#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||২৫তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
রাত প্রায় তিনটে। আবরারের ঘুম ভেঙে যায় ফোনের শব্দে। উঠিয়ে দেখে অনন্যা কল দিয়েছে। কল রিসিভ করে ডানে তাকায়, ধরে নেয় স্ত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
“হ্যালো অনন্যা। আপনার এত রাতে কল দেওয়ার মানে কী?”
আবরারের মুখ থেকে দুটো বাক্য উচ্চারণ হওয়া মাত্রই সামিয়ার কপালে ভাজ পড়ে, তার হাতজোড়া শক্ত করে আকড়ে ধরে বিছানার চাদর।
“আপনি, আপনি করছো কেন আবরার? আগে তো সবসময় তুমি করেই ডাক দিতে।”
“আগের দিন বাঘে খাইসে। এত রাতে আপনি এসব বলতে আমারে ফোন দিসেন? যত্তসব ফাউল! ফোন রাখেন!”
আবরারের মেজাজ বেশ চড়া হয়েই আছে। এমনিতেই দুদিন ধরে তার সকাল ছয়টা প্রায় রাত নয়টা অবধি ডিউটি করা লাগছে, তার উপর এত রাতে ঘুম ভাঙানো কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না তার।
“প্লিজ, প্লিজ, কল কেটো না আবরার।”
হাড়তাড় করে অনুরোধ করে অনন্যা। সে খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে এবার তার মূল্য আবরারের জীবনে এখন শূণ্যের কোঠায় যেয়ে আটকেছে।
“কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলেন? রাত-বিরাতে ফাজলামি সহ্য করতে পারব না।”
“আবরার, আমার স্বামী আমাকে তালাক দিয়ে দিচ্ছে। আমি এই মুহূর্তে দুই বছরের বাচ্চা নিয়ে কোথায় উঠব জানি না। বাবার বাসায় আছি খুব কষ্টে, ভাবী সামনাসামনিই দূর-দূর করছে। হয়তো কিছুদিন পর বেরই করে দিবে…”
বলেই হুহু করে কেঁদে ফেলে। এই নারীটি তো জানে ফোনের অপরপাশে থাকা পুরুষটার অশ্রু সহ্য হয় না। তবে কী করে হাত গুটিয়ে থাকবে সে? নিশ্চয়ই হাত বাড়িয়ে দিবে। আর সেই বাড়ানো হাত আগলে নিয়েই পুনরায় বুকে জায়গা করার ফন্দী এঁটেছে সে।
“দেখো, আমি দুঃখিত তোমার সাথে যা হচ্ছে তার জন্য। তবে আমি তোমাকে খুব বেশি হলে একটা চাকরির খোঁজ করে দিতে পারি, তাও নিশ্চিত না। এর চেয়ে বেশি তোমার কোনো আর্থিক বা অন্যকোনো সহায়তা আমার পক্ষে সম্ভব না। কারণ তা আমার ফ্যামিলির সাথে ধোঁকা হবে।
আমার টাকায় হক আমার পরিবারের, আমার স্ত্রীর। তুমি না আমার বোন হও, না কোনো পরিবারের সদস্য, না বন্ধু; তাই আমার পক্ষে তোমাকে এর বাইরে সাহায্য করা সম্ভব নয়।
আরেকটা কথা, আমাকে আর কল করবে না। চাকরির খোঁজ পেলে আমি তোমাকে সব ডিটেইল সহ টেক্সট করে দিব। বাই।”
অতঃপর টুৎটুৎ শব্দ শুনতে পেল নিশা। মানে কলটা কেটে দিয়েছে আবরার। রাগে ফুঁসে উঠে সে, ছেলেটার উপর তার কোনো ফন্দীই কাজ করছে না।
এর মাঝেই শাড়ির ফাঁকে শক্ত একজোড়া হাত আঁকড়ে ধরে অনন্যা ফর্সা কোমর। চমকে উঠে যুবতী, তার চোখেমুখে কয়েক হাজার বিরক্তি। তবুও তা আড়াল করে হেসে বলে,
“আরে তুমি? এত রাতে জেগে গেলে যে?”
