে নর্দমার কিট।তুতুলের মামি স্বার্থপর মহিলা।নিজের সার্থ যেদিকে তিনি ঠিক সেদিকেরই মানুষ।এতো বড় পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতে পেরে তিনি তো আকাশে বাতাসে উড়ছেন।ছোট মেয়েকেও যদি একুই বাড়ির বউ করা যায় মন্দ হয় না।উল্টো ছোট ছেলেটিকে তো অসম্ভব ভালো লাগে।বড় মেয়েকে বলেছিলো,এই ছেলের সাথে কেনো প্রেম করলো না?রুচিকা তখন নিজের মায়ের প্রতি খুব রাগ হয়।কিছু কথাও শুনিয়ে দেয়।রুচিকার মা ভাবছে এই ছেলে যদি তার ছোট জামাই হয়!মহল্লায় তো উনার একটা দাম বেড়ে যাবে।সুদর্শন ছেলে,বুয়েটের ছাত্র,কত ভালো চাকুরী।সব মিলিয়ে তিনিও মেয়ের পক্ষে।রিঝ বাকরূদ্ধ!আরোহীর কথা গুলো এমন যেনো সে আরোহীর সাথে অনেক দিন রিলেশনে ছিলো।এখন তাকে ধোঁকা দিয়েছে।এইটুকু মেয়ে এতো কাহিনী বানিয়ে নিতে পারে?তাও এতো অল্প সময়ে?
আলভী আসে একটু পরেই।তখন রুম জুড়ে নিরবতা।মামি হঠাৎ করে চেঁচিয়ে বললেন,’ তুতুল তুই এতো খারাপ আমার তো জানা ছিলো না?তলে তলে এতো?ছেলে দেখলেই হলো।গায়ে পড়া লাগে?’
রাগে অপমানে তুতুলের দু’পাশের গাল থরথর করে কাঁপছে।এই প্রথম এতো কড়া কথা শুনেও তার চোখে অঝরে কান্না আসছে না।ক্রদ্ধে ফেটে পড়ছে সে।লাল বর্ণ ধারণ করছে চোখ।আলভী মামির কথার কিছুই বুঝলো না।আদ্রিতা পিছনে ছিলো।আলভী পাশে এসে জিজ্ঞেস করে,’ কি হয়েছে?’
সবটা খুলে বলে সে।রগ চটা আলভীর রগ আরো বেঁকে বসে।চিৎকার করে সে বললো,’ আরোহী তোর সাহস তো কম না।এসব আজেবাজে কথা বলার সাহস হয় কি করে তোর?ঠাটিয়ে গাল লাল করে দিবো বেয়াদপ।’
আরোহীর মা মুখটা বাঁকা করে নেয়।বিশ্রী ভঙ্গীতে বললেন,’ তোর বোন সাধু না।সাধু হলে কি আর বিয়ে ভাঙ্গতো।এসব মেয়েকে চিনা আছে।রক্ত’
‘রক্তের একটা দোষ আছে না’ কথাটা বলতে চেয়েও বললেন না।আমিনা যেমন করে তাকিয়ে আছে তাতে তিনি ভয় পেয়ে গেলো।ঢোক গিলে চুপ করে রইলেন।আলভী খেঁপে গিয়ে আরোহীর কাছেই যাচ্ছিলো।রিঝ থামিয়ে বললো,’ ওয়াও সবাই তো এক একজন ড্রামাবাজ।স্যরি ভাই তবুও বলছি তোর মতো মানুষ চিনতে পারা ছেলে কিভাবে এমন ফ্যামেলি খুঁজে বের করলি?হাউ?’
আনাস খুব রাগী চোখে তাকালো রুচিকার দিকে।রুচিকা ছোট হয়ে গেছে।বাবার দিকে অসহায় চোখে তাকায়।তার বাবা মেয়ের হয়ে বললেন,’ দেখো বাবা সবাইকে এক পাল্লায় মাফতে যাও কেনো?আর যদি আমাদের ফ্যামিলিই খারাপ হয় তাহলে আলভী তুতুলও আমাদের ফ্যামেলির।কথা বলতে সাবধানে বলো।তোমরা নেহাত আলভীর বাবার বন্ধুর পরিবার।তাই সম্মানটা বেশি দেখাচ্ছি।সবাই এখন আত্নীয় হই।মনে রেখো কথাটা।’
রিঝ অদ্ভুত ভাবে হাসলো।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,’ খারাপ তো তাদের পরিবারের মেয়েকেই বলছেন।তাও আপনারা।এখন আবার নিজেদের তাদের ফ্যামেলি বলছেন?সত্যি আপনারা তারিপের যোগ্য।বাই দ্যা ওয়ে আরোহী তোর সাথে কি আমার রিলেশন ছিলো??’
