#আরশি
#Part_18
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
— তোমার আপত্তি না থাকলে আমি তোমায় ড্রপ করে দেই?
সাদ এর কথা শুনে আমি ভরকে যাই। পরক্ষণে নিজেকে সামলে চঞ্চল দৃষ্টিতে এইদিক সেদিক তাকাই। উশখুশ করতে থাকি। মনের মাঝে এসে ভীড় জমায় হাজারো প্রশ্ন। বুঝে উঠতে পারি না আমার কি করা উচিৎ। ওর থেকে লিফট নিবো নাকি না। এতদিনে যতটুকু বুঝেছি ছেলেটা খারাপ না। চরিত্রে কোন দোষ। ভরসা করার মত পাত্র সে। কিন্তু তাও কার মনে কি আছে তা তো বলা যায় না। ধীরে ধীরে মনের মধ্যে সংকোচের দানা বুনতে শুরু করে। আমি যখন এই আকাশ-কুসুম ভাবনায় বিভোর তখন সাদ আবার বলে উঠে,
— এই মি দর্পণ! কোথায় হারালে? বৃষ্টি নামবে তো।
সাদের কথা কর্ণপাত হতেই আমি বিচক্ষণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। সাদ আমার দৃষ্টির মনোভাব ধরতে পেরে আনমনে কিছু একটা ভাবে। হঠাৎ কিঞ্চিৎ ভূবণ ভুলানো হাসি হাসে সে। সাথে সাথে গালের ভাঁজে ফুটে উঠে এক গভীর গর্ত। সাদ ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে রেখে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,
— ভয় করছে বুঝি? তা ভয়ে হওয়া স্বাভাবিক। আমি আবার মানুষ সুবিধার না।
বলে নিজের এক হাত তার ঘন কালো চুলের মাঝে নিয়ে নেড়ে ঠিক করে নেয়। কথাটা শুনে সাথে খানিকটা অবাকও হলাম যে সে নিজেকে আমার সামনে ভালো বলে দাবী করছে না। যেখানে সকলে নিজের গুনগান গেয়ে নিজেকে সর্বস্তরের প্রাণী প্রমাণ করতে ব্যস্ত সেখানে এই ছেলে নাকি নিজেকে নিচুই দেখাচ্ছে। আদৌ কি তা সম্ভব? আমি আরেকবার সাদের মুখ পানে চাই। দেখি তার ঠোঁটের কোনে দুষ্টু মাখা হাসি। তা দেখে আমি বুঝে যাই সাদ আবার ফাজলামো করছে। কথাটা বুঝার সাথে সাথে আমি ফুঁসে উঠে বলি,
— ফাজলামো হচ্ছে?
সাদ আমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখেই বলে,
— কি যে বলো না। তোমার ফাজলামো করার মত দুঃসাহস কি আমার আছে? এমন দুঃসাহস দেখালে বুঝি তোমার অগ্নিগিরির ন্যায় নয়ন জোড়া আমায় ভস্ম করে দিবে না?
