#হতে পারি বৃষ্টি ❤️
#পর্ব-৭
#লেখনীতে- মৌশ্রী রায়
“মা,মা,চলনা আমাকে দোলনা বানিয়ে দেবে।চল না।প্লিজ প্লিজ! ”
বিকেলবেলা,সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে।তাই তার তীব্র উত্তাপটা আর এখন নেই।এমন সময়ই হঠাৎ ঐশীর হাত ধরে তার কাছে রায়া দোলনা বানিয়ে দেয়ার আবদার জানাতেই ঐশী মিষ্টি হেসে মেয়ের দিকে চেয়ে বলে ওঠে ,
“ছাদে তো দোলনা আছে মা!সেখানে গিয়ে বসো।আমার বানানো দোলনা তো অত আরামদায়ক হবে না মা।তা তো শুধু দড়ি আর কাঠের তক্তা দিয়ে বানাবো।তোমার কি ওসবে চড়ার অভ্যেস আছে!অসুবিধে হবে তোমার।তার চেয়ে বরং… ”
“না আমি ছাদের দোলনায় চড়বো না।আমি তোমার নিজের হাতে বানানো দোলনাতেই চড়বো।তুমি যেমন দোলনা বানিয়ে নিজো দোল খেতে ঠিক তেমন করে আমিও দুলব।দাও না বানিয়ে! ”
রায়া তার কথায় অনড় বুঝতে পেরে অগত্যা ঐশী বাধ্য হয়েই পা বাড়ালো বাগানের দিকে।মেয়ের বায়না পূরণের জন্য মা হয়ে এতটুকু সে করতেই পারে।এ আর এমন কি!
বাগানের পুব দিকটায় একটা বড় কামরাঙা গাছ।সে গাছের হলদে ফুলে ছেয়ে গেছে ডালের ভাজে ভাজে লুকিয়ে থাকা সবুজ পাতা।ছোট ছোট ফুল গুলো ঝড়ে পড়ে গাছের তলেও যেন বিছিয়ে দিয়েছে হলুদ গালিচা।তাতেই পা ফেলে ফেলে ঐশী এগিয়ে গেল সেদিকে,হাতে তার লম্বা মতোন একটা মোটা দড়ি আর বেশ বড়-চ্যাপ্টা একটা কাঠের তক্তা।
কাঠের তক্তাটা একপাশে নামিয়ে রেখে যেই না সে কামরাঙা গাছের শক্তপোক্ত একটা ডাল দেখে তাতে দড়ি বাঁধতে যাবে,অমনি সে দেখলো সে ডাল অবধি তো দুর,তার আশেপাশেও ঐশীর হাত পৌঁছাচ্ছে না।লাফিয়ে,ঝাপিয়ে, দুপায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কোনভাবেই হাতে থাকা দড়ি আর গাছে থাকা ডালের মেলবন্ধন সে ঘটাতে পারছেনা।
ঐশী ঠোঁট উল্টে দুহাত কোমড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। সে যে এতটা বেটে তা সে এতদিন বুঝতে পারেনি।আজ বুঝতে পেরে তার মারাত্মক কান্না পাচ্ছে। তার মেয়েটা এত শখ করে একটা দোলনা বানিয়ে চাইলো আর সে তা বানিয়ে দিতে পারছেনা,শুধু মাত্র সে খাটো বলে।ইশশ!কি কষ্ট!
ঐশীর ভাবনার মাঝেই হঠাৎ সে উপলব্ধি করলো সে আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠছে।কি কাহিনী, একা একা সে শুণ্যে উড়ছে কি করে?তার সাথে কি অ্যান্টি গ্র্যাভিটি টাইপ কিছু ঘটছে,এসব আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝে ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছে তাকাতেই সে আবিষ্কার করলো একা উড়ছে না,তাকে হাতে ধরে তুলে ওড়ানো হচ্ছে। আর তাকে ওড়াচ্ছে সায়াহ্ন! এতক্ষণ তার লম্ফঝম্প সবটাই নিজেদের রুমের ব্যালকনি থেকে সায়াহ্ন দেখছিল।তাই দেখে নিজেই নিচে নেমে এসে ঐশী কে ওপরে তুলে ধরেছে সে।কেন ধরেছে তা তার জানা নেই,কেন এসেছে তাও জানেনা,তবু নিজেকে আটকাতে পারেনি,তাই চলে এসেছে।
সায়াহ্নকে এভাবে তার এত কাছে নিজে থেকে আসতে দেখে ঐশীর কিছুক্ষণের জন্য মনে হল সে স্বপ্ন দেখছে।হাতের উল্টো পিঠে চোখ ডলে নিয়ে আবার তাকাতেই যখন সে একই দৃশ্য দেখতে পেল,তখন ঐশী অবাক স্বরে বলে উঠল,
“আপনি!”
