গল্প : #একমুঠো_সোনালি_রোদ (পর্ব : তিন)
সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল তারা।
পুরো বাড়ি নিঃস্তব্ধ। কোথাও একটুকু আলো নেই৷ সাড়া-শব্দ কিছুই নেই। শুধু সুমেহরার ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরের ভেতর থেকে দরজার ফাঁক দিয়ে কিছুটা আলো বেলকনিতে এসে পড়েছে। সেই আলোয় দাঁড়িয়ে আছে তারা দু’জন। সুমেহরা আর সামির।
‘আমি একটা রেস্তোরাঁয় কাজ করতাম। রেস্তোরাঁর মালিক সাদার চামড়ার একটি মেয়ে। মেয়েটার নাম মার্লিনা। মার্লিনা নামের অর্থ জানো তো?’ সামির সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সুমেহরার দিকে তাকাল।
মার্লিনা নামের অর্থ? তা তো সে জানে না। জেনে কী লাভ? কিংবা সামির এতদিন পর দেশে ফিরে গভীর রাতে অন্য এক মেয়ের কথা তাকে বলছে কেন? সে তো বলবে সুমেহরার কথা। এটা-ওটা জিজ্ঞেস করবে। দেখবে, শুনবে। শুধু সুমেহরার কথাই ভাববে।
সুমেহরার শরীর কেন জানি হিম হয়ে আসছে। বুকের ভেতর কেমন যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কান্না পাচ্ছে খুব। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আপনি অন্য একটা মেয়ের কথা আমাকে শোনাচ্ছেন কেন? মেয়েটা কী হয় আপনার?’
কিন্তু না। সে কিছুই বলল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। চোখের জল আটকে রাখার তীব্র চেষ্টা করছে সে। কিন্তু কতটা সফল হবে? কতটা সময় অশ্রুজল লুকিয়ে রাখতে পারবে?
সামির আবার বলতে শুরু করল, ‘আমি শুধু জানতাম, রেস্তোরাঁর মালিক একটা মেয়ে। চোখের দেখা পেতে ছ’মাস লেগে গেল। মেয়েটার বাবা বুড়ো লোক। বয়সের ভারে ঠিকমতো চলতে পারে না। সে-ই সবকিছু দেখাশোনা করত। আমি কাজে জয়েন করার প্রায় ছ’মাস পর মার্লিনাকে দেখলাম। খুব সম্ভবত সাতাস-আঠাশ হবে বয়স। মেয়েটা চুপচাপ এসে টেবিলে বসল। একজন আমাকে বলল, এই দেখ মার্লিনা। আমি দেখলাম…’
‘মেয়েটা কি খুব সুন্দর?’ সুমেহরা মুখ তুলে তাকিয়ে ধরা গলায় বলল।
‘সাদা চামড়ার মেয়েদের আমার ভালো লাগে না। কিন্তু মার্লিনাকে দেখতে ভালোই লাগল সেদিন। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় কী, জানো?’
‘কী?’
‘মেয়েটা রেস্তোরাঁর মালিক। অথচ কেউ তাকে খেয়াল করল না। এক গেলাস পানি পর্যন্ত দেওয়া হলো না তাকে। মেয়েটার বাবা এমন ভান করল, যেন মেয়েটা রেস্তোরাঁয় এসেছে তা সে জানেই না। প্রায় দু’ঘন্টা চুপচাপ বসে থাকার পর সে চলে গেল। ততদিনে মার্লিনার বাবার সাথে আমার বিশেষ খাতির হয়ে গেছে। আমি সোজা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, মার্লিনা এসে আবার চলে গেল কেন? লোকটা গম্ভীর ভাবে বলল, তার রেস্টুরেন্ট। সে কখন আসবে কখন যাবে এটা সম্পুর্ণ তার ব্যাপার।’
‘তারপর কী হলো?’ সুমেহরা জিজ্ঞেস করল। সত্যি বলতে, তার এসব জানতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে সামিরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলতে। হাউমাউ করে বলতে, ‘আপনি আর কখনো কোনো মেয়ের কথা আমাকে শোনাবেন না। কখনোই না।’
‘তারপর? তারপর মেয়েটা রোজ আসতে লাগল। দু’এক ঘন্টা চুপচাপ বসে থাকত। হঠাৎ চলে যেত। কেউ তার ধারে ঘেঁষত না। সবাই যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলত। এভাবে সপ্তাহখানেক যাবার পর একজন স্টাফের কাছে পুরো ব্যাপার জানতে চাইলাম। কিন্তু সে আশানুরূপ কোনো জবাব দিলো না। এটা-সেটা বলে এড়িয়ে গেল। আমি বুঝলাম, সবাই কিছু একটা গোপন করতে চাচ্ছে।’
‘কী গোপন করতে চাচ্ছে?’ সুমেহরা বলল।
‘সেটা জানার জন্য আরো একটা দিন অপেক্ষা করতে হলো। পরদিন মার্লিনা আসতেই আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাই-হ্যালো বললাম। কিন্তু মেয়েটা ফিরেই তাকাল না। যেন সে শুনতেই পায়নি আমার কথা।’
‘সে কি কানে শুনতে পায় না?’
