আরশি পর্ব ১৬+১৭

#আরশি
#Part_16
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— শাড়িটা মিহি আন্টির না? আজ হঠাৎ এতদিন পর বের করলে যে?

আমার কথায় যে মামার মধ্যে কোন ভাবান্তর তা কিন্তু না। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কোন কথা বললেন না। আমি তখনও মামার মুখপানে উত্তরের আশায় চেয়ে রই। সে নিজের চোখ আমার দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে সামনে থাকা আলমারির দিকে চেয়ে রইলো। আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম তার নিকট। তার পায়ের সামনে দুই হাটু ভাজ করে মেঝে বসে পড়লাম। নরম চোখে তাকালাম মামার মুখ পানে। কেমন মলিন হয়ে আছে। আমি সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে মামাকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তার চেহেরায় বয়সের ছাপ গাঢ় হয়ে আসছে৷ চিবুকের দিকে চামড়া ঝুলতে শুরু করেছে।ইতিমধ্যে চামড়ায় ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। চোখ দুইটি ভেতরে ডেবে গিয়েছে। তক খসখসে হয়ে গিয়েছে। ঠোঁট দুইটি শুকিয়ে কেমন আধমরা হয়ে আছে। অর্ধেক পড়ে যাওয়া চুলগুলো কেমন প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে আছে। মামাকে আগে এইভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। করলে হয়তো বুঝতে পারতাম তিনি ভালো নেই। একদম ভালো নেই। কিছুক্ষণ মামার পানে তাকিয়ে থেকে নিচে তাকাই। সাথে সাথেই সর্বপ্রথম গাঢ় বাসন্তী রঙের জামদানী শাড়িটি চোখ কাড়ে। রঙটা এখনো চকচক করছে। তারই পাশে রাখা কিছু হলদে রাঙ্গা রেশমি চুড়ি, একটা ছোট আলতার কোটা, ছোট কাজলের একটা কৌটা ও একটি রঙ উঠে যাওয়া পায়েল। জিনিসগুলো দেখেই বুঝাই যাচ্ছে এতটা বছর কত যত্নে সহকারে তুলে রাখা হয়েছিল। অতি গভীর ভালবাসার আবরণে মুড়িয়ে রাখা হয়েছিল এইগুলোকে। সব দেখে আমি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,

— এখনো জিনিসগুলো আগলে রেখেছ? তা ক’বছর হলো? ১১ নাকি ১২?

মামা এইবার শীতল কন্ঠে বলে উঠেন,

— ১১ বছর ৮ মাস ৯ দিন হলো।

সাথে সাথে আমি ভরকে যাই। শীতল চোখে তাকিয়ে রই তার মুখপানে। ভেবেছিলাম বছর হয়তো গুনে রেখেছে কিন্তু না সে যে মাস দিন পর্যন্ত গুনে রেখেছে। আমি নিচু গলায় বলি,

— দেখে বুঝাই যায় না জিনিসগুলো আসলে এত বছর পুরানো। এখনো নতুনত্বের ছাপ রয়েই গিয়েছে।

মামা স্মিত হাসলেন। তা দেখে আমি বলি,

— এখনো এত ভালবাসো মিহি আন্টিকে?

মামা কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। কয়েক মূহুর্ত এইভাবেই কেটে যাওয়ার পর মামা নরম কন্ঠে বলে উঠেন,

— জানিস! আমার প্রথম পাওয়া পারিশ্রমিকের টাকা দিয়ে মিহি আর মায়ের জন্য দুইটা শাড়ি । মায়ের শাড়িটা মাকে দেওয়া হলেও ওর শাড়িটা দেওয়া হলো না।

কথাটা শুনে আমি চুপ করে রইলাম। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম আমার মুখ পানে। মামা আবার বলে উঠলেন,

