হলুদ খাম, পর্ব:১৭

#হলুদ_খাম
লেখিকাঃ #তানজীমা_ইসলাম

_________________[১৭]__________________

সায়ন আর বিন্দুমাত্র না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিল।
তনুর চোখে নোনা পানি ভরে উঠছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

” আম্মু আমি তোমার বাধ্যগত মেয়ে। তোমার সম্মতি না পেলে আমি কোনোদিন সায়নের কাছে যাবো না। তবে আমাকে অন্য কারো সাথে বিয়ে করতে বইলো না। আমি যে সায়ন ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসি।

তনিমা কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা, এতোদিন না বলতে পেরে অপরাধবোধে ভুগছিলো।
বলার পর এবার বোধহয় ছেলেমেয়েদের অভিমানের আগুনে পুড়তে হবে তাকে!

__________________________

এলোমেলো পা ফেলে তনুও ঘরে চলে গেল। অন্ধকারের মধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো তনিমা।
রাত অনেক হয়েছে, ঘুমাতে যাওয়ার দরকার। কিন্তু আজ তো তার ঘুম আসবে না।
শুধু শুধু বেড এ শুয়ে সারারাত এপাশ ওপাশ করতে হবে।
তারচেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগানো বেশি শ্রেয়।

হটাৎ কারোর পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে তাকালো তনিমা।
তার থেকে হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে সেলিনা! তনিমার চোখ জোড়া আরেক দফা আঁতকে উঠল। কাপা কাপা গলায় বলল,

” ভা’ভাবি তুমি! এখানে কখন এলে!?

আকাশে ঝুলে থাকা রূপোলী চাঁদের আলোয আর বারান্দার অন্ধকার মিলে অদ্ভুত আলোছায়া খেলছে।
সেই আলোছায়ায় তনিমা স্পষ্ট দেখতে পেলো সেলিনার চোখ জোড়া ছলছল করছে! সে তনিমাকে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য খুজতে এসেছিলো। সিড়ির মুখে আসতেই এদের কথোপকথন শুনে দাঁড়িয়ে গেছিলো সে। তনিমা আরেকবার ডেকে উঠল,

” ভা’ভাবি!!

সেলিনা কোনো জবাব দিলো না। নিরবতা কাটিয়ে বলতে লাগল,

“তোমার ভাইয়া সত্যিই খুব ভালো মানুষ তনিমা। সে বউয়ের কথায় বাবা-মাকে ছাড়েনি।
প্রথম প্রথম আমার না খুব রাগ হত জানো। যখন দেখতাম তোমার ভাইয়া বাসায় ফিরে আগে বাবা মায়ের ঘরে যায়, মনে হত সে কেন আগে আমাদের ঘরে এলো না।
ছুটির দিনে তোমরা ভাইবোনেরা মিলে যখন মুভি দেখতে আমাকেও ডাকতে।
কিন্তু আমি যেতাম না, আমার কেন জানি তোমার ভাইয়া ছাড়া কারোর সাথে মিশতে ভাল্লাগতো না।
শুধু চাইতাম আমাদের আলাদা একটা সংসার হোক। জানো, যেদিন বাবা-মা তোমার ভাইয়াকে বলল আলাদা হয়ে যেতে, আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।
আমি তো ঘরে এসে লিস্টও বানিয়ে ফেলেছিলাম নতুন সংসারে কি কি কিনতে হবে।
সারারাত নতুন সংসারের চিন্তায় আমি ঘুমাতে পারিনি। আনন্দে নাকি কি জন্য কে জানে। খুব অস্থির লাগছিলো। পরদিন রাতে খবর আসে আবার বাবা ভীষণ অসুস্থ।
খবরটা পেয়ে আমার যেন হাতপা অসাড় হয়ে আসছিলো।
সে রাতে তোমার মা আমায় বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন।
বাবাও এসে এসে আমাকে শান্ত হতে বলছিলেন।
কিন্তু তোমার ভাইয়া একটাবার আমার পাশে আসেনি।
সে রাতে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো। কাদের থেকে আলাদা হতে চাইছি আমি!?
আলাদা সংসারে থেকে যদি এ খবর পেতাম তাহলে তো আমাকে বুকে জড়িয়ে কাদার জন্য এই মাকে আমি পেতাম না!
পরদিন আমাকে নিয়ে তোমার বাবা আমার বাপেরবাড়িতে গেলেন।
তোমার ভাইয়ার অফিস থেকে ছুটি দেয়নি তাই সাথে আসতে পারেনি।
বাড়ি ফিরে দেখলাম বাবার চিকিৎসা খরচ কে করবে তাই নিয়ে ভাইদের মধ্যে রেষারেষি চলছে!
আমার সেদিন যেমন ভাইদের ওপর রাগ হচ্ছিলো, তেমন তোমার বাবার সামনে লজ্জাও লাগছিলো।
সে দেখছে আমার বাবাকে দেখার জন্য কোনো ছেলেই সেভাবে প্রস্তুত নয়।
ভাইয়েরা মুখে না বললেও তাদের ভাবভঙ্গিতে একেবারে স্পষ্ট।
সেদিন ছোট ভাইটা বাবাকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেলো।
ও তখনও বিয়ে করেনি। চাকরি করে যা বেতন পায় তার সবটাই বাবার পেছনে খরচ করতো।
বাবা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু আমার মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছিলো না।
বারবার আমার চোখে শ্বাশুড়ি মায়ের কোলে গুটিসুটি মেরে থাকা আমি আর আপন ছেলেদের অবহেলার পাত্র হওয়া আমার বাবার চেহারা ভাসতো।
তোমার ভাইয়া তার পরিবারের সাথে থাকতে চাইছে আর আমি তাকে নিয়ে নিজের আলাদা সংসার তৈরির চিন্তা করছি।
ওদিকে আমার ভাইয়েরা যারা বিয়ে করে যে যার মতো আলাদা হয়ে গেছে।
এমনকি নিজের বাবার জীবন মৃত্যু ক্ষণে দাঁড়িয়ে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে!!
আমি সেদিন থেকে শুরু করে কয়েক মাস পর্যন্ত একটা রাত শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি।
আলাদা সংসারের কথা বলতে গেলে ভুলেই গেছিলাম। সারাক্ষণ শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে সময় কাটাতাম আমি।
আর এও বুঝতাম তোমার ভাইয়া এতে ভীষণ খুশি হত। হটাৎ একদিন জানতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি।
সেই থেকে আমাদের সুখের দিন শুরু। তারপর পেছনের সব ভুলে গেছিলাম।
যদিও মাঝেমধ্যে সেসব দিন গুলো মনে পড়লেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।
তবে বুঝতে পারিনি সেই দিন গুলো তোমার মনে দাগ কেটে গেছে।
পারলে আমাকে মাফ করে দিও আপা। কিন্তু ছেলেমেয়ে দুটোকে আলাদা করে দিও না।

