শতরূপা পর্ব ১

আমার ছাত্রী দিবিয়ার বিয়েতে এসে বিরাটভাবে ফেঁসে গেছি। দেরি করে এসে ভেতরে পা রাখতেই মহা হুলস্থুল কান্ডতে আমার জবানবন্ধ হয়ে গেলো। বিয়েতে বকশিস দিতে এক হাজার টাকা হাতে রেখেছিলাম,কিন্তু সবার টানাটানিতে সেটা হাত ছিঁটকে কোথায় গিয়ে পড়লো বুঝতে পারলাম না। চোখের পলকে আমাকে জামাই সাজে সজ্জিত করলো। আমার কোনো প্রশ্নের জবাব তো পাচ্ছিই না উল্টো আমি দেরি করার জন্য সবাই শাসাচ্ছে।
চারপাশে তাকাচ্ছি আর ভাবছি এসব দুঃস্বপ্ন নয়তো?
এদিকে আমার আজ বিয়ে অথচ আমিই জানিনা, সেটা কি করে সম্ভব? তাছাড়া দিবিয়া কোনো সাধারণ পরিবারের মেয়ে নয় যে আমার মতো একটা মধ্যবিত্ত ছেলে বিয়ে করার ক্ষমতা রাখে! শুধুমাত্র ওকে পড়ানোর জন্যই বছরখানেক ধরে আমার পকেট গরম থাকে। ওর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো এটা ভেবে যে আমি এমন একটা টিউশনি হাতছাড়া করতে যাচ্ছি। তবে মনে মনে খরচের খাতাটা ছোট করে ফেলার বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করছিলাম।

কাল গায়ে হলুদে আসিনি,সেজন্য দিবিয়া অসংখ্যবার ফোন দিয়েছিল। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই যাইনি। আজকেও একটা ক্লাস ছিল, সেটা শেষ করে কোনোরকম বিয়েতে উপস্থিত হয়েছিলাম। কিন্তু কে জানতো এখানে আমার জন্য এতবড় বিপদ অপেক্ষা করছে।
সবার এমন ঘেঁষাঘেঁষিতে আমি প্রচন্ডভাবে ঘামছিলাম। সবার মাথার ভীড়ে ফ্যানের বাতাস আমার শরীরে এসে ঠেকছেনা। আমি ভীড় ঠেলে টয়লেটে যাওয়ার বাহানায় রাস্তা চাইলাম। সবাই সরে যাওয়ার পরে গুটিগুটি পায়ে বাথরুম পর্যন্ত গিয়ে একটা দৌঁড় দিয়ে বেড়িয়ে যাবো তখনি পাঞ্জাবীর কলার টেনে ধরলো দিবিয়া।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
___দিবিয়া তুমি তোমার স্যারের কলারে কীভাবে ধরলে ছি! ছাড়ো প্লিজ, আর দেখো সবাই আমার সাথে কি করছে? তুমি বাঁধা দাও ওদের!

দিবিয়া এবার আরো কাছে এসে আমাকে দেয়ালে ঠেসে ধরলো, আর অন্য রকম স্বরে বললো..
___এই-ই তীব্র, তুমি এমন করছো কেন? আমাদের আজ বিয়ে হচ্ছেনা? তারপর আমি তোমার বউ হবো তো! এখন বলো আমাকে বউ সাজে কেমন লাগছে?

আমি হাত সরিয়ে রেগে বললাম,
___খুব খারাপ হচ্ছে দিবিয়া। আমাকে নাম ধরে, আবার তুমি তুমি করে বলছো কেন? এতো সাহস কোথায় পেলে? শুনো, তোমাকে কোনোভাবেই বিয়ে করবোনা আমি। আর তোমাকে বউসাজেও জঘন্য লাগছে!

দিবিয়া পেছনে তাকিয়ে বললো,
___উমমম আমি জানি আমার তীব্র’র বুক ফেটে গেলেও মুখ ফাটেনা। আমার দিকে এইজন্যই নজর দিচ্ছোনা কারণ তাকালে চোখ ফেরাতে পারবেনা তাইতো?

