#গল্পঃকুয়াশার_মতো।
#পর্বঃ- ০৫
” শাকিলা যখন তার বাবাকে খুন করার হুমকি দেয়, তার আগে আপনাদের মধ্যে ঠিক কি কথা হয়েছে জানতে পারি? ” প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে সাজু, তার পাশেই বসে আছে তার বন্ধু রামিশা।
” শাকিলার মা বললেন, সাজ্জাদের সঙ্গে সম্পর্ক আমরা রাখতে চাচ্ছিলাম না। শাকিলা নিজেও যেতে চায়নি তাই ওর বাবা তার উকিল বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু হঠাৎ করে যেই শাকিলা মতামত পরিবর্তন করে তখন তার বাবা রেগে যায়। ”
” আপনি একজন মা, নিজের মেয়ের সংসার রক্ষা করার জন্য কখনো স্বামীকে বুঝিয়েছেন? ”
” আমি আমার স্বামীর কথার উপর কোনদিন কথা বলতে পারতাম না। কারণ তিনি কখনো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতেন না, আমার মনে হচ্ছিল তিনি শাকিলার বিষয় সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ”
” হাদিস অনুযায়ী একটা পুরুষের চরিত্র সম্পর্কে তার স্ত্রী সবচেয়ে বেশি জানেন। আপনি আপনার স্বামীকে ঠিক কতটুকু ভালো মনে করতেন, তিনি যা করতেন সবকিছুই কি ঠিক? ”
” দেখুন, পৃথিবীতে সকল মানুষের ভুলত্রুটি আছে বা থাকবে, তবে ব্যক্তিগত হিসেবে আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ”
” তাহলে আপনি শাকিলার পা ধরে কেন একদিন বলেছিলেন ‘ তোর বাবার কথা শোন নাহলে তো আমাদের সংসারে অশান্তি আসবে। ‘ এই কথা বলে কেন তার সাজ্জাদের সঙ্গে তাকে খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য করেছেন? ”
” দেখুন এটা পুরোপুরি সত্যি নয়, তাছাড়া মাঝে শাকিলা নিজেই সাজ্জাদকে সহ্য করতে পারতো না। সে বিবাহিতা অবস্থায়…”
এতটুকু বলতেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুমনা বলে উঠলো ” আহ মা, কিসব বলছো? ”
সাজু বললো ” দেখুন আমার কাছে কিছু গোপন করতে গেলে আপনারা বিপদে পড়বেন। কারণ আমি সত্যিটা খুঁজে বের করবোই, কিন্তু আপনারা যদি কিছু গোপন করেন তারপর সেটা আমাকে খুঁজে বের করতে হয়। তাহলে তখন সম্পুর্ণ সন্দেহ আপনাদের উপর এসে পড়বে, তাই একটা কথা গোপন করতে গিয়ে অনেকটা মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকুন। ”
সুমনা বললো ” আমরা কিছু লুকাইনি। ”
” শাকিলা তার স্বামীর সঙ্গে রাগ শেষে যতদিন এই বাড়িতে ছিল তখন কোন রুমে থাকতো। ”
” সুমনা বললো, আমার রুমে। ”
” আমি সেই রুমের মধ্যে একটু যেতে চাই। ”
” দেখুন রুমটা আমার, একটা মেয়ের রুমের মধ্যে হুট করে বাহিরের মানুষ প্রবেশ করতে পারে না। ”
” কিন্তু তবুও যেতে হবে। ”
” আচ্ছা চলুন। ”
|
|
সাজ্জাদকে আইসিইউ থেকে বের করে কেবিনে নেওয়া হয়েছে। যদিও মোটামুটি সুস্থ কিন্তু এখনো পরিষ্কার করে কথা বলে কিছু বলার শক্তি তার মধ্যে নেই। সাজুর পরামর্শে পুলিশ পাহারা আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে, ওসি সাহেব নিজে সকাল বেলা ও বিকাল বা সন্ধ্যায় আসেন। সাজু ও রামিশা দুজন মিলে ওসি সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে এসেছে।
সাজ্জাদকে কিছু জিজ্ঞেস করার অনুমতি ডাক্তার দিলেন না, আরও একটা দিন অপেক্ষা করতে হবে তার সঙ্গে কথা বলতে হলে। কেবিন থেকে বেরিয়ে সাজু বললো,
” সাজ্জাদের বাসার প্রতিটি জিনিসে কার কার হাতের ছাপ আছে, বা কতজনের আছে, এগুলোর রিপোর্ট এসেছে? ”
