#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ১২
সামিয়া অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। সে বসে ভাবছে নানানকিছু, জীবনের অর্থ খুঁজে ফিরছে আনমনে। অদ্ভুত ভাবে জীবনের কোন অর্থই সে খুঁজে পাচ্ছে না। আর না খুঁজে পাচ্ছে বেচেঁ থাকার ইচ্ছা। কুমির ভর্তি পুকুরে নামলে যেমন অনুভূতি হয়, সামিয়ারও ইদানিং তেমন অনুভূতি কাজ করে।
সে অফিসার শীলার সাথে আবারও কথা বলতে শুরু করলো। সামিয়াকে এখন কিছুটা বিমর্ষ দেখাচ্ছে। নিস্তেজও লাগছে খানিক। সে থেমে থেমেই কথা বলছে।
“সুমনের সাথে আমার সম্পর্কের মাস খানেকের মাথাতেই আমার ঘোর কেটে যেতে শুরু করে। আমি নিজে নিজেই বুঝতে পারি আমি ভুল করছি। নিলয় আমাকে আগের মত ভালো না বাসলেও সে আমার স্বামী। আমি ঠিক করে নিলাম সুমনের সাথে দেখা করে সবকিছু শেষ করে দেবো। ভাবনা অনুযায়ী আমি সুমনের সাথে দেখা করতে যাই। দুজনে একটা রেস্টুরেন্টে বসি। দু’একটা কথা হয়েছে সবে।
আমাদের কথার মাঝেই সুমনের ফোনে একটা কল আসে। আমি তখনও ওকে সবটা বলতে পারিনি। সে আমার সামনেই কথা বলে ফোনে। আমার সামনে কথা বললেও ওকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল তখন। মনে হচ্ছিল সে কোন অন্যায় কাজ করছে। যার জন্য তাকে কিছুটা চুরি করে ধরা পড়ার মতো অবস্থায় পড়েছে মনে হচ্ছিল। আমি সেদিকে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করলাম না। ওকে ব্যাপারটা কিভাবে বলবো সেটাই ভাবছিলাম মনে মনে।
সে ফোনে কথা বলা শেষ করে আমার দিকে তাকালো। আমি ওকে কেন ডেকেছি হুট করে সেটা জানতে চাইলো। আমি ওকে কিছু বলার আগেই ও বললো ওয়াশরুমে যাবে। সে ওয়াশরুমে গেল। সুমন যাওয়ার সাথে সাথেই সুমনের ফোনে একটা মেসেজ এলো। কী মনে করে আমি মেসেজটা দেখলাম। ওর ফোন লক করা ছিল। আমি উপর থেকে মেসেজ টেনে যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই পড়লাম। সেখানের কিছু লেখা আমার মনে একটা সন্দেহের বীজ রোপণ করলো। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না আমার ওই মুহূর্তে কী করা উচিত। ওর ফোনে যে নাম্বার থেকে মেসেজটা এসেছিল সেই নাম্বারও আমার বহুদিনের চেনা। আমার সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করতে শুরু করলো। মাথাটাও কেমন চক্কর দিচ্ছিলো। আমি সেখানে আর এক মুহুর্ত দেরি করলাম না। ফোনটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালাম।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হবার আগেই সুমন চলে এলো। আমার শরীর ভালো লাগছে না বলে আমি সেখান থেকে চলে এলাম। চলে এলাম ঠিক না, এক প্রকার আমি সেখান থেকে পালিয়ে এলাম। আমি চেয়েছিলাম এখনই ওকে সবটা বলবো না। ওকে আরো কিছুদিন দেখবো। ফোন করা লোকটার সাথে ওর কী সম্পর্ক সেটা খুঁজে বের করবো। তারপরই যা হবার হবে। আমি বাড়িতে চলে এলাম।
বাড়িতে এসেও আমি স্থির থাকতে পারছিলাম না। সারাক্ষণ ওর মেসেজের কথাগুলোই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কোনরকমে সেদিক থেকে নিজের মনকে সরিয়ে বাড়ির কাজে মনোযোগ দিলাম।
সন্ধ্যার পরপরই নিলয় বাসায় ফিরলো। অদ্ভুতভাবে সে আজ বেশ ভালো মেজাজে আছে। যেটা অনেকদিনই তার মধ্যে আমি লক্ষ্য করিনি। আমিও ঠিক করলাম ওর সাথে ভালোভাবে কথা বলবো। কফি বানিয়ে দু’মগ কফি নিয়ে গেলাম ওর কাছে। সেও পরম আবেশে আমাকে আকড়ে ধরলো। বেশ ভালো মেজাজেই দুজনে কিছু সময় পার করলাম। নিলয় ল্যাপটপে নিজের কাজ নিয়ে বসতেই আমিও ফোন হাতে নিলাম। সুমনের অনেকগুলো মিসড কল আর মেসেজ পেলাম। প্রথমে সে ব্যথিত হৃদয়ে মেসেজ করলেও পরেরগুলো কেমন আক্রমণাত্বক ছিল। একটা মেসেজে সে লিখেছে,
” জামাই কে কাছে পেতেই আমাকে ইগনোর। বাহ্! জামাইয়ের বাহুডোরে তো বেশ আরাম আয়েশ করছো। আমাকে ভুলে গেছো দিব্যি। অথচ এই আমাকেই সারাক্ষণ মিস করতে! আচমকা এমন বদলে গেলে কেন? জামাই আগের থেকে বেশি ভালোবাসছে বুঝি!”
ওর মেসেজটা পড়ে আমার মেজাজটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে এতদিন এমন কথা কখনোই বলেনি, আজই কেন বললো সেটাও বুঝতে পারলাম না। আমি ওর মেসেজের কোন রিপ্লাই করলাম না। উল্টো নিলয়ের কাছে গেলাম। নিলয়কে ডিনার করতে তাড়া দিলাম। সেও বাধ্য ছেলের মত আমার কথায় ডিনার টেবিলে এলো। দুজনে একসাথে খেলাম। ওকে বেশ রোমান্টিক দেখাচ্ছিল সেদিন। অনেকদিন এমন মুডে ওকে দেখিনি। ওকে এভাবে দেখেও আমার তেমন কোন অনুভূতি কাজ করলো না। আমি শুধু ওর ঘুমনোর অপেক্ষায় ছিলাম। সে খেয়ে আমাকে নিয়েই শোবার ঘরে গেল। আমিও ওর চাহিদামত সব কিছু করতে লাগলাম। একটা সময় সে ঘুমিয়ে পড়লো। সে ঘুমনোর সাথে সাথেই ফোনটা হাতে নিলাম।
ফোন নিয়েই আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিলয়ের ফোনের লক আমি আগে থেকেই জানতাম। চুরি করে একদিন দেখে নিয়েছিলাম। ফোনের লক খুলে ওর কল লিস্ট চেক করলাম। যেটা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই হলো। নিলয়ের কল লিস্ট জুড়ে শুধু সুমনের নাম্বার। খানিক আগেও কল গিয়েছিল। হয়ত সে বাসায় ঢুকেই কল করেছিল সুমনকে। এরপর মেসেজে গেলাম। খুব একটা মেসেজ সেখানে পেলাম না। সমস্তটা ডিলিট করে দিয়েছে বোধহয়। শুধু আজকের করা মেসেজটা পেলাম। সেখানে লেখা ছিল,
“সুমন, আজ হঠাৎ ম্যাডাম কী কারণে তোমাকে দেখা করতে বললো কিছু জানতে পেরেছ? কিছু সন্দেহ করেছে না কী? সন্দেহজনক কিছু দেখলে অবশ্যই আমাকে জানাবে। আর আরো বেশি সাবধান হবে। কেমন?”
মেসেজটা পড়ে বুঝে গেলাম দুজনের মধ্যে বেশ ঘনিষ্ট একটা যোগসূত্র আছে। কিন্তু, সেটা কিভাবে? তবে কী দুজনে দুজনের পূর্ব পরিচিত! কোন প্ল্যান করেই আমাকে ফাঁসিয়েছে সুমন?
কিছুই মাথায় আসছিল না। ঠিক করলাম সুমনের অফিস কোথায় সেটা বের করব। কিন্তু, কিভাবে বের করবো সেটা মাথায় আসছিল না।
এই পর্যন্ত বলেই থেমে গেল সামিয়া। শীলাও বেশ উত্তেজিত হয়ে আছে। সামিয়াকে থামতে দেখে শীলা কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
“আহা, এমন সময়ে কেউ থেমে যায়?”
সামিয়া কে বেশ অসুস্থ দেখাচ্ছিল। সে খানিক হাসফাঁস করছে। চোখদুটো উপরে বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছে। সে কাঁপা গলায় বললো,
“পানি, একটু পানি হবে?”