— ওর না খুব ইচ্ছে ছিল, কোন আষাঢ়ে প্রবল বর্ষণের দিনে গায়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি জড়িয়ে বৃষ্টিবিলাস করবে। এক পায়ে পায়েল জড়িয়ে মৃদু মৃদু ঝঙ্কার তুলবে স্বচ্ছ বর্ষণের ধারায়। পায়ের উপরের পৃষ্ঠায় রাঙ্গাবে রক্তিম আভায়। আবার সেই পায়ের ছাপই ছেড়ে দিবে বর্ণহীন পানির ধারায়। গভীর ঘন কাজল দিয়ে সাজাবে নিজের দুটি নয়ন আর আমাকে ওর আঁচলের শেষ প্রান্তে বেঁধে নয়ন দুইটির দায়িত্ব দিবে আমায়। লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছে দেওয়ার দায়িত্ব। সেই ইচ্ছের সাথেই ছিল কত শত স্বপ্ন তার। বেশিরভাগই ছিল আজগুবি স্বপ্ন বেশি ছিল। এই যেমন, আমাদের নাকি ছোট এক সংসার হবে। কুঁড়ে ঘরের ছাউনি দেওয়া একটা ঘর। আমি মাঠে কাজ করতে গেলে রোদ্দুরে নিজের ঘাম ঝড়াব তখন নাকি সে মাথায় কাপড় দিতে আমার জন্য গরম ধোঁয়া উঠা ভাত আর ভর্তা নিয়ে হাজির হবে। মাঠের কোন এক ছাউনিতে বসে আমার মাথার ঘাম মুছে দিবে। আমি যখন তৃপ্তি করে ভাত খাব সে দুই নয়ন জুড়ে আমায় দেখবে। কি আজগুবি স্বপ্ন ছিল দেখেছিস। কিন্তু দেখ শেষে নিজেরই হাতে বোনা সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়ে এক নিমিষে চলে গেল। আমায় কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে নিজের পারি দিল সুখের রাজ্যে।কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে বেঁধে গেল প্রতিশ্রুতির মায়াজালে। যে মায়াজালে আমি এখন ফেঁসে আছে। এখন তো এর শিকড় ছড়িয়ে পড়েছে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
মানুষ ঠিকই বলে, “দিন শেষে প্রতারকরাই সুখে থাকে।” দেখিস না ও কত সুখে আছে। ভালো আছে।

কথাটি বলার সাথে সাথে মামার চোখ রক্তিম লাল হয়ে যায়৷ চোখের মনি ঝলমল করে উঠে। শেষের কথাটা উচ্চারণ করার সময় কন্ঠ কেঁপে উঠে। বুঝতে আর দেরি মামা আজ নিজের মধ্যে নেই। সে আজ বেসামাল হয়ে গিয়েছে। অনুভূতিরা যেন তাকে ঝাঁকড়ে ধরেছে তাকে। হঠাৎ আমার দুই নয়নে নেমে আসে বর্ষার ধারা। যা গড়িয়ে নেমে আসে গাল থেকে চিবুক পর্যন্ত। আমি অস্পষ্ট সুরে বলি উঠি,

— সে প্রতারক নয় মামা। সে তো তোমার বিরহে বিরহিত হওয়া এক মায়াবিনী। যার ভালবাসা এতটাই প্রখর ছিল যে তার রেশ তুমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছো না। আর হয়তো কখনো কাটিয়ে উঠতেও পারবে না। সেই ক্ষমতা যে তোমার নেই।

মামা কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। নিরলস তার ভাব ভঙ্গি। আমি কিছুক্ষণ মামার মুখপানে তাকিয়ে থাকি। ভাবতে থাকি, ঠিক কতটাই না ভালবাসতো দুইজন দুইজনকে। তাদের ভালবাসার সাক্ষী যে সে নিজেই। সে তো দেখেছে তাদের সম্পর্ক কেমন ছিল। কতটা মিষ্টি ছিল। কিন্তু এক দামকা হাওয়া এসে সব তছনছ করে দিল। আলাদা করে দিল তাদের। কিন্তু তাও ভালবাসাটায় কোন ফাটল ধরলো না। এখনো সেই সোনার খাঁটিই আছে।
আমি কিছুক্ষণ মামার পাশে বসে থেকে চলে যাই নিজের রুমে। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চোখ দুইটি এখনো জ্বলছে। হয়তো বাঁধ ভেঙ্গে বেরুবে বর্ষণের ধারা। হঠাৎ খেয়াল করলাম। আকাশে কালো ঘন মেঘ জমেছে। শো শো শব্দ করে বাতাস বইছে। তার সাথে মিশিয়ে উঁড়ে বেড়াচ্ছে ধুলোবালি। গাছের ডালপালা একে অপরের সাথে বারি খাচ্ছে৷ মাঝে মধ্যে মেঘ তীক্ষ্ণ স্বরে জেগে উঠছে। প্রত্যেক ডাকে যেন তীব্র আর্তনাদ লুকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কাউরো কষ্ট যেন দেখে তাদের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। তাই তার এবং নিজের কষ্ট মিহিয়ে দিতে সে বৃষ্টি হয়ে নামতে চাইচ্ছে। কতটাই না আকুলতা তার। আমি একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। এমন সময় বিকট শব্দে মেঘ হাহাকার করে উঠলো সেই সাথে ভেসে এলো অহনার তীব্র চিৎকার। চিৎকারটা কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতেই হকচকিয়ে উঠে। দ্রুত পায়ে চলে যাই রুমে। খাটে উঠে অহনাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেই। মেয়েটা আমার ছোঁয়া পেয়ে পিঠের জামা আঁকড়ে ধরে। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। ফুঁপানোর ফলে চেহেরায় ফুটে উঠে রক্তিম আভা। মেঘের ডাকটা যে সে ভীষণ ভয় পায় ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি কিছু না বলে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

