#হলুদ_খাম
লেখিকাঃ #তানজীমা_ইসলাম
___________________[১৬]___________________
ঘড়িতে রাত এগারোটা বাজে। খাওয়া শেষে সবাই যে যার ঘরে ঘুমাতে গেছে।
কাল সকালে সবাই ফিরে যাবে। খালি বাড়িটাতে একা থেকে যাবে হাসু মিয়া।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
তাকে সবাই কত করে বলেছে একটা বিয়ে করার জন্য। কিন্তু সে কথা সে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়।
বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আরেকটা জীবন সে নষ্ট করতে চায় না।
কারণ সে জানে, নতুন যে তার জীবনে আসবে তাকে সে ভালোবাসতে পারবে না।
পারবে শুধু দায়িত্ব পালন করতে। সেই দমবন্ধ হওয়া দায়িত্বের জীবন পাওয়ার চেয়ে সারাজীবন একা থাকাই শ্রেয়।
সেও হয়তো পারতো আর পাঁচ জনের মতো বিয়ে করে সুখে সংসার করতে।
যদি না তার জীবনে “প্রেম”আসতো। হ্যাঁ, সাদাসিধে এই সরল মানুষটার জীবনেও প্রেম এসেছিলো। কিন্তু তা ছিলো ক্ষণস্থায়ী।
ইলা নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতো হাসু। ইলাও তাকে খুব ভালোবাসতো।
বাজারে তার বাবার একটা দোকান ছিলো। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো।
এরমধ্যে হটাৎ একদিন শোনা গেলো, ইলা খুব অসুস্থ হয়ে গেছে।
হাসু খবর পাওয়া মাত্রই ইলা’দের বাড়ি ছুটে গেলো। কিন্তু কেউই তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি।
উলটো মারধোর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলো। তবুও হাসু হাল ছাড়েনি, একদিন গভীর রাতে পাচিল টপকে ইলা’র ঘরের জানালায় কড়া নাড়ল সে।
বেশ কিছুক্ষণ পর জানালা খুলে দিল ইলা। কিন্তু তাকে দেখে হাসু খুশি হওয়ার বদলে চমকে উঠল।
কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার! ঘোমটা দেওয়া সত্ত্বেও ইলার মাথায় টাক বোঝা যাচ্ছে!
তার দুই চোখে যেন আলকাতরা লেপে দিয়েছে কেউ। শরীরে একটুকরো মাংস নেই।
ফর্সা চামড়া তামাটে বর্ণ ধারণ করে হাড়ের গায়ে লেগে আছে।
সেই রাতের পর থেকে বহু রাত হাসু চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
ইলার ব্রেইন ক্যান্সার ধরা পড়েছে। সে জানতো হাসু এই কঠিন সত্যি মেনে নিতে পারবে না।
তাই সে নিজেই হাসুর থেকে দূরে চলে আসতে চাইছিলো।
আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না হওয়ায় ইলার পরিবার চিকিৎসা খরচ টেনে পারেনি।
ঢাকায় নিয়ে যস্তে হবে শুনে হাসু তার জমানো টাকা গুলো ইলার বাবার হাতে দিয়ে বলেছিলো,
” ইলারে য্যামনে হউক সুস্থ কইরা ফিরায় আইনেন, চাচা।
প্রতিত্তোরে ইলার বাবা শুধু অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে হাসুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
ইলাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো, কিন্তু সুস্থ অবস্থায় না। সাদা কাফনে মুড়িয়ে তার লাশ আনা হয়েছিলো।
__________________________
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|___________________________
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টির ছিচ এসে লাগছে গায়ে।
ওপরতলার বড় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে তনিমা। তার থেকে হাত কয়েক দূরে গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সায়ন। তনু বসে আছে দোলনায়।
বিকেলের ঘটনার জন্য দুজনের কেউই কারো দিকে তাকাচ্ছেনা।
দু’জনেই তাদের রাগ আর জেদ ধরে বসে আছে। মুখে প্রকাশ না করলেও মনেমনে চাচ্ছে, অপরজন এসে তার রাগ ভাংগুক।
তনিমা তাদের দুজনকে ডেকে পাঠিয়েছে। কাল সবাই ফিরে যাবে। তাই আজই সবটা তাকে বলতে হবে।
কথা গুলো না বলা পর্যন্ত সে স্বস্তি পাচ্ছে না। তনিমা বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বলল,
” রাইসার বৌভাতের দিন রাইসার চাচি শ্বাশুড়ি আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলো।
তার ছেলে প্রিয়ম’ এর সাথে আমার মেয়ে তনুর বিয়ের ব্যাপারে।
হটাৎ সবার সামনে এমন প্রস্তাব পেয়ে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়েছিলাম আমি। কি বলবো না বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
তনু অবাক হয়ে বলে উঠল, ” প্রিয়ম!
