স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
|পর্ব-০২|
পরপর আজ তিনদিন কেটে গেল।তুরাব ভাইয়া এবং খালামণি উনারা কেউই আর আমাদের সাথে যোগাযোগ করেনি।আমরাও যেচে গিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি।
ডিভোর্স পেপারটা সাইন বিহীন ঘরের এক কোণের আলমারির উপর পড়ে আছে।ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখি নি।
তবে আমার অনুপস্থিততে মা সেখানে যেয়ে পেপারটা নেড়েচেড়ে দেখেন এবং সেটি বুকে চেপে ঢুকরে ঢুকরে খুব কাঁদেনও।আমি দরজার আড়াল থেকে দাড়িয়ে নিরবে মায়ের কষ্টগুলো অনুভব করি।কিছু চাইলেও বলতে পারি না।
আজ দুপুরে আলনার জামাকাপড় গুলো গোছাচ্ছিলাম।এমতাবস্থায় মা আমার রুমে আসেন। আমার দিকে খানিক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।তারপর ধীর পায়ে হেঁটে যেয়ে বিছানার উপর বসেন।অত্যন্ত কাতর গলায় বলেন,
“সানা,কিছুদিন পর এসে যদি তোর খালামণি বলে তুরাব ডিভোর্স চাচ্ছে না।তখন ব্যাপারটা কতই না খুশির হবে,তাই না?”
আমি হাতের কাজ থামিয়ে মায়ের দিকে ফিরে তাকাই।মায়ের চোখমুখ কিঞ্চিৎ আশাতে এখনো চকচক করছে। আশার একবিন্দুও রেশ নেই, অথচ বুকে এখনো কত আশা পুষে রেখেছেন !মুহূর্তে চোখদুটো আমার ভিঁজে আসে। মনের অপার্থিব ব্যথাগুলোর টাল সামলে অন্তঃগোপনে একটা ঢোক গিলি।মাকে জবাব দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাইনি ।
মা আমার জবাবের অপেক্ষা না করে নিজমনে আবার বিড়বিড় করে বলেন,
“আমার মেয়ে কি দেখতে খারাপ?আমার মেয়ে কি অশিক্ষিত? আমার মেয়ে কি চরিত্রহীন?তুরাব রে আমার মেয়েরে চিনলি না।”কথাগুলো ছিল অত্যন্ত বেদনা ভরা অভিমানের।তারপর খানিক চুপ থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ান।আমার দিকে ফিরে বলেন,
“টেবিলে খাবার বেড়ে রেখেছি। খেতে আয়।”
আমি আলতো মাথা নেড়ে “হ্যাঁ-বোধক” জবাব দিই।মা কুরকুর পায়ে হেঁটে চলে যান।এতক্ষণে চেপে রাখা চোখের
জল এবার ঝরঝর করে পড়তে থাকে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।একটা চাপা কষ্ট।যে কষ্টের মাত্রা মায়ের ক্লান্তি মুখখানা দিকে তাকালে আরো বেড়ে যায়।।
রাতে শুতে যাবো। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠে।আমি বিছানা থেকে নেমে ওয়াড্রব থেকে মোবাইলটা নিই।স্ক্রিনের দিকে চোখ রাখতেই আমার ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠে।আমি ক্ষণিক সময়ের জন্যে চোখ বুঁজে আনি।তারপর আলতো চোখের পাতা খুলে নিয়ে সন্তপর্ণে পায়ে মাকে গিয়ে মোবাইলটা দিই।মা ফোন হাতে নিয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসূচকে তাকাতেই আমি মৃদু গলায় বললাম,
“ছোট খালামণি কল করেছেন।”
বলেই বাইরে চলে আসি।মায়ের সাথে ছোট খালামণির কি কথা হলো তা জানি না।তবে তা আর বেশিক্ষণ সময় মায়ের মুখে থাকে নি।পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসতেই মা ছোট খালামণির প্রসঙ্গ তুলেন।বলেন,
“শাহিদা বললো,ও নাকি ভীষণ চাপে আছে।ওর ভাসুরের শরীর ওতটা ভালো যাচ্ছে না।কি একটা অপারেশন করিয়েছে।তারউপর ছোট মেয়ে লিনার সমাপণী পরিক্ষা!কুমিল্লায় আসতে তাদের আরো দু’সপ্তাহ খানেক দেরী হবে।”
“ওহ।”
ছোট অক্ষরে জবাব প্রদান করে আবার খাবারে মনোযোগ দিই। মা আরো কিছু বলতে চাইলেন।চোখমুখে দ্বিধা। তাই বলতে যেয়েও পারছেন না।আমি না দেখলেও মনের গভীরে অনুভব করতে পেরেছি।তাই মাথা তুলে তাকিয়ে মাকে বললাম,
“আর কিছু বলবে,মা?”
“ইয়ে মানে…..
” সমস্যা নেই,বলো।”
“ভাবলাম তোর খালামণিকে যদি বলতাম তুরাবকে একটু বুঝাতে!দেখতে তুরাব ফিডব্যাক….,,!”
