#বুনোভাই
#পর্ব_২০
#লেখনিতে_তিথি_মজুমদার
২০
-শুভ জন্মদিন মায়াবতী।
মৃদুলের কথায় টিপটিপ করে নিজের চোখ খুলল মৃণালীনি। নিভুনিভু চোখে সে মৃদুলের দিকে জিজ্ঞসা দৃষ্টিতে তাকালো,
-কিরে নিজের জন্মদিনের কথাও ভুলে গেলি আমাকে পাওয়ার আনন্দে!
বলই হো হো করে হেসে উঠলো মৃদুল। ততক্ষনে মৃণালের মনে পড়ে যে আজ সত্যিই তার জন্মদিন। ২০ বছর আগে এমনি এক বসন্তেই তার জন্ম ।সেদিন ঘর আলো করে সে পৃথিবীতে এসেছিলো কিন্তু তার ভাগ্য সেদিন তার সহায় হয়নি , যে মায়ের কোল জুড়ে সে এসেছিলো সেই মা’ই তার জন্মের পরপর তাকে এ কন্ঠকময় পৃথিবীতে একা করে দিয়ে চলে গিয়েছিলো । যার ভরসায় তাকে রেখে গিয়েছিলো তার মা , সে বাবা নামক মানুষটিও তাকে সেদিন ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো । এরপর তার বৃদ্ধা নানি আর দুই মামার সহযোগিতায় আজ সে এতো বড় হয়েছে।এসব অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝরছে মৃণালের।
মৃদুল মৃণালের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে দুহাত দিয়ে নিজের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে। মৃদুলের ছোয়ায যেনো অন্যরকম কিছু একটা ছিলো তাইতো মৃদুলের বাহুতে আবদ্ধ হতেই হু হু করে কেদেঁ উঠলো সে। মৃণালের এমন আর্তনাত ভরা কান্নায় বুকটা ছটফট করে উঠলো মৃদুলের। আরও গভীরভাবে সে মৃণালেকে জরিয়ে ধরলো।
-কাদঁ,যত খুশি কেঁদে নে আজ।কারণ আজকের পর থেকে তোর এই চোখে আমি কখনো পানি আসতে দিবো না মিনু।আজকের পর থেকে তুই অতীতের সকল তিক্ততা ভুলে নতুন করে বাচঁবি,তোর নিজের জন্য তুই বাচঁবি,আমার জন্য বাচঁবি!!
বলেই আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সে মৃণালিনী কে।
এতোক্ষণে ওদের এমন আবেগ ঘন মুহূর্ত দেখে নিরবেই সরে গিয়েছিল বিপাশা।
ছাঁদ থেকে নামর সময় চিলেকোঠার পাশে সে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো বিশানকে।টলমলে চোখ নিয়ে হাসি মুখে সে মৃনাল-মৃদূলের ভালোবাসার মূহুর্তগুলো দেখছে।
বিপাশা ধীর পায়ে হেঁটে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,
-খুব ভালোবাসে ফেলেছিলিস মেয়েটাকে তাই না!
হঠাৎ বিপাশার কথায় চমকে তাকালো বিশান।
”
”
”
-বিশ বিশটা বছর হয়ে গেলো মা, মামুকে দেখছি প্রতি বছর এই দিনে এই বিদেশে থেকেও দেশে গরীব আত্মীয়দের অর্থ সহযোগিতা করে আসছে,মসজিদে দোয়া পড়ায়,আর এতিমখানায়ও অনেক টাকা দান করে।যে মানুষটা এতো দানশীল সে কি করে জন্মের এতোগুলো বছরেও নিজের মেয়ের মুখ না দেখে থাকতে পারে বলোত।
ছেলের কথায় মনিরা চৌধুরী মৃদূ হেসে বললেন সবটাই আমার কারসাজি।
মায়ের কথায় অনেকটা চমকে যায় অনিশ।সে তার মাকে পুরো ঘটনা জিজ্ঞেস করতেই মনিরা চৌধুরী তাকে শুধু এটুকুই বললেন।
-আমি যা করেছি তা কেবল তোর সুখের জন্যই করেছি।কিন্তু কিভাবে কি করেছি সেসব প্রশ্ন তুই আমাকে করিস না আমি তার কোনো উত্তর তোকে দিতে পারবো না।
