নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-৮

#নিস্তব্ধ_বিচরণ
#তানজিলা
#পর্ব -৮

গোসল সেরে চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো ইনায়া। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। সকালেই গোসল করে বেরিয়েছিল।
কাল রাতে হয়েছিল তুমুল বৃষ্টি। সেই মিলিয়ে আজ ঠান্ডাও ভালো পড়েছে। বৃষ্টিতে ভিজবে বলে একবার ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ইনায়া। কিন্তু চাচা তো বাড়িতে! কাদা পানিতে দিনে দ্বিতীয় বারের মতো গোসল করে এইমাত্র তৃতীয় গোসল করে বের হয়ে যদি এখন বৃষ্টিতে ভেজার বায়না করে চাচা মনে হয়না মানবে!

মনে মনে ভিষণ রাগ হচ্ছে ঐ গাড়ির ওপর, না! গাড়িতে লুকিয়ে থাকা মানুষটার ওপর! চিরকুটটা ভাজ করা অবস্থায় ড্রয়ারে রেখে দিয়েছে। ওর সম্পূর্ণ সন্দেহ ঐ গাড়িতে আটকে আছে। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল হয়তো ওর ভুল হচ্ছে। ওভাররিয়েক্ট করছে! কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না! নিজের ভাবনায় মশগুল ইনায়া খেয়ালও করেনি কখন আরিফা এসে বিছানায় বসে মিটিমিটি হাসছে।
-“এই তুই এভাবে হাসছিস কেন?”
ইনায়ার কথা আরিফা সাথে সাথে হাসি বন্ধ করে বললো,
-“আপু ছাদে চলো!”

ইনায়া মুখ গোমরা করে খাটে গিয়ে বসলো। ঠান্ডা হাওয়ায় ঘরের পর্দাগুলো মৃদু দুলছে। আর দরজার পর্দা টেনে ধরে আনন্দে নাচছে আরিফা। তখনই ইনায়ার চাচী এসে আরিফাকে ধমক দিয়ে বসে। গতকালই এভাবে নাচতে গিয়ে ঠাস করে পড়ে পুরো ঘরের সকলের কানের ওপর ভিষণ অত্যাচার চালিয়েছিল। যাওয়ার আগে একবার ইনায়াকে বললো,
-“একটু ছাদ থেকে কাপড়গুলো আনতে পারবি! বৃষ্টি শুরু হবে হয়তো! বেশি না, তোর চাচার দুইটা শার্ট!”

চাচীর কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে ইনায়া। এইতো সুযোগ। আরিফাকে নিয়ে ছাদে উঠে কাপড়গুলো আরিফার হাতে ধরিয়ে দিল ইনায়া। আরিফা মুখ ফুলিয়ে বললো,
-“এখন নিচে গেলে আব্বু আর আসতে দেবে!”
ইনায়া মিষ্টি হেসে আরিফার গাল টেনে বললো,
-“কাপড়গুলো রেখেই চুপচাপ চলে আসবি! আওয়াজ ছাড়া৷ চাচা তো ঘুমাচ্ছে!”

বাতাসে পরিবেশ হয়ে উঠেছে মনোমুগ্ধকর। আশেপাশের কোন দিকেরই খেয়াল নেই ইনায়ার। বৃষ্টি হবে হবে ভাব। দোলনায় বসে চোখ বন্ধ করে নিজের কাল্পনিক দুনিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিমুখোর পরিবেশের আলাদা একটা ঘ্রানই আছে। মন ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে। নিচে যেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না।

হঠাৎ একটা বাচ্চার চিৎকারের আওয়াজে চোখ খুললো ইনায়া। ছাদের রেলিঙের কাছে যেয়ে দেখে সামনের বাড়ির ছাদে একটা পিচ্চি পড়ে গিয়ে কান্না করছে আর পিচ্চির মা এসে প্রথমে একটা থাপ্পড় দিয়ে পরে নিজেই বকে বাচ্চাকে কোলে তুলে আদর করতে করতে নিয়ে গেল।

মলিন হেসে সবটুকু দেখলো ইনায়া। ওর স্পষ্ট মনে আছে ছোটকালে এভাবেই মেরে পরে নিজেই কান্না করতে করতে আদর করতো ওর মা। ভিষণ দুষ্টু ছিল ও। মাকে জ্বালিয়ে মারতো একেবারে। দুষ্টুমিটা ওর মাঝে এখনো থেকে গেলেও একবার কান মলে শাসন করার মতো মানুষটাই যে এখন ওর পাশে নেই!

