হতে_পারি_বৃষ্টি পর্ব ৬

#হতে পারি বৃষ্টি ❤️
#পর্ব-৬
#লেখনীতে- মৌশ্রী রায়

“রায়া,আম্মু তাড়াতাড়ি খেয়ে রেডি হয়ে নাও তো আম্মু।তোমাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে যাব।”

সকালে ব্রেকফাস্ট করার জন্য নিচে নামার পরেই ডায়নিং টেবিলের সামনে বসে থাকা রায়ার উদ্দেশ্যে কথা গুলো বলে, নিজেও তার ঠিক পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ে সায়াহ্ন।
রায়ার দীর্ঘ ছ’বছরের জীবনে বাবার থেকে শোনা এটাই তার প্রথম আদুরে ডাক,বাবার পাশে এটাই প্রথম বসা।

সায়াহ্নর এমন আমূল পরিবর্তনে রায়া সহ মিস্টার ও মিসেস রহমানও মাত্রাতিরিক্ত বিস্মিত! ওনাদের ছেলে, যে কিনা কাল সকালেও রায়া এ বাড়িতে আছে বলে বাড়ি থেকেই বেড়িয়ে গিয়েছিল সেই আজ রায়াকে এভাবে বলছে!এতটা বদল একরাতে কিকরে সম্ভব তা ভেবেই সকলে অবাক!
তবে সবার চোখে-মুখে সায়াহ্নর ব্যবহারে বিস্ময় খেলে গেলেও ঐশী একদম স্বাভাবিক। সে খুব ভালো করেই জানে সায়াহ্নর এই বদলের কারণ।
রায়ার সাথে সায়াহ্ন যত খারাপ ব্যবহারই করুক,যত অবহেলাই করুক,ও যে রায়ার বাবা তা তো সত্যি। রায়া ওরই অংশ।আর নিজের অংশকে কেউ আর যাই করুক,একটা বাইরের মানুষের উপরে ওঠার সিড়ি হতে দিতে চাইবেনা।
আর সায়াহ্নর দৃষ্টিতে তো ঐশী একজন আউটসাইডারই!আর আজকের পর থেকে লোভী, স্বার্থপরও হয়ে গেছে সে সায়াহ্নর চোখে!
যদিও এতে তার আক্ষেপ নেই।অন্তত সে ছোট হয়েও,ঘৃণার পাত্রী হয়েও যদি রায়া তার জীবনের হারানো সুখ,না পাওয়া আনন্দ গুলো খুঁজে পায় তবে সেটাই তো অনেক!
আর রায়াকে সবটা ফিরিয়ে দেবার প্রথম ধাপটা সে পেড়িয়ে গেছে।কখনো রায়ার সাথে ভালো করে কথা না বলা সায়াহ্ন তাই তো আজ রায়াকে আদুরে কন্ঠে আম্মু বলে ডেকেছে, তার পাশে বসেছে,তাকে নিয়ে নতুন স্কুলে ভর্তি করাতে যেতে চেয়েছে। এই বা কম কিসে?

ঐশীর ভাবনার সুতো কাটলো মিসেস রহমানের কথায়।তিনি সায়াহ্নকে জিজ্ঞেস করলেন,
“দিদিভাই কে নতুন স্কুলে ভর্তি করাবি কেন?ও তো বোর্ডিংয়েই…”

মুখে পোড়া খাবারটা আস্তেধীরে চিবিয়ে নিয়ে তা গলধকরণ করে সায়াহ্ন তার মায়ের প্রশ্নের জবাবে বলে ওঠে,
“আমি রায়ার বোর্ডিংয়ের সিট ক্যান্সেল করিয়েছি। ও আর কোন বোর্ডিংয়ে যাবেনা।ও এখন থেকে এ বাড়িতেই থাকবে,আমাদের সবার সাথে। ”