কথাটা কর্ণপাত হতেই আমি রাগা বদলে নিভে গেলাম। ছোট ছোট চোখ তার দিকে চেয়ে থাকলাম। জড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলো। ধুলোবালি মিশে একাকার। তা দেখে সাদ কিছুটা একটা ভাবলো। অতঃপর আমার মুখ পানে তাকিয়ে বলে,
— আবহাওয়া খারাপ করছে। হয়তো ঝড় নামবে। তুমি কি যাবে নাকি থাকবে? এখন ট্রাস্ট করবে কি না সেটা তোমার ব্যাপার। বাট আমার তাড়া আছে।
কথাটা শুনে আমি চারদিকে তাকালাম। জায়গায়টা ধীরে ধীরে মানব শূন্য হয়ে আসছে। হয়তো ইতি মধ্যে তারাও খবর পেয়ে গিয়েছে আজ বাস আসবে না। তাই হয়তো যে যার মত পথ দেখছে। আমি সাদের দিকে তাকালাম। ১ মাসে যতটা চিনেছি ছেলেটা মোটেও খারাপ না। পরিষ্কার মনের মানুষ। কত সময় কাজের বাহানায় একা পেয়েছে তাও কোন অসভ্য আচরণ করে নি। ফাজলামো করে ঠিকই কিন্তু তাও বাজে মিন করে না। আকাশ-কুসুম ভেবে আমি ছোট এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,
— চলেন।
_______________________
রাত হয়েছে বেশ। বৃষ্টি এখন আর নেই। কালো মেঘেরা আকাশের বুকে বেশিক্ষণ সুবিধা না করতে পেরে হাল ছেড়ে হাওয়ায় মিইয়ে গিয়েছে। পরিষ্কার হয়ে উঠেছে আকাশ। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে উড়ে উড়ে আসছে ভেজা মাটির গন্ধ। আমি জানালার ধার ঘেষে সেই ঘ্রাণ উপভোগ করছি।এই বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ আমার বেশ লাগে। পাশেই কিছু ফাইল রাখা। যা বাতাসের শক্তি গায়ে মাখিয়ে মৃদু মৃদু উড়ছে। মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছে সন্ধ্যার ঘটনাটা। সাদের সাথে আমি যেতে রাজী হতেই সে আর এক মূহুর্ত দেরি না করে বাইকে গিয়ে বসে আর স্টার্ট দেয়। আমিও ওর পিছু পিছু যাই আর ওর পিছে গিয়ে বসি। শক্ত করে বাইকটা ধরে রাখি। বাইকে বসতেই মন কেমন আনচান করে উঠে। উশখুশ করে উঠে। হয়তো এই প্রথম পর পুরুষের বাইকে উঠছি বলে। আগে ভাইয়ার বাইকে অনেক বারই উঠা হয়েছে তাই বাইকে উঠার অভিজ্ঞতাটা আমার আছে। বাইক চলতে শুরু করে। বাইকের স্পীড কমই ছিল। সে না জোড়ে চালিয়েছে আর না হার্ড ব্রেক কসেছে। বিষয়টা তখন ভালো লেগেছিল। সাদ আমার ঠিকানা জানতে চাইলে বলি, “মোহাম্মদপুর বি ব্লক।” তখন সে চমকিত হয়ে জানায় সেও নাকি মোহাম্মদপুরই থাকে। ও এ ব্লকে থাকে। কথা শুনে আমিও চমকাল। কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। সাদ আপন মনে বাইক চালাতে চালাতে বলে,
— ভার্সিটির লাইফে তুমি আমার সাথে অমনটা না করলেও পারতে।
সাথে সাথে আমি চমকে তাকাই। মনে পড়ে যায় সেই ১০ বছর আগের কথা। আমি তখন সবে মাত্র ডিইউতে ফিন্যান্স বিভাগে ভর্তি হয়েছি। সকল ফরমালিটি শেষে ক্লাস মনিটার হিসাবে আমাকে সিলেক্ট করা হয়। আমিও সে দায়িত্ব ভালো ভাবেই পূরণ করতে থাকি। ক্লাসের মনিটার হওয়া সুবাদে সকলেই চিনে গিয়েছিল আমায়। সাদও আমার সেকশনেই ছিল। কিন্তু কখনো আমাদের মাঝে কথা হয়নি। তো একবার কিছু এসাইনমেন্ট জমা নেওয়ার সময় আমার ওড়না পিছের বেঞ্চে লেগে যায়। আর সেটাতেই সেদিন সাদ বসেছিল। আমি ভুলবসত মনে করি