#আরোও_একবার_বসন্ত
#৩য়_পর্ব
কোনো সময় নষ্ট না করেই ছুটলো হাসপাতালে। চিন্তায় মাথা বন্ধ বন্ধ লাগছে। হাসপাতালে যেতেই প্রিয়ন্তীর সাথে ওয়ার্ডের বাহিরে দেখা হলো আরাফাতের। প্রিয়ন্তীকে দেখেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে? আপনি বলেছিলেন ইটস ইমারজেন্সি।
আরাফাত রীতিমতো ঘামছে, পৌষের থরথর কাপুনিময় শীতে তার কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। গলার স্বর কাঁপছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে রয়েছে যেনো ঝড়ের বেগে ছুটে এসেছে সে। প্রিয়ন্তী একনজরে তাকে পর্যবেক্ষণ করে ধীর কন্ঠে বলে,
– আপনি আগে একটু শান্ত হোন।
– ও ঠিক আছে তো?
– ও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে, আমার সাথে আসুন কিছু ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলার আছে।
আরাফাত কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে শান্ত করে। রাসেল নামক ছেলেটির প্রতি একরকম মায়া সৃষ্টি হয়ে গেছে। লোককথিত আছে, আর্মি, পুলিশদের কোনো মায়া দয়া থাকতে নেই। কিন্তু না চাইতেও রাসেলের প্রতি একপ্রকার টান তৈরি হয়ে গেছে আরাফাতের। একটু শান্ত হবার পর, আরাফাত প্রিয়ন্তীর পিছু পিছু তার ডেস্কে যায়। সে চেয়ারে বসলে প্রিয়ন্তী ধীর কন্ঠে বলে,
– আমরা কিছু টেস্ট করেছি, ওর বা হাতে প্রচন্ড ব্যাথা। প্রথম ভেবেছিলাম হাড় ভেঙ্গেছে হয়তো। যেভাবে মার খেয়েছে এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সিটিস্ক্যানের পর খেয়াল করলাম, ওর হাত ভাঙ্গে নি কিছু লিগামেন্ট ছিড়ে গেছে। এবং ওর হাড়ের কাছে একটা টিউমার আছে। সেটা বাড়ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আমি রিপোর্টস গুলো আমাদের কন্সাল্টেন্ট ডাক্তার শৌভিক চ্যাটার্জিকে দেখিয়েছি। উনি কিছু টেস্ট দিয়েছে। টেস্ট গুলোর উপর ভিত্তি করে আমরা ফারদার স্টেপ নিবো। যেহেতু ওর কোনো গার্ডিয়ান নেই। সেহেতু আপনার সাথে কথা বলাটা জরুরি ছিলো। যদি টিউমারটা অপারেট করা যায় তাহলে আমরা বলবো অপারেশন করাতে।
– অপারেশন করলে কি ও সুস্থ হয়ে যাবে?
– আশা রাখছি, আসলে টিউমার, ক্যান্সার ব্যাপারগুলো খুব সেন্সিটিভ। আর বয়সটাও ছোট। চিকিৎসাগুলো ব্যয়বহুল। একজন অচেনা মানুষের জন্য এতটা ব্যয়বহুল চিকিৎসা কি আপনি করাতে রাজী?
– আপনি প্লিজ টাকা নিয়ে চিন্তা করবেন না। বাচ্চাটা বেঁচে উঠুক আমি সেটাই চাই।
আরাফাত নির্লিপ্ত কন্ঠে অকপটে কথাটা বললো। প্রিয়ন্তী তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। আজকাল এমন মানুষ হয়? একাবিংশ শতাব্দীতে এসে এমন হাতেম তাই এর মতো মানুষ দেখতে পাওয়াটা কোনো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হাজার বছর পুরোনো ডাইনোসরের হাড়ের মত দূর্লভ ব্যাপার। প্রিয়ন্তীর কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই আবারো জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি ওর চিকিৎসা করাতে চান? এটা কিন্তু ব্যয়বহুল চিকিৎসা
– আমি কানে কালা নই ডাক্তার সাহেবা, আমি তো বললাম টাকা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি কোনো না কোনো ভাবে এরেঞ্জ করবো। ওর চিকিৎসার ত্রুটি রাখবেন না। এটা আমার রিকুয়েষ্ট।
আরাফাতের কথাগুলো নিতান্ত গা জ্বালানো। কিন্তু এখন ঝগড়া করাটা পরিস্থিতি অনুকুল নয়। তাই ছোট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রিয়ন্তী বললো,
– ঠিক আছে, তাহলে কালকে সকাল ১০টার দিকে উপস্থিত থাকবেন। স্যার রাউন্ডের পর আপনার সাথে এই কেসটার ব্রিফিং দিবেন।
– আপনি থাকবেন না?
