নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-৯

#নিস্তব্ধ_বিচরণ
#তানজিলা
#পর্ব -৯

পড়ার টেবিলে বই খুলে চুপচাপ বসে আছে আরিফা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকা ব্যাক্তির গম্ভীর কন্ঠ কানে এতেই স্নিগ্ধর দিকে তাকালো ও।
-“গতকাল তোমার হাতে কয়বার স্কেলের বারি পড়েছে?”
আরিফা ভয়ে ভয়ে মাথা চুলকাচ্ছে আর হাতের আঙুলের সাহায্যে কি যেন গুনছে!
-“৫ বার!”
স্নিগ্ধ এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
-“সিওর? আমি তো মনে করেছি ৩০বার স্কেলের বারি পড়েছে হাতে!”
সাথে সাথে বড় বড় চোখ করে তাকায় আরিফা। ওর মাকে একটু বাড়িয়েই বলেছিল আরিফা। যদিও লাভ হয়নি। ওর ক্লাসে সবসময় ফার্স্ট হওয়া গার্ল স্নিগ্ধর কাছে পড়ে। এখন আরিফার মায়ের জেদ আরিফাকেও পড়তে হবে। এই বদ টিচারের হাতে প্রথম দিন থেকেই মার খেয়ে আসছে আরিফা। এর চেয়ে তো আগের টিচারই ভালো ছিল! শুধু বকতো! হাতটা কেমন রক্তলাল হয়ে গেছিলো ওর। আরও মারলে হয়তো হাত দিয়ে রক্ত পড়তো। একটা মাসুম বাচ্চার ওপর কেউ এমন অত্যাচার করে!
-“এখন বলো কালকে এতো মার কেন খেতে হলো তোমাকে?”
আরিফা কাচুমাচু হয়ে তাকালো স্নিগ্ধর দিকে কিন্তু কিছু বললো না।
-“স্পিক!”
-“আমি আপনার ফোন ধরছি।”
-“ফোন ধরে কি বলেছিলে!”
আরিফা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বললো,
-“বলবো না! আপনি আমাকে আবার মারবেন, তাই না!”
ওর দৃষ্টি স্নিগ্ধর হাতে থাকা স্কেলটার দিকে। নিজের স্কেল লুকিয়ে রেখেও লাভ হয়নি। স্নিগ্ধর ব্যাগেও স্কেল ছিল।
টেবিলের স্কেল দিয়ে বারি দিতেই আরিফা ফটফট করে বললো,
-“আপনি আমাকে না পড়িয়ে ফোন এখানে রেখে গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটিংএ গেছেন!”
স্নিগ্ধ আরিফার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
-“একেতো মিথ্যা বলেছো! তারচেয়েও বড় কথা ক্লাসে টু তে পড়া পিচ্চি এসব কি করে বলতে পারে!কে শিখিয়েছে এসব তোমাকে!”
আরিফার মুখ থেকে কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। স্নিগ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“ম্যাথ করেছো আজকে?”
আরিফা মাথা নাড়িয়ে না বলে। এই হাত নিয়ে কালকে আর পড়তে বসেনি ও! স্নিগ্ধ কড়া চোখে একবার তাকিয়ে বললো,
-“থাক! আজকে ইংরেজি বই আগে বের করো।”
আরিফা তো মনে করেছিল ম্যাথ না করায় হয়তো আজকেও মার খাবে!
-“আরেকটা কথা।”
আরিফা বই টেবিলে রেখে স্নিগ্ধর দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধ গম্ভীর কন্ঠে বললো,

-“তোমার ইনায়া আপুকে বলো লুকিয়ে লুকিয়ে কারও কথা শোনার আগে নিজের পায়ের দিকে যেন একবার খেয়াল করে! দেখা যাচ্ছে কি-না!”

ইনায়া কথাটা শুনেই নিজের মুখে হাত দিয়ে ছুটে অন্য রুমে চলে যায়। স্নিগ্ধ আগেই জানতো ইনায়া দরজার পর্দার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। বিষয়টা ভিষণ লজ্জাজনক মনে হচ্ছে ওর কাছে। আর আরিফা তো আরিফাই! পাকা বুড়ি একটা! এখনকার বাচ্চাদের যে কী অবস্থা!
___________________

-“ঐ বদ স্যার আবারও নিজের ফোন ভুলে গেছে! একটা ভালো গেমসও নেই এই ফালতু মোবাইলে!”

সাথে সাথে ছো মেরে আরিফার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল ইনায়া।
-“আকাম করিস তুই আর সবাই বলে আমার থেকে শিখছিস!”
আরিফার কপট রাগ দেখিয়ে হাত উঁচু করে ফোনটা নেয়ার চেষ্টা করছে। পরে না পেরে দুই হাত কোমড়ে রেখে বললো,
-“হ্যা তো ভুল কি বলেছে! আর তোমার তো আমাকে থ্যাঙ্কস বলা উচিত! তোমার হয়ে রিভেঞ্জ নিয়েছি আমি!”
-“মানে কি!”
আরিফা হাতের ইশারায় ইনায়াকে বসতে বসে ওর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-“ঐ গাড়িটাকে কাঁদা পানি দিয়ে গোসল করিয়েছি।”
ইনায়ার চোখ অটোমেটিক বড় বড় হয়ে গেল। ছাদ থেকে ঐদিন গাড়িটা দেখার পর থেকে এখন পর্যন্ত গাড়িটাকে আর দেখেনি ইনায়া। এই কারণে!
ইনায়া একবার চোখ ছোট ছোট করে আরিফার দিকে তাকিয়ে বাইরে বের হলো।