মা সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারে নি।তার আগেই আমি মাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিই। রাগভরা চোখ নিয়ে বলি,
“আমি ত আগেই বললাম,অন্যের তুচ্ছতার থেকেও আমার আত্মসম্মান অনেক বড়!আমি আরো খুশি হবো ডিভোর্স টা হয়ে গেলে!আমি ত এখন অপেক্ষায় আছি উনারা কবে আসবেন আর আমি সাইন করে দিব!প্লিজ,দ্বিতীয়বার এ’কথা না বলো তাহলে আমি খুব ভালো থাকবো।”
মা আর আমার এই কথার পিঠে জবাব দিলেন না।শুধু ক্ষীণ একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।
নাস্তা শেষ করে আমি রুমে ঢুকতেই আমার বান্ধবী টোয়া আমাদের বাসায় আসে।সে আমার দিকে একটি বিজ্ঞাপন পেপার এগিয়ে দিয়ে আনন্দিত গলায় বলে উঠে,
“সানা রে, একটা খুশির সংবাদ আছে!”
“কী!”
“এই দ্যাখ, জবের বিজ্ঞাপন!দেশের নামকরা ” এগোরা “-কম্পানিতে মোটিভেটর পদে লোক নিয়োগ দিচ্ছে। সেলারী প্রথম দিকে চল্লিশ হাজার।পরে তোর দক্ষতা, যোগ্যতা,অভিজ্ঞতায় সেলারী আরো বাড়বে!কতবড় একটা সুযোগ!এমন সুযোগ হাতছাড়া করবো না।চল আমরা ক’দিন ট্রেনিং করে কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়ে আসি!কপাল থাকলে যদি হয়ে যায় তাহলে আলহামদুলিল্লাহ! ”
আমি কৌতূহলী হয়ে টোয়ার থেকে পেপারটি হাতে নিই।বিজ্ঞাপনের সবগুলো লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। একটা লেখা দেখে কিছুটা ইতস্তত বোধ করি।বলি,
“এটা ত ঢাকায়!”
“হ্যাঁ,ঢাকায় ই ত।”
“এতদূর!কীভাবে সম্ভব!?”
টোয়া আমার কথা শুনে খিলখিল হেসে দেয়।হাসি থামিয়ে তারপর বললো,
“কুমিল্লা থেকে ঢাকা অল্পের পথ!এই টুকুর যাত্রায় তুই এতটাই ইতস্তত! ”
“তা না।ব্যাপার হলো আমার যদি ওখানে জবটা হয়ে যায় তাহলে মাকে এখানে রেখে ওখানে কীভাবে সম্ভব!?”
টোয়া এবার আরো হট্ট হাসিতে ফেঁটে পড়ে।হাসি টেনে টেনে বললো,
“ভাবতাম তুই সুশীতল,সহজ-সরল মেয়ে।কিন্তু অত্যধিক সহজ-সরল যে গাধার হাড্ডিসার জানতাম না!”
টোয়া কথায় আমি ওর দিকে রাগী রাগী মুখে তাকাতেই ও আমার মাথায় একটা চাটি মেরে বললো,
“দূর পাগলী,মজা করলাম।এরজন্যে রাগতে হয়!?আন্টিকে নিয়ে চিন্তা কীসের?ওখানে যদি ভালোভাবে সেটেল হস তাহলে আন্টিকে তোর সাথেই রাখবি।ব্যাস্ ঝামেলা মিটমাট।”
“হুম।ঠিক বলেছিস।”
“ত এখন ডিসিশন?”
“আমি মায়ের সাথে কথা বলেই তোকে রাতে জানাচ্ছি!”
“হুম,তাড়াতাড়ি কর।দেখেছিস ত ইন্টারভিউ ডেটটা একদম হাতে গোনা। ”
বিকেলের দিকে মাকে জবের ব্যাপারটা বলি।ঢাকা বিধায় মা প্রথমে যেতে দিতে রাজি হননি। অনেক আকুতি-মিনুতি,অনুপ্রেরণা মূলক বাণী শুনার পর রাজি হয়।মা রাজী হওয়াতে আমি জীবনে নতুন একটা একটা টার্নিং পয়েন্ট খুঁজে পাই।
আমি নিজের পায়ে দাড়ালে ওই মানুষ গুলোর নীচক মনোভাবের জবাব ফিরিয়ে দিতে পারবো।সমাজের ছোট শ্রেণীর মানুষেরও যে মূল্য আছে তা বুঝিয়ে দিব।অর্থালোভই পৃথিবীর সব সুখ এনে দিতে পারে না তার প্রমাণ দেখিয়ে দিব।
কত কত স্বপ্ন, ইয়া আল্লাহ পূরণ করো!