মায়ের কথায় অনেকটা রহস্যের গন্ধ পেলো অনিশ।তবুও সে তার মাকে বেশি ঘাটালো না।কারন সে জানে তার মা যা বলো তাই করে এখন যেহেতু সে একবার বলেছে যে মামুর অতীতের কোনো কিছুই সে বলবেনা তো সে তা কখনোই বলবে না।অনিশ তার মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো গভীর ভাবে।সে তার বাবাকে জন্মোর পর থেকে কোনোদিন দেখে নি।সে বরাবরই জেনে এসেছে তার জন্মের আগেই তার বাবা একটা রোড এক্সিডেন্ট এ মারা যায়।এরপর থেকেই তার মায়ের আশ্রয় হয় এই মামুর বাড়িতে।মামি মারা যাওয়ার পর মামু যখন বিদেশে
চলে আসছিলো তখন তার মাও তাকে নিয়ে মৈনাখের সাথে নিজের দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলো এই দেশে।এরপর থেকে সে আর তার মা এইখানে তাদের মামুর কাছেই আছে।ছোট বেলা থেকেই সে দেখে আসছে তার মামু প্রতি বছর বসন্তে এসব কাজ করেন।এতো বছর কোনো প্রশ্ন না করলেও আজ হঠাৎ করেই তার মনে এ প্রশ্ন টা জাগে যে তার মামু এতো ভালো মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কেনো তার নিজের মেয়েকে চোখের দেখাটুকুও দেখেনা।
—————————————————-
রাতের অন্ধকার বিশাল আকাশের নিচে ছাঁদের রেলিং ঘেসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মৈনাখ।আজ তার প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর কুঁড়ি বছর পূর্ণ হলো তার সাথে তারই উরসজাত সন্তানের জন্মদিনও।আজ কেনো জেনো তার বড্ড ইচ্ছে করছে নিজের মেয়েকে দেখতে।তার মুখে বাবা ডাক শুনতে,তার সাথে গল্প করতে,খুব ইচ্ছে করছে মৈনাখের।কিন্তু যখনই তার মনে পড়ে এই মেয়েকে পৃথিবীতে আনতে গিয়েই তার প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রান চলে গিয়েছিলো তখনই তার মনে তীব্র একটা ঘৃণার সৃষ্টি হয়।তাইতো এতোগুলো বছরেও নিজের মেয়েকে চোখের দেখাটুকুও সে দেখতে চায়নি,কখনো তার সাথে দেখা করেনি,কথা বলেনি।শুধু প্রতি মাসে মাসে মেয়ের নামে মোটা অংকের একটা এমাউন্ট সে দেশে পাঠায়।কিন্তু তার কোনো অংশই মৃণালিনীর মামা,বা নানুরা নেয়না।তারা তাদের খরছেই তাদের ভাগনি/নাতনিকে লালন-পালন করে আসছে এতোগুলো বছর।এটা এতোদিন মৈনাখ জানতো না।কিছুদিন আগে যে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে সে টাকা পাঠাতো সে ব্যাংকের ম্যানেজার তাকে ফোন করে এসব জানায়।তখনই মৈনাখ সবটা জানতে পারে।তবে আজ ইচ্ছে হলেও তার করার কোনো উপায় নেই।কারন তিনি একদিন সেচ্ছায় নিজের মেয়েকে ত্যাগ করেছিলেন,আজ এতোগুলো বছর তার কোনো খোঁজ খবরও তিনি নেননি,সেই তিনিই আবার কোন মুখে নিজের মেয়ের সামনে দাঁড়াবেন!
——————————————-
বিশান দ্রুতই নিজের চোখের পানি হাতের ভাঁজে খুব সাবধানে মুছে হাসিমুখে বলল,
-কিসব আবোলতাবোল বলছিস বিপু।ভালোবাসবো আমি দ্যা গ্রেট বিশান এও কি সম্ভব বিপু।আমি ফ্ল্যাট করতে পছন্দ করি কিন্তু লাভ! আই ডোন্ট লাইক লাভ।সো এসব বাজে বকা বন্ধ কর।
-তোর চোখ কিন্তু অন্য কথা বলছে ভাইয়া।
বিপাশার এই কথায় হকচকিয়ে তাকালো একবার বিশান তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
-এসব বাদ দে বনু।সামনের দিকে তাকিয়ে দেখ কি সুন্দর মানিয়েছে আমাদের মৃদুল আর মৃণালিনী কে।আর তুই কি না এখন এসব আজগুবি চিন্তা নিয়ে পড়ে আছিস।
জবাবে মুচকি হেসে বিপশা শুধু হুম বলল।তারপর আস্তে করে নিচে নেমে গেলো
এদিকে বিপাশা যাওয়ার পর বিশান মনে মনে ভাবলো,