শীলা সামনের গ্লাস টা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো। সামিয়া হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটাই শেষ করে ফেললো। তবুও যেন তৃষ্ণা নিবারণ হলো না। সামিয়া বেশ কাঁপছে। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে কন্নামাখা গলায় বললো,
“ঠাণ্ডা পানি হবে একটু? প্লিজ। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”
শীলা ওর অবস্থা দেখে বেশ ভরকে গেল। এই মুহূর্তে ঠাণ্ডা পানি কোথায় পাবে সে! তবুও একজন কনস্টেবল কে পানি আনানোর জন্য পাঠিয়ে দিলো। সামিয়া ততক্ষণে চেয়ার থেকে লুটিয়ে নিচে পড়ে গেছে। শীলা অবস্থার বেগতিক দেখে থানার কর্তব্যরত অফিসার ইনচার্জ কে ডেকে পাঠালো। একজন ডাক্তারকেও খবর দেওয়া হলো। তাৎক্ষণিক অবস্থায় কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না। সামিয়া কে বদ্ধ কামড়া থেকে বের করে খোলা একটা কামড়ায় শুয়ে রাখা হয়েছে। তার জ্ঞান আছে, কিন্তু সে বেশ নিস্তেজ। খানিক পরেই একজন ডাক্তার এলো। সেই ডাক্তার থেটোস্কপ দিয়ে সামিয়ার হার্টবিট চেক করলো। হার্টবিট বেশ দ্রুত গতিতে চলছে। নার্ভও বেশ দূর্বল। ডাক্তার কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বললো,
“আসামি কী প্রেগনেন্ট?”
ডাক্তারের কথায় অফিসার শীলাসহ বাকিরাও বেশ ভরকে গেল। শীলা সামিয়ার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সামিয়া কিছুই বলছে না। শুধু মরার মত পড়ে আছে। ডাক্তার আবারও বললো,
“মেয়েটা বেশ দূর্বল। থানায় তেমন খাওয়া-দাওয়া পাচ্ছে না মনেহয়। সেই সাথে প্রচণ্ড গরমে সে এমন অবস্থায় পড়েছে। আমার যতদূর মনে হচ্ছে সে প্রেগনেন্ট, যদিও আমি শিওর না। আপনারা তাকে পারলে একবার হাসপাতালে নিয়ে চেকআপ করাবেন। সত্যিই যদি প্রেগনেন্ট হয়ে থাকে, তবে তাকে সেভাবেই রাখতে হবে।”
ডাক্তারের কথায় থানার কর্তব্যরত অফিসার বাঁকা ঠোঁটে হেসে বললো,
“একজন ডাবল মার্ডার কেইসের আসামির জন্য এমন সুব্যবস্থা কখনোই সম্ভব না ডাক্তার। সে তো রিমান্ডে আছে। আজই অবশ্য রিমান্ড শেষে হবে। তাকে আগামিকলা বা পরশু আবারও কোর্টে তোলা হবে। তারপরই কোর্ট ঠিক করবে তাকে কী করা হবে না হবে।”
অফিসারের কথায় আতকে উঠলো ডাক্তার সাহেব। বয়স্ক মানুষ হওয়ায় মেয়েটার জন্য মনের মধ্যে একটা মায়াও কাজ করতে শুরু করলো। ডাক্তার আর কিছু না বলে চলে গেল।
অফিসার শীলা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। থানার কর্তব্যরত অফিসার হাসতে হাসতে বললো,
“আরে ম্যাডাম, এসব ছোটখাট বিষয় নিয়ে এমন চিন্তা করলে হবে? ভুলে যাবেন না, সে একজন খুনের আসামি আর আপনি তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসার।”
শীলা মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
“জি, আমার মনে আছে সব।”
কিন্তু তার মনের ভেতরটায় কেমন যেন অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল। মেয়েটা যদি সত্যিই প্রেগন্যান্ট হয়, তখন!
খানিক বাদেই সামিয়া আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লো। এবার সে বমি করছে। তার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। পেট ধরে নীরবে কাদঁছে। হাজারও হোক, পুলিশ হলেও অফিসার শীলা একজন মেয়ে, একজন মা। সামিয়ার এমন অবস্থা সে সহ্য করতে পারলো না। সে নিজেও নিশ্চিত হয়ে গেছে সামিয়া প্রেগন্যান্ট। শীলা আর এক মুহুর্ত দেরি না করে উপর মহলে কল করলো। উপর মহলের পারমিশন নিয়ে সে সামিয়া কে সদর হাসপাতালে পাঠালো।
চলবে….