শতরূপা পর্ব শেষ

গল্পঃ #শতরূপা (৩য় পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

এটা এক অন্য রকম বিয়ে, যেখানে বউ নিজেই শ্বশুর
বাড়ি এসে তার রুম সাজাচ্ছে। বাকিরা তাকে সাহায্য সহযোগীতা করছে মাত্র। বিকেল প্রায় শেষ হতে চলেছে। আমি দিবিয়ার আশপাশ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছিলাম। বাবার সাথে আগামীকালের বাজারের তালিকা নিয়েও আমার ব্যস্ততা ছিলো। হঠাৎ বাবার সামনে এসে দিবিয়া পরিশ্রান্ত স্বরে বললো,
___তীব্র, আরো অনেক ফুল লাগবে। তুমি এখনি নিয়ে আসোনা।

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আর আমি মাথা নিচু করে নিজেকেই গালি দিচ্ছিলাম। কারণ ওরে কিছু বললে না জানি আরো কি কি শুনতে হয়। বাবার সামনে সে কি করে ফুলের কথা বললো? তার উপর একদিনের বিয়েতে আবার আমাকে তুমি সম্বোধন করে!
অথচ আমার মায়ের কথা শুনেছি যিনি আমার দাদা মানে আম্মার শ্বশুরের সাথে কোথাও গেলে পায়ে জুতা পর্যন্ত পরতেন না, বেয়াদবি হবে বলে। আগের এমন অসংখ্য নিয়মাবলি ছিল নাকি!
এমনকি মা আজ পর্যন্ত আমার বাবার নাম তো উচ্চারণ করতে শুনিই নি, উনাকে আপনি ছাড়া তুমি করে কখনোই বলেননি। আর এই মেয়ে একদিনেই যে ব্যবহার প্রয়োগ করছে,নিঃসন্দেহে সে আমাকে পরে তুই করে বলবে।

দিবিয়ার কথামতো আমি ফুল আনিনি। অন্য কাউকে দিয়ে আনিয়েছে কিনা তাও জানিনা। কিন্তু সন্ধ্যার পর পর সবকিছু কোনোরকম গুছিয়ে রুমে যেতে চাইলাম। কাছাকাছি এগুতেই ফাহিমা ভাবী আমাকে বললো,
___তীব্র প্রমিতা এসেছে। আর সে দিবিয়াকে সব বলেও দিয়েছে। দুজন এখনো ভেতরে কথা বলতেছে।

আমি হন্তদন্ত হয়ে রুমে ছুটে গেলাম। দেখলাম আমার এতো অগুছালো চেনা রুমটা পরীর ছোঁয়ায় ফুলে ছেঁয়ে গেছে। তার মধ্যখানে সেই ফুলেদের রাণী হাত গুটিয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে কথা বলছে। কিন্তু বামে চোখ পড়তেই মনে আসা জমকালো অনূভুতিটা থেমে গেলো। কারণ এই সুন্দরকে কুৎসিত করতে রাক্ষসীর রূপেও একজনকে দেখতে পাচ্ছি,আমি আসছি কেউ খেয়াল করেনি হয়তো।
অতঃপর আমি তাদের কথা শুনতে কান পাতলাম। দিবিয়া বলছে..
___হ্যাঁ তীব্র আমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলো, প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। তারপর কৌশলে আমাকে পড়াতে আসতো। তখন পুরোটা সময়ই আমরা প্রেম করতাম। বইয়ের বদলে দুজন দুজনকে পড়তাম। বলতে পারেন এটা লাভ ম্যারেজ। আমরা একে অন্যের জন্য জন্মেছিলাম। তীব্র তার সবটুকু ভালোবাসা আমার জন্য জমিয়ে রেখেছিলো। আর আমিও!
আর শুনেন মানুষের অতীত থাকে জানি, কিন্তু এসব আবেগের হয়। দুদিন পরেই সবাই ভুলে যায়। নয়তো তীব্রকে জিজ্ঞাসা করিয়েন দেখবেন আপনাকেই চিনবেই না। হাহাহাহা!

দিবিয়ার কোনো কথা এই প্রথম আমার ভালো লাগলো। মিথ্যে হোক, কিন্তু কথাগুলো আমাকে অন্য রকম আনন্দ দিচ্ছে। প্রমিতা বউ দেখতে এসেছিল বহু শখ করে, হয়তো এটাও বলতে চেয়েছিল একসময় আমি তার জন্য পাগল ছিলাম। সাথে ভাব নিতে আসছিলো নিশ্চিত। এবার জ্বলন খেয়ে ফিরবে।
ওরা আমাকে দেখার আগেই আমি এখান থেকে সরে গেলাম। আমি বের হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমিতা চলে গেলো। এরপর আমি আস্তে আস্তে ভেতরে গেলাম। আড়চোখে একবার দিবিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
___সন্ধ্যার পরে কিছু খাইছো?

দিবিয়া আস্তে আস্তে উঠে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
___আপনার সাথে খাবো। চলুন..