স্নিগ্ধ এখনো মেইন রোডের একপাশে দাঁড়িয়ে পকেটে কি যেন খুঁজছিলো। ইনায়া ফোনটা স্নিগ্ধর সামনে ধরতেই স্নিগ্ধ ইনায়ার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ইনায়ার দিকে তাকায়,
-“বাচ্চাদের উদ্ভট বুদ্ধি একটু কম দেবেন। কাছের মানুষদের কাজ বাচ্চাদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে।”

ইনায়া এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে স্নিগ্ধর কথা শুনছিলো। যেইনা স্নিগ্ধ রোড ক্রস করতে নিল ইনায়া সাথে সাথে স্নিগ্ধর সামনে এসে দাঁড়ালো।
-“আজব তো! আপনি আমাকে ঠিকমতো চেনেন পর্যন্ত না। এভাবেই একটা কথা বললেই হলো! আপনি মানুষের দিকে কিভাবে তাকান খেয়াল আছে আপনার। আপনার থেকে না কেন যেন একটা সিরিয়াল কিলার টাইপ ভাইভ আসে! মনে হয় এই হয়তো আমাকে আপনার নেক্সট ভিকটিম করার প্লেনিং করছেন। কই, আমি তো কিছু বলি নি!”

একদমে কথাগুলো বলে স্নিগ্ধর চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল ইনায়া। এখন চুপ হয়েও বা কী! যা বলার তা তো বলেই দিয়েছে।
কিছু মানুষ আছে যাদের চেহারায় স্বাভাবিক ভাবেই একটা গাম্ভীর্য ভাব ফুটে থাকে। স্নিগ্ধ হয়তো তাদের মাঝেই একজন। কিন্তু এমুহূর্তে তার মুখে কোন গাম্ভীর্যের রেশ নেই যেমনটা আগে ছিল। আর না রাগের কোন ছিটেফোঁটা আছে। একেবারে অনুভূতিহীন চেহারা! ইনায়ার ইচ্ছে করছে নিজের মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে রাখতে। কোন লাগাম নেই এতে!
হঠাৎ স্নিগ্ধ ওর কিছুটা সামনে এসে দাঁড়াতেই হুট করে পিছিয়ে গেল ইনায়া। স্নিগ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-“ভয় পাচ্ছেন, আমার নেক্সট ভিকটিম!”

এর আগে কখনো এতটা বিব্রতবোধ করেছে কি-না ইনায়ার জানা নাই। স্নিগ্ধর দিকে না তাকিয়েই কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
-“আই এম সরি! কিন্তু আপনারও বোঝা উচিত। এভাবে না জেনে কাউকে ব্লেম করা একদম উচিত হয়নি!”
ইনায়ার কথা শুনে এবার সশব্দে হেসে ওঠে স্নিগ্ধ।
-“কথাটা নিজের দিকেও খাটাবেন ম্যাডাম! উপদেশ দিলই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না!”

ইনায়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই হঠাৎ তখনই পাশ থেকে অনবরত গাড়ির হর্নের আওয়াজ ভেসে আসতে শুরু করলো। ইনায়া বিরক্ত নিয়ে সেদিকে তাকাতেই গাড়িটা চলে গেল। এটা তো সেই গাড়ি ছিল! ইনায়া গাড়িটা দেখেই চিনে ফেলেছে। পুরো রাস্তা বলতে গেলে খালি। এত হর্ণ বাজানোর কী ছিল! পাশে ফিরে দেখে স্নিগ্ধ ও নেই।

রুমে বসে নিজের ফোন ঘাটছিল ইনায়া। এখন আবার জ্বর এসেছে ওর। ওষুধ খেয়েই বসে ছিল। পাশের রুমে ইনায়ার চাচী আর আরিফার ঝগড়ার আওয়াজে পুরো ঘর মুখরিত। সে রোজকার ঘটনা। আরিফাকে পড়তে বসাতে গিয়ে ঘরে ছোটখাট একটা যুদ্ধই বেঁধে যায়!

ফিহার সাথে বেশ কিছুক্ষণ চ্যাটিং করে ফোনটা রাখতে গিয়েও রাখলো না ইনায়া। আবারও কিছু আননোন নাম্বার থেকে ওয়াটস এপ এ মেসেজ। ঐদিন তো মেসেজগুলো চেক করেনি ও। এরপরও আর চেক করা হয়নি। নতুন করে আরও কিছু মেসেজ আসায় মেসেজ ওপেন করতেই কিছুসময়ের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে গেল ইনায়া। সাথে সাথে উঠে গিয়ে জানালা অফ করে দিলো। বিষয়টাকে আর হালকা ভাবে নেয়া যাবে না। ভয়ার্ত চোখে মোবাইল স্কিনে ভেসে ওঠা ছবিগুলোর দিকে আবারও নজর দিল ও।

সেদিন ছাদে থাকাকালীন সময় তোলা ইনায়ার কিছু ছবি, আর আজকে স্নিগ্ধর সাথে কথা বলার সময়ও কেউ লুকিয়ে ওদের ছবি তুলেছে! তখনই ঐ নাম্বারটা থেকে ফোন আসে। ইনায়া কিছুক্ষণ চিন্তা করে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ কল কেটে দিল। ইনায়া এবার নিজেই কল করলো।
ধোঁয়াসায় কেটে গেল সে রাত। ফোন কেউ তোলেনি আর। রাতের দিকে ইনায়ার জ্বরটাও তড়তড় করে বেড়ে গেছে। বারবার নিজের বাবাকে কল করছে। কিন্তু সেও ফোন ধরছে না। ইনায়ার চাচাও ইদানিং বাইরে বেশি থাকে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না ও!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here