যে সাদই আমার ওড়না ধরে টেনে ধরেছে। ভীতু প্রকৃতির ছিলাম তো আমি পিছে না ঘুরেই চিৎকার দিয়ে বসি। সেই চিৎকারে ক্লাসের স্টুডেন্টরা জোড়ো হয়। ঘটনা বুঝে সাদকে উল্টাপাল্টা বলতে শুরু করে। সাদ বেকুব বোনে রয়ে যায়। বুঝে উঠতে পারে না আসলে ঘটনা কি। এইদিকে আমি ওড়নাটা ছুটাতে যেয়ে বুঝতে পারি সাদ আমার ওড়না টেনে ধরে নি বরং বেঞ্চের সাথে বেজেছে। লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। কোন মতে সবাইকে থামিয়ে সাদকে সরি বলে ওড়না ছুটিয়ে চলে আসি। ব্যাস! এরপর থেকেই সাদ আমার পিছে পড়ে যায়। যতদিন ডিইউতে ছিলাম ও সবসময় আমাকে আমার নাম ও সেই ঘটনা নিয়ে পিঞ্চ করতো। এই নিয়ে আমার আর ওর মধ্যে লেগে যেত। কিন্তু কখনো ওর মধ্যে প্রতিশোধের ভাবনা নিয়ে আমার বিপক্ষে কাজ করতে দেখিনি। এরপর তো আমি সেখান থেকে চলেই আসি। পারি জমাই খুলনাতে। সাথে সব স্মৃতি বন্দী পড়ে যায় মনের কোঠায়। সেইসব ভেবেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। নিচু গলায় বলি,
— সেই বিষয় নিয়ে দুঃখিত।
সাদ হেসে বলে,
— তা অবশ্য তোমার হওয়াই উচিৎ। আমার মত ইনোসেন্ট একটা ছেলেকে ফাঁসিয়েছিলে তুমি। হুহ!
আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না। চুপ করে রইলাম। তা দেখে সাদ আর কিছু বললো না। নীরবে কেটে যায় সময়। সাদ আমায় বাসায় নামিয়ে চলে যায়। আমি বাসার ভিতর ঢুকতেই শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি।
হঠাৎ কানে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ কানে এসে বারি খেতেই আমি ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসি। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকাই। অহনা গাল ফুলিয়ে ধুপধাপ করে এগিয়ে আসছে। অহনা আমার সামনে এসে দুই হাত কোমড়ে রেখে ছোট ছোট ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে ঠোঁট উল্টিয়ে দাঁড়ায়। অহনার এমন মনোভাব দেখে আমিও ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে তাকাই। আদর মাখা কন্ঠে বলি,
— কি হয়েছে আমার মামনীটার? এইভাবে মুখ ফুলিয়ে আছে কেন?
অহনা আদো আদো গলায় বলে উঠে,
— তুমি কেন আমাকে আগের মত ভালোবাসো না? তুমিও কি পঁচা হয়ে গিয়েছ?
#চলবে
#আরশি
#Part_19
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
— তুমি কেন আমাকে আগের মত ভালোবাসো না? তুমিও কি পঁচা হয়ে গিয়েছ?
কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। মনের মধ্যে কোথ থেকে জানি এক ঝাঁক ভয় এসে বাসা বাঁধতে শুরু করে। ভিতরটা ধীরে ধীরে দুমড়ে মুচড়ে উঠতে শুরু করে। ছন্দছাড়া মনে হতে থাকে নিজেকে। মনটার মাঝে একটা প্রশ্ন বার বার আঁচড়ে পড়তে থাকে, “অহনা এই কথা কেন বললো আমি ওকে ভালোবাসি না? ওর নরম মনে এই প্রশ্ন কেন জাগ্রত হলো?” নিজেকে শান্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও আমি বার বার ব্যর্থ হচ্ছিলাম। ছটফটানি ভাব চলে আসছিল নিজের মধ্যে। তা দেখে অহনা আবার বলে উঠে,
— বলো না আম্মি! তুমি কি আর আমায় ভালোবাসো না?
