মেঘের ওপারে মেঘ | পাঁচ
অবশেষে সায়রা মত ঠিক করল। সে শ্বশুর বাড়ি যাবে। আজই যাবে। সে কাপড় বোঝাই করা একটি ব্যাগ টেনে টেনে জিন্নাতুন নুরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পা ছুঁয়ে বলল, ‘যাচ্ছি, মা।’
জিন্নাতুন নুর যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ‘চলে যাচ্ছিস!’
‘সেটাইতো চেয়েছিলে!’
জিন্নাতুন নুর তটস্থ করলেন, ‘কিন্তু এখনি রাজি হয়ে যাবি, ভাবিনি।’
‘বাবা এলে বলে দিও, অলক্ষুণেটা চলে গেছে। আর জ্বালাবে না।’ বলে ব্যাগ টেনে টেনে বেরিয়ে গেল সায়রা। তার পিছন পিছন মেহেদি। জিন্নাতুন নুর ব্যথাহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন দরজার ওদিকে। ওঁরা যাচ্ছে। যেতে যেতে হারিয়ে যাচ্ছে তার চোখের সামনে থেকে। ওঁরা যত দূর যাচ্ছে, ততই বুকটা ফাঁকা হয়ে আসছে। তখনই দুড়ুম করে শব্দ হলো। জিন্নাতুন নুর ওদিকে তাকালেন। শান্তা ওলট পালট হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে আছাড় খেয়েছে। অন্য সময় হলে জিন্নাতুন নুর ছুঁটে যেতেন। এখন তা করলেন না। হাত-পা দু’টো যেন পাথর হয়ে গেছে।
শান্তা খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে এসে জিন্নাতুন নুরের কাঁধের উপর হাত রেখে বলল, ‘হ্যাঁগো, মেহেদি ছেলেটা কেমন?’
জিন্নাতুন নুর উদাসীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েই রইলেন। শান্তা আবার বলল, ‘কী জিজ্ঞেস করেছি? মেহেদি ছেলেটা কেমন?’
‘কোন মেহেদি?’
‘ইশ! ঢং! মনে হয় কিছুই জানো না। ওই মেহেদি। যে আপাকে নিয়ে গেল। আপার দেওর।’
‘ওঃ! সে তো ভালোই।’
‘কেমন ভালো?’ শান্তা আরো একটু চেপে দাঁড়িয়ে বলল।
‘দেখে তো মনে হয় অনেক ভালো।’
‘অনেক ভালো বলতে কেমন? অন্য সব ছেলেদের মতোই না কি তার চেয়েও বেশি ভালো?’
‘তোর এসব জেনে কী কাজ? তুই কি ওঁকে বিয়ে করবি?’
শান্তা বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে বলল, ‘ধুরু!’ এরপর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে অন্য ঘরে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিল।
গাড়িতে বসা পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলল না। পরিবেশ শান্ত। গাড়িতে উঠার পরও কেউ কিছু বলল না। এমনকি যখন ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, ‘এসিটা ডিস্টার্ব করছে। আপনাদের কোনো প্রভলেম হবে না তো?’ তখনও কেউ কিছু বলল না। মাইক্রোবাসটা ভন ভন শাঁ শাঁ শব্দ তোলে ছুটে চলল। গাড়ির দু’পাশের সিটে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল তারা দু’জন। সায়রা আর মেহেদি। তবে এই দূরত্ব বেশি সময় রইল না। মেহেদি হঠাৎ টের পেল, তার হাতটা কে যেন টেনে নিচ্ছে। নিচ্ছে বললে ভুল হবে, অলরেডি টেনে নিয়ে গেছে। মেহেদি বসেছে ডান পাশে। মেহেদির বাঁ হাত সায়রা টেনে ধরেছে। এত জোরে ধরেছে, সায়রার লম্বা নখ মেহেদির হাতে অনেকখানি বিঁধে গেছে। একটু একটু রক্ত জমেছে সেখানে। মেহেদি দাঁত কটমট করে বসে রইল। সায়রা হঠাৎ মেহেদিকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘ওই লোকটা! ওই লোকটা!’
ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ব্রেক কষল। নির্জন জায়গা। ল্যাম্পপোস্ট আছে। তবে বাতিগুলো নষ্ট। অন্ধকারে মাইক্রোবাসের আলো সূর্যের আলোর মতো ফরসা দেখা যায়। সায়রা নামল সবার আগে। কয়েক পা সামনে গিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘এখানেই তো ছিল! কোথায় গেল?’
এর মধ্যে দু’টো বাস ছুটে গেল সাঁই সাঁই করে। কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। মেহেদি অনেক বার জানতে চেয়েছে, ‘কী দেখেছেন ভাবি? কাকে দেখেছেন?’
সায়রা শুধু বিড়বিড় করে বলে, ‘এখানেই তো ছিল! কোথায় গেল লোকটা?’