আরোহী থতমত খেয়ে গেলো।সব কথা ঠেকরে যে তাকেই প্রশ্ন করবে সে ভাবেনি।ভয় পেয়ে যায়।হুট করে প্রশ্নটা কানে আসায় সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।তার উপরে আবার তুই করে ডাকছে।রিঝ অসম্ভব জোরে চেঁচিয়ে বললো,’ উত্তর দে?’
আরোহী ভয়ে কান্না করতে করতে বললো,’ না।কিন্তু আপনি তো আমাকে পছন্দ করতেন।মাঝে তুতুল আপু চলে এসেছে।’
‘ সেট আপ।বেয়াদপ মেয়ে।তোকে আমি পছন্দ করি কে বলেছে??স্কুল লাইফের বা কলেজ অথবা ভার্সিটির কোনো মেয়েই এটা বলার সাহস করেনি।তুই কিভাবে করলি?আর কি দেখে মনে হলো আমি তোকে পছন্দ করি??হ্যাঁ আমি কোমড় জোড়িয়ে ছিলাম।চুমুও খেয়েছি।আরো অনেক কিছু করেছি।সমস্যা??’
রিঝের শেষের কথা গুলো শুনে সবাই ভুত দেখার মতো চমকে উঠে।তুতুল নিজেও অবাক।হাত পা কাঁপছে তার।
‘ কি?সবার এভাবে তাকিয়ে থাকার মনে আমি বুঝলাম না।’
রিঝের সহজ গলা।আয়েশা রহমান বাদে সবার মধ্যে একটা ভয়ংকর অবস্থার জন্ম হয়েছে।আলভী তো সোজা রিঝের কলার চেপে ধরে।রিঝ এবার শান্ত স্বাভাবিক।তাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছে না।তুতুলের কপালে ঘাম।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সে ঘাম মুছতে ব্যস্ত।গলা শুকিয়ে চৌচির।রিঝ দু হাতে আলভীর হাত ঝেড়ে ফেলে।যতটা স্বাভাবিক থাকা উঁচিত তার চেয়েও দ্বীগুন স্বাভাবিক থেকে সে বললো,’ আমার বাবা যদি আমার মায়ের কোমড় ধরে বা চুমু খায় তাহলে কি আমার মায়ের ভাই এভাবে কলার ধরবে??না কি তোর বাবা যদি তোর মায়ের সাথে এমন করে তোর মামা কলার ধরবে?তুই সারাটা জীবন এমনই থাকবি ঠিক করলি না কি?বলদ।’
আলভী ঝাঝালো কন্ঠে বললো,’ বাবা মায়ের ব্যাপার আলাদা।তোর সাহস কিভাবে হলো আমার বোনের সাথে এমন করার??কিভাবে??ও তো তোরও বোন।’
‘ ওই গরু পৃথিবীর সব মেয়ে যদি বোন হয় তাহলে তো আর তোর বাপ তোর মাকে পেতো না।কারণ সেও বোন হতো।তোর বোন ছাড়া দুনিয়ার সব মেয়ে আমার বোন।আচ্ছা বাবা মায়ের চাপ্টার বাদ।আমার ভাই যদি রুচিকার সাথে এগুলো করে তখন কি তুই ওর কলার ধরবি??’
‘ দেখ ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিস না।’
‘ তোর ধৈর্য্য শূন্যের কোটায়।পরীক্ষা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
‘ রিঝ!’
‘ চিৎকার করছিস কেনো?এটা হসপিটাল।উত্তর দে।তুই কি ভাইয়ার কলার ধরবি??’