কথা দ্বিতীয় বারের মত কর্ণপাত হতেই আমি স্থির হয়ে যাই। মনোবল শক্ত করলাম। নিয়ন্ত্রণে আনলাম নিজেকে। ঘন ঘন নিশ্বাস নিয়ে ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিৎ এক হাসি ঝুলিয়ে অহনার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দেই। ওকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে দেই। ওর নরম তুলতুলে গালে একটা চুমু খেয়ে ভালো মত জড়িয়ে ধরে বিনয়ী কন্ঠে বলি,
— তোমার এমন কেন মনে হলো মামণি যে আমি তোমায় ভালবাসি না? আম্মি তো তোমাকে এত এত এত ভালবাসে।
অহনা এইবার ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
— তাহলে তুমি কেন আগের মত আমার সাথে খেল না,আমায় গোসল করিয়ে দাও না,নিজ হাতে খায়িয়ে দাও না, ঘুরতে নিয়ে যাও না,আদর করো না।
সাথে সাথে বুকটা ধক করে উঠে। সত্যি তো অহনাকে এই কয়েকদিন যাবৎ ধরে ঠিক মত সময় দিতে পারছি না। নতুন নতুন কাজে জয়েন করেছি। প্রথমদিকে কাজ বুঝতে আমার বেশ কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে। এই ফাইল ওই ফাইল ঘাটতে হয়েছে। রাত জেগে সাদের দেওয়া বই- ফাইলগুলো দেখে শেষ করতে হয়েছে। ল্যাপটপের বিভিন্ন সাইট বুঝতে ও শিখতে হয়েছে। যার ফলে হাতের নাগালে কাজের গতিটা ধরা দিয়েছে। কিন্তু এর মাঝে যে আমার ছোট পরীটা কষ্ট পাচ্ছে তা তো বুঝতে উঠতে পারিনি। এমন নয় যে আমি অহনাকে দেখে রাখিনি। রেখেছি কিন্তু কম। মামার ভরসায় ছেড়ে দিয়েছিলাম। কথাটা বলা বাহুল্য যে, আমি কাজের প্রতি একটু বেশি মনোযোগ দেওয়ার ফলে ওর দিকে নজর একটু কম দিয়েছি। ওর সাথে ভালো মত সময় কাটাতে পারি নি, টুকিটাকি সময় কাটিয়েছি। কিন্তু এখন ওকে কিভাবে বুঝাই আমি এই কষ্ট গুলো ওর জন্যই করছি। ওর ভবিষ্যৎ সাজানোর জন্য আজ ওকে সময় দিতে পারছি না। এই ৫ বছরের অবুঝ বাচ্চাকে আমি কিভাবে বুঝাই আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি সবদিক সামলাবার কিন্তু পেরে উঠছি না। এই জীবনটা যে আমার জন্য একদমই ভিন্ন। আমি এইভাবে অভ্যস্ত নই। কিছু সময় আমার প্রয়োজন সব সামলে উঠার। আচ্ছা সকল কর্মজীবী মায়েরই এই একই কষ্টে ভুগে? যদি এমনই হয় তাহলে তো সকলে তাদের বাহিরটাই দেখে ভিতরটা না। তাদের মলিন হাসি চোখে পড়ে কিন্তু তাদের ভিতরের কষ্টটা না। আর এই কষ্টটাই তীব্র হয়ে উঠে যখন নাকি তার নিজের সন্তানই তাকে ভুল বুঝে। তাকে বলে উঠে, “তুমি তো আমায় ভালবাসা না। অন্যের মায়েদের মত আমার জন্য এটা ওটা করো না।” মনের মাঝে এই ভাবনাগুলো বিচরণ করতেই বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। সাথে এক রাশ বিষন্নতা। আমি আহত চোখে অহনার দিকে তাকিয়ে বলি,
— একটা গল্প শুনাই শুনবে?