অনন্যার স্বামী রাতুলও হাসে, তবে তার হাসিটা বেশ ভিন্ন, দু ঠোঁট দাঁতের মাঝে নিয়ে হাসে সে। তাকে ছেড়ে সাদাকালো চুল ভর্তি মাথাটা দুলিয়ে বলেন,
“বেশ ভালোই তো কথা এড়াতে পারো। পুরাতন প্রেমিককে কল করেছিলে বুঝি? সে নিশ্চয়ই নিজ স্ত্রীর সুগন্ধা চুলে ডুবে আছে। আহারে কী কষ্ট! তা আমার সাথে থাকলে বুঝি আরও বেশি কষ্ট?”
“উহু কষ্ট না বিষাদ! এই বিরস জীবন বুকটা ছিদ্র ছিদ্র করে ফেলে। প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই; আছে শুধু ব্যাংক ভর্তি টাকা, শ্বশুরবাড়ির এক ঝাঁক মানুষের দায়িত্ব, বাচ্চার দায়িত্ব, এক রসকষহীন বয়স্ক স্বামী।”
“আমার বয়সটাই দোষী? সব জেনেই তো বিয়ে বসেছিলে।”
“উহু, তোমার বয়সটা দোষের নয়। আফসোস তো শুধু এটুকুর মহাশয়, কবুল বলে আমায় তোমার অধীনস্থ করে এই শরীর ছুঁয়ে স্বামী তো হয়ে গেলে, তবে প্রেমিক হয়ে মন ছুঁতে পারলে না কখনো। জানো প্রেমিক হওয়া বেশ সহজ, একজন প্রকৃত ও আদর্শ স্বামী হওয়া অনেক মুশকিল।”
রাতুল নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে অন্যেরকম লাগছে আজ দেখতে। সবসময়কার অহংকারী ও রূঢ় মুখের থেকে যেন আজ এক নরম মেয়েলি চেহারা বেরিয়ে আসছে। পুনরায় মুখ খুলে অনন্যা।
“স্বামী হলে চোখজোড়ার দিকে তাকালে মুগ্ধনয়ন রাখতে হয়, কাছে আসলে প্রিয় হতে হয়, দেহ ছুঁয়ার পূর্বে সাধক হতে হয়, অধিকার নেওয়ার আগে প্রেমিক হতে হয়। স্বামী হতে হলে শুধু দায়িত্ব নিলেই হয় না, ভালোবেসে আগলে রাখার জন্য তৈরি হতে হয়, তৈরি করতে হয় সঙ্গিনীকে।”
“আমি কি তোমায় ভালোবেসে আগলে নেইনি? কোন দিক দিয়ে কমতি রেখেছি বলতে পারো? কত মেয়ে আছে স্বামী মারধোর করে, পরকীয়া করে, তবুও একসাথে থাকছে। আমাদের সংসারে তো সব ঠিক-ঠাক।”
“যতটুকু সেসব মেয়ে এবং তাদের স্বামী-সংসারের কথা। তারা সেসবে অভ্যস্থ। আমি এমন একজনকে পেয়েছিলাম যে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে প্রকাশ করত সে আমায় কতটা ভালোবাসে, কতটা চায়, কতটা বিশেষ আমি তার নিকট। আপনাকে বিয়ে করার সময়, এমন কী আজ থেকে কয়েকটা মাস আগেও আমি মনে করতাম আমিও সেসব মেয়েদের মতোন শুধু টাকার বিছানায় শুয়ে মানিয়ে নিতে পারব। ভুলে গিয়েছিলাম আমি আসলে আরও মধুর ভালোবাসায় অভ্যস্ত, তাই এতটা মানিয়ে নেওয়াও সম্ভব নয়, ক্লান্ত হয়ে হার মেনেছি।
আর ভালোবেসে আগলে হয়তো নিয়েছেন, হয়তো নেননি। বলুন তো কী অন্তর্যামী ঐ উপরওয়ালা, আমি না। প্রেমে পড়লেই শুধু হয় না, প্রেমে ফেলতে হয়। ভালোবাসলেই শুধু হয় না, ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়। তা নাহলে সব অহেতুক, বৃথা, জলে যায় সব।