‘ ওই শালা ওরা হচ্ছে বিয়ে করা হাজবেন্ড ওয়াইফ।ওদের এসবে আমি কেনো যাবো??ওদের মধ্যে এসব হালাল।কিন্তু তুই …’
‘ ইয়েস।এটাই বুঝাতে চাচ্ছি।আমি যা করেছি হালাল।আমার বউ।আমার যদি ইচ্ছে করে ওর কোমড় ধরতে ধরবো।যদি ইচ্ছে করে কোলে নিতে নিবো।যদি ইচ্ছে করে কিস করতে করবো।তোর বা আমার কারো বাপের কিছু যায় আসে না এতে।শুধু শুধু শার্টটা নষ্ট করে দিলি।আমেরিকান ক্লাইন্ট এব্রব দিয়েছিলো এটা।বাংলাদেশি মূল্য দশহাজার তিনশত টাকা।তুই নষ্ট করে দিলি।ধ্যৎ।’
রিঝ নিজের শার্টে পড়া শক্ত হাতের মুঠো ভাজ ঠিক করতে লাগলো।সবাই স্তব্ধ।হতবাক।কারো মুখে কোনো কথা নেই।শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ গুলো ছুটে বেড়াচ্ছে।সবাই তাকিয়ে আছে তুতুলের দিকে।তুতুল মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে।ভয়ে উত্তেজনায় কথা বলতে ভুলে গেছে সে।সবাই প্রশ্ন করবে এখন।সে কি বলবে??পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে তুতুল ফ্লোর খোঁচাচ্ছে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ন্য কাজ এই পৃথিবীতে আর কিছু নয়।রিঝ কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।তুতুলের বরাবর দাঁড়িয়ে পরে।বাম হাতটা বাড়িয়ে তুতুলের পিঠময় ছড়িয়ে বাহুতে রাখে।শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এক হাতে।খুবই দাপুটে ভাব দেখিয়ে বললো,’ সি ইজ মাই ওয়াইফ।আমার বউ।ক্লিয়ার সবার কাছে?’

সামনের বড় রুমটা জুড়ে কিছু থমথমে চেহারা।কেউ এখন বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারলো না।প্রশ্নের ছোটখাটো বন্যা বয়ে চলেছে সবার মনের মধ্যে।আলভীর মনে প্রশ্ন থাকলেও চোখে আছে অধম্য অবিশ্বাস।সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না তার বোন তাকে,কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে??তাও রিঝকে??কিভাবে সম্ভব?মাথায় কিছু ঢুকছে না।সবার মাঝে একটা চাপা উৎকন্ঠা কাজ করছে।ঘরে আলো নেই।অন্ধকার।ছোট ভাইজানের বিয়ে হয়ে গেছে।তাও বড় ভাইজানকে টুপকে।এটা ব্রেকিং নিউজ হয়ে ঘুরছে চারদিকে।উপরের দিকটায় আলো আছে।সেই আলোর ছোপ ছোপ রেশ এসে পড়ছে দু’একজনের চোখে মুখে।আয়েশা রহমান বউ বরং করতে গিয়েও করলেন না।কি আর করবেন?বউ আগেই ঢুকে পড়েছে।দোষটা তার নয়।সবার মাঝে যে টান টান উত্তেজনা কাজ করছে তা তাকেও ঘ্রাস করেছে।তাই ওতো ভাবেনি।যে এটা তার সদ্য হওয়া শ্বশুরর বাড়ি।আয়েশা রহমান হাক দিয়ে কাজের লোকগুলোকে জড়ো করলেন।রাগি একটা স্বর ছেড়ে বললেন,’ তোরা ঘরের আলো জ্বালাচ্ছিস না কেনো?যা আলো জ্বলা।’
তাদের মাঝে একজন বললো,’ খালাম্মা এখন তো ছোডো ভাইজানের বিয়ার গল্প হইবো।হুনমু সবাই মিল্লা।অন্ধকারেই হুনি?ভালা লাগবো।’
আয়েশা রহমান খুব বিরক্ত হয়ে বললেন,’ ফাইজলামি পাইছোস সবাই মিলে?যা আলো জ্বালা।’
তাদের মধ্যে কেউ একজন দৌড়ে ছুঁটে গেলো।ঠাস করে শব্দ হলো।ফুলদানি ভেঙ্গে ফেলেছে।আয়েশা রহমান বুঝতে পেরে নিজেই উঠে গেলেন।কয়েকটা লাইট জ্বলে উঠে দ্রুত।মেয়েটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।যানে আয়েশা রহমান বকা দিবেনা।এটা ফরমালিটি মাত্র।কিছু ভেঙ্গে ফেললে ভদ্রতা দেখাতে হয়।রিঝ রয়ে সয়ে খোশ মেজাজে নিজের ঐতিহাসিক বিয়ের সেই মারাত্নক কাহিনী সবাইকে শুনায়।সব শুনে সবাই আরো কয়েক ধাপ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।হতভম্ব হয়ে যায়।রিঝ সোফার গায়ে হেলান দেয়।ডিরেক্ট তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,’ বাবা আমার বিয়ের কাহিনী শুনে তোমার কেমন লাগলো?’