আমি জোরে কিছু বলতে যাবো তখনি দিবিয়া আমার মুখ চেপে বললো,
___এদিকে মুরব্বিদের আসতে দেখা যাচ্ছে। বিয়ের আগেই জামাইকে বউয়ের সাথে এভাবে কথা বলতে দেখলে বাজে রটনা করবে।

আমি একটানে হাত ছিটকে সরে চলে যেতে চাইলেই দেখলাম আশপাশে পালানোর রাস্তা নেই। ফোনটা বের করলাম। আর আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু সাবেরকে ফোন দিয়ে বললাম,
___দোস্ত আমি ফেঁসে গেছিরে। দিবিয়ার সাথে আমার জোর করে বিয়ের বন্দোবস্ত হয়েছে। আমি এই পাগল মেয়েকে বিয়ে করতে পারবোনা। জানিসই তো সে আমার সাথে আগেই কতো বেয়াদবি করতো। বিয়ের করলে তো ভাজাপোড়া করে ফেলবে। সাবের তুই তোর ভাই-বন্ধু নিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার কর প্লিজ।

কথাগুলো বলতে বলতে দেখলাম দিবিয়া শুনে শুনে হাসছে। ওর হাসির সাথে ওপাশ থেকে সাবেরও হেসে উঠলো। ভেবেছিলাম সে আমাকে সাহায্য করার ভরসা দিবে কিন্তু উল্টো বলতে লাগলো,
___তোদের বিয়েটা আজ রাতে হচ্ছে। দিবিয়া দুষ্ট হলেও ভালো মেয়ে,ওর সাথে কথা বল। আমরা রাতে আসবো। একটু আগেই জেনেছি আর দাওয়াতও পেয়েছি, অনেকদিন পরে মজা করে খাওয়াদাওয়া চলবে।

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম,
___তুই জেনেছিলি তাহলে আমাকে জানাবিনা? আজব! তাহলে জীবনেও আসতাম না এখানে। সাবের, এই সাবের শুন তুই …

আমার কথা শোনার আগেই ফোন কেটে গেলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম দিবিয়া হাত গুটিয়ে তাকিয়ে আছে। এখন তার পাশে তার বোন
সাবিয়া সহ তার চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো সব বোনেরাও দাঁড়িয়ে ভয়ানক চেহেরায় তাকিয়ে আছে।
দোয়া পড়ে বারবার বুকে ফুঁ দিতে লাগলাম। কিন্তু কাজ হলোনা, সাবিয়া একটানে আমার ফোনটা কেড়ে নিয়ে হাত টেনে বললো,
___ দুলাভাই পালানোর চেষ্টা করলেও লাভ নাই। এমনিতেই দেরি করে ফেলেছেন। চলেন চলেন আপনার জন্য বিশেষ আসন পাতা আছে৷

তখনি দিবিয়া এগিয়ে এসে সাবিয়াকে টেনে সরিয়ে দিয়ে ধমকে বললো,
___এই তুই হাতে ধরলি কেন? এতো সাহস কেন তোর? শুন, তীব্র তোর দুলাভাই হলেও তুই দুরত্ব মানবি বুঝেছিস? বেশি কাছে আসবিনা।

সাবিয়া আমতাআমতা করে সরে গেলো। বাকিরাও হাসতে লাগলো। আমি না চাওয়া সত্ত্বেও দিবিয়ার পেছন পেছন হাঁটা ধরলাম।

হাজার প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দিবিয়ার সাথে ওর চাচাতো ভাই শোভনের বিয়ের কথা ছিল।
দিবিয়ার বাবা মারা যাওয়ার সময় ওদের দুইবোনের নামে সম্পত্তির যে উইল করেছিলো তাতে বলা আছে দুই মেয়ের আঠারো বছর হলে এবং এর পরবর্তীতে যখনি বিয়ে হবে তখনি তারা সম্পত্তির অধিকারী হবে। তাদের বাবার রেখে যাওয়া দুইটা বাড়ির ভাড়া দিয়েই তারা ভীষণ জাঁকজমকভাবে চলতো। দিবিয়ার চাচা তাদের দেখাশোনা করতো বলে তিনি দিবিয়ার বিয়ে তার বড় ছেলের সাথে ঠিক করে রেখেছেন। এই দুই মেয়ের নামে এতো টাকার সম্পত্তি থাকলে যে কেউই এটা চাইবে। তাই তিনি দিবিয়ার আঠারো পূর্ণ হওয়ার আগেই শোভনের সাথে বিয়ে নিয়ে পাকা কথা বলে রেখেছেন । দিবিয়ার মাও এই বিষয়ে একমত ছিল। তবে দিবিয়া শোভনকে বিয়ে করতে রাজী ছিল কিনা কখনো বুঝিনি। কারণ সে সবসময় আমার সাথে উল্টা পাল্টা আচরণ করেছে।
আমি সবসময় না বুঝার মতো করে এড়িয়ে গেছি। কিন্তু এবার আর শেষ রক্ষে হলো না বুঝি!