মিসেস রহমানের এবার মনে হতে লাগলো উনি স্বপ্ন দেখছেন।তাই কনুই দিয়ে মিস্টার রহমানের পেটে একটা গুঁতো দিয়ে ওনাকে নিজের হাতে চিমটি কাটার জন্য বলতেই মিস্টার রহমান ছোট্ট করে হালকা চিমটি কাটলেন ওনার হাতে।উনি খানিকটা ব্যথা পেলেন।তার মানে তো উনি জেগে আছেন। এটা তো স্বপ্ন না।
তবে এটা বাস্তব কি করে হতে পারে তাই বুঝতে পারছেন না উনি।ওনার হঠাৎই মনে হচ্ছে গতরাতের জোলাপের প্রভাবেই সায়াহ্নর মাথাটা গেছে।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে রায়াকে আরেকবার তৈরী হতে বলে সায়াহ্ন নিজের রুমে চলে আসতেই সকলে মিলে ঘিরে ধরলো ঐশীকে।চোখমুখ ভরা বিস্ময় নিয়েই তারা একসাথে প্রশ্ন করে উঠলো,
“এটা কিভাবে হলো!সায়াহ্ন রায়াকে নিজের মুখে এ বাড়িতে থাকতে বলে গেল?এটা সত্যি হয়ে গেল? ”

ঐশী তাদের সকলের কথায় একটা হালকা হাসি ফেরত দিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানাতেই সকলে খুশিতে এক প্রকার লাফিয়ে উঠলো।
আর রায়া!তার কথা তো বলা বাহুল্য। তার চোখে মুখে এত নিদারুন আনন্দের ছটা হয়তো আগে কখনো দেখা যায় নি।বাবার একটু ভালোবাসা,কেয়ারও যে এতটা শান্তির তা এর আগে কখনো অনুভব করার সুযোগ হয়নি তার।তবে আজ এত বছর পর সেই সৌভাগ্য হয়েছে তার আর সে জানে এসব তার মায়ের জন্যই সম্ভব হয়েছে।সে ছাড়া এই অসাধ্য সাধন কখনোই সম্ভব ছিল না।
রায়া দুহাত ছড়িয়ে ঐশীর কোমড় জড়িয়ে ধরে তার সাথে মিশে যায়।ঐশীর শরীরের সাথে নিজের ঘ্রাণেন্দ্রিয়র মিলন ঘটামাত্রই সে অনুভব করে দাদীমার আলমারিতে তোলা তার রিধি মায়ের শাড়ি দিয়ে যেমন মিষ্টি একটা ঘ্রান ভেসে আসে, ঐশীর শরীর থেকেও সেই একই রকম সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।
মুহুর্তেই রায়ার শিশুমনে এই ধারণার জন্ম হয় যে,যারা মা হয়,তাদের শরীরেই এই মিষ্টি সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।
বেশ অনেকক্ষণ রায়ার সাথে লেপ্টে থেকে তার শরীর থেকে ছড়ানো মাতৃসুলভ ঘ্রাণ প্রাণভরে গ্রহণ করে অবশেষে ঐশীকে ছেড়ে দুরে সরে দাড়ায় রায়া।মুচকি হেসে তার চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে,
“তোমার গা থেকে কি সুন্দর একটা গন্ধ করে মা।এই গন্ধটা না রিধি মায়ের শাড়ি থেকেও আসে।এটা কি মা মা গন্ধ? ”
রায়ার নিষ্পাপ মনের বাচ্চাসুলভ প্রশ্নে নির্মল হাসি উপহার দেয় ঐশী। মেয়ে মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
“জানি না মা।তবে তুমি যখন বলছো তখন তাই নিশ্চই!এখন চলো,ঝটপট তৈরী হয়ে নেবে চলো তো।নইলে ইভিনিং স্টার এসে বকবে তো!”

রায়া মাথা নেড়ে সায়া জানায়।তৈরী হবার উদ্দেশ্যে নিজের ঘরের দিকে যেতে নিয়েও থেমে যায়। পিছু ফিরে আবার ঐশী কে আবদারের সুরে বলে ওঠে,
“তুমিও চল না মা আমাদের সাথে! প্লিজ!”