তুতুল কাঁশতে শুরু করে।আলভী পানি দেয়।রিঝ ভ্রু কুঁচকে বললো,’ তোর বোনরে মাফ করে দিলি??ভুলে গেলি না বলে বিয়ে করে নিয়েছে??’
আলভী আগুন চোখে তাকায়।বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,’ ওর দোষ তো দেখছি না।’
রিঝ ভারী অবাক হলো।যেনো ভয়ংকর কিছু একটা বলে দিয়েছে আলভী।এমন ভাব নিয়ে সে বললো,’ কি বললি??দোষ নেই??’
‘ না নেই।’ আলভীর সহজ গলা।রিঝ দুই হাত এক করে মাথায় ঠেকায়।তারপর বলে,’ তোর বোন মদ খেয়ে মাতলামু করেছে।তোর মনে হচ্ছে সে নির্দোষ??বাহ্ কি নীতি তোর।ওই দিকে নিজের বউয়ের কোমড় ধরেছি বলে কলার ধরলি??’
তুতুল আড়চোখে নিজের বাবা মায়ের দিকে তাকায়।তারা একটু লজ্জিত।লজ্জারই তো কথা।কোমড়,চুমু এগুলো বার বার বলার কি আছে?তুতুল এতক্ষনে কথা বললো,’ সমস্যা কি আপনার??কথায় কথাই ওসব না বললে হয় না?’
রিঝ চোখ ঘুরিয়ে পূর্ন্য দৃষ্টি মেলে তুতুলের দিকে তাকায়।দারুন ভঙ্গীতে চুল সরিয়ে নেয় কপাল থেকে।ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে চশমাটা একটু উঁচিয়ে বললো,’ কিসব না বললে হয় না??’
তুতুল আবার চুপ করে গেলো।তুতুলের বাবা বললেন,’ তুতুলকে আমাদের একা ছাড়াই উঁচিত হয়নি।’
আলভীও তালমিলিয়ে বললো,’ আমি তো দিতেই চাইনি।’
রিঝের বাবা খুব খুশি হয়ে বললেন,’ যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয়ে গেলো।’
রিঝ হেসে উঠে নিজের বাবার ডান হাতের তালুতে তালি মেরে বললো,’ সবার মাঝে তুমি গ্রেট কথা বলেছ।বুঝতে হবে আমার বাবা।’
তুতুল যত দেখছে ততো অবাক হচ্ছে।বিস্ময় ধরে রাখতে না পেরে সে বললো,’ আপনি সবার সাথে এতো মজা করে কথা বলছেন??আপনি??কিভাবে সম্ভব??’
‘ বউয়ের প্রেমে পড়লে সব সম্ভব।কি বাবা আই এম রাইট?’
উচ্চ শব্দে হাসির ঝড় নামে।তুতুল নিজের বাবা মায়ের দিকে তাকাতে পারছে না।আলভী কৌতুহলি হয়ে বললো,’ তুই আর প্রেম পড়া??তাও আমার বোনের??মাথা ঠিক আছে??’