‘পায়। সেদিন ইচ্ছে করেই কানে নেয়নি। তারপর তিন দিন সে রেস্তোরাঁয় আসেনি। চতুর্থ দিন এসেই আমাকে ডাকল। সবাই তো অবাক। মেয়েটার বাবা স্বয়ং আমার কাছে ছুটে এলেন। বিস্ময়ের স্বরে বললেন, মার্লিনা তোমাকে ডাকছে। ব্যাপার কী বলো তো?’
‘কেন ডেকেছিল আপনাকে?’
‘ডেকেছিল একটি কথা জিজ্ঞেস করার জন্য। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বসতে বলল। আমি বসলাম। তারপর জিজ্ঞেস করল, কী জানতে চাও? আমি বললাম, কিছুই জানতে চাই না। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল, কিছু জানতে না চাইলে সেদিন আমার আশপাশে ঘুরঘুর করছিলে কেন? তখন আমি জানতে চাইলাম, তার এতটা নির্লিপ্ততার কারণ। মেয়েটার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েই রইলাম তার দিকে।’
‘কী বলেছিল সে?’
‘লোকাল বারে একটা ছেলের সাথে মার্লিনার দেখা হয়েছিল। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেল। বিদেশী মেয়ে। সাতপাঁচ না ভেবেই ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মার্লিন আগ বাড়িয়ে পরিচিত হলেও প্রপোজ কিন্তু ছেলেটা আগে করেছিল। তাদের মধ্যে সম্পর্ক হলো। ধীরে ধীরে সেই সম্পর্ক গভীর হয়ে এল। একসময় তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। বিয়ের পরদিন ছেলেটা মার্লিনার গাড়ির চাবি চাইতেই মার্লিন চোখ বুজে তা দিয়ে দিলো। সেটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল। ছেলেটা মার্লিনার সাড়ে চার কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে উধাও হয়ে গেল। সেই যে গেল আর ফিরেনি…’
সুমেহরা অবাক হয়ে বলল, ‘সাড়ে চার কোটি!’
‘হ্যাঁ। গাড়ির জন্যই ছেলেটা মার্লিনার পিছু নিয়েছিল। উধাও হবার পর দু’বছর তার খুঁজ মিলেনি। ছেলেটা মার্লিনাকে ধোঁকা দিয়েছে জেনেও সে তাকে প্রতিদিন খুঁজে বেড়াত। চোর হোক, ভালোবাসার মানুষ তো! একদিন মার্লিনা ছেলেটার ঠিকানা জানতে পারল। তখনই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। কিন্তু নিয়তি বলেও একটা জিনিস আছে! সেদিনই মার্লিনা অ্যাক্সিডেন্ট করল। তার জখম খুব বেশি গভীর না হলেও যে গাড়িটার সাথে মার্লিনা অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল সেই গাড়িতে থাকা তিনজনই মরে গেল। সেই তিনজন ছিল মার্লিনার স্বামী এবং তার স্ত্রী-সন্তান। ছেলেটার রক্তাক্ত দেহ মার্লিনা নিজ চোখে দেখেছিল। এর পর দু’বছর সে পাগলাগারদে ছিল।’
‘সেই ছেলেটা আরো একটা বিয়ে করেছিল?’
‘হ্যাঁ। তবে ওটা তার আসল ফ্যামিলি।’
‘মার্লিনা পাগল হয়ে গেছে?’
‘পাগল ছিল দু’বছর। তারপর অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিল। সেদিন মার্লিনার চোখে জল দেখেছিলাম। মানুষ মানুষকে এতটা ভালোবাসতে পারে! তখনই তোমার কথা মনে পড়ল। ভাবলাম, তোমাকেওতো বহুদিন যাবৎ ফেলে এসেছি…’
‘মার্লিনা এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি?’ সুমেহরা জিজ্ঞেস করল।
‘সে আর নেই। কয়েক মাস আগে মারা গেছে। নরম্যাল ডেথ। মেয়েটাকে মরে যেতে দেখে তোমাকে আরো বেশি মনে পড়তে লাগল। শেষ ক’টা দিন কীভাবে যে কাটিয়েছি…’
‘একটা কথা বলব?’ সুমেহরা মাথা নিচু করে বলল।
‘বলো।’
‘আমি আপনাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।’ বলেই হনহন করে শোবার ঘরে চলে এল। নীরবে গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। সে খুব করে চাইছিল, সামির আসুক। তার পাশে বসে আহ্লাদী গলায় জিজ্ঞেস করুক, ‘সত্যিই ভালোবাসো? কতখানি বাসো?’
সময় চলে যায়, সামির আসে না। সুমেহরার চোখের জলে ভিজে যায় বালিশ। আর কতকাল এভাবে পরীক্ষা দিতে হবে? কতকাল মুখ বুজে সব সহ্য করলে বিষাদ কেটে যাবে? কতকাল?
একসময় সুমেহরার চোখ জুড়ে ঘুম লেগে আসে। কিন্তু সেই ঘুম খুব বেশি স্থায়ী হয়নি। হঠাৎ কারোর হাতের স্পর্শে সুমেহরা কেঁপে উঠে।
(চলবে)
মো. ইয়াছিন