বিশ্বনবি (স.) এর প্রিয় স্ত্রী হলেন আয়েশা (রা.), এ কথা কে না জানে? তাদের বয়সের পার্থক্যও কিন্তু বেশ। তবুও নবিজি (স) ভালোবাসি বলতেন, স্ত্রীকে আদর করে হুমায়রা ডাকতেন, কেন না বিবি আয়েশা (রা) রাগলে, লজ্জা পেলে তার গাল ডালিমের রঙ ধারণ করত। তিনি স্ত্রীর দিকে মুগ্ধনয়নে, রহমতের দৃষ্টিতে তাকাতেন, ঘুরেতে যেতেন, স্ত্রীর কাজে সাহায্য করতেন, বাড়ি ফিরার আগে কারো হাতে খবর পাঠাতেন যাতে প্রিয় বিবি তৈরি হতে পারেন তার উদ্দেশ্যে।
নবিজি (স.) কিন্তু অনেক টাকা, ঐশ্বর্য দিয়ে রাখেননি স্ত্রীদের, তবুও তাঁরা সুখী ছিলেন। কারণ হয়তো তিনি অর্থের অভাবটা ভালোবাসা দিয়ে পূরণ করেছিলেন। এখনকার পুরুষরা এটা তো বুঝে যে নবিজি (স) একাধিক বিয়ে করেছেন এবং তাদের জন্য একাধিক বিয়ে করা জায়েজ। তবে সমতা রক্ষা তো দূরেই থাক, এক স্ত্রীর হক ঠিক মতো আদায় করার কথাও তাদের মস্তিষ্কে আসে না। অথবা, আসলেও দেনমোহর আদায় করলেই মনে করে হক পূরণ শেষ এবং দায় শেষ মনে করে। দায়? হ্যাঁ, এও মনে করে স্ত্রীর সাথে শুধু দায়ের সম্পর্ক তাদের।”
অনন্যার কণ্ঠে তীব্র আক্ষেপ। রাতুল আহত হয়। সে কী কখনো চিন্তা করেছিল স্ত্রীকে প্রেমে ফেলা নিয়ে? ভেবেছিল স্ত্রীর আর্থিক চাহিদা বাদে অন্যকিছু নিয়ে? না, বিশাল ব্যবসা তার। চালের আরত, বসুন্ধরায় দুটো ফোনের দোকান। সব একা হাতে সামলিয়ে ক্লান্তি থাকে দেহে, মনে থাকে না রঙ, মুখে থাকে না প্রেম, থাকে না তার মুগ্ধ দুই নয়ন।
“এভাবে কখনো… আমি…”
শূণ্য হয়ে পড়েছে তার শব্দের থলি। অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু ভেবে পাচ্ছে না কী বলবে। সব যেন ধূসরে, ঘোলাটে, দূরে-দূরে, অগোছালো, অগোচরে।
অনন্যার দমবন্ধ হয়ে আসছে। চোখ দুখানা জ্বালাপোড়া করছে, সে শক্ত খোলসের নারী, চোখে চোখ রেখে নিজের অন্যায় বলে সে, কাঁদতে তো তার বড়োই লাজ। তাই দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে। যাওয়ার আগে শুধু বলে যায়,
“জানো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কী বলেছেন? বলেছেন,
‘নারীকে ছুঁতে পারা সাধনার বিষয়
শরীর ছুঁয়েই যে পুরুষ বলে নারীকে ছুঁয়েছি, সে নির্বোধ।
নারীর হৃদয় ছুঁয়েই তবে দেহ ছুঁতে হয়
শরীর তো ধর্ষকও ছোঁয়।
পুরুষের ভালোবাসা পাওয়াও সাধনার বিষয়।
দেহদানের পরেই যে নারী ব’লে পুরুষের ভালোবাসা পেয়েছি, সে নির্বোধ।
পুরুষের বিশ্বাস ছুঁয়েই দেহ ছুঁতে হয়
শরীর তো বেশ্যাও দেয়।’
তুমিও একবার ভেবো আমি প্রেয়সী, স্ত্রী হয়ে তোমায় নিজের আগলে রাখা যৌবন দিতে পেরেছি না কি… আর এও ভেবো তুমি প্রেমিক, স্বামী হয়ে আমার দেহ ছুঁয়েছো না কি… একটু চিন্তে করো, যদি উপলব্ধি টুকু হয় তোমার-আমার মৃত্যুর আগে। হতেও তো পারে কাল সকালে আর আলো দেখলাম না। দু টা মুহূর্ত যদি ভালোবাসাময় দাম্পত্যজীবন কাটিয়ে যেতে পারি এই বিশ্বে।”