অহনা জোরে দুইপাশে মাথা দুলাই। যার অর্থ হ্যাঁ সে শুনবে৷ আমি স্মিত হেসে বলা শুরু করি,
— এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার রাজত্বে ছিল এক রাণী আর এক ছোট রাজকন্যা৷ সাথেই ছিল তার অসংখ্য সৈন্য,শিপাহি। ছিল এক বিশাল প্রজা। খুব সুন্দর প্রসাদ ছিল তাদের। কিন্তু রাজাটা ছিল দুষ্টু প্রকৃতির। সে সকলের সামনে ভালো সেজে থাকলেও ভিতর দিয়ে ছিল ততোই বাজে। সে সকল প্রজাদের সামনে দেখাত সে তার রাণী আর রাজকন্যাকে খুব ভালোবাসে কিন্তু যখন তার প্রজারা তার সামনে থাকতো না সে তখন রাণীর সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করতো। মারতো। এমনকি সে তার রাজকন্যাকেও বকতো, দুই একসময় মারতোও। তাই রাজকন্যা রাজাকে সবসময় ভয় পেত। রাজা কখনো রাণী আর রাজকন্যাকে ভালোবাসে নি। সে সবসময় তাদের প্রসাদের চারদেয়ালে বন্দী করে রাখতো। কখনো কোথাও বের হতে দিত না। এইভাবে চলতে থাকে দিন। একদিন রাজা প্রসাদে নতুন এক রাণীকে নিয়ে আসে আর আগের রাণী ও রাজকন্যাকে প্রসাদ থেকে বের করে দেয়। এতে রাজকন্যা আর রাণী মোটেও কষ্ট পায় নি বরং তারা ছিল অনেক খুশি। কেন না তারা সেইদিন চিরতরের জন্য এই বন্দীশালা থেকে মুক্ত পেয়েছিল। তাই তারা ছিল খুশি। আর সেই খুশি মন নিয়েই তারা বেড়িয়ে যায় রাজ্য থেকে। সেখান থেকেই শুরু তাদের নতুন জীবনের রচনা।
এতটুকু বলে আমি নিঃশ্বাস ফেলি। অহনার দিকে তাকিয়ে দেখি ও আমার মুখপানে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুইটি বলছে সে বাকি কাহিনী শুনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে। আমি অহনার এমন উৎসুক দৃষ্টি দেখে আমি মুচকি হাসি। আবার বলতে শুরু করি,
— রাণী তার রাজকন্যাকে নিয়ে তার ভাইয়ের রাজ্যে উঠেন। সেখানে তাদের দিন ভালোই যাচ্ছিল কিন্তু তার ভাইয়ের উপর চাপ পড়ছিল। সে তার নিজের রাজ্য চালাতে হিমসিম খাচ্ছিল। কেন না তার রাজ্য ছিল অতি ক্ষুদ্র। মানে ছোট। আর তখন সেই বিষয়টা রাণীর চোখ এড়ায় নি। সে ঠিকই বুঝতে পেরেছি তার ভাইয়ের অভাব। তাই সে সেখান থেকে চলে আসতে নেয়। যখন তার চলে যাওয়ার সকল পরিকল্পনা স্থির তখনই সেখানে এসে হাজির হয় রাণীর একমাত্র মামা। রাণীর মামা ছিলেন অতি বুদ্ধিমতি একজন মানুষ। সে চারদিকে এক নজর বুলিয়েই সকল সমস্যার কথা জেনে যান। সব বুঝে তিনি তখন সকল সমস্যার সমাধান করে দেন আর রাণী ও রাজকন্যা তার সাথে নিজের রাজ্যে নিয়ে যান। মামার রাজ্যে তারা দুইজন বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু রাণীর মাথায় তখন জীদ চাপে সে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। নিজের এক রাজ্য তৈরি করবে আর নিজে রাজত্ব করবে। সাথেই রাজকন্যাকে পুরো রাজ্যের দেখাশুনা করার জন্য যোগ্য করে তুলবেন। যোদ্ধা বানাবেন তার রাজকন্যাকে। যাতে সে কখনো ভেঙ্গে না পড়ে। সেই পরিকল্পনা মনে নিয়েই রাণী কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন। দিন রাত খাটতে থাকেন। যার ফলে সে রাজকন্যাকে বেশি সময় দিতে পারতেন না। তার সাথে আগের মত খেলতে পারতেন না, তাকে খায়িয়ে দিতে পারতেন না, মনভরে আদর করতে পারতেন না। সে পরিকল্পনা করে একবার সব গুঁছিয়ে নিয়ে