__________________________________________________

দেখতেই দেখতে ২ দিন কেটে গেল। কাজের ব্যস্ততায় কেটেছে আমার দিনগুলো। কাজগুলো নিজের আয়ত্তে আনার বেশ চেষ্টা করছি। গতকাল রাতেই মামা নিউ একটা ল্যাপটপ কিনে এনেছেন আমার কাজের জন্য। আমারও এতে সুবিধা হয়েছে। বার বার মামার রুম থেকে ল্যাপটপটা আনতে কেমন বিব্রতবোধ করছিলাম। মামা হয়তো বিষয়টা বুঝতে পেরেই নতুন একটা কিনে নিয়ে এসেছেন।

সাদের কেবিনে আধা ঘন্টা যাবৎ ধরে বসে আছি আমি। অথচ এই ছেলেটার কোন খোঁজ খবরই নেই। অসহ্য লাগছে বেশ। ও আমাকে কিছু ফাইল দেখতে দিয়েছ। এখন সেগুলো ওকে দেখাতে হবে। ও যতক্ষণ না ফাইলগুলো দেখে এপ্রুভাল দিচ্ছে ততক্ষণ আমি পরবর্তী কাজে এগুতে পারবো না। আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর সাদ মহোদয়ের আবর্তন ঘটে। কেবিনে ঢুকতেউ সর্ব প্রথম আমাকে দেখতে পেয়ে বেশ অবাকই হলো বোধ হয়। এমন ভাবার কারণ ওর কপালের সুরু ভাঁজটি। সে কিছু না বলে আগে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। অতঃপর স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,

— আজকের সূর্য কোন দিক দিয়ে উদয় হয়েছে যে মিস আরশি আমার দরবারে এসে দাঁড়িয়েছেন?

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদ এর দিকে তাকিয়ে বলি,

— আপনি একটু বেশি কথা বলেন।

— তাই নাকি? কিন্তু আমার জানা মতে আমি খুব অল্প পরিমাণে কথা বলি। তাহলে কি আমার জানায় ভুল আছে?

— মানুষের স্বভাব মনের মধ্যে নিজের প্রতি এক ভুল ধারণা পোষণ করে রাখা। আপনার বেলায়ও বিষয়টা ব্যতিক্রম নয়।

— আহা! কত সুন্দর উক্তি। মন যেন খুশিতে নেচে উঠলো।

কথাটা শুনে আমি কটমট দৃষ্টিতে সাদ এর দিকে তাকাই। কথায় কথায় পিঞ্চ করার স্বভাব যে এর জন্মগত তা নিয়ে আমার মনে আর কোন সন্দেহ নেই। আমি কিছু না বলে ধুপ করে তার সামনে ফাইলগুলো এগিয়ে দিলাম। সেগুলো দেখে সাদ মুচকি হাসে। সাথে সাথে গালের মাঝে তৈরি হয় সেই গর্তটি। বরাবরের মত এইবারও সেই গর্তটা আমার চোখ কাড়লো। কিন্তু অবাক করার বিষয় আজ চোখের সামনে শুধু অহনার চেহেরাটা ভেসে উঠলো। ফাহাদের কোন অস্তিত্বই চোখের সামনে আসলো না। তাহলে কি আমি ওকে একটু একটু করে ভুলিয়ে দিচ্ছি? অতীতকে পেছনে ফেলে নব্য জীবন সূচনা লিখছি?

