অদিতি জেল পলাতক আসামীর মতো তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চলে আসতে পারলে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। মোড়ের দোকান থেকে এক বোতল পানি কিনে একটা রিকশা ডাক দিয়ে বাসার উদ্দেশ্য রওনা হলো৷ এই আনাফকে সে চিনতো না। কি অদ্ভুত পরিবর্তন! ভাবতেই পারছে না। কিন্তু আনাফের কি দোষ, তার জন্য ই এমন হয়েছে। আর এই সবকিছু তার ই কর্মের ফল। সেদিন তো এরকম উতলা আনাফ ও হয়েছিলো আমি তো সময় দেই নি তাহলে ও আমাকে দিবে সেটা আমি কিভাবে আশা করছি। আমি সময় দেই নি তা বললেও ভুল হবে পরিস্থিতির স্বীকার ছিলাম সেদিন।
রুমে এসে মেঝেতে চোখ বন্ধ করে বসে পড়লো অদিতি।
নিজেকে অসহায় লাগছে খুব। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে সারা শরীর জুড়ে, নিজের ভেতরে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে। দুই বছর আগেও ধরেই নিয়েছিলো আর কখনো দেখা হবে না আনাফের সাথে। দেখা হওয়া কি খুব জরুরি ছিলো পুরোনো ক্ষত নতুন করে তাজা হলো। এতদিনে আনাফকে এতটুকু ও ভুলতে পারি নি তবে মনের কোথাও চাপা পড়েছিলো আজ সেটা আবার তাজা হয়ে উঠল অনেকটা চাপা পড়া কয়লার আগুনের মতো। চাপা পড়ে থাকলে দেখা যায় না কিন্তু একটু সরালেই আগুন গণ গণ করে উঠে তেমন। পৃথিবীটা হয়তো এতটাও বড় না, হলে এত মানুষ থাকতে কেন ই বা ওর সাথে দেখা হবে। ভাগ্য সবসময় আমাকে নিয়ে খেলে। অস্থির লাগছে, রসকষহীন কাঠখোট্টা জীবনে কিছুই নেই আজ নতুন করে আবার বিষাদের ছায়া নেমে আসলো৷ এখন প্রতিদিনের একমাত্র সঙ্গী বলতে এই ঘুমের ঔষধ ই একমাত্র ভরসা।
রাত দুটো বাজে! ঘুম ভেঙে ফোনের স্ক্রিনে দেখলো বাবার নাম্বার থেকে ফোন এসেছে সাত টা। ফোন সাইলেন্ট করা ছিলো শুনতেও পায় নি। এই একটা মানুষ যার জন্য বেঁচে থাকতেই হবে। বাস্তবতা কেন গল্পের মতো সুন্দর হয় না, কেন নিরামিষ হয়। আমার জীবনে কি কখনো আর আগের মতন রঙিন হবে না? কি ভাবছি এসব আর ভেবেই কি লাভ?