আমাকে নিয়ে সব ছেলেপুলেরা খাওয়ালো, জোর করে সব আইটেমগুলোই খাওয়ালো। মনে হচ্ছে খাবারের সাথে সংগ্রাম করে এই পর্যায়ে বেঁচে থাকলেই আমার বিজয় লাভ হবে। জানিনা এটা কোন পাপের শাস্তি আমার!
বিকেল পর্যন্ত সবার টানাটানি, কাড়াকাড়ি, চিমটি, কিল,ঘুষিতে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

তবে সন্ধ্যার দিকে নিজের লোকেদের চেহেরা দেখেই আমার চোখমুখ চকচক করে উঠলো। বাচ্চাদের মতো কেঁদে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
___আম্মা তুমি আসছো? দেখো ওরা আমার সাথে কি করছে! ও আম্মা আব্বাকে বলো আমাকে এখান থেকে তারাতাড়ি নিয়ে যেতে।

আম্মা আমার মাথায় যত্নে হাত বুলালেও আব্বা রাগী চোখে ফিসফিস করে বললো,
___এই চুপ করে থাক। আমিও তো সারাজীবন মাস্টারি করলাম, কি করতে পারছি জীবনে? আর তুই তো সুন্দরী মেয়ের সাথে বাড়িঘর পাবি। তোর বিয়ে এখানে হবে আর আজকেই হবে।

আমি এবার হাঁউমাঁউ করে কেঁদে ফেলতে গিয়েও কাঁদতে পারলাম না। আজীবন স্বপ্ন দেখেছি আমার এমন একটা মানুষের সাথে বিয়ে হবে, যে আমাকে আপনি আপনি করে বলবে। আমাকে ভয় পাবে,সম্মান করবে, যা বলবো তাই শুনবে। কিন্তু সব ভাবনার উল্টো চরিত্রে কেউ আসতে যাচ্ছে! আমি জানি এই মেয়ে আমার জীবনটা দুইদিনে তেজপাতা করে ছেড়ে দিবে। সব ছেড়ে আমার বনবাসে চলে যেতে হবে, তাছাড়া আমার কোনো ভবিষ্যৎ দেখছিনা।

রাতের দিকে দিবিয়া আবার ভিন্নভাবে সাজলো। ওকে ভীষণ সুন্দর লাগছিল। কিন্তু আমি তাকাতে ইচ্ছে করলেও তাকাচ্ছিলাম না। এই মূহুর্তে আমাকে দেখলে সবাই ভাব্বে আমি কনে, আর দিবিয়া বর। কারণ সে ছিল হাসিখুশি, চঞ্চল। মনেই হচ্ছেনা সে পাত্রী, আর আজ তার বিয়ে। কিন্তু আমাকে
ভীতু আর শোকে কাতর এক প্রাচীন নারীদের ভূষণে দেখা যাচ্ছে।
দিবিয়া এসে আমার পাশে বসতেই আমি আস্তে আস্তে বললাম,
___শোভন কোথায়?

দিবিয়া অন্যদিকে মনোযোগ রেখে আমার কথার জবাবে ধিরে ধিরে বললো,
___এতক্ষণ কাজে ব্যস্ত ছিল। এখন কোথাও আছে হয়তো।

আমি দাঁত খিঁচে বললাম,
___আমি ওইটা বলছিনা, বলতেছি বিয়ে তো ওর সাথে হওয়ার কথা ছিল।

দিবিয়া সাবিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
___ওই যে সাবিয়া, কালকে হুট করেই বলতেছে আমি শোভন ভাইকে বিয়ে করলে সে আমার মাষ্টারমশাই মানে আপনাকে বিয়ে করবে। এটা কি করে হতে দেব বলেন? চাচাকে সামলাতে কষ্ট হয়নি কারণ সাবিয়া শোভন ভাইকে বিয়ে করতে রাজী। শোভন ভাইও রাজী। চাচা তো আমাদের দুজনের মধ্যে একজনকে পুত্রবধূ করে পেলেই খুশি।
তবে এসব উলটপালট করা এতটাও সহজ ছিল না, শুধু তোমাকে পেতে এতো অসাধ্য সাধন করেছি।

শেষের কথা শুনে আমি রেগেমেগে বললাম,
___এই আমাকে আবার তুমি করে বললে কেন? আবার বললে আমি তোমাকে বিয়ে করবোনা। কোনদিকে যে পালাবো টেরও পাবেনা।

গল্পঃ #শতরূপা (প্রথম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here