সায়ন সাথেসাথে তনুর দিকে তাকালো, তনু কি তাহলে প্রিয়মকে চেনে!? কিন্তু তনুর সেদিকে হুস নেই। সে অবাক হচ্ছে এই ভেবে যে, প্রিয়মের মা তার জন্য বিয়ের প্রোপোজাল পাঠিয়েছিলো!
তনুর সেদিনই সন্দেহ হয়েছিলো। কিন্তু মহিলা যে এতো ফাস্ট! তা ভাবতে পারেনি সে।
তনিমা মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, ” হুম প্রিয়ম। সে নাকি রাইসার হলুদে তোকে দেখে খুব পছন্দ করেছে।
যাইহোক, আমি তখন ভদ্রতার খাতিরে বললাম যে, আল্লাহ যেখানে রেখেছে সেখানেই হবে।
সেও আর কথা বাড়ায়নি। তবে রাবেয়া ভাবিকে বলে রেখেছিলো আমাদের রাজি করানোর জন্য।
বৌভাত থেকে ফিরেই ভাবি প্রিয়মের প্রসঙ্গ তুলল। প্রিয়মের যত গুনাগুন আছে সব বলতে লাগল।
আমি তখন শুধু একটা কথাই বলেছিলাম, ” ভাবি আমি এখন মেয়ে বিয়ে দেবো না। ও মাত্র ইন্টারে পড়ে, আগে অনার্সে উঠুক তখন ভেবে দেখবো।
ভাবিও আর কিছু বলল না। কিন্তু এই কথা সায়ন শুনতেই চেচামেচি শুরু করে দিল রাবেয়া ভাবির সাথে।
কে তাকে তনুর জন্য ঘটকালি করতে বলেছে! আর এই প্রিয়ম কে!?
চেনা নাই জানা নাই আপনার মেয়ের শ্বশুর বাড়ির কোন গুষ্টির ছাতার মাথা!!
তার সাথে তনুর বিয়ে দিতে চাচ্ছেন!!! আরও না জানি কত কি!!!
তনিমার কথার মাঝেই সায়ন লজ্জায় অন্যদিকে তাকালো। সে নিশ্চিত, তনু এখন তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
তার অদৃশ্য শক্তি থাকলে এখন সেই শক্তি দিয়ে তনুর চোখে কাদা লেপে দিতো সায়ন।
এদিকে তনুর চোখ জোড়া বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে গেছে। সায়ন তার জন্য ছোট মামিকে এসব বলেছিলো!
ভাবতেই মনের মধ্যে অজানা সুখ অনুভব হচ্ছে তনুর!! কিন্তু মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে সায়নের দিকে ভালোভাবে তাকাতেই পারছেনা সে। তনিমা স্মিত হেসে বলল,
” সেদিন সায়নের এতো রিয়াক্ট করা দেখেই সন্দেহ হয়েছিলো। কিন্তু আমি খুব করে চাইছিলাম যেন এটা সত্যি না হয়।
সাথেসাথেই সায়ন আর তনু তনিমার দিকে তাকালো। সায়নের তুলনায় তনু বেশি অবাক হচ্ছে। তাহলে কি তাদের বিচ্ছেদের কারণ তার মা নিজেই! তনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” আমি ব্যাপারটা শিওর হতে তনুর সাথে কথা বলতে চাইছিলাম। কিন্তু তনু তখন গোসলে।
এদিকে সায়ন এসে আমাকে সোজাসুজি বলে দিল, ফুপ্পি আমি আর তনু দুজন দু’জনকে ভালোবাসি।
কথাটা শুনে আমি খুশি হতে পারলাম না। সায়ন আর কিছু বলার আগেই থমথমে গলায় শুধু একটা কথাই বলেছিলাম, তনুর সাথে এই সম্পর্ক তুই শেষ করবি নাহলে আর কোনোদিন ফুপ্পির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না।
তনু বুঝতে পারছেনা তার মায়ের এমন বলার মানেটা কি? সায়ন তো কোনো খারাপ ছেলে নয়, খারাপ কিছুর নেশাও নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, সায়ন তো তার মায়ের একেবারে কলিজার টুকরো। সায়নও ফুপ্পি ছাড়া কিছু বোঝেনা।
তনু সায়নের দিকে তাকিয়ে দেখল সায়ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তনু এখন বুঝতে পারছে সেদিন কেন সায়ন তার সাথে ওমন বিহেভ করেছিলো।
তনিমার শরীর কেপে কেপে উঠছে। ঠান্ডায় নাকি চাপা উত্তেজনায় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তনিমা একটু থেমে আবার বলল,
” পরদিন বাড়ি ফিরে গেলাম। সারাটা রাস্তা তনু একটা কথাও বলেনি কারো সাথে।
ভাবলাম কয়েকদিন যাক ও নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে দিন গেলো, সপ্তাহ গেলো, মাস চলে গেলো।
কিন্তু তনু আর স্বাভাবিক হল না, ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটতে লাগল।