এরপর যখন গাড়িটা ছুটতে লাগল, মেহেদি টের পেল, সায়রা কাঁপছে। মাঝে মাঝে ভয়ে আঁতকে উঠছে। আর চলন্ত গাড়ির বাইরে কড়া দৃষ্টি ফেলে কী যেন খুঁজছে। দ্বিতীয় বারও একই কান্ড হলো। সায়রা চেঁচাল। গাড়ি থামানো হলো। আঙুল দিয়ে সায়রা একটি লোককে দেখাল। কিন্তু সায়রা ব্যতীত আর কেউ সেই লোকটাকে দেখতে পেল না। মেহেদিও না। ড্রাইভারও না। শুধু সায়রা দেখল। সেই উন্মাদটা। যাকে সে প্রায়ই দেখে। ভয়ে আঁতকে উঠে। মাঝে মাঝে ভয়কে জয় করে পা বাড়ায়, উন্মাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সেই লোকটাকে সামনাসামনি কখনো পাওয়া হয় না।
তারা গাড়ি থেকে নেমে লোকটাকে খুঁজল। সায়রা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আবারো একই কথা বিড়বিড় করল, ‘এখানেই তো ছিল! কোথায় গেল লোকটা?’
গাড়িটা আবারো চলতে শুরু করল। মেহেদি একটু ইতস্তত করে বলল, ‘ভাবি, আপনার যদি আপত্তি না থাকে তো… দেখুন, আমার মনে হচ্ছে, আপনি খুব ভয় পাচ্ছেন। তাই আপনার আপত্তি না থাকলে, আপনি কিছু মনে না করলে, আমার হাতটা ধরে রাখুন। ভয় পাবেন না।’
কথাগুলো শুনে সায়রা কোনোকিছু না ভেবেই মেহেদির হাত টেনে নিল। দু’হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল। মেহেদির কথামতো চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করল। ঘুম না এলেও এভাবে চোখ বন্ধ করেই সারাটা পথ পাড়ি দিলো সে। সায়রার নখ ধারালো। অনেক লম্বা লম্বা। নখ লেগে মেহেদির বাঁ হাতের অনেক জায়গায় ছিলে গেছে। কেটেছেও খানিকটা। একটু রক্তও বেরিয়েছে।
আবাদপুর আসতে আসতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে গেছে। সায়রা সরাসরি তার শাশুড়ির ঘরে এল। জাহানারা বেগম বাচ্চা শিশুর মতো বিছানার এক পাশে হাঁটু ভাঁজ করে শুয়ে আছেন। বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন তিনি। সায়রা তার পাশে বসে রইল অনেক্ষণ। হঠাৎ যখন তার গালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেল, তখন অজান্তেই বুকের ভেতর থেতে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল। চিৎকার শুনে জাহানারা বেগম মুচকি হাসলেন, ‘এসেছো বউমা! কত অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য, জানো? এসো না! একবার আমার বুকে এসো!’
তিনি সায়রাকে বুকে নিলেন না ঠিক, তবে তার হাত ধরে শুয়ে থাকলেন। বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগলেন। সায়রা সেসব শুনল না। একসময় তিনি কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লেন। সায়রা বসে রইল। অনেক রাতে ঘুম ভাঙল তার। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘এখনও বসে আছো বউমা! যাও, ঘুমাও গিয়ে!’
সায়রার চোখেও ঘুম এসে পড়েছিল। সে তন্দ্রা ভেঙে বলল, ‘ভয় লাগছে।’
‘শোনো বোকা মেয়ের কথা! ভয় লাগছে তো কি শোবে না? আমার ঘরে শোও। আমার পাশে শুয়ে পড়ো।’ বলে জাহানারা বেগম সরে গিয়ে জায়গা করে দিলেন। সায়রা উঠে দাঁড়াল। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। জাহানারা বেগম চেয়ে থাকতে থাকতে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
নিজের ঘরে প্রবেশ করে বড়োসড়ো ধাক্কা খেল সায়রা। এ ঘরে কি কেউ আসেনি! একটি বারও না! এক মাস আগে যেমন রেখে গিয়েছিল, তেমনই আছে। বিছানার চারপাশে সাজিয়ে রাখা ফুলগুলো শুকিয়ে পুড়ে যাওয়া কাগজের মতো হয়ে গেছে। কাচের জানালাটা একটু ফাঁক করা। পরদা পুরোপুরি খোলা। জানালা পেরিয়ে বৃষ্টির পানি ভেতরে এসে পড়েছে। সেই পানির কিছুটা এখনও ফ্লোরে জমে আছে। পুরো ঘরে কেমন যেন একটা গন্ধ আসছে। এখন এসব দেখার সময় না। সায়রার চোখ জুড়ে ঘুম আসছে। সে শুধু বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বুজতে পারলেই বাঁচে!