সায়াহ্ন কপাল কুচকে বললো,
“না আমার ভুত।আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে না তাকিয়ে থেকে যেটা করতে চাইছিলে সেটা কর।দড়িটা বাঁধ।তোমার এই দশ মণ ওজনের শরীর আর বেশিক্ষণ এভাবে তুলে ধরে থাকলে আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।শহীদ হয়ে যাব!”
ঐশী নাক মুখ কুচকে বলে উঠল,
“কি বললেন,আপনি?আমার শরীরের ওজন দশ মণ!!অসভ্য লোক।আপনি জানেন এক মণে কত কেজি হয়?এক মণে চল্লিশ কেজি,তার মানে দশ মণে হয় চারশ কেজি!আপনি আমাকে চারশ কেজি ওজনের হাতি বলতে চাইছেন সায়াহ্ন? ”
সায়াহ্ন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
“বলতে চাইছি না,আমি বলছিই।তুমি নিঃসন্দেহে হাতি।না না,হাতি তো মেইল ফর্ম,তুমি হাতিনী!বুঝতে পারলে?এবারে দড়িটা বাধ।আমার কোমড় খুলে যাবে এবার।কুইক!”
ঐশী আর কথা বাড়ালো না,ঠোঁট উল্টে সায়াহ্নকে একটা ভেংচি কেটে সামনে ঘুড়লো।গাছের একটা শক্ত চেয়ে ডাল দেখে তাতে অনেক শক্ত বাঁধনে দড়িটা বেঁধে নিজ হাতে টেনে দেখলো ঠিকঠাক আছে কি না!যতই হোক,তার রায়া যে এতে করে দোল খাবে,একটু এদিক ওদিক হলেই তো মেয়েটা চোট পাবে,তা কি আর সে হতে দিতে পারে?একদমই না।যতই হোক সে যে মা!
গাছে দড়ি বাঁধা হয়ে গেলে সায়াহ্ন ঐশীকে নামিয়ে দিল।ঐশীও কাঠের তক্তাটাকে খুব যত্ন করে দড়িতে বাঁধতে লাগলো।তার চোখে মুখে মেয়ের আবদার রাখতে পারার আনন্দ,উৎসাহ!
গাছের সাথে হেলান দিয়ে ঐশীর প্রতিটা ভাবভঙ্গীই ভীষণ তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো সায়াহ্ন। সে ভাবছে এত বড় মেয়ের দোলনায় দোলার এত আগ্রহ কি করে হতয়!তবে তার এ ভাবনা আর দীর্ঘস্থায়ী হলনা।খানিক বাদেই সেখানে এসে উপস্থিত হল রায়া।ছুটে এসে ঐশীকে জড়িয়ে ধরে নিদারুণ আনন্দ নিয়ে বলে উঠল,
“মা,থ্যাঙ্কিউ গো।কি মজা আমিও এবার তোমার মতো হাতে বানানো দোলনায় দুলব!ইয়েএএএএ!”
সায়াহ্ন এতক্ষণে বুঝতে পারলো আসল ঘটনা।ঐশী যে রায়ার জন্যই এত কষ্ট করে দোলনা বাঁধছিল তা ভেবে সে অবাকও হল।শুধু মাত্র লোক দেখানোর জন্য কি এতটা যত্ন কেউ কারো নিতে পারে,কারো জন্য এত কিছু করতে পারে?তাও আবার এমন কারো জন্য যার সাথে রক্তের কোন সম্পর্কই নেই!
আচ্ছা ঐশীর চোখে মুখে রায়ার জন্য সে যে ভালোবাসা,স্নেহ দেখতে পায়,সবটাই কি নাটক,এত নিঁখুত অভিনয় কি করা যায়?জানা নেই। তবে চোখের সামনে ভেসে ওঠা একটা অমায়িক দৃশ্য দেখে সায়াহ্ন সব ভাবনা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে,দৃষ্টি নিবেশিত করলো তার সামনে দাঁড়ানো মা মেয়ের এক মিষ্টি জুটিতে।
রায়া দোলনায় বসে আছে আর তাকে নিজের হাতে দোল দিয়ে যাচ্ছে ঐশী। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না বলেই সায়াহ্নর ধারণা।
তাই কামরাঙা গাছের সুশীতল ছায়াতলে দাঁড়িয়ে গোধূলি রাঙা বিকেলে ঐশী আর রায়ার মধ্যকার এই মধুর বন্ধনই দুচোখ ভরে উপভোগ করে গেল সে।
.