যেটা আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারছিলাম। হয়তো আমি সবটা জানতাম তাই।
তনু নিজেকে ঘরকুনো করে ফেলল। কারো সাথে মিশতো না। বাসায় কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতো না। ধীরে ধীরে প্রচন্ড জেদি হয়ে উঠল তনু।
কথায় কথায় ওর রাগ উঠতো। একবার তো ওর বাবা ওকে সামান্য ধমক দেওয়াতেই সারাদিন ঘরের দরজা লক করে রাখল।
লোক ডেকে সেই দরজা ভাংতে হয়েছিলো, না জানি আমার মেয়ে কোন সর্বনাশ করে বসেছে।
কিন্তু তনু তেমন কিছুই করেনি, চুপচাপ গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিলো।
তারপর থেকে ওকে কেউ ধমক দেওয়া দূর হাসিমুখে ছাড়া কথাই বলতাম না।
এরমধ্যে খেয়াল করলাম ও রাতে ঘুমায় না। সারারাত জেগে থাকে। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে ওর ঘরে উঁকি দিলেই দেখতাম পড়ার টেবিলে মাথা রেখে বসে আছে।
প্রথম প্রথম ভাবতাম সামনে এইচএসসি, তাই হয়তো রাত জেগে পড়ছে।
আবার দেখতাম, এক দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে ও। দিনদিন ওর শরীরও বেশ ভেঙে পড়তে লাগল। ওর দুই চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না। কেমন যেন শূন্য দৃষ্টি।
ওর এই অবস্থা দেখে বুঝতে বাকি ছিলোনা, পরীক্ষার টেনশন ছাড়া ও আরও অনেক টেনশন করে।
তীব্র অপরাধবোধ জেকে ধরল আমায়। বারবার মনে হত, মেয়ের ভালো চাইতে গিয়ে ওর ক্ষতি করে চলেছি আমি।
তনিমার গলা ধরে এসেছে। চোখ জোড়ায় নোনা পানি টলমল করছে। যেন টোকা দিলেই গড়িয়ে পড়বে। তনিমা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” ওকে ডক্টর দেখালাম। বলল ওর নাকি ইনসোমনিয়া হয়ে গেছে। দীর্ঘ দিন ঠিকমতো না ঘুমানোর কারণে ওর এই অবস্থা। সেইসাথে খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করেনি, শরীর একেবারে দূর্বল হয়ে গেছে। একগাদা মেডিসিন দিল ডক্টর। প্রায় সবগুলোই স্লিপিং পিল। সেদিন থেকে ও স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমাতো। ধীরে ধীরে শরীর মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে এলো। কিন্তু তনুর ঘরকুনো স্বভাবটা গেলো না। ডক্টরের সাথে এ ব্যাপারে কথা বললাম। সে তনুকে এনালাইসিস করে বলল, তনু কোনো কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। ওকে ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। আমি তখন অসহায়ের মতো ডক্টরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এ আমি কি করে ফেললাম আমার মেয়ের সাথে!?
তনিমা কাদছে! নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, ” তখন ওর এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। মাঝে এক ছুটির দিন ওকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো বললাম। কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হল না। ওর নাকি পড়া আছে, এখন ও পড়া ছেড়ে কোথাও যাবে না। আমিও আর জোর করলাম না। ভাবলাম পরীক্ষা শেষে নিয়ে যাবো।
টানা এক বছর তনু সাইকিয়াট্রিস্ট এর চেকাপে থেকে সুস্থ হল। কিন্তু নানুবাসার নাম শুনতে পারতো না। ছুটি কাটাতে মন চাইলে ওর দাদুবাসায় চলে যেতো।
বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে, ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে কাপুনি তুলছে। তনিমা চোখমুখ মুছে নিজেকে সামলে নিল।
সায়ন এতক্ষণে আবার তনুর দিকে তাকালো। এই মেয়েটা এইটুকু বয়সে তার জন্য কতকিছু সহ্য করেছে! ইনসোমনিয়া! স্লিপিং পিল!! সাইকিয়াট্রিস্ট!!!