” হ্যাঁ, যে লোহার রড দিয়ে সাজ্জাদকে আঘাত করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট সাজ্জাদের নিজের হাতের ছাপ আছে। ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র মোটামুটি অনেক কিছু টেস্ট করা হয়েছে কিন্তু সেখানে তেমন কিছু মেলেনি। ”
” আপনি কি জানেন, ওদের বাসায় একটা চেকবই ছিল সেখানে ২০ লাখ টাকা সিগনেচার করা। সাজ্জাদ নিজে শাকিলার জন্য রেখেছিল কিন্তু শাকিলা সেটা রেখেই নোয়াখালী গিয়েছিল। ”
” আমরা তো কোন চেকবই পাইনি, কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে? ”
” শাকিলা বলেছে, তবে সেই চেকবইয়ের কথা সাজ্জাদ সজীব ও শাকিলা ছাড়া আর কেউ মনে হয় জানে না। ”
” তাহলে সেটা কোথায়? ”
” সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আপনার, আপনি সাজ্জাদের ব্যাঙ্ক একাউন্টে খোঁজ লাগান। খোঁজ নিয়ে জানুন টাকা কি কেউ তুলে নিয়ে গেছে বা টাকা তুলতে কেউ গিয়েছে? ”
” আপনি এখন কোথায় যাবেন? ”
” সানোয়ার হোসেন, শাকিলার বন্ধুর কাছে। আর সেখান থেকে আপনার থানায় যেতে হবে কারণ শাকিলার কাছে কিছু প্রশ্ন করতে হবে। ”
” তাহলে থানাতেই দেখা হবে। ”
” আপনাকে তিনটা কাজ করতে হবে স্যার। ”
” বলুন। ”
” সজীব সাহেবকে চেকবই এর বিষয় ভালো করে জিজ্ঞেস করবেন। আপনার কাছে তিনটা নাম্বার দিচ্ছি সেই তিনটা নাম্বারের গত এক মাসের সকল কল লিস্ট যোগাড় করবেন। ”
” আর? ”
” আপাতত এগুলো। ”
” আমরা মোটামুটি নিশ্চিত সাজ্জাদ খুন করেছে, কেন শুধু শুধু জটিলতা তৈরি করেন? ”
” আচ্ছা আমিই সংগ্রহ করতে পারবো। ”
” দরকার নেই, আমি আপনার সবকিছু বের করে জানাবো, কিন্তু আমি বোঝাতে চাই এই বিষয়টা কেমন জটিল করছেন। ”
” স্কুলে আমার এক শিক্ষক ছিল, তিনি অংকের সময় সকল অংক জটিল সূত্রে সমাধান করতেন। একটা কঠিন সূত্র প্রয়োগ করে তাড়াতাড়ি করে সমাধান হয়ে যেত। তিনি বলতেন, একটু কষ্ট করে সূত্র মুখস্থ করলে পরীক্ষার হলে অনেক সময় সঞ্চয় করা যায়! ”
” ঠিক বলেছেন, মানুষ যত বেশি কষ্ট করবে ততই তাড়াতাড়ি সফল হবে। ”
” আমি তিনদিনের মধ্যে চেষ্টা করবো সমাধান করতে, কারণ আমার এক বন্ধু থাকে চট্টগ্রামে আর সে খুবই অসুস্থ। ”
” তার নাম কি? ”
” শফিক সজীব রকি ও সাজু আমরা চার বন্ধু, যে অসুস্থ তার নাম সজীব। ”
|
|
পড়ন্ত বিকেল, রাস্তার পাশে খোলা স্থানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে সানোয়ার। সানোয়ার হোসেন ছেলেটাকে যতটা চঞ্চল ভেবেছিল ততটা চঞ্চল মনে হচ্ছে না।
” জ্বি বলেন কে আপনি? ”
” শাকিলার বাবার খুনের রহস্য বের করার জন্য আমি চেষ্টা করছি। আপনি শাকিলার বন্ধু এবং তাকে একসময় অনেক পছন্দ করতেন তাই সেই কারণে আপনার কাছে আসা৷ ”
” আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে? ”
” তেমন কিছু না, শাকিলার বাবার কিছু গোপন কারবার বের করতে হবে। শাকিলা নিজেই স্বীকার করেছে তার বাবা অনেক অন্যায় কাজ করতেন, সেগুলোর দু একটা বের করতে হবে। ”
” কিন্তু আমি কীভাবে জানবো? ”
” যেহেতু শাকিলা তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড সেহেতু তার বাসায় নিশ্চয়ই যাতায়াত ছিল। অথবা ভুল করে হলেও একদিন না একদিন শাকিলা তার বাবার ছোটখাটো কোনো অপরাধ হলেও বলেছে। ”
” কিন্তু? ”
” আমি সেসব জানতে চাই না, আপনি শুধু তার সেই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু ব্যক্তি খুঁজে বের করবেন। ব্যাপার টা যতটা কঠিন মনে হচ্ছে ততটা কঠিন নয়, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই দেখবেন আপনি অনেক কিছু বের করতে পারবেন। ”
” আমাকে এসবের মধ্যে কেন জড়াচ্ছেন? ”