শেষ আষাঢ়ের কিছু ভয়ানক বর্ষণরত দিন।দিন-রাত ছাপিয়ে শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এক অতি অনবদ্য আষাঢ়ে কান্না।সেই কান্নায়ই হয়তো ধুঁয়ে মুছে স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে ধুলোমাখা পিচঢালা রাস্তা,স্নিগ্ধ সবুজ আভায় নিজেদের নতুনরুপে সাজাচ্ছে বৃক্ষরাজি।আকাশের কোল ঘেষে এখন কেবল ধুষর রাঙা মেঘের ছড়াছড়ি। সেই মেঘের আচ্ছাদন যেন প্রকৃতি থেকে গোপণ করে রেখেছে সময়ের বাঁধা সীমা।তাই তো উজ্জ্বল দুপুরবেলাকেও বিষন্ন সন্ধ্যার মতোই অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হচ্ছে ঐশীর কাছে।
থেকে থেকে গর্জে ওঠা ময়ুখমালা কম্পিত করছে তার শরীরকেও,শিহরিত করছে প্রতিটা রোমকুপ!
বাদলা হাওয়া জানালার মধ্যে দিয়ে চোখে-মুখে এসে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়ে যেতেই খুলে রাখা দীঘল কেশরাশি উড়ে চলেছে অনিয়মিত।
তবে এতো কিছুর ভীড়ে,প্রকৃতির বুকে বৃষ্টিকন্যাদের এমন আড়ম্বরপূর্ণ প্রকাশে ঐশীর মাঝে তেমন কোন উদ্দীপনা দেখা দিল না।তার নিস্পৃহ নয়নযুগল কেবল জানালার বাইরে অবসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলো ঝুম ঝুম শব্দে পতিত ধারা,খানিক পর পরই ঝলকে ওঠা বিদ্যুতের মেলা।
ঐশীর এই বিষন্ন দৃষ্টি ক্রমেই বদলে যেতে লাগলো একজোড়া ব্যাথাতুর নয়নের ভাষায়।দৃষ্টির বিষন্নতা ধীরে ধীরে রুপ নিল প্রগাঢ় ব্যাথায়।সেই অসহনীয় ব্যথাতেই ভিজে উঠলো তার ঐ কাজল কালো আঁখি।
তবুও ভিজে আসা চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়াতে দিলনা ঐশী।
তার আগেই বরাবরের মতো নিজেকে সামলে নিল।পলক ঝাপটে ভিজে আসা চোখের ভাষা আড়াল করেই মুখে টানলো প্রশস্ত হাসির রেখা।এতক্ষণের সকল মলিনতা চেহারা থেকে সরিয়ে দিয়ে তার ঠোঁটের সেই মায়াভরা,মনকাড়া হাসি ফুটিয়ে তুলল সুনিপুণ ভাবে।যেন তার কোন কষ্ট নেই,নেই কোন যন্ত্রণা, অপ্রাপ্তি,বিমর্ষতা! অথচ কেউ কখনো জানতেই পারলো না এই বিস্তর হাস্যোজ্জল মুখটার আড়ালেই কত ব্যাথাতুর দিনের কাহিনী লুকিয়ে আছে,না বলা আছে কত না ঘুমোতে পারা রাতের গল্প।
মা-বাবা মারা যাবার পর যখন তাকে অনাথ আশ্রমে রেখে যায় তার বাড়ির লোকজন,তখন তার কতই বা বয়স।মাত্র এক কি দের বছরের ছোট্ট শিশু সে।সে তো এও শুনেছে এত ছোট বাচ্চা হওয়ায় তাকে প্রথমদফায় আশ্রমে নিতেই চায়নি আশ্রমের লোকেরা।অনেক বলেও যখন লাভ হয়না,তখন তার চাচা তাকে ফেলে রেখে যায় আশ্রমের গেটের সামনে।তারপর তার কান্না আর তাড় স্বরে করা চিৎকারে যখন সবাই এসে দেখে এক দেড় বছরের দুধের শিশু এভাবে অবহেলায় মাটিতে লুটিয়ে আছে,তখন খানিকটা মানবতার খাতিরে হোক কিংবা তার শিশুসুলভ মুখাবয়বের মায়ায় পড়ে,আশ্রমে থাকার একটা জায়গা হয় তার!জুটে যায় মাথা গোজার মতো একটা ঠাঁই।
সেখানেই কাটে তার শৈশব,কৈশোর,যৌবন সবটাই।বরাবর প্রচন্ড প্রাণোচ্ছল,হাসিখুশিতে গোটা আশ্রম মাতিয়ে রাখা সেই মেয়েটাকে আশ্রমের সবাই ভালোবাসলেও একটা শুণ্যতা,একটা অভাব বোধ সবসময় তার মনে রয়েই যায়,তা হলো পরিবার নামক সুখের ঠিকানার।তাই তো তার বহুকালের স্বপ্ন ছিল এমন কোন সুখের নিবাস একান্তই তার হয়ে তার জীবনে আসবে!যা আকড়ে ধরে সে বাকিটা জীবন বাঁচবে,লোক দেখানো হাসি না হেসে বাস্তবিকই হাসবে।