আনাস এখানে বড় ভাসণ দেয়।প্রথম থেকে বলে।সেই ছোট বেলা থেকে।কিভাবে অপছন্দের মানুষটার প্রতি তৈরি হয়েছিলো অবাধ্য ভালোবাসা।আমিনার ভাই ভাবি আশ্চর্য হয়ে সব শুনছিলো।সাথে দেখছিলো সবার প্রতিক্রিয়া।কারো মাঝে তেমন রাগ ক্ষোভ দেখলো না তারা।আরোহী রাগে দুঃখে বললো,’ আমি কিনা বিবাহিত ছেলের জন্য সুইসাইড করতে গেলাম??ছেঃ।’
নিজের প্রতি তার খুব রাগ হচ্ছে।পরক্ষণেই ভাবে কত বাজে কথাই না বলেছে সে।নায়িকা সাজতে গিয়ে ভিলেন হয়ে গেলো।এক বুক দুঃখ, হতাশা তাকে ঘ্রাস করে।সে লক্ষ করছে রিঝকে তার আর ভালো লাগছে না।কেনো??সকালেও এই মানুষটার প্রতি তার ছিলো তীব্র লোভ!পাওয়ার লোভ!কত আকাঙ্খিত মানুষ ছিলো সে।এখন কি হলো??হঠাৎ করে কেনো মনে হচ্ছে বিবাহিত মানুষকে ভালোবাসা উঁচিত না।যা তোমার নয় তার দিকে তোমার তাকাতে নেই।যতটুকু তোমার ভাগ্যে বরাদ্দ আছে তার বেশি তুমি এক বিন্দুও পাবে না।

রিঝ আরোহীকে উদ্দেশ্য করে বললো,’ তোরটা ছিলো পছন্দ মাত্র।ভালো লাগা।যখন আমরা মুভি দেখি তখন অনেক নায়ক নায়িকা আমাদের পছন্দ হয়ে যায়।মনে মনে হাজারো স্বপ্ন আঁকি।এভাবে তার সাথে দেখা হবে।ওভাবে সে আমার প্রেমে পড়বে।বিয়েও হবে।কত কি।কিন্তু যখন সে অন্যের হয়ে যায় তখন তার প্রতি সেই পাওয়ার আগ্রহ কমে যায়।এটা পছন্দ মাত্র।যখন ভালোবাসবি তখন সে যেমনই হোক তার প্রতি ভালোবাসাই আসবে।বাকি ফিলিংস কাজ করবে না।বলদের মতো সুইসাইড করতে গেলি কেনো??সাইসাইড মানে সব শেষ।তুই কি মনে করছিস সুইসাইড করলে তুই যা চাইবি পেয়া যাবি??ভুল ধারণা।জীবন কেড়ে নিবে,ভাঙ্গবে,গড়বে।কিন্তু যদি শেষ করে দিস তখন শেষই হবে যাবে।কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ।’
আরোহী মনোযোগ দিয়ে কথা গুলো শুনলো।তারপর এক রোখা ভাব নিয়ে বললো,’ পারবো না।কন্ট্রোল টন্ট্রোল হবে না।কিন্তু তুমি আমাকে তুই তুই করে কেনো ডাকছো??হইছে বুঝলাম বউ তুতুল আপুই।তবুও তুই করে বলবে না।’
‘ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বউ আর মা ছাড়া বাকি সব তুই আপনি।’
আরোহী ঠোঁট উল্টে নেয়।
রিঝ সহজ কন্ঠে বললো,’ বাবা আমি আবার বিয়ে করতে চাই।’
আলভী বজ্রবেগে ছুটে এসে কলার ধরে বললো,’ আবার বিয়ে করবি মানে কি??হারামখোর খুন করে দিবো।’
‘ তুই কি কলার ধরা ছাড়া কিছু পারছ না??আর আমি হারাম খাই না।সো এটাও আর বলবি না।সম্মানদে।তোর বোনের জামাই আমি।’
‘ তাহলে বিয়ে করবি বললি কেনো??’