” আপনি নিশ্চয়ই চান শাকিলার বাবার খুনের আসল খুনি ধরা পড়ুক। ”
” হ্যাঁ অবশ্যই চাই। ”
” আমি পুলিশের সঙ্গে সবকিছু বলতে পারি না, কারণ তারা ছোটখাটো কিছু পেলেই সেটাকে হাত-পা বানিয়ে মিডিয়ার কাছে বলে দেয়। তখন তদন্তের অনেক গোপনীয়তা বের হয়ে যায়, আর এজন্যই কিন্তু পুলিশের চেয়ে গোয়েন্দারা রহস্য তাড়াতাড়ি বের করতে পারে। ”
” আমি চেষ্টা করবো আপনাকে সাহায্য করতে। ”
” আপনি তো শাকিলার সঙ্গে জেলের মধ্যে দেখা করতে যান মনে হয়, তাই না? ”
” হ্যাঁ দুবার গেছিলাম, ওর স্বামীর জন্য কান্না করে আবার নিজে বন্দী সেটাও আফসোস করে। ”
” দরকার হলে তার কাছে জিজ্ঞেস করে হলেও কিছু বের করবেন। ”
” জ্বি ভাই। ”
” মেলা মেলা ধন্যবাদ সানোয়ার হোসেন। ”
|
|
|
রিক্সায় পাশাপাশি বসে থানার দিকে যাচ্ছে সাজু ভাই ও রামিশা। ফুরফুরে বাতাস আর ব্যস্ততম শহরের মধ্যে মানুষের আনাগোনা। রামিশার ধারণা ছিল সাজু এখন গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকবে কিন্তু তা না করে সে গুনগুন করে গান গাইছে।
” সাজু বললো, রামিশা তুমি কি কালকে সকালে উঠে নোয়াখালী যেতে পারবে আমার সঙ্গে? ”
” কিন্তু কেন সাজু ভাই ? ”
” সাজ্জাদ যে বাড়িতে গেছিলো সেই বাড়িতে ফেরদৌস গেছে কিনা সেটা জানার জন্য। ”
” মানে? ”
” ফেরদৌস সেদিন হয়তো ইচ্ছে করেই সাজ্জাদের সফর সঙ্গী হয়েছে। ”
” কিন্তু কেন? ”
” গোলমালটা সেখানেই, কার সঙ্গে কার যোগসূত্র সেটা নাম্বারের যাবতীয় কল লিস্ট পাওয়া পর্যন্ত বুঝতে পারছি না। ”
” কার কার নাম্বার ছিল সেখানে? ”
” শাকিলা, ফেরদৌস ও সাজ্জাদের বন্ধু সজীব। ”
” বলেন কি? এদের তিনজনের লিস্ট কেন? ”
” আগে রিক্সা থেকে নামো। ”
থানার মধ্যে ওসি সাহেব নেই, তিনি মাগরিবের কিছুক্ষণ আগে বের হয়েছেন। তবে সাজু আসলে যেন তার জন্য অপেক্ষা করে সেটা দারোগার কাছে বলে গেছে। দারোগা সাহেবের অনুমতি নিয়ে সাজু ভাই শাকিলার কাছে গেল।
শাকিলা বিমর্ষ মনে বসে আছে, সাজুকে দেখে মুখ তুলে তাকিয়ে রইল। চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল রামিশা, পিতার মৃত্যু আর স্বামীর অসুস্থতার টেনশনে কেমন হয়ে গেছে সে।
সাজু বললো ” কেমন আছেন আপনি? ”
” এইতো, আপনার কি অবস্থা? কোনকিছু খুঁজে বের করতে পেরেছেন? ”
” হ্যাঁ পেরেছি। ”
” তাহলে কি আমার বাবার খুনি তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে? আমি আর আমার স্বামী মুক্তি পাবো? ”
” সবকিছু ঠিক হলে ঠিকই মুক্তি পাবেন। ”
” অনেক ধন্যবাদ। ”
” একটা কথা বলবো? ”
” বলেন। ”
” আপনি আমার সঙ্গে অনেক কিছু মিথ্যা বলেছেন আবার অনেক কিছু গোপন করেছেন। এর কারণ কি? ”
” কি মিথ্যা বলেছি? আর গোপন করবো কেন? ”
” সজীব সাহেবকে নিয়ে আপনার আর সাজ্জাদ এর মধ্যে কোনো ঝামেলা ছিল? সত্যি করে বলেন তো, সেদিন রাতে আপনাদের বাসায় সাজ্জাদ সজীব সাহেব আর আপনার বাবা ছিল তাই না? আপনি আমার কাছে এসব লুকিয়ে ঘটনা ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন তাই না? এজন্যই সাজ্জাদ তার চিঠির শেষে লিখেছিল, ‘ তুমি কেন এমনটা করলে সেটা জানতে পারি নাই। ”
.
.
আপনাদের মতামত আর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য পড়ার জন্য আমি কিন্তু কমেন্ট বক্সে অপেক্ষা করি৷ আশা করি সবাই ভুল গুলো তুলে ধরবেন এবং সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিবেন।
.
চলবে…
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।