আর আজ যখন তার জীবনে সত্যিই পরিবারের অস্তিত্ব আছে,তখন সেই স্বপ্ন সুখের ঠিকানার স্থায়ীত্ব নেই।যখন তখন তাসের ঘরের মতোই ধ্বসে পড়তে পারে তার এই ক্ষণস্থায়ী সুখ নিবাস।
তবে এতে তার কোন কষ্ট নেই,তার এই সুখের ঠিকানায় তার বাস না হলেও তার ছোট্ট রায়ার বাস হলেই সে খুশি।ভীষণ খুশি।
সে তো গোটা জীবনটাই হাসি মুখের আবরণে থেকেই কাটিয়ে দিয়েছে,সেই আবরণের আড়ালে যে কতশত অশ্রুর পাহাড় গড়ে উঠেছে তা তো কারোরই জানা নেই।কেউ জানবেও না কখনো।
তাই বাকি জীবনটাও এমনি করেই মিথ্যে হাসির অভিনয়েই সে কাটিয়ে দিতে পারবে।ঠিক পারবে।তবুও দিনশেষে রায়া,বাবা-মায়ের হাসিমাখা মুখটা,তাদের চোখে মুখে উপচে পড়া প্রাপ্তির ছটাটুকু ভেবেই নাহয় একটিবার সত্যি সত্যি হাসবে সে,প্রাণখুলে,মন ভরে।
ক্ষতি তো কিছু নেই।
আমাদের জীবনটাই তো এমন।একজীবনে এ জীবনের প্রাপ্তির খাতার সবকটা পৃষ্ঠায় কেউই তো দাগ কাটতে পারেনা,কিছু পৃষ্টা ফাঁকা থাকে,শুণ্য পড়ে থাকে অপ্রাপ্তিগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিতে।তফাৎ কেবল এটুকুই কারো কারো জীবনে এই ভরা পৃষ্ঠার সংখ্যা বেশি থাকে,আর কারো জীবনে বিস্তৃতি ছড়ায় ফাঁকা পৃষ্টার সংখ্যা। তবে জীবনের এই প্রাপ্তির খাতার সবকটা পৃষ্ঠা কারোর ক্ষেত্রেই পূর্ণরুপে শুণ্য থাকে না।থাকতে পারেনা।কারণ!ঐ যে প্রকৃতি কখনোই অসমতা করেনা।কখনো না।
ঐশী নাহয় দ্বিতীয় দলের মানুষই হলো,তার ক্ষুদ্র প্রাপ্তিটুকু নাহয় শুধুই রায়ার হাসিতেই সীমাবদ্ধ থাকলো,তাতে ক্ষতির তো কিছুই নেই, তবুও তো প্রাপ্তির খাতার কয়েকটা পাতা এই অতিশয় সুখানুভূতির প্রাপ্তির গল্পে সাজবে।একাকি দিনগুলোতে নাহয় সেই খাতার ভাজে ভাজে জমা পড়া এই খুশিটুকু নিংড়ে নিয়েই হাসবে সে!
ঐশীর এই আকাশকুসুম ভাবনার সুতোয় টান পড়লো তুমুল শব্দে গর্জানো এক তড়িৎ আন্দোলনে।ঐশী হঠাৎ সেই তীব্র শব্দে চমকে গেল।ধুসর আকাশে এলোমেলে ভাবে ছড়িয়ে পড়া ঈষৎ হলদে আলোক রেখার উদ্ভব চোখে পড়তেই দ্রুত দুহাতে কান চেপে ধরলো সে।ক্ষণিকের ব্যবধানে আবার ডেকে উঠল আষাঢ়ে আকাশ।
ঐশী জানালার কাচটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে পর্দা টেনে দিলো তাতে।এলোমেলো চুলগুলোকে দুহাতের বাঁধনে খানিক আয়ত্তে এনে হাতখোপা করে নিয়ে পিছু ফিরতেই চমকে উঠল।দু হাত বুকে চেপে ধরে মাথাটা খানিকটা পিছিয়ে নিল সে।
তার সামনে সায়াহ্ন দাঁড়িয়ে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে সে। তবে ঐশী হঠাৎ খেয়াল করলো,বিগত দিনগুলোর মতো সে দৃষ্টিতে কোন ঘৃণার ছাপ নেই,নেই কোন রাগের ছোয়া।কিন্তু অচেনা এই দৃষ্টির মানে ঐশী ধরতে না পেরে চোখ নামিয়ে নিল নিমেষে।
সায়াহ্ন দুহাত জিন্সের পকেটে গুঁজে বলে উঠল,
“এভাবে বৃষ্টিতে জানালা খুলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছো কেন?সমস্ত শরীরই তো ভিজিয়ে ফেলেছ।এই অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে যদি জ্বর বেধে যায় তো কি হবে শুনি?