সম্পূর্ণ কাকভেজা হয়ে আছে ইনায়া। কখন যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল ওর তাতে কোন ধ্যান নেই। একদৃষ্টিতে সামনের বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তখনই কানে ভেসে এলো এক বিরক্তিকর আওয়াজ। গাড়ির হর্ণ! নিচে তাকিয়ে দেখে ঐ গাড়িটা রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইনায়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এতক্ষণ তো খেয়ালও করেনি। চোখের সামনে ঝাঁপটে লেগে থাকা চুলগুলো সরিয়ে ছাদের রেলিং থেকে কিছুটা পিছিয়ে আসলো ও।এখন খেয়াল করলো পুরো শরীর কাঁপছে ওর। ঠান্ডায় যেন জমে যাচ্ছে! এখন আর কিছু চিন্তা করতে ইচ্ছে করছে না। মাথাটা ভার হয়ে আছে। জ্বর আসবে হয়তো!
নিচে নেমে জামাটা পালটেই শুয়ে পরলো কাথা জড়িয়ে। রাতের দিকে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। খেতেও পারেনি কিছু।ওর চাচী আর আরিফা ঘুমাচ্ছে। চাচাও বাড়িতে নেই। এখন কাউকে ডাকতেও ইচ্ছে করছে না। দূর্বল শরীর নিয়েই অল্প কিছু ভাত খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিল। রাত তখন ২ টা। বিছানায় শুতেই মোবাইলের টুং আওয়াজে বিরক্তি নিয়ে মোবাইল অন করলো ইনায়া। এমনিও চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে। আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ দেখে মেসেজটা আর ওপেন করলো না ইনায়া। ফোন সাইলেন্ট করেই হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে!

সকালের দিকে জ্বর অনেকটাই কমে গেছে। ইনায়ার চাচা এখনো বাড়ি আসেনি। এর আগে রাতে অন্তত বাইরে থাকেনি ওর চাচা। ইনায়ার চাচীকেও বেশ রাগান্বিত মনে হচ্ছে।
আরিফার জন্য নতুন টিচার রাখা হয়েছে মাসের মাঝেই। ও এখন পড়ছে। ইনায়ার চাচী চা নিয়ে যাবে তখনি কলিং বেলটা বেজে ওঠায় চা সাথে বিস্কুটের ট্রে নিয়ে ইনায়াই যায়।

ইনায়ার কাজিন হিসেবে আরিফাও দুষ্টুমিতে কম যায় না। খুব বেশি রাগী টিচার ছাড়া যেন ওকে কেউ পড়াতেই পারে না। প্রথম দিনই সব টিচারের মাথা খারাপ করে দেয়। সেই আরিফাকেই চুপচাপ ম্যাথ করতে দেখে কিছুটা অবাকই হলো ইনায়া। আরিফার নতুন প্রাইভেট টিউটর স্নিগ্ধ একবার ইনায়ার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে আরিফার খাতার দিকে মনোযোগ দিল। স্নিগ্ধকে দেখে তেমন কড়া টাইপ টিচার তো মনে হচ্ছে না। কিন্তু তাও চেহারা দেখে কতটুকুই বা বোঝা যায়। হঠাৎই টেবিলের এক সাইডে রাখা কাঠের স্কেলটা নিয়ে বেশ জোরেই আরিফার হাতে আঘাত করে বসে স্নিগ্ধ। আরিফা মুখ চেপে বসে আছে।যেন কান্নাও করা যাবে না! হাতটাও লাল হয়ে আছে।
-“আপনি প্লিজ একটু বাইরে যাবেন? আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি ডিস্টার্বেন্স!”

স্নিগ্ধ কথাটা শান্ত গলায় বললেও ইনায়ার তা মোটেও পছন্দ হলো না। আরিফার হাত দেখে ভিষণ রাগ হচ্ছে ওর। এর আগেও অনেক টিচারের হাতে মার খেয়েছে আরিফা। কিন্তু এমন অমানুষের মতো না। দেখে মনে হচ্ছে এখনি রক্ত পড়বে!
ইনায়া স্নিগ্ধর কথাকে পাত্তা না দিয়েই আরিফার হাত ধরলো। এভাবে কেউ একটা বাচ্চাকে মারে! স্নিগ্ধ একবার ইনায়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইনায়ার চাচীকে কিছু একটা বলে চলে গেল।

ইনায়ার মনে হয়েছিল স্নিগ্ধ হয়তো আর আরিফাকে পড়াবে না। কিন্তু ইনায়ার ধারণাকে ভুল প্রমান করে পরেরদিনই স্নিগ্ধ আবারও এলো। আর ইনায়ার চাচী ইনায়াকে ঐ রুমে যেতে নিষেধ করলো। আরিফার সে কি কান্না, ও স্নিগ্ধর কাছে পড়বেই না। কিন্তু ইনায়ার চাচী একটা কথাও শুনলো না। স্নিগ্ধ নামের এই মানুষটাকে কেন যেন ইনায়ার মোটেও সুবিধার মনে হয় না। কেমন যেন রহস্যজনক মানুষটা। চোখে তাকাতেই কেমন শীতল চাহনিতে তাকায় ওর দিকে, ভয়ংকর শীতল দৃষ্টি!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here