রাতুলের চোখেও বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমেছে। ভাবে,
“সত্যিই তো আমাদের দাম্পত্য জীবনে কোনোদিন তো দুই মুহূর্তে ভালোবাসার ছিল? ছিল হয়তো। বিয়ের প্রথম একটা মাস কিছুটা কৌতূহল, আগ্রহ, অনুভূতি ছিল। কিন্তু তারপরই ব্যবসার ব্যস্ততা, সব কিছু কেমন যেন মেটো হয়ে গিয়েছিল, না ছিল আগ্রহ, না অন্যকিছু। কেমন যেন মরা মরা।”
___
এদিকে আবরার কল কেটে বিছানায় শুয়ে পড়তেই তার উপর উঠে বসে দু হাত দিয়ে টিশার্টের কলার চেপে ধরে সামিয়া। হুড়মুড়িয়ে চোখ খুলে উঠে বসতে চায় আবরার। কিন্তু তার প্রিয়তমা কলিজার উপর বসে তাণ্ডব নৃত্য করছে বলে তা আর সম্ভব হয় না। হিসহিসিয়ে বলে,
“এই ছেলে, তোর আমাকে দিয়ে হয় না? তুই এত রাতে ঐ মেয়ের সাথে কথা বলোস? এত রঙ লাগসে তোর মনে”
অন্যকোনো পুরুষ আবরারের স্থানে হলে নির্ঘাত অপ্রস্তুত, নার্ভাস এবং চিন্তিত হয়ে পড়ত। কিন্তু এ তো আবরার। তার প্রেয়সীর প্রেমে মত্ত তিনি৷ এই আঁধার রাতে রণচণ্ডী রূপ দেখে তার টেনশন নয়, বরং প্রেম প্রেম পাচ্ছে।
রমণীর গেঞ্জির গলা বেশ বড়, একপাশে যেয়ে ডান কাঁধ সহ বেশ কিছুটা স্থানই প্রকাশিত। যুবকের চোখজোড়া যেন ঝলসে আসছে। এলোমেলো চুল, অগোছালো পোশাক, তার উপর নিজের সিলমোহর লাগানো স্ত্রী, এমতাবস্থায় নিজেকে সামলানোর কি কোনো মানে হয়?
আবরারের নিকট বর্তমানে এই ধৈর্য্য, এই নিয়ন্ত্রণ, এই সাধনা সব বৃথা, বরং এই রাগে ভর্তি বাঘিনীকে বন্দিনী করতে পারাটাই তার জন্য বৃহৎ কর্ম।
“উফঃ আবরার তুই কি জঙ্গলের শিকারী! কী সব আজগুবি কথা বলছিস!”
ভেবেই ফিক করে হেসে দেয় সে। সামিয়া এই হাসি দেখে আরও তেঁতে উঠে। কিছু বলতে, করতে উদ্যোত হতেই আবরারের কাজে থেমে যায়। আর কী বাঘিনী বন্দী শিকারী জালে। আর কোনো সুযোগ পেল না যুবতী নিজের রাগ দেখানোর। অথবা, প্রিয়তমই সেই সুযোগ দিল না।
সামিয়ার সকালে ঘুম ভাঙে আবরারের বেশ ডাকাডাকিতে, সবে আলো ফুটেছে তখন। আবরার চা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“দেখেন মহারাণী, আমি জানি আমি আপনার অধীনস্থ অতি নগণ্য মানব। তাই বলে সব সময় বিনা দোষে আমায় শুনাবেন তা আমি মানব না। আপনি যেহেতু জেগে আমার সব কথা শুনেছিলেন তাহলে রাগার কোনো মানে হয় না।”
সামিয়া মনে এখন হাজার খাণেক প্রজাপতি খেলা করছে। সে চাদরের বাহিরে হাত দুটো না বের করে জবাব দেয়,
“শুনুন মি. মহারাজ, আমি মহারাণী হলে আমার স্বামীও মহারাজ। তাই তাকে নগণ্য বলে অবমাননা করা বিরাট ভুল। এই ভুলের শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে। কাজ করুন চা’টা সুন্দর করে খায়িয়ে দিন।”
চলবে..