দিবিয়ার আপনি সম্বোধনটা আমার ভীষণ ভালো লাগলো। আমি আলতো হেসে ওর হাত ধরেই খেতে চললাম। বড় আপা বাচ্চা নিয়ে এদিক দিয়েই যাচ্ছে কোথাও, তখনি দিবিয়া বলে উঠলো..
___আচ্ছা তীব্র তুমি আমাকে কখন থেকে ভালোবাসো?

আমি রাগে কটমট করে ওর হাতটা আরো চেপে ধরে উল্টো দিকে ফিরে রুমে গেলাম। রুমে প্রবেশ করিয়েই আমি দরজা বন্ধ করে বললাম,
___কখন কোথায় কার সাথে কীভাবে কি বলতে হয় না জানলে তোমাকে রুম থেকে বের করছিনা। ফাজিল মেয়ে কোথাকার। শুধরে যাও তারাতাড়ি!

দরজা বন্ধ করে খেয়েদেয়ে আমি বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ একটু গল্পগুজব করছিলাম৷ এর মধ্যে দিবিয়াকে খাবার দেওয়ার কথা বলতে ভুলে গেছি।
আবার চাবিও আমার হাতে। মনে হতেই আমি এক দৌঁড়ে রুমের সামনে গেলাম। গিয়ে দেখি সবাই দরজার সামনে দাঁড়ানো, আর ভেতর থেকে দিবিয়ার মুখে বাংলা বয়ান। ভেবেছিলাম পরবর্তীতে আমাকে তুই বলতে পারে, কিন্তু আজকেই যে তুইতোকারি করে বকা শুনবো ভাবতে পারিনি৷ মা আমার দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে আছে। আমি তারাতাড়ি করে দরজা খুললাম। সাথে সাথে দিবিয়া একটানে আমাকে ভেতরে ঠেলে সে বের হয়ে গেলো আর আমাকে রেখে দরজা বন্ধ করে দিলো।

দরজার উপরে হাত রেখে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলাম। ডাকতেও পারছিনা কাউকে। বাইরে তালা মেরে দিয়েছে এদিকে চাবি আমার হাতে। এই মূহুর্তে সাহায্য চাওয়াও সম্ভব না। কারণ সবাই আমাকে বকতেছে। বুঝতেছিনা মেয়েটা আমার সাথে এমন কেন করছে! ভালোবাসে শুনে ভাবলাম শত হোক ভালো তো বাসে, জীবনে এটাই তো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন বুঝে গেছি সে আমাকে বনের পাগল করে ছেড়ে দিবে।
দরজার নিচে চাবিটা রেখে দিলাম। যেন দরজা খুলতে ইচ্ছে হলে চাবি খুঁজে পেতে সমস্যা না হয়।

এদিকে একা একা দিবিয়াকে ভীষণ মনে পড়ছিলো। আমার এমনটা করা সত্যি উচিত হয়নি। মেয়েটা চঞ্চল কিন্তু খারাপ তো বলেনি। স্বামী দাবী করে যেখানে সেখানে যা-তা বলে ফেলে,তাই বলে আমি তাকে কিনা রুমে রেখে চলে গেছিলাম। আবারও দরজার সামনে গিয়ে গিয়ে ফিরে আসলাম আর শুয়ে পড়লাম।

রাতের দিকে কখন দরজা খোলেছিল জানিনা। কিন্তু চোখ মৃদু খোলে মাথায় একটা নরম হাতের স্পর্শ অনূভব করছিলাম। ঘুমের ভান করেই শুয়েই রইলাম। দিবিয়া আস্তে আস্তে আমার বুকের উপর মাথা রেখেছে। সত্যি বলতে দিবিয়াকে প্রথম থেকেই ভালো লাগতো কিন্তু তার বেয়াদবি আচরণ, দুষ্টমনা কারবারীতে আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম। তারপরও এখন নিজেকে বুঝাচ্ছি তার সংসারের সঠিক বুঝজ্ঞান হয়নি। নিজের শ্বশুর – শাশুড়ী, বড়রা কিংবা নিজের স্বামীর সাথে সম্মানের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটা সে শিখেনি কিন্তু শিখে যাবে হয়তো।

কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারলাম দিবিয়া ঘুমিয়ে গেছে। এভাবে তাকে দেখতে পারছিলাম না। তারপর উঠে আস্তে আস্তে মাথায় বালিশে রাখলাম কিন্তু হাতটা মাথার নিচ থেকে সরাতে চাইলেই সে নড়েচড়ে উঠলো। কিন্তু ঘুম ভাঙবে ভয়ে আমি আর হাত সরাইনি। ঘুমের ভেতরেই সে আমার আরো কাছে এসে মুখ গুঁজলো।
তার দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছি একদিনেও প্রেমে পড়া যায়? সে জানতো আমাকে প্রেমে ফেলতে পারবে! তার যেই স্বভাবগুলো আমি অপছন্দ করি সে সেগুলোর প্রভাবেই আমাকে তার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলবে। সে আমাকে চুম্বকের মতো টানছিলো!
এখন ওর উদ্ভট কথাগুলো শুনতে ইচ্ছে করছে, কেন জানি ওর মুখে আমার নাম ধরে ডাকাটাকেও ফিল করছিলাম। ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষের সব ভালো লাগে বুঝি?


পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি সামনে নাস্তাসহ দিবিয়া দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় শেওলা রঙের পাতলা একটা শাড়ী পরনে, কীভাবে যেন পরেছে পেট অর্ধেক দেখা যাচ্ছে।
আমি চোখ কচলে আবার তাকাতেই দেখি আর দেখা যাচ্ছেনা। দিবিয়া খাবার রেখে আস্তে আস্তে বললো,
___খেয়ে নিন, ঠান্ডা হয়ে যাবে!

আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না, দিবিয়া চলে গেছে। আমাকে আপনি করে বললো, আবার আমি বকা দিবো ভয়ে সে শাড়ী ঠিক করে ফেলেছে। কিন্তু আমি বকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, ঝাপসা দেখছিলাম বলে চোখ কচলালাম, আর সে কিনা ভাবলো বকা দিবো!

খাবার মুখে দিয়েই বুঝলাম এটা নতুন মানুষের রান্না। নিশ্চয়ই দিবিয়া রান্না করেছে। কিন্তু আমার জানামতে দিবিয়া রান্নাবান্না পারার মতো মেয়ে না। ওর মধ্যে এসব গুণ থাকাটা অসম্ভব। কিন্তু এই অসম্ভবকে বিশ্বাস করতে সময় লাগলোনা। আজ সকালের সব রান্না দিবিয়া করেছে। যাবতীয় কাজে তাকে ভীষণ আগ্রহের সাথে দেখা যাচ্ছে৷
আমার আম্মার চোখেমুখে রাজ্যের খুশি জমা হয়েছে। শুধুমাত্র আম্মার খুশির জন্য সংসারী একটা গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করার পরিকল্পনা ছিল। ভদ্র নম্র আর শালীন। দিবিয়ার কথাবার্তায়ও এই মূহুর্তে অনেক সংসারী ভাব আর আম্মার মনমতো মনে হচ্ছে।

কয়েকদিনেই পুরো সংসারের হাল ধরলো দিবিয়া। সে আর পাগলামো করে না, আমার সাথে বেয়াদবি করে না, উল্টা পাল্টা বলেনা৷ আম্মা অসুস্থ তার দেখাশোনাসহ যাবতীয় কিছু সে একা দেখভাল করে। আমাদের সাথে অন্য বাড়ির কোনো সংঘর্ষ বাঁধলে দিবিয়া সেটাকে সংশোধন করে। সে প্রতিবাদী, সংসারী, আম্মার কথামতো ঘরের লক্ষী, আমার আব্বা আম্মার চোখের মণি। আর আমার পুরো দুনিয়া!
আব্বার স্কুলের জায়গা নিয়ে একটা মামলা চলছিল, যেটাতে আব্বাকে প্রধান আসামী দেওয়া হয়েছিল। এই পুরো কেসটা দিবিয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। তার পরিচিত মানুষজন সেটাকে সহজেই থামিয়েছে।
বছর ঘুরতেই দিবিয়া আমার সন্তানের মা হলো।
তার মাধ্যমেই আমার ভালো চাকরি হলো।

এখন দিবিয়া একজন আদর্শ মা, সন্তান পালন, সাথে আমার আব্বা আম্মার সেবা করা, আমি ফিরলে নিয়ম করে আমার সবকিছু এগিয়ে দেওয়া, প্রয়োজনীয় সবকিছু সামনে রাখা, সে একা করে।
মাঝে মাঝে আমি তার বিয়ের আগের স্বভাবগুলো কথা মনে করে হাসি। বিয়েরদিন করা পাগলামি কথা মনে করে ঘুম থেকে উঠেই হুট করেই ওর কপালে ভালোবাসার স্পর্শ আঁকি। খুব ইচ্ছে তার পাগলামোগুলো আবার দেখতে। তার মধ্যে প্রেমিকার মতো আচরণ দেখতে। কিন্তু সে এখন বুঝে সে একজন স্ত্রী, একজন মা, শ্বশুর শাশুড়ীর আদরের বউমা। তাই সে তার অবুঝের মতো পাগলামোগুলো লুকিয়ে ফেলেছে।
সবার খুশিকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন সাজাতে জেনেছে।

আমি তাকে দেখে বুঝতে পারি, প্রতিটি মেয়ের মধ্যে অসংখ্য রূপ থাকে। তারা কখনো বোকার মতো, আবার কখনো বজ্রের মতো, কিংবা কখনো বিশুদ্ধ কোমলপ্রাণে জলজ্যান্ত প্রতিকী। তাদের এক রূপের আড়ালে থাকে শত রূপ। সেসব রূপকে জাগ্রত করতে ভালোবাসতে হয়, সুযোগ দিতে হয়, ভরসা হয়ে পাশে থাকতে হয়। তাহলে তারা হয়ে উঠে দায়িত্বশীল এবং গুণের প্রসারে পরিপূর্ণ শতরূপা।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here