সে তার পুরো সময় রাজকন্যাকে দিবেন। কিন্তু অবুঝ রাজকন্যা তো সেটা বুঝতো না। সে ভাবত রাণী আর তাকে ভালবাসে না। তাই তাকে আদর করে না, তার সাথে খেলে না। একদা সে রাণীকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করে। রাণী তাকে বুঝাতে চাইলেন কিন্তু সে বুঝতে চাইলো না। ভুল বুঝলো রাণীকে। মুখ ফিরিয়ে নিল। রাণী এতে খুব কষ্ট পেলেন। রাণীর মনে তো শুরু থেকেই কষ্ট ছিল। কিন্তু কখনো তা প্রকাশ করতেন না। কারণ সে ভাবতো তার কষ্ট দেখতে পেয়ে রাজকন্যাও খুব কষ্ট পাবে। কিন্তু যখন রাজকন্যা তার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো তখন যেন তার কষ্ট দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তাও সে দমে যায়নি। একা সব কাজ করতে থাকেন। দেখতেই দেখতে কেটে যায় বহু বছর। ধীরে ধীরে রাণী গড়ে তুলেন গোটা এক রাজ্য। হয়ে উঠেন সেই রাজ্যের রাজরানী। রাণী ছিলেন ভীষণ দয়ালু। তিনি সবসময় তার প্রজাদের সাহায্য করতেন। যার ফলে ধীরে ধীরে তার গুনগান চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। হয়ে উঠেন প্রভাবশালী রাণী। তা দেখে অন্যের রাজ্যের রাজারা ঈর্ষা করতে শুরু করে। রাণীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে। অন্যদিকে রাজকন্যা তখনও রাণী প্রতি নারাজ। কোন কথা বুঝতে সে রাজি নয় সে। দুইজনের মাঝে তৈরি হয় বিশাল দূরত্ব। আর এই দূরত্বের ফায়দা উঠায় অন্যের রাজ্যের রাজারা। তারা রাজকন্যাকে ব্যবহার করে রাণীকে নিজের পথ থেকে সরানোর পরিকল্পনা করে। আর সফলও হয়। রাজকন্যা রাণীর খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়। রাণী সেই বিষাক্ত খাবার খাওয়ার পরে তার রাজকন্যাকে নিজের রুমে ডেকে আনেন। তাকে রাজ্যের দায়িত্ব দেন। রাজরাণীর মুকট পড়িয়ে দেন। শেষবারের মত রাজকন্যাকে বুঝান যে তিনি কেন তখন তাকে আদর করতে পারেন নি। সময় দিতে পারেন নি। সাথে তিনি এইটাও জানান সে জানতেন খাবারের বিষ কিন্তু তাও তিনি সেই খাবারটা খেয়েছেন একমাত্র রাজকন্যার খুশির জন্য। তখন সব জেনে রাজকন্যা নিজের ভুল বুঝতে পারে আর রাণীর কাছে ক্ষমা চায়। রাণীর ভালবাসা চায়। কিন্তু ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল। রাণী তখনই লুটিয়ে পড়ে মাটিতে আর তৎক্ষনাৎ সেইখানেই মারা যান। রয়ে যায় শুধু আর্তনাদ আর অনুশোচনা।
আমার কথা শুনে অহনা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আমার বুকে মুখ লুকায়। আদো আদো গলায় বলে উঠে,
— আমিও তো রাজকন্যার মত তোমাকে ভুল বুঝেছি তাই না আম্মি?
কথাটা শুনে আমি অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি,
— আমি জানি আমার মামণি খুবই বুদ্ধিমতি। বুঝদার। আম্মি তাকে বুঝালে সে ঠিকই আম্মির কথা বুঝবে। সে তো আর ওই রাজকন্যার মত বোকা নয় তাই না?
অহনা জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায়। আমি মুচকি হেসে বলি,
— আম্মি যা করছে তোমার জন্যই করছে সোনা। একটু সময় দাও আম্মিকে, আম্মি সব গুছিয়ে উঠলেই তোমাকে আগের মত সময় দিবে। তোমার সাথে খেলবে। আদর করবে। এখনও করবে কিন্তু হয়তো তা একটু কম কম লাগবে। কিন্তু তুমি এতে মানিয়ে নিতে পারবে না?