ঐশী কি বলবে বুঝতে পারেনা।তার রায়ার সাথে যাওয়াটা সায়াহ্ন যে ভালো চোখে দেখবে না তা ঐশী জানে।এমনকি এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।রাগ করে সায়াহ্ন রায়াকেও না নিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু সে এটা হতে দিতে পারেনা।তাই রায়াকে বুঝিয়ে শুনিয়ে একা সায়াহ্নর সাথেই তাকে পাঠিয়ে দেয় ঐশী।

আর মায়ের কথা মেনে নিয়ে রায়াও খুশিমনে বেরিয়ে যায় তার বাবার সাথে, জীবনে প্রথমবারের মতো।এত আনন্দ সে কোথায় রাখবে তা ভেবেই কুল পায়না আর!!
.
শহরের সবচেয়ে নামীদামী স্কুলগুলোর মধ্যে থেকে একটাতে আজ ভর্তি হয়েছে রায়া।বাবা তাকে নিজে হাতে ধরে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে গোটা স্কুল।
পার্কিং এরিয়াতে গাড়ি পার্ক করে রেখে বাবা মেয়ে হাত ধরে হেঁটে হেঁটে ঘুরেও বেরিয়েছে বহুক্ষণ,অনেকটা রাস্তা।
পথের ধারে মাথা তুলে দাঁড়ানো সারি সারি গাছের সাথে সায়াহ্ন নিজে থেকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে রায়ার।
মেয়ের সাথে মিলে একসাথে হাওয়াই মিঠাইও কিনে খেয়েছে তারা দুজনে।
রায়ার জীবনে এ সবটাই নতুন হলেও অভুতপুর্ব আনন্দের।অপরিসীম শান্তির।
অন্যদিকে সায়াহ্ন প্রথমটা সবটা বাধ্য হয়ে করলেও এখন আর তার রায়ার প্রতি করা এই স্নেহাচরণ আর বাধ্যবাধকতার মাঝে সীমাবদ্ধ নেই।সে অনুভব করছে,রায়া নামের এই ছোট্ট মেয়েটির প্রতি তার এক অদৃশ্য টান কাজ করছে।তাই এখন তার প্রতিটা আচরণই মন থেকে প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে কোন অভিনয় নেই,কোন বাধ্যতা নেই।সবটাই আর পাঁচটা বাবার আচরণের মতোই স্নিগ্ধ, কোমল,সত্য।
সায়াহ্নর আজ প্রথম মনে হচ্ছে সে এতদিন রায়ার সাথে অন্যায় করেছে, তার মেয়েটাকে অযথা এত কষ্ট দিয়েছে, অকারণেই দুরে সরিয়ে রেখেছে। আর আজ যখন ঐশী নামক মেয়েটির ছলনার আড়ালে থাকা রুপটা বের করে আনার জন্য সায়াহ্ন এই দুরত্ব নিজ হাতে ঘুচিয়ে দিল তখন প্রথমবারের মতো তার মনে হলো বাবা হবার মতো আনন্দ এটৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।আর এতদিন মুর্খামি করে সে যে নিজেকে এই অপার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে তা ভেবেই নিজের প্রতি কিছুটা বিতৃষ্ণা এল তার।তবে রায়ার সামনে তা প্রকাশ করলো না।

তার অকারণ রাগ আর জেদের জন্যই তো বাবা-মা ঐশীর মতো একটা লোভী,স্বার্থান্বেষী মেয়েকে তার জীবনে তার মেয়ের জীবনে নিয়ে এল,যে কিনা নিজের লাভের জন্য সবার বিশ্বাস, ভরসা,স্নেহ,ভালোবাসা নিয়ে খেলা করছে।তবে সায়াহ্ন আর এটা কিছুতেই করবে না।সে ঠিক করে নিয়েছে ঐশী নামক মেয়েটিকে সে আর তার পরিবারকে ঠকাতে দেবেনা।যেভাবেই হোক তার আসল চেহারাটা সবার সামনে বের করে আনবে।আনবেই।
আর তার জন্য তাকে যতদুরই যেতে হোক সে যাবে।
তার ভাবনার মাঝেই রায়া তাকে ইভিনিং স্টার বলে ডেকে উঠতেই সে ঘাড় ফেরালো।রায়া তার ঘন পল্লবাবৃত ছোট দুটো পিটপিটে চোখে তাকিয়ে থেকে সায়াহ্নকে বলে উঠল,
“ইভিনিং স্টার? তোমার কি মন খারাপ?চুপ কেন?”

সায়াহ্ন হালকা হেসে রায়ার মাথায় হাত রেখে বলে ওঠে,
“না মা মন খারাপ না।মা,তোমার বাবা তোমার কাছে সরি সোনা,বাবা তোমাকে অনেক হার্ট করেছে। প্লিজ বাবাকে ক্ষমা করে দাও!”