সেলিনার এতদিনের অপ্রকাশিত কথা গুলো জানতে পেরে তনিমার নিজেরই ভীষণ খারাপ লাগছে।
কিন্তু তার শেষের কথাটা শুনে তনিমা বেশ অবাক হল। তাহলে কি সেলিনাও সায়ন আর তনুর ব্যাপারে জানে!? তনিমা এগিয়ে গিয়ে সেলিনাকে বলল,

” ভাবি আমি তোমাকে আমার বিয়ের অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি। যেদিন দেখেছি, তুমি আমার পরিবার নিয়ে ভীষণ সুখে আছো।
আমার বাবা-মা, ভাই সবার দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে এসেছি। আমি শুধু ভয় পেয়েছিলাম আর চাইছিলাম না যে, ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে ভাইবোনের মধ্যে কোনো ঝামেলা হউক!

প্রায় সাথেসাথেই সেলিনার চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। তনিমা তাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বলল,

” এভাবে কাদলে হবে ভাবি!? জামাইয়ের শ্বাশুড়ির থেকে এবার বউমার শ্বাশুড়ি হতে চলেছো। তোমাকে এখন কাদলে মানায়!?

সেলিনা সাথে সাথে মুখ তুলে তনিমার দিকে তাকালো। তনিমা মুচকি হেসে বলল, ”

” সে যাইহোক! তুমিও জানতে! সায়ন তনুকে ভালোবাসে!?

সেলিনা হেসে ফেলল। তনিমা হাত দিয়ে সেলিনার চোখমুখ মুছে দিচ্ছে। সেলিনা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

” ইশ! শুধু কি সায়ন নাকি!? তনুও তো সায়নকে ভালোবাসে!

” বাব্বাহ! এখন থেকেই বউমার শ্বাশুড়ি শ্বাশুড়ি ভাব চলে এসেছে দেখছি তোমার!!

এবার দুজনে একসাথে হেসে ফেলল। সাথেসাথে আবার গলা নামিয়ে নিল।
অনেক রাত হয়েছে, এখন কেউ হাসাহাসির শব্দ পেলে ছুটে এসে ভূত বলে না পেদায় আবার। তনিমা গলার স্বর নামিয়ে বলল,

” বললে না যে! তুমিও জানতে!!