— হুম পারবো। তুমি আমায় আদর না করলেও চলবে শুধু তুমি আমার পাশে থেক। আমার আর কিছু চাই না। প্রমিস!
আমি অহনার মুখ তুলে তার কপালে চুমু একে বলি,
— এই গল্প থেকে কি শিখলাম জানো? সম্পর্কে কখনো দূরত্ব আসতে দিতে নেই। ভুল বোঝাবুঝি হলে তা মিটিয়ে নিতে হয় কখন তা মনের মধ্যে পুষে রাখতে হয় না। না হলে সম্পর্কে ফাটল ধরে যায়। আর এত মোক্ষম সুযোগই খারাপ মানুষেরা নেয়। তো তুমি কখনো আম্মিকে ভুল বুঝবে না কেমন। আর মনের মধ্যে কোন প্রশ্ন হতে আম্মিকে জিজ্ঞেস করবে। ঠিক আছে?
অহনা মাথা দুলায়। কিছু বুঝা আগেই সে টুপ করে আমার গালে চুমু দিয়ে বসে আর গলা জড়িয়ে ধরে।
___________________________
সবে ভোর হতে শুরু করেছে। সূর্যদেব তার নরম আলো ছড়িয়ে দিয়ে আলোকিত করছে আধারে ডুবে থাকা জগৎটাকে৷ দূর থেকে ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ। দক্ষিণা বাতাস বইছে। এক কিঞ্চিৎ রোদ এসে উঁকি দিচ্ছে জানালার ফাঁক দিয়ে। আমি ফজরের নামাজটা আদায় করে অহনার কাছে এগিয়ে গেলাম। হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে সে। আমি অহনার মাথায় ফুঁ দিয়ে ওর পাশে বসি। মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। বেশ কিছুক্ষণ পর নামাজের পোশাক ছেড়ে অন্য পোশাক পড়ি। চলে যাই রান্নাঘরে দিকে। ডাইনিং রুমে আসতেই কানে ভেসে আসে পুরুষালী কন্ঠে কোরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ। অতি মিষ্টি তার সুর। সাথে সাথে আমি থমকে যাই। সর্তক চোখে মামার রুমের দিকে তাকাই। ধীর পায়ে এগিয়ে যাই তার রুমে। দরজা ভেজানো। আমি আলতো হাতে দরজাটা ঠেলে দেই। উঁকি মারি ভিতরের দিকে। রুমের মধ্যভাগে পাটি বিছিয়ে একজন মধ্যবয়স্ক মানব বসে আছে। গায়ে তার ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর পায়েজামা। মাথায় টুপি। রেহালের উপর কোরআন শরিফটা রেখে সে এক ধ্যানে তা তিলাওয়াত করছে। আমি চেয়ে রই সেইপানে। ওড়না টেনে মাথায় কাপড় দেই। দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে শুনতে থাকি তিলাওয়াতটা। বেশ কিছুক্ষণ পেরুতেই মাথায় টনক নাড়ে, ” মামা আজ কোরআন তিলাওয়াত কেন করছে? তিনি তো সচারাচর কোরআন তিলাওয়াত করেন না। যখনই কারো মৃত্যুবার্ষিকী আসে তখনই… ” কথাটা মনে হতেই আমার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে যায়। মনটা অস্থির হয়ে উঠে। দ্রুত মনে করার চেষ্টা করি আজকের তারিখটা। মনে পড়তেই আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। করুণ চোখে তাকাই সামনের দিকে। মনটা ধীরে ধীরে ভরে যায় বিষাদে। বুকটা ভারী হয়ে আস্তে শুরু করে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করি। কিভাবে ভুলে গেলাম আমি যে আজকে মিহি আন্টির মৃত্যুবার্ষিকী।
#চলবে
রেগুলার দিতে পারবো কি না জানি কিন্তু চেষ্টা করবো। রেগুলার দিতে না পারায় অসম্ভব দুঃখিত।