তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২১
__________
অরূণীর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নাস্তানাবুদ মুখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে রুদ্র।এমন অপ্রীতিকর অবস্থায় কখনো পড়ে নি। হতবুদ্ধি হয়ে শুধু দেখছে চারদিকে পরিচিত কেউ আছে কি-না।অরূণী এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে বুঝতে পারে নি রুদ্র। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে অরূণীর দিকে তাকাতেই দেখে অরূণী ঢলে পড়ে যাচ্ছে। ঘটনার আকস্মিকতায় রুদ্র সাত-পাঁচ ভাবার সময় পেল না।দ্রুত অরূণী’কে ধরে ফেলল। চারদিকে মানুষ জড়ো হয়ে গেল। সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে।এক মুরুব্বি ঝাঁঝালো গলায় বলল, “রাস্তার ভিতর জড়াজড়ি।এই প্রজন্মটাই নষ্ট হয়ে গেছে! একবারে নষ্ট হয়ে গেছে।”
অরূণী’কে ধরে রেখেছে রুদ্র।অরূণী অচেতন অবস্থায় আছে।রুদ্র বুঝতে পারছে না ওঁর কি করা উচিত। এই অচেতন অবস্থায় কষিয়ে দুই-চার ঘা দেওয়া উচিত?রাগে রুদ্রের ভিতরে ভিতরে কাঁপছে। এক ভদ্রলোক বলল, “আরে ভাই বাসার ঝামেলা বাসায় মিটাবেন।রাস্তা ঘাটে এসব কী?এখনো হসপিটালে নিচ্ছেন না কেন?দোষ তো আপনারই মিয়া। আপনার চেহেরায়ই দোষের ছাপ আছে।”
পাবলিকের সাথে ঝামেলা করে লাভ নেই। রুদ্র অরূণীকে নিয়ে গাড়িতে তুলে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। রুদ্রের মেজাজ তখন সপ্তমে। কিন্তু এই মূর্ছা যাওয়া মানুষ’কে কিছু বলে লাভ নেই।আগে জ্ঞান ফিরুক। গাড়ি হসপিটালের সামনে থামালো। রুদ্র গাড়ি থেকে নামার পর গাড়িওয়ালার সাথে ভাড়া নিয়ে ঝামেলা হলো। চল্লিশ টাকার ভাড়া সত্তর টাকা চায় ঝামেলা তো হবেই।শেষে ষাট টাকা ভাড়া দিয়ে গাড়ির ভিতর থেকে অরূণী’কে নামাতে উদ্যত হলো। রুদ্রের শূন্য দৃষ্টি।অরূণী কোথায়?গাড়ির ভিতরে তো নেই। রুদ্র হন্তদন্ত হয়ে চারদিকে তাকালো। গাড়িওয়ালা গাড়ি ছাড়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতেই বসতেই রুদ্র অস্থির ভাবে গাড়িওয়ালা’কে জিজ্ঞেস করল, “আরে ভাই আমার রোগী কোথায়?”
গাড়িওয়ালা অদ্ভুত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলো রুদ্রের দিকে।বলল, “আপনের রোগীর কথা আমি কেমনে কমু?”
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। গাড়িওয়ালা চলে গেল। রুদ্র স্তম্ভিত হয়ে ঘাড়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। রুদ্রের মস্তিষ্ক জানান দিলো গাড়িওয়ালার সাথে তর্ক-বিতর্কের সময় অরূণী পালিয়ে গেছে। রুদ্র বেকুব হয়ে মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে ছিলো হসপিটালের সামনে। অদ্ভুত ব্যাপার!রুদ্রের কেন জানি রাগ হচ্ছে না।ব্যাপার’টা ভাবতেই রুদ্রের হাসি চাপছে। কিরণকে কিছুতেই বলা যাবে না। হাসতে হাসতে ওঁর দাঁতে খিল লেগে যাবে। রুদ্র একা একা হেসে ওঠলো। হাসা শেষে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো কেউ কেউ ওঁর দিকে সরু চোখে তাকাচ্ছে। রুদ্র পুনরায় গম্ভীর হয়ে যায়। কি এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। রুদ্র নিজেকে ধমক দিচ্ছে। এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে অরূণী! রুদ্রের মেজাজ খারাপ হওয়া কাম্য। অরূণীর এই সহজ-সরল ,অদ্ভুত আচরণের কারণে রুদ্রের রাগ স্থায়িত্ব লাভ করে না। কিছু কিছু মানুষের প্রতি রাগ করা কিংবা মেজাজ দেখানো যায় না। রুদ্র ভেবে দেখলো অরূণী প্রথম থেকে যেসব কাণ্ড ঘটিয়েছে তাতে রুদ্রের উচিত অন্তত দু চার’টা চড় দেওয়া অরূণীকে। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে সেটা কখনো করা হয় নি।