” আরে আমি জেনেছি রাইসার বৌভাত থেকে বীরগঞ্জে ফেরার পর।
রাইসার বিয়ে উপলক্ষে সায়ন যে কয়দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিলো, তারমধ্যে দুইদিন বাকি ছিলো মাত্র।
সেই দুইদিন ছেলে আমার নাওয়াখাওয়া পর্যন্ত ভুলে গেছিলো! সকালে ব্রেকফাস্ট করতে বসতো বেলা বারোটায়।
তখন আবার পরোটায় তেল বেশি হয়েছে বলে চেচাতে লাগল। আধখাওয়া পরোটা ফেলেই উঠে গেলো। দুপুরে খেতে আসল বিকেল পাঁচটায়!
ততক্ষণ মহাশয় ঘরে দরজা লক করে ছিল। রাতের খাবারেও একই অবস্থা।
ওর বাবা কিছু বলতেই একরকম খেকিয়ে উঠে সোজা ঘরে চলে গেলো। পরদিনও একই অবস্থা!
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। তারপরদিন ছেলেটা ঢাকায় চলে যাবে, শুধু শুধু আবার রাগারাগি করবে।
কিন্তু পরেরবার এসেই দেখলাম মহাশয় একদম ভালোমানুষ।
কিন্তু ওর এই অস্বাভাবিক ভালো মানুষিকতা আমার কেমন যেন লাগছিলো।
ওকে জিজ্ঞেস করেও কোনো লাভ হল না। কিন্তু ওর শুকিয়ে যাওয়া শরীর আর রক্তলাল চোখ দেখে বুঝতে বাকি ছিলো না কিছু তো একটা ঘটেছে।
অগত্যা ওর বেস্টফ্রেন্ড জুবায়েরকে ডেকে পাঠালাম। সায়নের ব্যাপারে আমার পরে আগাগোড়া সবই সে জানে।
প্রথমে বদমায়েশটা মুখ খুলছিলো না। পরে কেদেকেটে ওর মুখ খুললাম।
আর সেদিনই জানলাম সায়ন আর তনুর মধ্যে রিলেশন ছিলো এবং তাদের ব্রেকাপও হয়ে গেছে।
কিন্তু কেন হয়েছে তা ও জানতো না।
আমি ভেবেছিলাম সাধারণ কোনো কারণে হয়তো।
সেজন্য তনুর সাথে দেখাও করতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু ও তো তারপরে আর আমাদের বাসায় আসেনি। এমনকি আমতলীতেও আসেনি।
গতবার তোমাদের বাসায় গেলাম, তাও তো শুনলাম ও দাদুবাসায় গেছে।
_______________________
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
জানালা দিয়ে আসা রোদের আলো মুখে পড়তেই সায়নের ঘুম ভেঙে গেল। আস্তেধীরে চোখ মেলে দেখল তার মা বসে আছে তার সামনে! সায়ন ভ্রু কুচকে বলল,

” এভাবে কি দেখছো!? ছেলেকে আগে কখনো দেখোনি মনে হচ্ছে!?

” দেখেছি তো। আর এও দেখছি যে ছেলের বিয়ে দেওয়ার সময় হয়ে গেছে!

সায়ন এবার হেসে বলল, ” তোমার বেকার ছেলেকে এখন কে বিয়ে করবে হ্যাঁ!?

” যার সাথে আল্লাহ লিখে রেখেছে সেই করবে।

” তো কি আল্লাহ তাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে বলেছে? এই নে সেলিনা তোর বউমা!

সেলিনা কোনো কথা না বলে সায়নের কান মুলে দিল। সাথেসাথে লাফিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল সায়ন। কান ডলতে ডলতে চেচিয়ে উঠলো,

” আশ্চর্য! কান মুলে দিলে কেন!?

সেলিনা মুখ ভেংচি কেটে বিছানা ঠিক করতে করতে বলল, ” বেশ করেছি। তোকে যে মধুমোড়া দেইনি এই বেশি।

সায়ন বুঝতে পারছেনা তার মা হটাৎ এমন করছে কেন! আচ্ছা সে কি স্বপ্ন দেখছে!
দেখতেও পারে। গতরাতে ফুপ্পির কথা শোনার পর এমনিতেই জেগে জেগে উল্টাপাল্টা জিনিস দেখছে সে। একবার দেখছে তনু সেই প্রিয়ম না কি ছাই তাকে বিয়ে করে ফেলেছে!
সাথেসাথেই সে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার!
তার তনু কি না অন্য কাউকে বিয়ে করেছে!? পরক্ষণেই বুঝল সে স্বপ্ন দেখছে অমনি আবার ঘুমিয়ে পড়ল। এবার দেখল আরও ভয়ানক স্বপ্ন!
প্রিয়ম আর তনুর বাচ্চা হয়েছে!! আর সায়ন তাদের হ্যাপি ফ্যামিলির ফটোশুট করছে!!
“গুল্লি মারি তোদের কচু মার্কা ফ্যামিলির”! বলতে বলতে আবারও সায়নের ঘুম ভেঙে গেল।
তাই এখনও সে স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তব ঠিক বুঝতে পারছেনা।

সেলিনা ভাবলেশহীন ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় যেতে যেতে বলল,

” আমার বউমা’টা এতো সকালে ঘুম থেকে কেন উঠেছে হ্যাঁ!? কাল রাতে তো ঠিকমতো ঘুমাওনি। যাও গিয়ে ঘুমাও।

সাথেসাথেই সায়নের মাথায় যেন বোমা বিস্ফোরণ ঘটল। তার মা এই সকাল সকাল কাকে বউমা বউমা ডাকছে!?
____________________
|
|
|
|[চলবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here