– জ্বী না, আমার ৯টায় ডিউটি শেষ। আমি এখান থেকে ৯.১৫তে বেড়িয়ে যাই।
– ওহ, রাসেলের সাথে কি একটু দেখা করা যাবে?
– কালকে সকালে করুন, এখন তো আসলে ভিজিটিং আওয়ার নয়। কিছু রুলস আমাদের ফলো করতে হয়
– বেশি না পাঁচ মিনিট নিবো, প্লিজ। পাঁচ মিনিট
আরাফাতের আকুতিভরা আবদারটি কেনো যেনো ফেলতে পারলো না প্রিয়ন্তী। তাই বাধা না দিয়েই রাসেলের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিলো আরাফাতকে। আরাফাত একটি কৃতজ্ঞতাময় হাসি দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। লোকটা হাসলে মন্দ লাগে না। একটু চ্যাটাং চ্যাটাং কথা ব্যাতীত লোকটাকে অপছন্দ করার কারণ খুজে পেলো না প্রিয়ন্তী।
আরাফাত যখন রাসেলের বেডের কাছে গেলো, তখন রাসেল বসে বসে সেলাইনের ক্যানোলা খোঁচাখোঁচি করছে। আরাফাত এসে পাশে বসতেই সে তার কাজ বন্ধ করে একেবারে ভদ্র ছেলের মতো মাথা নিচু করে বসে রইলো। রাসেলের এরুপ কাজ দেখে মুচকি হাসি দিয়ে আরাফাত বললো,
– কি রে? এখানে ভালো লাগছে না
– না সেইডা না। এইখানে সবাই খুব যত্ন নেয়, ওই সুন্দরী ডাক্তার আফাটা তো অনেক ভালো। আমারে চকলেট দিছে। আর এইখানে খাওনের চিন্তা নাই, ওরে খানা। শুধু একটা সমেস্যা বয়ে থাকোন লাগে।
– এতো সুবিধা পাচ্ছিস, একটু অসুবিধাতে কিছু যায় আসে না। এখন শরীরটা কেমন লাগছে?
– বেদনা আছে, তবে এহন কম। বিকাল বেলা সেই ঘুম দিছিলাম। তার আগে ওরে ব্যাথা, ঘুম থেইক্যা উঠার পর একটু কমছে।
– ওহ, ঠিক হয় যাবে। আর ওইরকম কাজ করবি না তাহলেই হবে। আমি আজকে উঠি, নয়তো তোর সুন্দরী ডাক্তার আফা আমাকে পিটাবে। কালকে আবার আসবো। এখন রেস্ট কর।
বলে উঠতে নিলে রাসেল আকুতিময় কন্ঠে ডেকে উঠে,
– ভাইজান?
– কিছু বলবি?