রায়া আগের মতোই চোখ পিটপিট করে চেয়ে বলে ওঠে,
“তুমি তো কোন ভুলই করনি,তো ক্ষমা কেন চাইছ?আমি তো হার্ট হইনা কখনো।আর তুমি তো যা যা করেছো সব আমাকে ব্রেভ বানাতেই করেছ।দাদীমা তো আমাকে বলেছে।তাই তো আমি স্ট্রং গার্ল।জানোতো দাদীমা বলতো যেদিন আমি একদম স্ট্রং হয়ে যাব সেদিনই তুমি আবার আমাকে রাগ না করে আদর করবে,বকা না দিয়ে ভালোবাসবে।দেখ আজ তো তুমি আমাকে বকছোনা,রাগ দেখাচ্ছ না।বরং আদর করছো,ভালোবাসছো।তার মানে আমি একদম ব্রেভ গার্ল হয়ে গেছি তাইনা?”

সায়াহ্ন হালকা হেসে মেয়ের চোখের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল রায়ার চোখে মুখে অবিকল রিধির ছোঁয়া। তার মতোই স্বচ্ছতা, কোন জটিলতা নেই।সায়াহ্নর আবার আক্ষেপ হল।নিজের রাগের জন্য নিজের প্রতি তৈরি হল বিতৃষ্ণাও। রায়ার সম্পুর্ণ শৈশবটাই সে ভয়ানকভাবে মিস করে গেছে অথচ এই শৈশবটাই তাকে রায়ার মধ্য দিয়ে রিধিকে পুরোদমে অনুভব করার, রিধির উপস্থিতি উপভোগ করার সুযোগ দিতে পারতো,তবে তা সে নিজ হাতেই নষ্ট করেছে।
তবে অতীত নিয়ে এখন আফসোস করে তো লাভ নেই।যা চলে গেছে তা তো আর ফেরানো যাবেনা।
কিন্তু সায়াহ্ন আর তার বর্তমানকে হাতছাড়া করবে না।সে এখন,এই মুহূর্ত থেকে নিজের পিতৃত্বের সুখ সম্পুর্ণ রুপে অনুভব করবে।নিজের মেয়েকে করা সব অবহেলা চারগুণ ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দেবে।
তাকে দিয়ে যাওয়া রিধির এই বেস্ট উপহারটাকে সে আর আঘাত করবে না।একদমই না।বরং ভালোবেসে আগলে নেবে বুকে।
আর সায়াহ্ন ঠিক তাই করলো।সেদিনের পর থেকে তার রায়ার প্রতি এক অন্যরকম অনুভূতি প্রকাশ পেল।পিতৃত্বের মোহময় সুখটুকু সগর্বে শুষে নিতে লাগলো নিজের প্রতিটা শ্বাসে প্রশ্বাসে।
আর তারপরেই বাবা-মেয়ের দীর্ঘ বিচ্ছেদ কাটিয়ে তাদের সম্পর্ক এক নতুন মোড় পেল।নতুন সূচনালগ্ন সুত্রপাত ঘটালো বাবা-মেয়ের মায়া জড়ানো সম্পর্কের,তাদের ভালোবাসার বন্ধনের।

আর আড়ালে এসবটা দেখে নীরবে তৃপ্তির শ্বাস ফেলতে লাগলো একজন।সে আর কেউ না,ঐশী।

#চলবে

[ছোট হয়ে গেছে! দুঃখিত!কিন্তু আমি খুবই অসুস্থ। লিখতে ইচ্ছে করছিলনা।কিন্তু অপেক্ষা করে আছেন অনেকেই তাই এটুকুই লিখলাম বহু কষ্টে।
তাই কেউ পঅব ছোট বলে লজ্জা দেবেন না।
শরীর ভালো হলে আগামী পর্ব বড় করে দেব।আর দুদিনের আগে মনে হয় না পরের পর্ব দিতে পারব।তাই কেউ অপেক্ষা করবেন না।
আর গঠনমুলক মন্তব্য আশা করছি। ধন্যবাদ সবাইকে।
হ্যাপি রিডিং]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here