এত রাতে বাবাকেও ফোন দেওয়া যাবে না, ঘুম ও আসবে না৷ এই অবস্থাটা খুব বিরক্তিকর যখন কিছু করার থাকে না৷ রাত দুটো বাজে এখন বাহিরেও যাওয়া যাবে না। তবে হ্যাঁ, একটাই কাজ করা যায় তা হলো এক কাপ কফি বানানো যেতে পারে তারপর দেখা যাবে কি করব।
পানি গরম করে এক কাপ কফি বানিয়ে জানালার পাশে বসলো অদিতি। ঢাকা শহরে এই এক সমস্যা প্রকৃতি বলতে কিছু নেই, জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালে শুধু ল্যাপপোস্টের আলো আর গাড়ি ছাড়া কিছু চোখে পড়ার মতো নেই৷ একটা কুকুর সেই আলোর নিচে বসে আছে দু’একটা গাড়ি যাচ্ছে, নিস্তব্ধ চারদিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে নিলো অদিতি ফেসবুক ক্রল করতে করতে আবার আনাফের কথা মনে হলো। আনাফের ফেসবুকের পাসওয়ার্ড জানতো এই দুই বছরে কখনো লগ ইন করতে মন চায় নি আজ চাচ্ছে কেন জানি। হঠাৎ করে নিজের আইডি থেকে লগ আউট করে আনাফের আইডি তে লগ ইন করতে ধরে মনে হলো পাসওয়ার্ড টা আসলে মনে নেই। তবে আনাফ আর অদিতির একটা ফেইক আইডি ছিলো যেটার পাসওয়ার্ড দু’জন ই জানতো সেটা মনে আছে। সেই আইডিতে লগ ইন করলো করে আনাফের আইডিতে ঢুকলো। রাত তখন পৌনে তিনটা বাজে আনাফ একটিভ, আগে কখনো আনাফ এত রাত জাগে নি। তবে দুই বছর কত বিশাল সময় না জানি আরও কত পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন হওয়ায় তো ভালো আমার মতো বিশ্বাসঘাতক এর জন্য কে বা অপেক্ষা করবে।
আচ্ছা, আমি নিজেকে বিশ্বাসঘাতক কেনো বলছি আমিও তো ওকে চাইতাম মনে প্রাণে চাইতাম। কতকিছু করেছি ওকে পেতে। আইডিতে আনাফের অনেক ছবি দেখতে সুন্দর লাগছে আগের থেকে নাকি আমার ই আজ ভীমরতি ধরছে সেজন্য এমন লাগছে কে জানে!
নিজের অজান্তেই ভালো লাগা কাজ করছে আনাফের ছবিগুলো দেখে, তবে কোন ছবিতেই সেই প্রাণবন্ত হাসি আর নেই। আমাকে নিয়ে দেওয়া পোস্টগুলো ও নেই হয়তো অনলি মি করা, নয়তো ডিলিট স্বাভাবিক ব্যাপার। এখন শুধু ছটফট লাগছে আনাফকে মেসেজ দেওয়ার জন্য, মেসেজ দিতে গিয়ে দেখলাম আনাফের সাথে লাস্ট মেসেজ ছিলো,
আনাফ ই দিয়েছিলো অবশ্য – “কাল একবার এসো মায়াবতী তোমাকে দেখতে মন চাচ্ছে ”
মেসেজটা দেখে বুকের ভেতরটা হঠাৎ ই কেমন করে উঠলো। যে মানুষটা আমাকে না দেখে থাকতে পারতো না সেই মানুষটাই এখন পাঁচটা মিনিট আমার সাথে কথা বলবে সেই আগ্রহটুকু দেখায় না। এমন কেনো হলো সবকিছু এর উল্টোও তো হতে পারতো। আমার জীবনটা এমন উল্টো কেনো। মোবাইল এর ডাটা অফ করে কাঁদতে লাগলো অদিতি জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেলে বেঁচে থাকা যে কত কঠিন। কে বলে আত্মহত্যা করতে সাহস লাগে? আত্নহত্যা করা তো সহজ এরপর বেঁচে গেলো, সাহস তো লাগে বেঁচে থাকতে প্রতিনিয়ত নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে। মিথ্যা নাটক করে ভালো থাকার অভিনয় করতে, সাহস তো লাগে এসব করতে।
আচ্ছা, আনাফের সাথে দেখা না হলে কি এসব আবার নতুন করে কষ্ট দিতো আমাকে? নাকি যেমন চাপা পড়ে ছিলো তেমন ই চাপা পড়ে থাকতো! আনাফ সত্যি ভুলে গেছে আমাকে? না আর ভাবতে পারব না। এই অসহ্য যন্ত্রণা আর নিতে পারছি না।
গল্পের নাম: প্রিয়তম প্রাক্তন
পর্ব: ০২
লেখনীতে: ISRAT( Ishu Moni )