বিছানায় ধুলো জমেছে। সায়রা বিছানার চাদর একপাশ থেকে ধরে জোরে ঢেউ তুলে দিতেই ধুলো সব উড়ে গেল। সেই সাথে বালিশ উল্টে গিয়ে বালিশের নিচ থেকে এক টুকরো সাদা কাগজ উড়ে গেল। সায়রা সেই কাগজের টুকরোটা কুড়িয়ে নিল। কাগজটা ছোটো নয়, এ-ফোর সাইজ। ভাঁজ করে রাখা। সায়রা নিপুণ হাতে ভাঁজ খুলল। কাগজটায় কী যেন সব লেখা। সায়রা শুধু প্রথম লাইন পড়ল, “প্রিয় সায়রা”
বুঝা গেল এটা যে সে কাগজ নয়। এই প্রযুক্তির যুগে চিঠি। তা-ও সায়রাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। সায়রা অবশ্য আর কিছু পড়ল না। তার চোখদু’টো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে আসছে। ইচ্ছে করলেও জেগে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। সে চিঠিটা আগের জায়গায় অর্থাৎ বালিশের নিচে চাপা দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।
পরদিন খুব ব্যস্ততা গেল। সায়রা নিজের কাপড়চোপড় সব ধুয়ে রোদে শুকাতে দিলো। হাতের নখগুলো অনেক বড়ো বড়ো হয়েছে। কাল সে কী কান্ডই না করেছে! ভয় পেয়ে মেহেদির হাত এত জোরে ধরেছিল, ওঁর হাত বোধহয় কেটেই গেছে! ভাবতে ভাবতে জিভ কামড়ে সায়রা নখ কাটল। এরপর এক বসায় একটি উপন্যাস পড়ে শেষ করল। যদিও উপন্যাসের শেষে নায়িকা মরে যাওয়ায় মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। এই সব কিছুর ভীড়ে সায়রা ভুলে গেল সেই চিঠিটার কথা। বালিশের নিচে রাখা চিঠিটা। যা সায়রাকে উদ্দেশ্য করে লেখা।
বিকেলে শাশুড়ির ঘরে উঁকি দিলো সায়রা। জাহানারা বেগম শুয়েই ছিলেন। আজকাল তার শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে। তিনি এ ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না। খাবার পর্যন্ত ঘরেই দেওয়া হয়। তবুও সায়রাকে দেখে তিনি উঠে বসলেন, ‘এতক্ষণে এলে! তোমার অপেক্ষাই করছিলাম বৌমা।’
সায়রা বসল জাহানারা বেগমের পাশে। আমতা আমতা করে কথাটা বলেই ফেলল। অথচ, সায়রার মা মানা করেছিলেন। সে যেন কাওকে এ-কথা না বলে। শ্বশুরবাড়ির লোকদের তো কোনোভাবেই না। কিন্তু সায়রা বলেই ফেলল, ‘জানেন মা, আমি যখন খুব ছোটো, তখন এক উন্মাদ বলেছিল, আমার কখনো বিয়ে হবে না। আর যদি কখনো বিয়ে হয়, তবে আমার স্বামী মারা যাবে। আর আমার পুরো শরীরে লোম গজাবে।’
জাহানারা বেগম বোধহয় এক কথা শুনে মজা পেয়েছেন। তিনি কুটিকুটি হয়ে হেসে বললেন, ‘শুনো বোকা মেয়ের কথা! উন্মাদ কবে কী বলেছিল তাই জন্য বাচ্চা শিশুর মতো কাঁদছো! ওসব ভুয়া, প্রতারক। মানুষকে ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দা। কোনো মানুষ কি ভবিষ্যতের কথা জানে?’
‘কিন্তু সে যে বলেছিল, আমার বরের নামের প্রথম অক্ষর হবে এস। আপনার ছেলের নাম কিন্তু এস দিয়ে শুরু হয়।’
জাহানারা বেগম এক গাল হাসলেন, ‘ওটা কাকতালীয়। ভবিষ্যতের কথা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। পৃথিবীর কেউ না। বুঝলে? তা ছাড়া তুমি বলেছো, উন্মাদের কথামতে তোমার বিয়ের পর গায়ে লোম গজাবে। কই, গজিয়েছে?’
সায়রা নিজের শরীরে চোখ বুলিয়ে বলে, ‘উঁহু।’
‘শোনো, সত্যি সত্যি যারা পবিত্র মানুষ। যারা আল্লাঅলা মানুষ, তারা কখনো ভবিষ্যত বলে না। মানুষের টাকা খেয়ে তাবিজ, সুতো এসব বেঁধে দেয় না। প্রকৃত আল্লাঅলা’রা দোয়া করে দেয়। আমি তো গোনাগগার পাপি বান্দা। তবুও তোমাকে দোয়া করে দিলাম।’ বলে জাহানারা বেগম মনে মনে দোয়া পড়লেন। সায়রার গায়ে ফুঁ দিলেন। নিজের গায়ে ফুঁ দিলেন।
আজ বহুদিন বাদে সায়রার মনে শান্তি লাগল। মুখে হাসি ফুটল। মন থেকে কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তা দূর হলো। সে নিশ্চিন্ত মনে অসুখে জর্জরিত দুর্বল মানুষটার কোলে মাথা পেতে দিলো। জাহানারা বেগম মুচকি হেসে সায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
(চলবে)
মো. ইয়াছিন