তনুর মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে। সে ক্লান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার ভালোর জন্য এইসব করেছিলে আম্মু? কোন ভালোর জন্য!? কি সেই ভালো দিক!!?
সায়নও এবার ফুপ্পির দিকে তাকালো। কি সেই কারণ যাতে তনুকে ছেড়ে থাকতে হল তাকে। তনিমা তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসল। এই হাসির মানে কি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তনিমা নাক টেনে বলল,
” আমরা তিন ভাইবোন বাবা-মায়ের খুব আদরের ছিলাম। বড় ভাইয়া মায়ের পাগল ছিলো আর ছোট ভাইয়া আব্বুর। আমি ছিলাম সবার প্রিয়, আব্বু আম্মুর একমাত্র মেয়ে। দুই ভাইয়ের ছোট্ট আদরের বোন।
বড় ভাইয়ার বিয়ে হল, আমাদের ভাবি হয়ে এলো সেলিনা। প্রথম প্রথম সব ঠিকই ছিলো, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম ভাবি ভাইয়াকে নিয়ে আলাদা হতে চাইছে। সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম যে, আমরা কি তাহলে আলাদা হয়ে যাবো!
আমার থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছিলো আমার আব্বু আম্মু। আমরা ছোট থেকেই দাদা দাদুর আদর পেয়ে বড় হয়েছি। আমার আব্বু বা আম্মু কখনোই তাদের থেকে আলাদা হওয়ার কথা চিন্তাও করেননি। অন্য ছেলের বউদের তুলনায় আমার আম্মু ছিলো দাদা দাদুর খুব আদরের বউমা।
যাইহোক, আলাদা হওয়ার ক্ষেত্রে ভাবির বিপত্তি বাধল ভাইয়ার জন্য। ভাইয়া কিছুতেই আলাদা হবে না।
আসলে আলাদা হওয়ার সঠিক কোনো কারণও ছিলো না। এই বাড়ি ছাড়াও শহরে আমাদের আরেকটা বাড়ি ছিলো। সেখানেই আমরা থাকতাম।
বাবা সরকারি চাকরি করতেন আর ভাইয়া প্রাইভেট কোম্পানিতে। শহরে বাড়ি হওয়ায় তাদের যাতায়াতে কোনো সমস্যাই ছিলো না।
কিন্তু এসব কিছুই ভাবিকে দমাতে পারেনি। সে তারমতো চেষ্টা চালিয়ে গেলো।
প্রায়ই দিন ভাইয়ার সাথে আবার কখনো আম্মুর সাথেও ঝগড়া শুরু করে দিতো।
কোনো কোনোদিন আমার সাথেও এবং ঝগড়াটা সেই শুরু করতো। আর কিছু হলেই চলে যেতো বাপেরবাড়ি।
আমি সব সহ্য করলেও আব্বু আম্মুর সাথে দূর্ব্যবহার সহ্য করতে পারতাম না।
যেখানে আমি বা ভাইয়ারা কোনোদিন আব্বু আম্মুর সাথে উঁচু গলায় কথা বলিনি।
সেখানে বউ হয়ে এমন ব্যবহার করার সাহস পায় কিভাবে। তাও যদি সঠিক কোনো কারণ থাকে তাও মানা যায়।
কারণ অবশ্যই ছিলো, আর তা হল আলাদা হওয়া।
এসব দেখতে দেখতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে আব্বু আম্মুকে বললাম, ভাইয়া হয়তো তোমরা কষ্ট পাবে ভেবে আলাদা হতে চাইছে না। তোমরা নিজে থেকেই বলো আলাদা হয়ে যেতে। ওরা আলাদা থাকুক, তাও ভালো থাকুক। এভাবে একসাথে থেকে ঝগড়াঝাটি করার কোনো মানেই হয় না।
আব্বু আম্মু বুকে পাথর চেপে আমার কথা মেনে নিল। ভাইয়াকে বলল আলাদা হয়ে যেতে।
তখন ভাইয়া কিচ্ছু বলেনি, শূন্য দৃষ্টিতে আব্বু আম্মুর দিকে তাকিয়ে ছিলো ও।
পরদিন ভাইয়া অফিসে থেকে ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেদেছিলো।
এতবড় একটা বিবাহিত পুরুষ বাচ্চাদের মতো কাদতে কাদতে বারবার বলছিলো, ” আম্মু আমাকে আলাদা হয়ে যেতে বলছে আপু। আমি কি করে যাবো!? আব্বু আম্মুকে ছেড়ে তোদের ছেড়ে আমি কিভাবে থাকবো!!?