-সত্যিই সে প্রেমে পড়েছিলো, একটা গ্রাম্য মেয়ের প্রেমে পড়েছিলো সে।তারমতন মেয়েবাজ ছেলেরও যে কাওকে ভালো লাগতে পারে,সেও যে কাওকে ভালোবাসতে পারে তা তার অজানাই ছিলো যতদিন না সে মৃণালকে দেখেছিলো।কিন্তু সেদিন গ্রামে প্রথমবার চোখ ভর্তি চোখের উপছে পড়া অতি সাধারণ একটা মেয়ের প্রেমে সে যেনো হাবুডুবু খাচ্ছিলো হঠাৎ। একেই যেনো লাভ এট ফাস্ট সাইড বলে।কিন্তু পরক্ষণেই যখন সে জানতে পারে এই মেয়েটিই তাদের বন্ধুর ভালোবাসা তখন যেনো এক মূহুর্তের জন্য তার পুরো পৃথিবী টা থমকে গিয়েছিল। তবে তখনো তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিলো যে মৃণালিনী হয়তো তাকে ভালোবাসলেও
ভাসতে পারে।মৃণালিনীর মনে সে নিজের জন্য একটা জায়গা তৈরি করতে অবশ্যই পারবে।তা সে অবশ্য পেরেছিলো মৃণালিনীর মনে নিজের একটা জায়গা তৈরি করতে কিন্তু নিজের জন্য ভালোবাসা কখনো জাগাতে পারেনি সে মৃণালের মনে।
এইতো সেদিনেরই কথা যেদিন প্ল্যান অনুযায়ী মৃণালকে প্রপোজ করতে যাচ্ছিলো বিশান সেদিন মৃদূলের মতন তার মনেও একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছিলো এই ভেবে যে শেষ পর্যন্ত মৃণালের উত্তর কী হয়,সে কি আদৌও ভালোবাসে মৃদূলকে নাকি নিজের জন্য ভালোবাসার স্থান তৈরি করতে পেরেছে সে মৃণালের মনে? এমন নানারকম চিন্তায় সে সেদিন বিভোর ছিলো।সবার কাছে সেদিনটা অভিনয় হলেও তার কাছে ওই
দিনের মতন ধ্রুব সত্যি আর কিছুই ছিলো না।
তারপর যখন মৃণাল বলেছিলো যে শুধু একজনকেই ভালোবাসতে পারে সে হচ্ছে মৃদুল! তারপর যেনো এক মূহুর্তের জন্ম তার পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন।মৃণালের উত্তরে যখন পুরো বন্ধু মহলে খুশির আমেজ তখন তার মনে যে কী তীব্র দহন হচ্ছিল তা শুধু সেই জানে।তার সেই দহন সে না পারছিলো সইতে না পারছিলো কাওকে বলতে।একা একা গুমরেছে সে কেবল।
তার ভালোবাসার জোর হয়তো কম ছিলো তাইতো আজ মৃদুল আর মৃণালিনী মিলন হয়েছে আর সে একা এই এক পাক্ষিক ভালোবাসার তীব্রতায় ভুগছে।
কাওকে পেয়ে হারানোর কষ্ট টা এক রকম,কাওকে দূর থেকে চাওয়াটা আবার অন্য রকম,আর কাওকে পাব না জেনেও নিষিদ্ধ চাওয়াটা অন্য রকম।সে তো প্রথম থেকেই জানতো মৃদুল মৃণালিনী কে ভালোবাসে,তবুও সে মনে মনে মৃণালিনী কে নিজের করে পেতে চেয়ছে।এ যেনো নিজের ইচ্ছেতে আগুনে ঝাপ দেওয়ার মতন ছিলো। তাইতো আজ সে পুড়ছে,পুড়ে খান খান হয়ে যাচ্ছে সে।
পৃথিবীতে এই এক পাক্ষিক ভালোবাসার যে কি ভীষণ যন্ত্রণা তা কেবল যে ভেসেছে সেই বুঝেছে।
তবে বিশান মন থেকে চায় মৃদুল আর মৃণালিনী যেনো সুখী হয়, অনেক ভালো থাকে যেনো তারা।তাইতো নিজের মনের তীব্র যন্ত্রনাকে এক পাশে ঠেলে রেখে সে তাদের দুজনকে মিলিয়ে দিয়েছে। শেষ বারের মতন একবার সে মৃদূল আর মৃণালিনী কে এক নজর দেখে মনে মনে একবার আউড়ালো
– না অনুরোধে,না মায়ায়,
বেঁধেছি তোমায় ভালোবাসার ছায়ায়।
একটা শপথ,অথবা কবুল করলেই কি হয়ে যাবে ভালোবাসারা র্নিভুল!!!
সত্যিই কি বিশান পারবে মৃণাল আর মৃদুলকে এক সাথে দেখতে,নিজের ভালোবাসা কে অন্যের বাহু বন্ধনে দেখাটা যে কতটা কষ্ট কর তা কেবল যে না দেখেছে সে বুঝে নি।মানুষের মন তো সেকেন্ডের মাথায় পরিবর্তন হয় যদি বিশানের মনও কখনো পরিবর্তন হয় তাহলে কি ঘটবে মৃদূল আর মৃণালিনীর জীবনে?
চলবে..