সাদ ফাইলগুলো খুব গভীর মনোযোগ সহকারে দেখছে। একেকটা পয়েন্ট চেক করছে। ফাইলগুলো দেখা শেষে ফাহাদ চওড়া হাসি দিয়ে বলে,

— গুড! আ’ম ইম্প্রেসড। ৩ দিনের মাঝেই ভালোই নিজের আয়ত্তে নিয়ে এসেছ। এইভাবে কাজ বুঝতে ও করতে থাকে সে দিন দেরি নয় যে তুমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওয়াইফের স্বীকৃতি পাবে। চালিয়ে যাও মিস দর্পণ। আই নো ইউ ক্যান ডু ইট।

প্রথম কথাটি শুনে যতটা না ভালো লাগলো লাস্টের কথাগুলো শুনে আমি পুরাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। মনে মনে ফুঁসে উঠি। ভাবতে থাকি, মানে একটা মানুষ ঠিক কতটুকু বদের হাড্ডি হলে এমন হতে পারে? ভার্সিটি লাইফেও এমন করেছে এখনো তেমনই করছে। জাস্ট অসহ্য! আমি কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলি,

— এতটা লেম মোটিভেশান আমি জীবনেও শুনি নি। যে কেউ আপনার কথা শুনলে নির্ঘাত ডিপ্রেশনে চলে যাবে।

সাদ এইবার চিবুকের উপর এক হাত রেখে ভাবার অভিনয় করে বলে,

— তাই নাকি? বিষয়টা তো তাহলে ভাবার বিষয়। তুমি এত বুদ্ধিমতি আগে জানা ছিল না। নাহলে বহুত আগেই তোমার এই সুন্দর চরণের দর্শন করতাম। তোমার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতাম।

আমি কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলি,

— ফুলানো হচ্ছে আমাকে? আপনার বউ যদি জানতে পারে আপনি অন্যের গুনের বাহারে পঞ্চমুখ হচ্ছেন তাহলে কি হতে পারে জানেন তো?

সাদ আমার কথাটা শুনে এক মূহুর্তের জন্য থমকে যায়। নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রয় আমার মুখপানে। এতে আমি অস্বস্তিতে পড়ে যাই। বুঝতে পারি বেশি বলে ফেলেছি। বেশ কিছুক্ষণ পর সাদ মিষ্টি হেসে নির্ভয়ে বলে,

— আমার বউ অনেক ভালো বুঝলে। সব শুনবে ঠিকই,রাগে ফুলবেও ঠিকই কিন্তু আমাকে কখনোই কিছু বলবে না। সো সেটা নিয়ে কোন প্যারাই নাই চিল।

সাদের কথা টনে বুঝা যাচ্ছে সে বিষয়টা নরমালি নিয়েছে। নেগেটিভে নেয় নি। কথা ভেবেই আমি একটু প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেই। এরপর আমি পুরোপুরি শীতল রুপ ধারণ করি। সাদ তা দেখে হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝতে তাই কথা না বাড়িয়ে আমায় নতুন কিছু ফাইল আর কাজ বুঝিয়ে দিতে শুরু করে। আমিও কাজগুলো ভালো মত বুঝে নিয়ে তার কেবিন থেকে বেড়িয়ে আসি।
#আরশি
#Part_17
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

অফিসে জয়েন করেছি আজ ১ মাস হতে চললো। চাকরিটা আমার পার্মানেন্টলি কনফার্ম হয়ে গিয়েছে। আমার কাজের কোয়ালিটি ভালো ও নিখুঁত হওয়ায় চাকরিটা অবশেষে হয়েই গেল। এরই মধ্যে জেসমিনের সাথে আমার বেশ খাতির হয়েছে বটে। এতদিনে যতটুকু ওর সম্পর্কে জেনেছি তাতে এতটুকু বুঝেছি, মেয়েটা ক্রিশ্চিয়ান হলেও স্বভাবে ভারী মিষ্টি একটা মেয়ে। তার ভিতরে কোন প্যাঁচ গোঁজ নেই। সরল মনের মানুষ। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে নিজের গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। এই অফিসে প্রায় ৩ বছর ধরে আছে। ৬ মাস হলো বিয়েও করেছে৷ বিবাহিত জীবনে নাকি বেশ সুখীও। জেসমিনের পাশাপাশি এই কয়েকদিনে অফিসের সকলের সাথে মোটামুটি একটা ভাব হয়ে গিয়েছে৷ এইখানের সকলেই বেশ ভালো আর মিশুক। শুধু দুই একজন বাদে। বস্তুত, দশজনের মধ্যে নয়জন ভালো হলে একজন খারাপ অবশ্যই হবে। এইটাই প্রকৃতির নিয়ম।

নিজের ডেস্কে বসে কিছু কাজ করছি। এমন সময় জেসমিন এসে হাজির হয় আমার সামনে। মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

— হেই আরশি! কি করছ?