#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||২৬তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে সামিয়াকে মার্কেটে নিয়ে এসেছিল আবরার। কিন্তু ঐ যে ডাক্তারি পেশা, তার জন্য আর একসাথে শপিং করা হয়ে উঠে না। সামিয়াকে রেখে মানিব্যাগ ধরিয়ে চলে যায়।
“বালিকা, যারে মন চায় তারে বিয়ে কইরো। তয় ডাক্তার বিয়া কইরো না, এমন খবিশ ডাক্তার তো জীবনেও না।”
কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে মার্কেটে প্রবেশ করে সে। শাড়ির দোকানে ঢুকে মনিপুরী ও সুতি শাড়ি কিনে বের হবে। তখনই চোখ আটকে যায় বিপরীতের দোকানে টাঙানো একটি পাঞ্জাবিতে। কালচে বেগুনি বর্ণের শর্ট পাঞ্চাবী গলায় ও হাতায় কপার গোল্ডেন কালারের লেসের মতোন ফেব্রিক দিয়ে পাইপিং করা।
হুট করেই সে আবরারকে এই পাঞ্জাবিতে কল্পনা করে ফেলে। মুচকি হেসে বড় বড় পা ফেলে সেই দোকানে ঢুকে।।
“ভাইয়া, এই পাঞ্জাবির প্রাইস কত?”
“আপনি যেহেতু আজকের প্রথম কাস্টোমার তাই শুধু মাত্র আপনার জন্য বাইশশো ট্যাকা। এমনে আরও বেশি রাখি আমরা।”
আঠারো উর্ধ্ব ছেলেটি এক্সেন্ট শুনে সামিয়া বুঝল উনি এখানের বাসিন্দা নয়, কারণ চাটগাঁইয়া ভাষার সামান্য টোনও তার নেই। কিন্তু ঢাকার ব্যবসায়ীদের টোন আছে।
“দেখেন ভাই, মেয়ে না মানুষ দেইখা ভাইবেন না এসবের দাম জানি না। এগুলার দাম কেমন আমার জানা আছে। সামান্য একটা পাঞ্জাবির দাম চাচ্ছেন বাইশশো? বলি স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো না কি আপনার দোকানের পাঞ্জাবি। যাকগে কমায় নেওয়ার মতোন বলেন।”
“আহ্হা আপা! কার না কার দোকানের দুই নম্বর মালের লগে আমার মালের তুলনা দেন? আরে জিনিস এক হইলে কী হইসে কোয়ালিটি আছে না? ঠিক আছে যান, আপনার জন্য মাত্র ঊনিশশো ট্যাকা। এর বেশি কমাইতে পারতাম না, এতেই আমার লাভ হইব মাত্র দুয়েকশো ট্যাকা।”
“হইসে, হইসে, অহেতুক লাভ-লস হিসাব করানো লাগবে না। আপনাদের যে লাভ নাই, নাই বলতে বলতে কত লাভ হয় জানা আছে। আরও কমান।”
“ইশশিরে আপা! কী যে বলেন না, আচ্ছা যান সতেরোশো ট্যাকা।”
“না, এগারোশো টাকা দিব৷”
ছেলেটার চেহারা মলিন হলো।
“না, আপা এত কমে বেচি না। আরেকটু বাড়ান।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। না আপনার, না আমার। তেরোশোতে দেন।”
খাণিক ক্ষণ খোশামোদি করে দোকানদারও রাজি হয়। সামিয়া বিজয়ীর হাসি দেয়। পাঞ্জাবির প্যাকেটটা হাতে তুলে দেওয়ার সময় ছেলেটা হাসি হাসি মুখ করে গর্বের সুরে বলে,
“এত কমে কাউরে দিতাম না আপা। আপনি প্রথম কাস্টোমার দেইখা দিলাম। একটু লাভ রাখি নাই আপা, আবার আইসেন কিন্তু।”
“অবশ্যই।
বলে প্যাকেটটা হাতে সামলে নিতে নিতে বেরিয়ে যায় সে দোকান থেকে। তবে তার মাথায় এখন আর পাঁচটা বাঙালি নারীর আরেক চিন্তা কাজ করছে। তা হলো-
“দামটা আবার বেশি হয়ে গেল না তো? ছেলেটা যে এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে গেল।”
“বেগম জান?”
তার ভাবনার মাঝেই ডাক দেয় কেউ। পরিচিত কণ্ঠ শুনে ফ্যাঁকাসে মুখে পিছন ঘুরে সে।
“ফাহাদ তুমি? এখানে…?”