______
অরূণী হুড়মুড়িয়ে বাসায় ঢুকলো। বাসায় ঢুকেই শব্দ করে রুম আটকে দিলো। রুদ্র’কে জড়িয়ে ধরার অনুভুতি’তে অরূণীর শরীর-মন অবশ হয়ে আসছে। অরূণী বুঝতে পারলো ওঁর শরীর কাঁপছে। খাটে ধপ করে বসে পড়লো। রুদ্রের সামনে ইচ্ছে করে অচেতন হওয়ার ভান করেছে। ঝোঁকের মাথায় কি যেন হয়ে গিয়েছিল অরূণীর।নয়ত ওমন পাবলিক প্লেসে জড়িয়ে ধরে কেউ? রুদ্র যখন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলো অরূণীর তখন যেন হুঁশ ফিরে। লজ্জায় কাঁপা কাঁপা অবস্থা। রুদ্র চড়ও মেরে বসতে পারত।এসব সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য মূর্ছা যাওয়ার চেয়ে উত্তম কিছু ছিলো না। রুদ্র ওঁর বাহুডোরে আবদ্ধ করে রেখেছিলো অরূণী’কে। কোলে নিয়ে গাড়িতে তুলেছে, পুরো রাস্তায় ধরে রেখেছে।অরূণী যেন হাওয়ায় ভাসছিলো তখন। অরূণীর শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরা কেঁপেছে।অরূণীর পাগল প্রায় অবস্থা। কি করবে বুঝতে পারছিলো না। হসপিটালের সামনে গাড়ি থামানোর পর ড্রাইভারের সাথে তর্কাতর্কির সময় পালানোর সুযোগ হাতছাড়া করে নি অরূণী।নয়ত হসপিটালে গিয়ে শুধু শুধু একটা সুস্থ মানুষের ট্রিটমেন্ট করিয়ে ডাক্তারের সময় নষ্ট করার মানে হয় না।
এত ভালোলাগা,এত রোমাঞ্চকর অনুভূতি হজম করতে গিয়ে অরূণীর গায়ে জ্বর এসে গেল। রাতে হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে।অরূণীর ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে রুদ্রের নম্বর। জ্বরের ঘোরে ভুল দেখছে?অরূণী চোখ কচলায়। স্বপ্ন না-কি বাস্তব?না-কি জ্বরের ঘোরে দেখছে?এসব ভাবতে ভাবতে ফোন কেটে যায়। রুদ্র আবার ফোন দেয়।অরূণী ফোন রিসিভ করে। রুদ্র বলল, “কমন সেন্স আছে?কি জড়িয়ে কেন ধরেছো?গাড়ি থেকে কেন পালিয়েছো?”
জ্বরের প্রকোপে অরূণীর গলা দুর্বল, “ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরি নি। আপনাআপনি হয়ে গেছে।আমি তো তোমার কাছে যেতে চেয়েছি,ডাক্তারের কাছে না।তাই পালিয়েছি।”
অরূণী সব সময় রুদ্র’কে আপনি বলে সম্বোধন করে।আজ কোনো জড়তা ছাড়াই তুমি বলছে। রুদ্র অবাক হলো। রুদ্র উত্তর দেওয়ার আগে অরূণী জড়ানো গলায় বলল, “রুদ্র ভালোবাসি।”
রুদ্রের বুকের ভিতর কেমন মোচড় দিয়ে ওঠলো। অদ্ভুত মোহময় গলা অরূণীর। রুদ্র নিজেকে সামলায়।কঠিন গলায় কথা বলতে চাইলেও বলতে পারছে না।কোথায়ও বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। বলল, “অরূণী তুমি অসুস্থ?”
জ্বরে অরূণীর গলার স্বর কেমন যেন হয়ে গেছে।ক্ষীণ স্বর মায়ায় মাখামাখা।
– “আমার জ্বর এসেছে। তুমি নিম্মি আপার দেবর এটা জানার পর আমার ভীষণ জ্বর এসেছিলো।আজও এসেছে।”
অরূণীর এসব পাগলামির বিপরীতে উত্তর খুঁজে পেলো না। রুদ্র চুপ থাকলো।অরূণী ডাকলো, “রুদ্র।”
রুদ্র নিজের আচরণে নিজে ভয় পাচ্ছে।অরূণীর মায়ার পরে যাচ্ছে? রুদ্র ব্যস্ত গলায় বলল, “অরূণী,রাখছি।”
ফোন রাখার আগে ওপাশ থেকে ভেসে আসলো, “ উদ্ভট কল্পনা মাঝে সকাল-সাঝে তোমার ওষ্ঠ ছুঁই।
নিশীথ রাতে আপন খেয়াল খুশি অনুভূতিতে তোমার ওষ্ঠের উষ্ণতা নিই।
চাতক পাখি আমি,অভিমানী হয়ে অপেক্ষায় থাকি।
সে অভিমান গলে সবার অগোচরে চুপিসারে।”
অরূণী কী কবিতা বলল?না-কি নিজের দুঃখ?নিজের কল্পনার কথা? এসব বুঝে উঠে উত্তর দেওয়ার আগেই অরূণী ফোন রেখে দেয়। রুদ্র হঠাৎ অস্থির হয়ে পড়ে। অস্থিরতা জেঁকে ধরেছে রুদ্র’কে। আবার ফোন দেয়।অরূণী ফোন ধরতেই রুদ্র ব্যস্ত হয়ে বলে, “অরূণী কাল দেখা করতে পারবে আমার সাথে?”
অরূণী যেন প্রলাপ বকে জ্বরের ঘোরে, “আমি যাবো কেন?তুমি আমায় দেখতে আসো।আনারস নিয়ে আসবে।আনারস খেতে আমার ভালোলাগে।”
রুদ্র মনে মনে হেসে ফেলল।অরূণী কথা বলতে পারছে না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কথা। রুদ্র অদ্ভুত এক টান অনুভব করে। এরকম আগে কখনো হয় নি।
(চলবে)