তুমি কি জানো না দেশের পরিস্থিতি এখন কেমন?করোনা পরিস্থিতি দিনদিন ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বর জারি বাধালে তোমার সাথে সাথে বাড়ির বাকি মানুষ গুলোরও যে কষ্ট হবে তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়!তার ওপর রায়া আছে এ বাড়িতে।আর কারো না হোক বাচ্চাটার কথা তো চিন্তা কর।এমন ছেলেমানুষী করে সবার জীবন ঝুঁকিতে ফেলার কি কোন মানে আছে? ”
ঐশী প্রশস্ত হাসি হেসে উত্তর দিল,
“কিছু হবে না।আমার অভ্যেস আছে।আশ্রমে এমন কত বৃষ্টিতে ভিজ……হাআআআয়াচ্চু!!”
ঐশী চোখ পিটপিট করে সায়াহ্নর দিকে তাকিয়ে দেখে সে দুহাত বুকে ভাজ করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
ঐশী অপরাধী ভঙ্গিতে একবার সেদিকে চেয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবার বলতে শুরু করে,
“আব..আসলে আমি…ঐ…হাআআআআয়াচ্চু!!”
ঐশী আরো একবার চোখ তুলে সায়াহ্নর দিকে চেয়েই দৃষ্টি সরিয়ে আনে।তৃতীয় বারের মতো কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খোলার আগেই সায়াহ্নর দৃঢ় পুরুষালি হাতের মুঠোয় বন্দী হয় তার হাত।তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজের হাতেই তোয়ালে নাড়িয়ে মুছে দিতে থাকে ঐশীর ভেজা চুল,জলাসিক্ত কাঁধ-গলা।
ঐশী হঠাৎ করেই খেয়াল করে,সায়াহ্নর আচরণ তার প্রতি খুব অদ্ভুত ভাবে পাল্টে যাচ্ছে। কেন,কি কারণে তা সে ধরতে না পারলেও পরিবর্তন টা বেশ ভালো করেই ধরতে পারছে।
তবে ঐশী চায়না সায়াহ্নর তার প্রতি থাকা ধারণাগুলো পাল্টাক।সে এ বাড়িতে রায়ার খুশিটুকু ফিরিয়ে দিতেই এসছে।তার সে কাজটুকু শেষ হলেই তো চলে যাবে সে।মিছিমিছি কাউকে মায়ায় জড়াতে চায়না সে।তাই সায়াহ্নকে কিছুটা রাগিয়ে দিতেই ঐশী বলে উঠল,
“আমার মতো একটা সার্থপর মেয়ের জন্য এত চিন্তা না করলেও হবে আপনার।ছাড়ুন আমাকে।আমি নিজেকে সামলাতে পারি।”
সায়াহ্ন ঐশীর কথা শুনে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।আলতো হাতেই মুছিয়ে দিতে লাগলো তার চুল।চুল মুছিয়ে দেয়া শেষ হলে বলে উঠল,
“তুমি যেমনটা নও,নিজেকে তেমনটা প্রমাণ করার চেষ্টা করোনা।এতে তোমারই মঙ্গল। ”
সায়াহ্নর বলা এই কথার কোন মানেই ঐশী বুঝতে পারলোনা।অবুঝ নয়ন জোড়া তাই এ কথার মানেই খুঁজে যেতে লাগলো সায়াহ্ন নামক সুদর্শন পুরুষটির চোখে,মুখে। তবে হাজার খুঁজেও যখন সে অর্থোদ্ধার করা গেলনা তখন ঐশী হতাশ চোখে চেয়ে রইল কেবল।
সায়াহ্ন সবটাই খেয়াল করলো।তবুও সে চুপ করে রইলো,আর ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলল এক রহস্যময় হাসি।
#চলবে।
[এলোমেলো পর্ব।আমার মাথাও এলোমেলো। দুঃখিত।]