___
আবরার আসলে হাসপাতালে আসেনি। সামিয়াকে মার্কেটে ড্রপ করে সে বাড়ি ফিরেছে। উদ্দেশ্য আলিফা খাতুন ও সায়রাজ কবিরের সাথে এমন কিছু কথা বলা বা জানা, যা সামিয়ার সম্মুখে সম্ভব নয়।
কলিং বেল বাজতেই টিভির রিমোটটা পায়ের উপর থেকে সরিয়ে দরজা খুলতে যান আলিফা খাতুন। সায়রাজ সাহেব তখনো খবরের কাগজে ডুবে। বস্তুত, দেশের খবরাখবর জানাতে নয় তার আগ্রহ কাগজে ছাপানো ছোট গল্প ও কৌতুক সহ কার্টুনিস্টদের আঁকা হাস্যকর ছবিগুলোতে।
“আরে বাবা, তুমি? তোমরা তো মাত্রই মার্কেটের জন্য বের হলে…”
আলিফা খাতুন অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় বলেন তারপর এদিকওদিক উঁকিঝুঁকি দিলেন সামিয়ার উদ্দেশ্যে।
“সামিয়া কোথায়?”
“আন্টি ও মার্কেটে। আমার আসলে আপনাদের সাথে কিছু কথা আছে, তাই-ই এখানে এসেছি।”
আলিফা খাতুন কথাটার অর্থ ঠিক করে বুঝে উঠতে পারলেন না। তবুও তার গলাটা শুকিয়ে আসছে অজানা কিংবা জানা কিছু ভয়ে।
আবরার যেয়ে সোজাসুজি সোফায় বসে। টিভিটা বন্ধ করে আলিফা খাতুনের উদ্দেশ্যে বলল,
“কী হলো আন্টি? বসেন।”
“হ-হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসছি।”
শাশুড়ির কম্পিত কণ্ঠ শুনে আবরার বুঝল তিনি কিছুটা হলে আঁচ করতে পেরেছেন। অবশ্য শ্বশুর তার নির্লিপ্ত হয়ে খবরের কাগজে ডুবে।
“আঙ্কেল, আন্টি আমার একটা বিষয় জানার আছে। আশা করি আপনারা লুকাবেন না। সামিয়ার লাইফে কি কাব্য নামের কেউ সত্যিই ছিল? কাব্য কি শুধুই একটা কাল্পনিক চরিত্র নয়?”
আলিফা খাতুনের কলিজায় পানি নেই আর, তা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অথচ, শ্বশুর স্বাভাবিক। তিনি গম্ভীরতার সুর ধরেই মুখ খুললেন,
“হ্যাঁ, আবরার। কাব্য নামক একজন ছিল সামিয়ার জগতে। যদিও প্রকৃত অর্থে বা বাস্তবিক অর্থে নয়, তবে ছিল।”
“সে কি আমিই?”
এবার একটু চমকালেন সায়রাজ কবির। তারপরও ভাব-ভঙ্গিমায় তা বুঝার উপায় নেই।
“আমি জানি তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, অতীত নিয়ে পড়ে থাকবে না। তারপরও এখন মাথাব্যথা যেহেতু হয়েছে অতীত জানার। ভালো হয় স্ত্রী থেকেই জেনে নেও, তারপর যা ভাবার, করার কোরো। আর যতটুকু তোমার এই প্রশ্নের কথা, তাহলে তুমিই ওর কাব্য ছিলে। এর থেকে বেশি কোনো প্রশ্ন কোরো না, উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।”
তিনি প্রস্থান করেন সেখান থেকে। আবরারের এবার আরও কৌতূহল জমছে। কিন্তু সামিয়াকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতেও সে ঘাবড়াচ্ছে। অনেকটা ভাবনার নিজেই নিজেকে আত্মস্থ করে মনে মনে বলে,
“এত ধোঁয়াশার মাঝে থাকলে ভালো থাকা সম্ভব নয়। এক না একদিন মুখোমুখি হতেই হবে আমাদের দুজনকে। তবে আজ কেন নয়?”
___
আশেপাশে ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট না থাকায় একটা স্বল্প দামের হোটেলেই বসতে হয়েছে ফাহাদ ও সামিয়াকে। সামিয়ার মাঝে দ্বিধা, কিছুটা ক্ষোভও দেখা দিচ্ছে, ফাহাদ হাসে সেসব খেয়াল করে।
“সেই বেইমানির কথা ভেবে আজও রেগে আছো আমার উপর বেগম জান?”