পরদিনই,আল্লাহর নাম নিয়ে টোয়াকে সঙ্গে করে ঢাকায় রওনা করি।ঢাকা শহরটা আমি তেমন চিনি না।ছোটবেলায় খালামণির বাসায় একবার মায়ের সঙ্গে নাকি এসেছি।বড় হওয়ার পর ঢাকায় আজ এই দ্বিতীয়।আমি এবং টোয়া টোয়ার একটা বান্ধবীর বাসায় উঠি।টোয়ার বান্ধবীও নাকি গ্রাজুয়েশন কম্প্লিটেড।সেও আমাদের সাথে ইন্টারভিউ দিবে।তারপর আমরা তিনজন মিলে “মোটিভেটর”-এর একটা শর্ট কোর্সে ভর্তি হয়ে যাই।কোর্সটা শেষ করতে করতে আমাদের ইন্টারভিউয়ের ডেট ঘনিয়ে আসে।ধানমন্ডির ” এগোরা”ব্রাঞ্চে আমাদের ইন্টারভিউ টাইম ফিক্সড হয়।
সেখানে আমরা তিনজনই যথাসময়ে পৌঁছাই।প্রথম ইন্টারভিউ ছিলো টোয়ার বান্ধবী রিনতির।আমি আর টোয়া বাইরে দাড়িয়ে ছিলাম।রিনতির ইন্টারভিউ শেষ হলে সে বেরিয়ে আসে।বাইরে এলে সে মুখটা কেমন গম্ভীর করে ফেলে।আমি এবং টোয়া তাকে দেখামাত্রই তার দিকে এগিয়ে যাই।হতাশ হতাশ গলায় বলি,
“কিরে,প্রশ্ন কী খুব জটিল ছিল?”
রিনতি আমাদের কথার জবাব না দিয়ে টোয়ার হাতে থাকা মাম বোতলটা এক সপাটে টান দিয়ে গদগদ করে বোতলের পুরো পানিটা শেষ করে দেয়।তারপর জোরে একটা দম ছেড়ে বুকে হাত রেখে হাঁপিয়ে হাঁপিয় বললো,
“প্রশ্ন জটিল না!স্যারের কথার ধরণ জটিল।ব্যাঁটা একটা গাইচ্ছা!যে লেভেলে কথা বলে প্রশ্নের থেকেও কথা জটিল মনে হয়।আমার তো গলা একদম শুকিয়া খড় হয়ে গেছে।মনে হয় না আমাকে ইন্টারভিউ তে সিলেক্ট করবে!”
“কেন?”
“আরেহ,যে জোরে থ্রেটকি দিয়া বের করে দিছে!ব্যাঁটার খুব তেজ!”
টোয়া ভেতরে ভেতরে একটু ভয় পায়।কারণ নেক্সট তার পালা।আমি টোয়ার মনের ভয়,জড়তা কাঁটিয়ে দিতে রিনতির বিষয়টাকে হাসিতে উড়িয়ে দিই।হাসতে হাসতে বলি,
“তোমার উত্তর করা ভুল ছিল।হয়তো দাঁতভাঙা উত্তর করছো তাই স্যারের রাগ উঠেছে !”
টোয়ার দিকে ফিরে বললাম,
“টোয়া,এত টেনশন নিস না।ইনসাল্লাহ ভালোই হবে।মনে সাহস রাখ।”
টোয়াকে বুঝাই,কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমিও ভয়ে শেষ।
টোয়ার ইন্টারভিউ শেষ হয়।ভাবলাম সে অন্তত ভালো কিছু নিয়ে আসবে।হলো উল্টোটা। রিনতির থেকে সে আরো বেশি ভয় পেয়েছে।এবার আমার মনের কোণে জমিয়ে রাখা সব আত্মবিশ্বাস তুলার মতো উড়ে যেতে থাকলে।আর ওই খচ্চর ব্যাটার তেজ মুখখানা দেখতে আমারও ভেতরটাও গিজগিজ করে উঠলো।অবশেষে আমারও ডাক পড়ে যায়।যাওয়ার সময় টোয়া আমার হাত শক্ত করে ধরে বললো,
“আমার বিশ্বাস তুই পারবি।মনে সাহস এবং আত্মবিশ্বাস ধরে রাখ।”
টোয়ার কথায় মাথা নেড়ে আমি ধীর পারে ইন্টারভিউ কক্ষের দরজায় হাত রাখি।দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিয়ে বলি,
“May i come in, sir?”
লোকটি মাথা নুইয়ে কি একটা ফাইল দেখতেছিল।তাই পূর্বানুসারে মাথা রেখেই জবাব দেয়,
“Yes,come in.”
আমি মিনমিন পায়ে ভেতরে ঢুকি।আর টেবিলের দিকে পা বাড়াতে থাকি।সাথে একগাট্টি ভয়,জড়তা,সংকোচ ত আছেই।
টেবিলের কাছে আসতেই লোকটি মাথা তুলে,
“Plz, sit down.”
বলবে।কিন্তু তা আর বলা হলো না!লোকটি আমার দিকে তাকাতেই আমার চোখদুটো গোল আলুর মতো আঁটকে যায় ।আমার চোখজোড়া শুধু গোল আলু নয়, যদি সম্ভব হতো তাহলে মাটির সাথে মিশে যেয়ে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম।থরথর পায়ের কাঁপুনি,বুকের ভেতর ধুকপুক, মাথায় শূণ্যতা নিয়ে তুরাব ভাইয়ার সামনে দাড়িয়ে আছি!!!!
চলবে…….