আমি মাথা তুলে জেসমিনকে দেখে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলি,

— এইতো ফাইলগুলো দেখছিলাম। কেন কোন দরকার?

— দরকার তেমন কিছুই না। লাঞ্চ টাইমে কাজ করছ তাই বললাম। লাঞ্চ করবে না?

জেসমিনের কথা শুনার সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। আমি টেবিলের উপর রাখা টেবিল ঘড়ির দিকে তাকাই। হ্যাঁ ঠিকই লাঞ্চ টাইম শুরু হয়ে গিয়েছে অথচ আমি টেরই পাই নি৷ জেসমিন না বললে হয়তো খেয়ালও করতাম না। আমি জেসমিনের দিকে মিষ্টি হেসে বলি,

— ফাইলটা চেক করছিলাম বিধায় সময়ের দিকে খেয়াল ছিল না। তুমি না বললে হয়তো আজকে লাঞ্চটা স্কিপ হয়ে যেত।

— মেনশন নট! বাট লাঞ্চে কি খাবে?

— আমি বাসা থেকে লাঞ্চ এনেছি। ডোন্ট ওয়ারি।

কথাটা বলতেই বলতে আমি ব্যাগ থেকে মিডিয়াম সাইজের এয়ারটাইট বক্সটা বের করে নিলাম। টেবিলের উপর বক্সটা রেখে জেসমিনকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

— তুমি দাঁড়াও আসছি আমি৷

এই বলেই আমি ওয়াশরুমের দিকে চলে যাই। হাত ধুয়ে নেই। নিকাবটা খুলে চোখে মুখেও একটু পানি দিয়ে নেই। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে দেখি জেসমিন একটা চেয়ার টেনে আমার ডেস্কের সামনেই বসেছে। আমি এইবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখি এই মূহুর্তে অফিসে মানুষ তেমন একটা নেই। লাঞ্চ টাইম বিধায় সকলে গিয়েছে নাইন্থ ফ্লোরের ক্যান্টিনে আড্ডা জমাতে। আর যারা আড্ডায় যেতে চায় নি তারা কয়েকজন একত্রিত হয়ে এইখানেই খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে। আমি আর কোনদিকে না তাকিয়ে চলে যাই নিজের ডেস্কে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে জেসমিনকে উদ্দেশ্য করে বলি,

— তুমি লাঞ্চ করবে না?

জেসমিন স্মিত হেসে বলে,

— আজকে আনতে ভুলে গিয়েছি। নুহাস আমার লাঞ্চ প্যাক করে টেবিলেই রেখেছিল কিন্তু আজ লেট হয়ে যাওয়ায় তারাহুরো করে বেরিয়ে পড়ি আমি। যার ফল আজ লাঞ্চ নেই আমার ভাগ্যে।

আমি কৌতূহলবসত জিজ্ঞাস করি,

— ভাইয়া রান্না করে?

— হ্যাঁ! সকালের নাস্তাটা ও বানায় আর রাতেরটা আমি। সকালে আমি উঠতে পারি না তাই সকালে নাস্তাটা ও করে। বাকি অবশ্য সকল কাজেই ভাগাভাগি করি আমরা।

কথাটার প্রত্যুত্তরে কি বলা যায় তা খুঁজে পেলাম না। তাই ছোট করে ‘ও’ বললাম। বাইরে দিয়ে কিছু প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে কথাটা শুনে বেশ ভালো লাগলো। মনে মনে ভাবলাম, ” যাক সবাই এক না।” এরই মাঝে জেসমিন বলে উঠে,

— কিন্তু এর মধ্যে আমার একটাই কষ্ট। নুহাস কাপড় ধুতে চায় না। গর্ধবটা নাকি উগান্ডা যেতে রাজি কিন্তু কাপড় ধুতে না। অতঃপর আমাকেই উকেন্ডে সব কাপড় ধুতে হয়। কি কষ্ট আমার।

আমি জেসমিনের কথা শুনে ঠোঁট টিপে হেসে বলি,

— ইশ! কত কষ্ট।

জেসমিন আমার কথায় সাই দিয়ে বাচ্চাদের মত ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,

— হ্যাঁ বহুত কষ্ট। জীবনটাই বেদনার।

আমি এইবার হাসিটা দুই ঠোঁটের মাঝে পিষে রাখতে পারলাম। ঠোঁটের দুইপাশ প্রসারিত হয়ে বেড়িয়ে স্বচ্ছ হাসি৷ সেই হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখেই আমি বলি,

— আজ আমার সাথেই খাও। আর না করার কিন্তু সুযোগ নেই। তুমি আর আমি আজ একসাথেই লাঞ্চ করবো।

জেসমিন তাও সৌজন্যতার খাতিরে বলে উঠলো,

— না না তার কোন দরকার নেই৷ আমি এইভাবেও ক্যান্টিনে যাচ্ছিলাম ওখান থেকে কিছু খেয়ে নিব নে৷

— তো আমার সাথে খাওয়ার পর আবার ক্যান্টিনে গিয়ে খেয়েও। কেউ ধরে রাখবে না তোমাকে।

— আমাকে দেখে কি রাক্ষসী মনে হয়?

আমি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,

— না তো! তোমাকে তো একদম পুতুল লাগে।

— এই যাহ!

আমি কিছু না বলে হাল্কা হাসি। খাবারের বক্সটা হাতে নিয়ে ঢাকনা খুলতেই চারদিকে বিরিয়ানির ঘ্রাণটা ছড়িয়ে পড়ে। জেসমিন ঘ্রাণ পেয়ে বলে,

— বাহ! চিকেন বিরিয়ানি এনেছিস?

আমি মুখে কিছু না বলে মাথা দুলালাম করলাম। যার অর্থ হ্যাঁ। তারপর বক্সের ঢাকনায় নিজের জন্য একটু বিরিয়ানি নিয়ে বাকিটা জেসমিনকে দিয়ে দিলাম। সাথে একটা চামচ। জেসমিন চামচটা নিয়েই খাওয়া শুরু করে। এক চামচ খেয়ে বলে,

— বিরিয়ানি কে বানিয়েছে?

কথা শুনে আমি সরু চোখে জেসমিনের দিকে তাকালাম। বুঝার চেষ্টা করলাম বিরিয়ানি খারাপ হয়নি তো। সকালে তারাহুরো করে অহনার জন্যই চিকেন বিরিয়ানি করেছিলাম। বিরিয়ানিটা আবার অহনা ভীষণ পছন্দ করে। গতকাল রাতেই বেশ জিদ ধরেছিল বিরিয়ানি খাবে। তাই আজকে সকালে আসার আগে সে রান্না করে দিয়ে আসে৷ আর নিজের জন্য একটু নিয়ে আসে কিন্তু টেস্ট করা হয়নি এখনো। আমি জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে হাল্কা হাসির রেখা ঠোঁটের কোনে ফুটিয়ে তুলে বলি,

— আমি রেঁধেছি। কেন ভালো হয়নি বুঝি?

— ভালো হয়নি মানে একদম ফাস্ট ক্লাস হয়েছে। এত সুস্বাদু বিরিয়ানি আমি আর কোথাও খাই নি। মানতে হবে তোমার হাতে জাদু আছে।

— তুমি এখন একটু বেশি বলছো।

— একদম না। আমার বরং মনে হচ্ছে কমিয়ে বলছি। সত্যি অসাধারণ হয়েছে। এন্ড তুমি কিন্তু আমাকে এইটার রেসিপি দিবে। আমি ট্রায় করবো।

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাই যে রেসিপি দিব। জেসমিন মুখে তৃপ্তির হাসি ঝুলিয়ে বলে,

— সরি ব্রো বাট এখন থেকে তোমার খাবারে আমি ভাগ বসাচ্ছি। তুমি দিতে না চাইলেও আমার কিছু করার নেই।

— আচ্ছা আচ্ছা ভাগ বসিও।

কথাটা বলে একগাল হাসলাম।

___________________________________________

কৃষ্ণ মেঘে মেঘে ছেয়ে আছে বিষন্ন আকাশ। ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। সূর্যদেব তার তেজি রশ্মি নিয়ে লুকিয়ে পড়েছে পশ্চিম আকাশে গহীনে। তীব্রগতিতে বাতাস বইছে৷ ঝড় আসার পূর্বাভাস। আমি বাস স্টেন্ডে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ মুখে বিরক্তির রেশ লেগে আছে। আজও বাস আসতে লেট করছে৷ এইদিকে আকাশের অবস্থা ক্ষণে ক্ষণে খারাপ হচ্ছে। আজ বাসায় পৌঁছাতেও পারবো কি না কে জানে। আমি যখন এইসব ভাবছি তখন হর্ণের আওয়াজ কর্ণধারে এসে বারি খায়। সাথে সাথে আমার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে দেখি একটা কালো রঙের বাইক আমার থেকে এক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। তার উপর একজন হেলমেট পরিহিত মানব। গায়ে ফরমাল ড্রেস। আমি সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে বাইকওয়ালার দিকে তাকাতেই সে নিজের হেলমেট খুলে নেমে পড়ে। তাকে দেখা মাত্র আমি হকচকিয়ে যাই৷ এই মানবটিকে এই মুহূর্তে আমি এইখানে মোটেও আশা করি নি। আমি চোখ নামিয়ে নেই। এরই মাঝেই সেই জলজ্যান্ত মানবটি আমার সামনে এসে মিষ্টি কন্ঠে বলে,

— মিস দর্পণ কি বাসের জন্য অপেক্ষা করছে?

আমি সাদের কথা শুনে চোখ তুলে তাকাই। আমি কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— তা নয়তো দেখে কি মনে হচ্ছে?

— মনে তো হচ্ছে যে, কোন এক বিষাদী কন্যা বিষাদের সাগর হতে উঠে এসে তার আপেক্ষিক দৃষ্টি আকাশে পানে স্থির করেছে। নয়নে বিষাদে আকাশকে করে তুলছে বিষন্ন।

আমি কটমট দৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকিয়ে বলি,

— আপনাকে মেনেজার না হয়ে কাব্যিক হওয়া উচিৎ ছিল।

সাদ এক গাল হেসে বলে,

— আমার বউও একই কথা বলে। আমাকে নাকি কাব্যিক হওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু কথাটা তো সেটা না কথাটা হচ্ছে, তোমাদের দুইজনের কথা মিললো কিভাবে? এই তুমি আমার বউকে স্টক করছো না তো?

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকাতেই সে ফিক করে হেসে দেয়। অতঃপর স্বাভাবিক ভাবেই বলে,

— ওকে কুল ডাউন! আই ওয়াস কিডিং। তুমি সব বিষয় এত সিরিয়াস নাও কেন বুঝি না ভাই।

আমি কিছু না বলে চুপ করে রই। কথাটা সত্যি যে আমি সকল কথা সিরিয়াসলি নিয়ে নেই। কেন যেন আমি সকলের সাথে ফ্রি হতে পারি না। মিশা আর ফ্রি হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। সকলের সাথে মিশা গেলেও ফ্রি হওয়া যায় না। সাদের বেলায়ও তাই। ভেবেই আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। এর মধ্যেই সাদ বলে উঠে,

— বাসের জন্য অপেক্ষা করছো?

আমি শীতল কন্ঠে বলি,

— হুম।

সাদ কিছু চিন্তা করে বলে,

— কিন্তু বাস আজ পাবে বলে মনে হচ্ছে না। সামনের বড় রাস্তার দিকে পুলিশ নাকি সিল করে রেখেছে। একটু পর কোন এক মন্ত্রি যাবে তাই এই ব্যবস্থা। আপাতত সেই রাস্তা দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ। সো এইসময়ে বাস আসার কোন চান্স নেই।

— আর ইউ সিরিয়াস?

— ইয়েস!

আমি এইবার চিন্তিত হয়ে পড়লাম। এখন বাসায় যাব কিভাবে তাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রিকশায় গেলে বেশ টাকা লাগবে। তার উপর আমি আজ বেশি টাকা আনিও নেই৷ স্বল্প পরিমাণ টাকা এনেছি। এখন কি করবো তাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এমন সময় সাদ বলে উঠে,

— তোমার আপত্তি না থাকলে আমি তোমায় ড্রপ করে দেই?

#চলবে

আমার সামনে এক্সাম। পড়ার চাপ অনেক। যার জন্য রেগুলার গল্প দিতে পারছি না। সরি!
#চলবে

যখন যে রহস্য উন্মোচন করার সময় আসবে সেটা তখনই উন্মোচন করা হবে। এর আগে নয়। তাই সবুর ধরুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here