চমকিত হয় না যুবতী। সামনে বসে থাকা পুরুষটি সদাই কীভাবে যেন বুঝে যায় তার মনের কথা।পুরুষটির ভালোবাসার গভীরত্বই এর কারণ বটে। আবরারও এত ভালোভাবে বুঝে না কি সন্দেহ, তবুও তার মন ও মস্তিষ্কের পুরোটা জুড়েই তার প্রেমকাব্য, তার আবরার।
“এমন ভাবে বলছো তুমি মনে হয় রাগবার মতোই কোনো কাজ করোনি? এতটা স্বাভাবিক কী করে তুমি ফাহাদ?”
চোখজোড়া ছলছল করছে সামিয়ার। ঐদিনের কথা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠে সে। ফাহাদ যখন সেসব বলে চলে গিয়েছিল তার চোখের সামনে শূণ্যতা ছেয়ে গিয়েছিল।
কী করবে, কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছিল না। সূর্য ডুবি যেতেই হুশ আসে তার, আশেপাশের হায়নাদের নজর থেকে বাঁচতে আশ্রয় হারা হয়ে নিজ বাড়িতেই ফিরে আসে। তাতেও কম জ্বালা পোহাতে হয়নি মায়ের বাজে বাজে কথাগুলো সহ্য করতে করতে কান থেকে রক্ত পড়েছিল। নিশার কটাক্ষ তো আছেই।
“আমি যাওয়াতে তো ভালোই হয়েছে, নাহলে তো তোমার কাব্যকে পেতে না? ভালোই তো আছো, তাই বলেই তো আমার এত কলের জবাব স্বামী আবরারকে দিয়ে দিয়েছো?”
কিছুটা চমকে উঠে এবার রমণী। ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
“মানে? কীসের জবাব? আর তুমি জানো কীভাবে কাব্যের সাথে আমার…? আর আবরারকে পাঠিয়েছিলাম মানে?”
ফাহাদ বুঝতে পারে সামিয়া কিছুই জানে না। সে তাই আবরারের সাথে সাক্ষাতের সব বিস্তারিত বলে। সামিয়ার প্রথমত ফাহাদ তাকে কেন ত্যাগ করেছিল জেনে খারাপ লাগা কাজ করে কিন্তু পরক্ষণেই আবরার কিছুটা সত্য জেনে গেছে ভাবলে দুশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পড়ে।
হাত-পা অনবরত কাঁপছে তার, শরীর শীতল হয়ে আসলেও কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। ফাহাদ বুঝে উঠতে পারছে না মেয়েটার এমন করার কারণ।
তবুও তার বেগম জানকে ভরসা দিতে ডানটি হাত দু’হাতের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“সব ঠিক হয়ে যাব চিন্তা কোরো না। যা তোমার, তোমারই থাকবে। ভাগ্যের লিখন তা।”
“এতটা ভালো কী করে বাসো? ”
“জানি না তো। শুধু জানি ভালোবাসি তোমাকে বেগম জান।”
“জানো না এই ভালোবাসা বৃথা, কষ্টকর, পাওয়ার নয়? এত ভালোবাসা ঠিক নয়, অসুখকর।”
“তুমিই তো কাব্যকে অপ্রাপ্তির তালিকায় রেখেও সবটা দিয়ে ভালোবেসেছো। তোমার কাব্য যদি প্রিয় অসুখ হয়, আমার বেগম জানও আমার প্রিয় অসুখ।”
গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায় সামিয়া। তাদের মাঝে আরও কথাবার্তা হওয়ার ছিল, তবে হুট করেই আবরার এসে তার হাত টেনে তাকে নিয়ে হোটল থেকে বেরিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় সামিয়া অবাক, আবরারের মুখভঙ্গি দেখে সে কিছু বলে না। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে।
___
বারান্দায় রেলিংয়ে হাত রেখে ঝুঁকে একদৃষ্টিতে কৃষ্ণচূড়া গাছটিকে দেখছে সে। মৃদু বাতাসে লাল বর্ণের ফুলগুলো তুলোর মতোন ধীর গতিতে মাটিতে এসে মিশছে। চমৎকার এক দৃশ্য!
তবে সামিয়া সেই দৃশ্য নয়, ফাহাদের ভাবনায় ডুবে। এতটা বছর পরও ছেলেটার ভালোবাসায় এতটুকুও খাদ পড়েনি।
চলবে…