আমি সেদিন কাদিনি, থমথমে গলায় বলেছিলাম,” তাহলে নিজেকে শক্ত কর। বউকে সঠিকভাবে সামলা। দেখবি সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সত্যিই সব ঠিক হয়ে গেছিলো। সায়ন হওয়ার পর আরও ঠিক হয়ে গেছিলো। ভাবি আব্বু, আম্মু, আমি বা ভাইয়া কারো সাথেই আর বিনা কারণে ঝামেলা করতো না।
আমার মাঝেমধ্যে মনে হত, এই ঠিক হওয়ার পেছনে সায়নই মূল কারণ।
সায়ন এই পরিবারে শান্তি নিয়ে এসেছে।যদিও মূল কারণটা ছিলো বড় ভাইয়া নিজেই।
আমার মনে শান্তি ছিলো এই ভেবে যে, বিয়ের আগেই একটা সুখী পরিবার দেখে বিদায় নিতে পারলাম।
তনিমা এবার সরাসরি সায়নের দিকে তাকিয়ে বলল, ” যখন তুই বললি তোরা দুজন দু’জনকে ভালোবাসিস! আমার চোখের সামনে বড় ভাবির সেই ঝগড়াঝাটির দৃশ্য ভেসে উঠল। কিভাবে সে আব্বু আম্মু আমার সাথে দূর্ব্যবহার করেছে! ভাবতে চাইনা সেসব, আর চাইনি সেই তার ঘরের বউমা আমার মেয়ে হউক!
তনুর মাথাব্যথাটা ভীষণ বেড়েছে, দোলনায় বসে থাকতে পারছেনা সে। দোলনা ছেড়ে নামতে নামতে বলল,
” বড় মামির ব্যবহার নাহয় তুমি দেখেছিলে। কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি যদি অন্য কেউও হয়। সে যে এমন বা তার থেকেও খারাপ হবে না ভাবলে কিভাবে!?
তনিমা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ” না জেনে দেওয়া আর জেনেশুনে দেওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য। যদিও সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু অতীত তো একসময় বাস্তব ছিলো। নিজের মেয়ের শ্বাশুড়ি হবে সেই সেলিনা! না জানি আমার মেয়েটার সাথেও ও কেমন ব্যবহার করবে!!
সায়ন এবার মুখ খুলল,” তাহলে আমার মায়ের জন্য আমাকে মেনে নিতে পারো নি তাই তো!?
তনিমা কিছু বলছে না। সায়ন এবার গমগমে গলায় বলল, ” ফুপ্পি আমি ছোট থেকে তোমার আদরে বড় হয়েছি। তোমার বিয়ের পরও তোমার কাছে ছুটে যেতাম। আম্মুর চেয়ে বেশি তোমার কাছে থেকেছি আমি। তুমি কি একবারও ভাবলেনা!? আমি থাকতে আম্মু বা কেউই তনুর সাথে বিনা কারণে খারাপ ব্যবহার করার সাহস পাবে কি না!
তনিমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, সায়ন কোনোদিন তার সাথে এভাবে কথা বলেনি। সায়নের এই রূপের সাথে সে একদমই অপরিচিত। তনিমা কিছু বলার আগেই সায়ন বলে উঠল,
” থাক ফুপ্পি! আমার মাকে তোমার মেয়ের শ্বাশুড়ি করতে হবে না।
তনুর দিকে তাকিয়ে বলল,” আর তোকে তো সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি! তাই অন্য কাউকে বিয়ে করতেও পারবো না। ভালো থাকিস, আর জেনে রাখিস আমি কোনোদিন ভালো থাকবো না।
সায়ন আর বিন্দুমাত্র না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিল। তনুর চোখে নোনা পানি ভরে উঠছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
” আম্মু আমি তোমার বাধ্যগত মেয়ে। তোমার সম্মতি না পেলে আমি কোনোদিন সায়নের কাছে যাবো না। তবে আমাকে অন্য কারো সাথে বিয়ে করতে বইলো না। আমি যে সায়ন ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসি।
তনিমা কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা, এতোদিন না বলতে পেরে অপরাধবোধে ভুগছিলো। বলার পর এবার বোধহয় ছেলেমেয়েদের অভিমানের আগুনে পুড়তে হবে তাকে!
|
|
|
|
|
[চলবে]