‘ ওই গাধা আবার বিয়ে করবো মানেই কি অন্য কাউরে করমু না কি?তোর বোনরেই করমু।কলার ছাড়।’
আলভী কলার ছেড়ে বসলো।রিঝের বাবা হেঁসে বললেন,’ অবশ্যয়।আমার ছেলের সাহস আমার মতই মারাত্নক।শ্বশুরকে ভয় পায় না।শুন আমি যখন বিয়ে করেছি তোর মাকে তখন সবে ভার্সিটি শেষ করেছি।চাকুরী একটা ঠেলে ঠুলে যোগার করেছি শুধু তোদের মায়ের জন্য।অন্যদিকে তোর মা ছিলো আমার দুই বছরের জুনিয়র।একুই ভার্সিটিতে পড়েছি,প্রেম করেছি।তোর মায়ের রূপ আর মেধা দেখে ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার,ক্যাডার সব পাগল হয়ে গেছে বিয়ে করতে।আমার হিটলার শ্বশুর তো তারে বিয়ে দিয়েই দিচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার ধরে।বুয়েটের ছাত্র।ওরে আল্লাহ।’
আয়েশা রহমান ফোঁড়ন কাটলেন,’ খবরদার বলছি বাবাকে একদম হিটলার বলবে না।’
‘ আচ্ছা যাও যাও ডাবল হিটলার।’
চোখ গরম করে আয়েশা রহমান তাকাতেই গলা পরিষ্কার করলেন শাহ আলম।বললেন,’ স্যরি।আর বলবো না।পরের কাহিনী শুন।পরে হইছে গিয়ে আমি সোজা উনার সামনে গেলাম।বললাম,’ দেখেন আপনার মেয়ের যদি বিয়ে অন্য কোনো ছেলের কাছে দেন।তাহলে আমি বাজারে যাবো একটা রিভলবার কিনবো।’ উনি তো মহা খুশি হয়ে বললো,’ এতো কষ্ট করতে যাবে কেনো।বাসায় আছে আমিই দিবো।সুইসাইড করবে তো?ওকে করো।’ এবার তোরাই বল এমন লোক হিটলার নয় তো কি?স্যরি বউ।তারপর শুন।আমি বললাম দরকার নেই।আমি ফ্রিতে কিছু পছন্দ করিনা।রিভলবার কিনে দুইটা বুলেট পুরে নিবো।প্রথমটা দিয়ে আপনার মেয়ের জামাইকে গুলি করবো।তারপরেরটা দিয়ে নিজেকে।মেয়ে প্রেমিকের বিধবাও হবে।জামাইয়ের বিধবাও হবে।হু হা হা।কাজ হয়ে গেছে।শ্বশুর আমার সোজা হয়ে মেয়েরে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলো।বিধবা হওয়ার হলে দুইজনের কেনো একজনেরই হ।আমি ইঞ্জিনিয়ার নই বলে তিনি খুব নাকছিটকে ছিলো সেদিন।আমিও কম কিসের।সেই শোধ নিয়েছি।নিজের ছেলেকেই বুয়েটের ছাত্র তৈরি করেছি।ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছি।’
রিঝের বাবা হাসতে লাগলেন।আয়েশা রহমান মুখটা গোমড়া করলেন।তিনি বিধবা হওয়ার কথা কেনো বললেন?ছেলে মেয়ে মুগ্ধ হয়ে বাবার মুখে তাদের সফল প্রেমের কাহিনী শুনলেন।কতটা ভালোবাসা থাকলে এতো সাহস পাওয়া যায়!দু’জন শক্ত করে নিজেদের হাতটা ধরে তিনটি ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে।তুতুল দীর্ঘস্বস্তির শ্বাস ফেলে মনে মনে দোয়া করলো।তারাও যেনো ঠিক এভাবেই হাতে হাত রেখে চিরোটাকাল পার করতে পারে।রিঝ চোখ ফিরিয়ে তুতুলের দিকে চায়।তুতুলও একুই ভাবে দৃষ্টি ফেলে।দু’টি চোখ এক হয়।কথা বলে নিজেদের মধ্যে।চোখের ভাষা কতই না সহজ।ভালোবাসা থাকলে দূনিয়াটাই সহজ মনে হয়।স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা যেনো আরো পবিত্র করে তুলেছে আশেপাশের সব।চোখ নিঃশব্দে বলছে,’আমি তোমার কৃষ্ণচূড়া তুতুল।আর আমার লাল রংটি শুধু তুমি।কৃষ্ণচূড়ার রং লাল।’
__________
#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
__________
#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here