– আপনে খুব ভালা মানুষ। কতলা টাকা যাইতেছে আপনার। আমার কিছু নাই, তবে সাইরে উইঠা আমি আপনার নিকট কাম করাম। এই দেনা তো শোধ করন লাগবে।
রাসেলের কথাটা শুনে কেনো যেনো চোখের কোনটা ভরে এলো আরাফাতের। কিন্তু পুরুষের নাকি কাঁদতে নেই, আর পুলিশের তো একেবারেই বারণ। তাই ধমকের স্বরে বললো,
– সেইটা নিয়ে তোর ভাবতে হবে না, আমার পাওনা আমি আদায় করে নিতে পারবো। থাক তুই আসি।
বলেন এক মূহুর্ত দেরি না করে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলো আরাফাত। রাসেল এবং আরাফাতের কথোপকথন দূর থেকে অবলোকন করলো প্রিয়ন্তী। আজ পাঁচ বছর সে ডাক্তারি প্রাক্টিস করছে। সবসময় এক সিনিয়র ডাক্তারের উপদেশ সে মেনে এনেছে,
“কখনো রোগীর প্রতি মায়া জন্মাতে দিবে না। তাহলে চিকিৎসা করার সময় হাত কাঁপবে।”______
এতোদিন এই উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সে, কিন্তু অযাচিত কারণে রাসেল নামক ছেলেটার প্রতি মায়া কাজ করছে তার। হয়তো তার বেদনাদায়ক ছেলেবেলাকে উপলদ্ধি করতে পারছে সে। হয়তো তার দূর্ভাগ্য প্রিয়ন্তীর মনের কোনায় দাগ কেটেছে। এই ছেলেটাকে সুস্থ দেখার একটি আশা মনের মাঝে জন্ম নিয়েছে। এখন সবকিছু ওই উপরওয়ালার উপর৷ যিনি সবার ভাগ্য লিখেন, তার ইশারা ব্যাতীত কিছুই সম্ভব নয়__________
সকাল ১০টা,
কন্সাল্টেন্ট ডাক্তার শৌভিক চ্যাটার্জির সাথে দেখা করবে বিধায় অপেক্ষা করছে আরাফাত। কম হলেও আধা ঘন্টা ধরে বসে রয়েছে। কাল সারারাত ঘুম হয় নি, চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। মাথায় বিভিন্ন চিন্তা। বড় গলায় বলে তো দিয়েছে চিকিৎসার সকল খরচ বহন করবে কিন্ত এতো বড় টাকাটা জোগাড় করতে খবর হয়ে যাবে তার। একটা লোনের আর্জি দিতে হবে আজকে। সরকারি চাকরি, লোন নিলেই স্যালারি থেকে প্রতিমাসে কেটে নিবে। কিন্তু কিছুই করার নেই। মা জানতে পারলে খবর আছে। চিৎকার করে ঘর মাথায় তুলবেন। লাখ খানিক টাকা অচেনা একটা পথশিশুর জন্য খরচ করবে নিজের আহাম্মক ছেলে সেটা রাফিজা বেগম কিছুতেই মানবেন না। সবকিছু মিলিয়ে বেশ চাপে আছে আরাফাত। এসব চিন্তা করছে এবং নখ কাটছে। তার একটা খুব খারাপ স্বভাব আছে। চিন্তায় পড়লেই নখ কাটে।
– নখ কাঁটলে বুদ্ধি কমে যায়, এই কথাটা তো একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও জানে। আপনি হয়তো ব্যতিক্রম
কন্ঠটা কানে আসতে মাথা তুলে তাকায় আরাফাত। তার সামনে প্রিয়ন্তী দাঁড়ানো। কিন্তু তার তো ডিউটি শেষ। তাহলে! অবাক কন্ঠে আরাফাত জিজ্ঞেস করে,
– আপনি? আপনার তো ৯টায় ডিউটি শেষ। তাহলে?
– রাসেলের ব্যাপারে শৌভিক স্যারের সাথে কথা বলতে থেকে গেছি।
– কথা হয়েছে?
– হুম, আগামী সোমবার স্যার অপারেশন করবেন। রবিবারের মধ্যে কিছু ব্লাড ডোনার যোগাড় করে ফেলতে হবে। যত তাড়াতাড়ি অপারেশন হবে ততটা ভালো হবে।
– ওহ, আচ্ছা অপারেশনের কস্টটা কত?
– আপনি হাজার চল্লিশ যোগাড় করুন
– এতো কম?
– হুম। টিউমারটি বেশি ক্রিটিক্যাল নয়৷
– ওহ, আমি কি ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারবেন?
– জ্বী, স্যার কেবিনে আছেন। থাকুন তাহলে আমি আসি।
বলেই প্রিয়ন্তী হাটা দিলো। প্রিয়ন্তীর যাবার পর আরফাত একদৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রিয়ন্তী নামক মেয়েটির মাঝে কিছু একটা রয়েছে যা আরাফাতকে আকর্ষণ করতে যথেষ্ট। ঠোঁটের কোনায় অজান্তেই প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো আরাফাতের। এখন গন্তব্য ডা. শৌভিকের কেবিন।
বাসায় পৌছাতে পৌছাতে এগারোটা বেজে গেলো প্রিয়ন্তীর। চব্বিশ ঘন্টা টানা ডিউটি করে শরীরটা যেনো চলতেই চাচ্ছে না। কাল রাতে দু ঘন্টা ঘুম হয় নি প্রিয়ন্তীর। এখন নিজ রুমে যেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিবে সে। কিন্তু বাসায় ঢুকেই……….
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে ইনশাল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি