আরশি পর্ব শেষ

#আরশি
#Part_32
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

রুমের ভিতর পিনপিন নীরবতা। আমি আর সাদ মুখোমুখি বসে আছি। দুইজনই নীরব। পাশের রুমেই অহনা মামার সাথে খেলছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে মুখ খুলি,

— তুমি কি আসলেই ফাহাদের চাচাতো ভাই?

সাদ একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। অতঃপর স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,

— হুম।

আমি কৌতহূলী সুরে বলি,

— কিন্তু কিভাবে কি? আমি যতটুকু জানি..

সাদ আমার কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে বলে,

— ফাহাদের কোন চাচাতো ভাই বোন নেই তাই তো?

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নারি। সাদ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। এরপর আবার নীরবতা। আমি সাহস নিয়ে বলি,

— তাহলে?

সাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে,

— আমি ছোট বেলায় যৌথ পরিবারে বড় হয়েছিলাম। যেখানে ছিল পরিবার বলতে ছিল বাবা-মা,দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, ফুপা-ফুপি। আর আমার চাচার একমাত্র ছেলেই ছিল ফাহাদ। ফাহাদ আমার থেকে ৬-৭ বছরের বড় হলে আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা বন্ধুসুলভ ছিল। ছোট থেকেই আমি আর ফাহাদ একই সাথে বেড়ে উঠেছি। এক সাথে একই স্কুলে পড়েছি। বলতে গেলে বাকি ৮-১০ টা পরিবারের মতই আমাদের পরিবার ছিল। কিন্তু হঠাৎ এই পরিবারটাই তন্ডভন্ড হয়ে গেল।
আমার যখন ১২ বছর বয়স তখন আমার বাবা মানে মি. আজাদ হোসেন দ্বিতীয় বিয়ে করেন আর সেই বউকেই আবার তিনি আমার সংসারেই উঠান। আমার আর মায়ের সামনেই তিনি তার নতুন অর্ধাঙ্গিনীকে নিয়ে তোড়জোড় লাগিয়ে দেন। মা সেসব দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে তার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল যে এসব সত্য। বলা বাহুল্য মায়ের বিয়েটা কিন্তু প্রেমের বিয়ে ছিল। মি. আজাদ হোসেনের জন্য আমার মা তার পুরো পরিবার ছেড়ে চলে এসেছিল তার ভালবাসার মানুষটির হাত ধরে। কিন্তু সেই ভালবাসার মানুষটি যে তার সাথে এত বড় প্রতারণা করবে তা সে কখনো ভাবতে পারে নি। তাই ধাক্কাটা নিতে না পেরে মা সেই মূহুর্তেই জ্ঞান হারায়। ডাক্তার আনা হলো। তিনি মাকে দেখে বললেন মা মাইন স্টোক করেছেন। হয়তো তিনি কোন বড় এক ধাক্কা খেয়েছেন যা তিনি সামলে উঠতে পারেন নি। যার ফলে স্টোক করেন। কথাটা শুনেও মি. আজাদের মধ্যে ভাবান্তর দেখা দিল না। বরং সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিজের রুম সজ্জিত করতে। ক্ষণিকের মাঝেই তিনি তার অসুস্থ স্ত্রীকে ফালিয়ে মেতে উঠলেন তার নতুন স্ত্রীকে নিয়ে। আর এইদিকে আমি মায়ের পাশে বসে সেদিন সারারাত কেঁদেছিলাম। আমি তো আর এত ছোট ছিলাম না যে এইসব বুঝবো না। সবই বুঝেছিলাম কিন্তু আমার যে কিছু করার ছিল না। পরিবারের বাকি সবাইও চুপ ছিল তারাও কিছু বলে নি মি. আজাদকে। ব্যাস! বেড়ে গেল তার সাহস।
প্রায় বারো ঘন্টা পর মায়ের জ্ঞান ফিরেছিল। জ্ঞান ফিরার পর সে চুপ হয়ে গেল। কাউরো সাথে কোন কথা বলেনি। আর না কেউ চেষ্টা করেছে তার সাথে কথা বলার। পরিবারের আচরণ মায়ের প্রতি সর্বদা এমনই ছিল। এর মূল কারণ কি জানো? সে বিয়ের সময় বাকি আট-দশটা মেয়ের মত ভুরি ভুরি যৌতুক আনতে পারি নি বলে। সাথে কোন দামী অলঙ্কার আনতে পারি নি বলে। এই নিয়ে মাকে উঠতে বসতে কথা শুনতে হতো। কিন্তু আমি হওয়ার পর মাকে আর তেমন কথা শুনতে হয় নি। কেন না সে যে আমাকে বংশের প্রদীপ হিসাবে দিয়েছে তাদেরকে। তাও আমার মায়ের কপালে সুখ সইলো কোথায়? কিন্তু তাও মা সেখানেই পড়েছিল। তার যে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কোন জায়গা ছিল না।
এইভাবেই এক মাস কেটে যায়। সেই একমাস নরকের চেয়ে কম ছিল না। পরিবারের সকলে আমার আর মায়ের মাত্রাতিরিক্ত বাজে ব্যবহার করতো৷ দু’বেলা ভাতও ঠিক মত দিত না। নিজের বিশাল বড় রুম রেখে সবশেষে ছাদের চিলেকোঠায় জায়গা হয়েছিল আমাদের। পরিবারের সকলের সাথে ফাহাদও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল আমার থেকে। তার কাছে গেলেই আমাকে রাস্তার কুকুরের মত ধুর ধুর করে সরিয়ে দিত। কিছু বলতে গেলে আমার সাথে হাতাহাতি লাগিয়ে দিত। বলতে গেলে একবারে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম সবকিছু থেকে। আর এইদিকে মি. আজাদ ব্যস্ত ছিল নতুন বউয়ের আয়েশ পূরণ করতে। আমরা বেঁচে আছি নাকি না তা নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা ছিল না।
একসময় মাও আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। প্রতিরোধ করলেন। সরাসরি ডিভোর্স চেয়ে বসলেন। আর মি. আজাদ! সে অহেতুক গালিগালাজ করে গোধুলির প্রহরে মাকে ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। আমাকে যেতে দিতে না চাইলেও আমি নিজ ইচ্ছায় বেরিয়ে আসি। সেই এক কাপড়েই মা আর আমি ওই বাসা চিরতরের জন্য ত্যাগ করি।

বলে সাদ দম নেয়। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে তার৷ মুখ তার রক্তশূণ্য। সবসময় জ্বলজ্বল করা নয়ন দু’টি একদম নিভে আছে। আমি জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— উঠেছিলে কোথায়?

সাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— আমরা যেই গ্রামে থাকতাম সেই পারায় এক আন্টি ছিল, তার আবার মায়ের সাথে খুব ভালো খাতির ছিল। সেই আমাদের সেইরাতে তাদের বাড়িতে জায়গা দিয়েছিল। আর কিছু পুঁজি দিয়েছিল ঢাকায় আসার জন্য। ঢাকায় এসে সর্বপ্রথম মা তার বাবার বাড়িতে আসা। নানাজানের মায়ে ধরে মাফ চায়। অনেক আকুতি মিনুতি করে। অবশেষে গিয়ে নানাজানের মন গলে যায়। সে মাকে তার বাসায় জায়গায় দেন। অতঃপর সেই থেকেই মায়ের জীবনের সংগ্রাম শুরু হয়। মা যেহেতু আমার শিক্ষিত ছিল তাই তিনি চাকরি জন্য চেষ্টা করেন এবং প্রায় ২ মাস এইদিক সেদিক ধাক্কাধাক্কি খাওয়ার পর গিয়ে তার একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়। শুরু হয় সিঙ্গেল মাদার হিসাবে তার স্ট্রাগল। একটা কথা না বললেই নয়, নানাজান ছিলেন মায়ের মেরুদণ্ড। যে কিনা মাকে কখনো মাকে ভেঙ্গে যেতে দেয়নি। তাই তো মা পেরেছিল এই সমাজে একা হাতে আমায় বড় করে তুলতে।

আমি জিজ্ঞেস করি,

— পরবর্তীতে আজিদ আঙ্কেল আর শোভা আন্টির ডিভোর্স হয়নি?

— হয়েছিল। মায়ের চাকরি হওয়ার ৬ মাসের মাথায় মা মি. আজাদের বাসায় লিগেল নোটিস পাঠায় এবং খুব পাকাপোক্ত ভাবে একটা কেস তৈরি করেন। যার ফলে মি. আজাদ বাধ্য হয় মাকে ডিভোর্স দিতে। আর সে কাস্টাডি কেস ফাইল করলে আমার কাস্টাডিও আমার মায়েই পান।

আমি কিছু না বলে ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লাম। ক্লান্ত চোখে সাদের দিকে তাকিয়ে বলি,

— এত বছর পরে ফাহাদকে চিনলে কিভাবে?

— বহু বছর আগে আমি আমার এক ফ্রেন্ডের ভাইয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম। সেখানেই আমার দেখা হয়েছে মি. আজাদ আর তার পুরো পরিবারের সাথে। তখন সেখানেও ফাহাদও ছিল। আমি ফাহাদকে ঠিক মত না চিনলেও বাকি আর কাউকে চিনতে ভুল করিনি। অতঃপর সেদিন ফাহাদকেও আমার ভালো মত চিনা হয়ে গিয়েছিলাম। বলা বাহুল্য, মি. আজাদ আমার ফ্রেন্ডের বাবার দূর সম্পর্কের আত্নীয় ছিলেম। সেই সুবাদে তিনি তার সপরিবার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বিয়েতে। জানো মি. আজাদ আর তার পরিবারকে দেখে আমার রক্ত টগবগ করে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল ভরা মহফিলের সামনেই আমি মি. আজাদকে খুন করে ফেলি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করা হয়নি।

এই কথাটা বলে সাদ চুপ হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা কাটানোর পর সাদ বলে,

— একটা কথা জানোই তো। প্রকৃতি কখনো কোন পাপীকে ছাড় দেয় না। প্রকৃতি সবকিছু সুদে আসলে ফিরত দিতে জানে। মি. আজিদের বেলায়ও ব্যতিক্রম হয়নি। সে যার জন্য আমাদের ত্যজ করেছিল সেই তার মুখে চুনকালি মাখিয়ে অন্যের হাত ধরে চলে যায়।

আমি সাদের দিকে তাকিয়ে বলি,

— শুধু কি তাই? শেষ বয়সে এসে কিনা তাকে আগলে রাখার কোন হাত ছিল না। না ছিল পরিবার, না ছিল স্ত্রী, না ছিল সন্তান। কঠিন রোগে ভুগে মারা গিয়েছিলেন তিনি।

সাদ আমার কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,

— পাপ যে তার বাপকেও ছাড়ে না।

কথাটা বলে সাদ ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে। আর আমি শক্ত হয়ে বসি। সিক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— তুমি কি শুরু থেকেই জানতে আমি ফাহাদের স্ত্রী?

সাদ কিছু দ্বিধাবোধ করে বলে,

— শুরু থেকে না। তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার বেশ কয়েকমাস পরেই জেনেছিলাম।

আমি শক্ত গলায় বলে উঠি,

— তাহলে কি আমি ধরে নিব তুমি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাকে অহনাকে ইউস করেছ? অহনার বাবা হওয়ার দাবী নিয়ে এতটা ভালো সেজে এতটা বছর ছলনা করে এসেছ?

কথাটা শুনার সাথে সাথে মনে হলো সাদ ভড়কে গেল। গোলগাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,

— এমনটাই মনে হয় তোমার? আমি তোমাদের ইউস করেছি? আমার সব তোমার অভিনয় মনে হচ্ছে?

আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। সাদ তা দেখে বলে,

— তোমাদের যদি ইউস করার হতো তাহলে এই সাড়ে ছয়টা বছর আমি কেন এইভাবে স্থির হয়ে থাকতাম? কেন এতটা সময় অবচয় করতাম এই অনাকাঙ্ক্ষিত দেখাটার জন্য? তোমাদের যদি আমার ইউজই করার হতো তাহলে সবার আগে আমি তোমায় বিয়ে করতাম। ভালবাসা কথা বলে তোমাকে হাত করতাম। কিন্তু আমি তো সেটা করি নি। আমি শুরুতেই তোমার কাছে অহনার বাবা হতে চেয়েছি। শুধু ওর মুখ দিয়ে বাবা ডাকটা শুনতে চেয়েছি। চাই নি তোমাকে। না তখন, না এখন। কখনো কি অহনার প্রতি আমার ভালবাসায় খাত দেখেছ? আমার কোন কর্মকাণ্ড কি আদৌ মনে হয়েছে প্রতিশোধের অংশ? বলো? এতটা ঠুকনো মনে হয় আমার মায়ের শিক্ষা?

আমি কিছু না বলে চুপ করে আছি৷ সাদ কিছুক্ষণ আমার পানে উত্তরের আশায় চেয়ে থাকে। অতঃপর বলে,

— বিশ্বাস করো কিনা জানি না। তাও বলছি! তুমি কার বউ ছিলে না ছিলে তাতে আমার কিছুই যায় আসতো না। আর না এখন আসে। আমি সবসময় তোমায় একজন বন্ধু হিসাবেই দেখেছি। আর বন্ধু হিসাবেই আমি সর্বদা তোমার পাশে থেকেছি। কখনো প্রতিশোধের কথায় মাথায়ও আসেনি আমার। না তখন আর না এখন। আর রইলো অহনার কথা? অহনা কার সন্তান তা নিয়ে তো আমার মাথা ব্যথা ছিল না। আমি শুরু থেকেই ওর প্রতি দূর্বল ছিলাম। কেন না কাকতালীয় ভাবে হোক আর যেভাবেই হোক তিন্নির সাথে অহনার অদ্ভুত কারণে কিছু মিল রয়েছে। যা বার বার আমাকে ওর প্রতি টানে। বার বার মনে হয় আমার সন্তান হলে হয়তো অবিকল অহনার মতই হতো। তাই তো আমি ওকে নিজের সন্তান মেনে এসেছি আর মানতে থাকবো। এখন তুমি চাও আর না চাও।
আর রইলো আজকের কথা, সেটা নিতান্তই কাকতালীয়। আমার জাস্ট তখন ফাহাদকে দেখে রাগ উঠে দিয়েছিল তাই রাফ বিহ্যাভ করেছি। নাথিং এলস! আমি কিছু প্রি-প্ল্যান্ড করে করিনি।

এই বলে সাদ দম নেয়। আমি সাদের দিকে তাকিয়ে বলি,

— কিছু মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং আজীবন রয়ে যায়৷ যা নাকি মানুষকে একটু একটু করে পিরা দেয়। আর একসময় নিঃস্ব করে দেয়। যেমন আমাকে আর তোমাকে নিয়ে ফাহাদের ধারণা। ওর দৃষ্টিকোন থেকে আমরা দুইজন হাসবেন্ড এন্ড ওয়াইফ। তুমি অহনার লিগেল ফাদার। কিন্তু আদৌ কি তাই? তোমার আমার তো কখনো বিয়েই হয়নি। আমরা এখনো দুইজন দুই প্রান্তের মেরু। তুমি অহনার বাবা হতে চেয়েছ তাই হয়েছ। অহনার দৃষ্টিকোন থেকে তুমি ওর বাবা। সকল জায়গায় তুমি সেই পরিচয়ই পাচ্ছ। আর কি? এর বেশি না তুমি চেয়েছ আর না আমি হতে দিয়েছি। কিন্তু মাঝ দিয়ে তৃপ্ত আগুনে জ্বলছে ফাহাদ নামক মানুষটি।

সাদ আমার দিকে নির্লোভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— এইটাই কি প্রকৃতির প্রতিশোধ নয়?

— হয়তো তাই। কিন্তু আজও মনের মাঝে যে হাজারো প্রশ্নের সেই অজানা উত্তরগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

— সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। আবার সকল প্রশ্নের উত্তর সবসময়ও পেতেও নেই। যেমন আমি আজ পেলাম না।

আমি কিছু না বলে সাদের দিকে চকিতে চাই। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলি,

— তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। চরম কৃতজ্ঞ। যা কোন কিছুর বিনিময়ে শোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এর বদলে যদি ক্ষানিকটা বিশ্বাস করতে বলো তাহলে সেটা নিরদ্বিধায় আমি মানতে রাজি। আজ তোমার জন্য আমার সাবলীল। একজন নারী উদ্যোগতা। একটি ওয়েল নোন বেকারির মালিক। সকলে ঠিকই এখন আমায় এক নামে চিনে। তুমি যদি সেসময় আমায় সাপোর্ট না করতে আমার পাশে না দাঁড়াতে তাহলে আমি এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারতাম না।

সাদ আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তোমার আমি দর্পণ কেন ডাকি জানো?

আমি স্বাভাবিক ভাবেই বলি,

— আরশি শব্দের সমার্থক শব্দ দর্পণ তাই।

সাদ হালকা হেসে বলে,

— উঁহু! আরশি সমার্থক শব্দ দর্পণ বলে আমি তোমায় দর্পণ ডাকি না। তুমি যে জীবনব্যাপী দর্পণ তাই তোমায় দর্পণ ডাকি। তুমি এমন এক দর্পণ যা কিনা নিজের প্রতিবিম্ব নিজে তৈরি করে এবং সেই প্রতিবিম্বই অন্যের সামনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়। যে নাকি তার চোখে চোখ রেখে তার সকল ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়। বাস্তবকে বুঝায়। শীতল হতে শিখায়।

আমি অদ্ভুত চোখে সাদের দিকে তাকাই। সে হালকা হাসে। আজ সাদের হাসি দেখে কেন যেন মনে হলো এই হাসির পিছনে লুকিয়ে আছে না বলা হাজারো কথা। কোন এক অনুভূতি। কাউকে না পাওয়ার তীব্র যন্ত্রণা।

____________________

সাদ চলে গিয়েছে প্রায় ঘন্টা খানিক হলো। আমি এখনো রুমের ভিতরেই বসে আছি। ভালো লাগছে না কিছু। চুপটি করে বিছানার এক কোনে বসে আছি। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। এমন সময় মামা রুমে আসেন। ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন আমার দিকে। আমার মাথায় হাত রাখতেই আমি চোখ খুলে মামার দিকে তাকাই। মামা স্মিত হেসে বলেন,

— শরীর খারাপ লাগছে?

আমি সোজা হয়ে উঠে বসে বলি,

— না তেমন না।

মামা আমার সামনে বসতে বসতে বলে,

— কিছু কি হয়েছে?

— কি হবে? কিছুই হয় নি?

— আমার সামনে নিজেকে শক্ত দেখিয়ে লাভ?

— দূর্বল দেখিয়ে লাভ?

— কথার পিঠে কথা বলা শিখেছিস।

— জীবনের মোড় যখন ঘুরে তখন সবই পরিবর্তন হয়। শুরুটা কিন্তু ছোট থেকেই হয়।

— তা জীবন যখন দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছিল তখন সেটা আঁকড়ে ধরলি না কেন?

আমি মামার দিকে চকিতে চেয়ে বলি,

— আদৌ কি সেটা দ্বিতীয় সুযোগ ছিল?

— তা নয় তো কি? সাদকে বিয়ে করলে কি হতো?

— বিয়ে না করে কি হয়েছে? খারাপ আছি?

— একটা সুযোগ তো দিয়ে দেখতে পারতি।

— সেই সুযোগ দেওয়ার সাধ্য আমার নেই মামা। না তখন ছিল না এখন আছে। যে সংসারের মায়া আমি একবার ছেড়েছি সেই সংসারের মায়ায় দ্বিতীয় বারের জড়ানোর মত দুঃসাহস আমার হয়নি।

— সাদ কিন্তু অহনাকে বড্ড ভালবাসে।

— জানি! সাদের এই ভালবাসা দেখেই তো আমি ওকে অহনার বাবা হতে দিয়েছি।

— দুইজন এক সম্পর্কে না থেকেও..

আমি মামাকে কথা বলতে না দিয়ে বলি,

— তুমি অহেতুক কারণ দেখাচ্ছ। এমন অনেকেই আছে বাবা নেই, কিন্তু তাই বলে যে বাবা বলে কাউকে ডাকতে পারবে তা কোথায় লিখা আছে? অনেকেই আছে যারা নাকি তাদের মামা বা চাচাকে বাবা ডাকে। তাহলে সাদকে বাবা ডাকলে সমস্যাই বা কোথায়?

— কোন সমস্যা নেই।

— তাহলে তুমি অফ যাও।

কথা বলে আমি চুপ হয়ে যাই। মামা তা দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— ফাহাদকে ভালবাসিস?

কথাটা কর্ণপাত হতেই আমি চকিতে চাই মামার দিকে। অস্বাভাবিক কন্ঠে বলি,

— এমন মনে হওয়ার কারণ?

— কেন জানি মনে হলো তাই বললাম।

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— না তাকে আমি ভালবাসি না। তাকে ভালবাসা প্রশ্নই আসে না। কিন্তু তাই বলে যে আমি তাকে ঘৃণা করি তাও না।

মামার আমার মুখ পানে তাকিয়ে থেকে বলে,

— একটা প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর দিতে পারবি? আর সেই প্রশ্নের বিপরীতে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারবি না কিন্তু।

— আচ্ছা বলো।

— জানিস তো মনের আরশি কখনো মিথ্যা বলে না। এখন তুই চোখ বন্ধ করে বলতো তোর মনের আরশিতে কে?

মামার কথা শুনে আমি স্মিত হাসি। মামার মুখ পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখের পাতা দুটি বন্ধ করে নেই। অতঃপর বেশ কিছুক্ষণ পর বলি,

— যার মনের আরশিতে আমি।

মামা আমার কথাটা শুনে কিছুক্ষণ আমার মুখ পানে তাকিয়ে রইলেন। আমি ধীরে চোখ খুলি। মামার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি। মামা তা দেখে ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— যা বুঝার বুঝে নিয়েছি।

— বেশ তো।

মামা আর কিছু না বলে দাঁড়িয়ে পরে। চোখের পলকেই বেরিয়ে যান রুম থেকে। এর কিছুক্ষণ পরেই অহনা রুমে আসে। এসেই ধপ করে আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আমি প্রথমে চমকে উঠলেও পরবর্তীতে নিজেকে সামলে নেই। আলতো হাতে ওর চুলে বিলি কেটে দেই। মিনিট খানিক যেতেই অহনা বলে উঠে,

— আম্মি তুমি ভালো আছো তো?

অহনার কথা কর্ণপাত হওয়ার সাথে সাথেই আমার বুকটা কেঁপে উঠে৷ গোলগাল চোখে তাকাই অহনার দিকে। আজ বহুদিন পর কেউ আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলো এই প্রশ্নটা। কিন্তু এর উত্তর কি হওয়ার উচিৎ? আমি আসলে কেমন আছি? ভালো নাকি খারাপ? ভালোই তো আছি বোধহয়। কিন্তু আদৌ কি তাই? অহনা যদি এই প্রশ্নটা আরও কয়েক ঘন্টা আগে করতো তাহলে হয়তো নিরদ্বিধায় বলতে পারতাম ভালো আছি। কিন্তু এখন? কি বলবো আমি? ঘন্টা খানিক আগে যাকে এক নজরের জন্য দেখিছি সে আমায় মুহূর্তেই পুরো উল্টেপাল্টে দিয়েছে? টানা ছয় বছর ধরে একটু একটু করে গুছানো এই আমিটাকে পুরো নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে? আচ্ছা সে কি বুঝেছে যে আমি বুঝেছি তার সময় ঘনিয়ে এসেছে? শত প্রশ্নের ভীড়ে একটা প্রশ্নের উত্তর আমার অজানাই রয়ে গেল। অবশ্য তাকে জড়িত সকল প্রশ্নের উত্তরই আমার অজানা। এই যেমন তার অতীত,বর্তমান,ভবিষ্যৎ সবই আমার অজানা। তখনও ছিল আজও আছে। কথাটা ভেবেই বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস৷
আমি অহনার দিকে তাকাই। সে চাতক পাখির মত আমার দিকে উত্তরের আশায় চেয়ে আছে। আমি তা দেখে মুচকি হেসে বলি,

— যতদিন আম্মির পাশে অহনা আছে ততোদিন আম্মি ভালো আছে।

অহনা আমার কথা শুনে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে,

— অহনা সবসময় তার আম্মির পাশে আছে৷

আমি মুচকি হেসে অহনার মাথায় একটা চুমু খাই। দেয়ালের সাথে মাথা হেলিয়ে বসি। শূন্য দৃষ্টিতে আনমনে তাকিয়ে থেকে আনমনে ভাবি, ” দিনের আলোয় ভালো আছি বলাটা যতটা না সহজ দিন শেষে রাতের আঁধারে সেই ভালো আছি বলাটাই এত কঠিন কেন? আঁধার কেন সকল কষ্ট বয়ে আনে? আচ্ছা! মনে বন্ধী সুপ্ত আরশিতে যার প্রতিচ্ছবি বসবাস করে সেই কি এর জন্য দায়ী? নাকি আমরা দায়ী? ক্ষানিকের সুখের আশায় সে প্রতিচ্ছবি যে আমরা নিজেরাই বসিয়েছি। কিন্তু আদৌ কি সেই সুখ মিলেছে? আসলেই জীবনের আরশি আর মনের আরশি এক নয়। এক আরশি বাস্তবতা দেখায় আরেক আরশি ভাঙ্গা স্বপ্ন দেখায়। আর এই দুই আরশির মাঝেই বাস করে আমার মত হাজারো আরশি।”

কথাটাগুলো ভাবতেই ভাবতে একটা গান হাওয়ায় ভেসে আসে৷ হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসতে থাকে সেই সুর। হঠাৎ শেষের চরণ গুলো কানে গুঞ্জিত হতে থাকে। সেই সুরের সাথে মিহিয়ে আসে এক তীব্র আর্তনাদ। সেই আর্তনাদে যেন খুঁজে পেলাম নিজেকে। নিজের অস্তিত্বকে।

“”আমি নই কলস হারা
নদীর মত
চরণে ব্যাকুল বকুল
ঝরে না তো
আমি নই কলস হারা
নদীর মত
চরণে ব্যাকুল বকুল
ঝরে না তো

কোকিলা মরে না তো
আমায় ডেকে
কোকিলা মরে না তো
আমায় ডেকে

তবু বলো বলো কে
রূপসী তোমার চোখে

বল তো আরশি
তুমি মুখটি দেখে
যদিও কাজল আমি পরিনি
যদিও কবরী আজ বাঁধিনি
তবু বল তো রূপসী কে
তোমার চোখে””

🌼 সমাপ্ত🌼

.
সব গল্পের পরিহাস যদি একই হয় তাহলে সেই গল্পে ভিন্নতা কোথায়? কিছু কিছু গল্পের পরিনতি পেতে নেই। সেগুলো অসমাপ্তই ভালো। তার মধ্যে এই গল্পটিও ঠিক তেমন। জানি না এই সমাপ্তি কার কেমন লেগেছে কিন্তু সমাপ্তি আমার আগে ভাবা ছিল তাই আর পরিবর্তন করলাম না। এখন বাদ বাকি অনেকের খারাপ লাগতেই পারে স্বাভাবিক৷ আর খারাপ লাগলে এর জন্য দুঃখিত।

এইবার আসি মূল কথায়। আমি শুরু দিকে বলেছিলাম গল্পটা বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া। আর পর্ব ৪ পর্যন্ত সব পুরোপুরি সত্য। বাকিটা কাল্পনিক। এখন প্রশ্ন হলো রিয়েল লাইফের ফাহাদ কি তার শাস্তি পেয়েছে? তাহলে আমি বলবো বাস্তবে তাদের কাহিনী এখনো সেই শুরু দিকেই আটকে আছে। কেউ কাউরো শেষ পরিনতি পর্যন্ত পৌছায় নি। কবে পৌছাবে জানি না। তাই আপাতত আমি কিছু বলতে পারছি না।

অবশেষে কার কাছে গল্পটা কেমন লেগেছে প্লিজ জানাবেন। খারাপ হোক আর ভালো হোক নিজের অনুভূতিটুকু শেয়ার করবেন প্লিজ। ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here