হতে_পারি_বৃষ্টি পর্ব শেষ

#হতে পারি বৃষ্টি ❤️
#পর্বঃ১০ (অন্তিম পর্ব)
#লেখনীতেঃ মৌশ্রী রায়

“শুভ জন্মদিন মা।জন্মদিনের অনেক অনেক শুভকামনা জানাই তোমাকে। আর তোমার এই মেয়ের পক্ষ থেকে তোমার জন্য আছে অনেক ভালোবাসা মা।আই লাভ ইউ!”

রায়ার কথায় ঐশীর চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে আনন্দাশ্রু। তার এই ছোট্ট জীবনে অনেক ছোট বড় পাওয়ার মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হলো তার এই মেয়েটি।রায়াকে কাছে পেলেই যেন তার সব কষ্ট,সব দুঃখ একদম হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তার সব কষ্টের অনুভূতি গুলো যেন রায়ার ঐ মায়াবী মুখশ্রী আর ভালোবাসার স্বরে ডাকা মা ডাকটাই শুষে নেয়।

এই যেমন এখন, ঐশীর খুব মন খারাপ করছে।
বিগত তিনটে বছর থেকে সে তার প্রিয় মানুষটাকে একটা বারের জন্যও চোখের দেখা দেখেনি।রাগে জেদে সেও যা না তা বলে দিল,আর সে মানুষটিও তার সামনে আর কখনো আসলোনা।
ঐশীর মাঝেমাঝে খুব মন খারাপ হয়।তার মন বলে, সে না হয় রাগের মাথায় অতগুলো কথা বলে দিল,তাই বলে কি সায়াহ্ন একটাবারও তার কাছে ছুটে আসবেনা?তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে তার অভিমানটুকু ভাঙাবেনা?কেন?
পরক্ষণেই তীব্র অভিমানে ঐশীর অন্তরের গোপন সত্তাটি বলে ওঠে,মানুষ তারই রাগ,অভিমানের দাম দেয় ঐশী যাদের সে ভালোবাসে।সায়াহ্ন কি তোমাকে কখনো ভালোবেসেছে?তবে তার থেকে এমন ব্যবহার তুমি কিকরে আশা কর?
ঐশী অবচেতন মনের সাথে একমত হয়।সত্যি তো!সায়াহ্ন তো আর তাকে ভালোবাসেনা।ভালোবাসেনি কখনো।তবে,সে দুরে থাক বা কাছে তাতে কি সায়াহ্নর কিছু আসে যায়?বরং সে হয়তো বেঁচে গেছে একপ্রকার!
ঐশী নামের কাঁটাটা যে তার পথ থেকে নিজের থেকেই সরে এসেছে,এতে হয়তো মানুষ টা শান্তিতেই আছে।
কথাগুলো মনের দর্পনে প্রতিফলিত হতেই প্রচন্ড অভিমানে ঐশীর চোখ ভিজে আসে।কষ্টে বুকের ভেতরটা পুড়ে ওঠে।গলায় আটকে আসে দলা পাকানো কান্না।
তবে ঐ যে,তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় প্রাপ্তি,তার মেয়েটা,তার রায়ার মুখের হাসি দেখলেই এই সব কষ্ট কোথায় যেন নিমেষেই মিলিয়ে যায় তার।তখন তার মনের দুঃখ কষ্ট সব ধুঁয়ে যায় মাতৃত্বের মোহময় আস্বাদনে।

ঐশীর ভাবনার সুতোতে টান পড়ে রায়ার মিহি মায়াময় কন্ঠস্বরে।সে অতি অনুনয়ের স্বরে তার মাকে বলে ওঠে,
“মা,আজ তো তোমার জন্মদিন।আজ একজন যদি তোমার সামনে আসতে চায়,তোমার সাথে একটাবার দেখা করতে চায়,কথা বলতে চায়,তবে কি তুমি আজও তাকে ফিরিয়ে দেবে মা?প্লিজ আজ আর তাকে ফিরিওনা মা।আজ সবটা ভুলে একবার তাকে তার কথা গুলো বলার সুযোগ করে দাও।আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তো খুনের আসামীকেও দেয়া হয়।তবে বাবার কি একটাবার সে সুযোগটা পাওয়া উচিত না মা?বল!”

রায়ার কথায় তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায় ঐশী। তার কথার মানে বুঝে নিয়ে ভ্রুযুগলের মধ্যে থাকা ভাজ আরো বিস্তৃত হয়।অবাক কন্ঠে বলে,
“বাবাকে সুযোগ দেব মানে?তোমার বাবা কি আজ এখানে এসেছে রায়া?কোথায় সে?”

রায়া মাথা নেড়ে সায় জানাতেই আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসে সায়াহ্ন। মা মেয়ের থেকে খানিকটা দুরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয় সে।
ওদিকে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিতা এক শুভ্র যুবককে দেখেই বুকের ভেতরটা টালমাটাল স্রোতে দুলে ওঠে ঐশীর। এই সেই কাঙ্ক্ষিত মুখশ্রী যা একটাবার প্রত্যক্ষ করার তীব্র বাসনায় কত শত নির্ঘুম রাত্রি পার করেছে সে।ইশশ!কি শান্তি এই মুখে।ভালোবাসার মানুষের মুখাবয়ব দৃষ্টি গোচর হলে এত শান্তি হয় বুঝি?
ভেতরে ভেতরে খুশিতে মনের প্রতিটা কোণ নেচে উঠলেও বাইরে গভীর গাম্ভীর্য চেহারায় প্রস্ফুটিত করে ঐশী বলে ওঠে,
“তোমার বাবা হঠাৎ কি মনে করে আমার সামনে এলেন রায়া?তাকে তো বহুদিন আগেই আমি মুক্তি দিয়ে দিয়েছি। আবার কি নতুন করে দয়া করতে এসেছেন উনি?”

সায়াহ্নর চোখ ছলছল করে ওঠে।এত রাগ,এত অভিমান আজও মেয়েটা পুষে রেখেছে তার প্রতি?আচ্ছা ঐশী কি কখনো বুঝবেনা সায়াহ্ন কি চায়?তার মনে ঐশীর জন্য কি রয়েছে?শুধু কি এতবছর আগের ঐ একটা ভুল ধারণাকে পুঁজি করে আজীবন অভিমান করেই রয়ে যাবে ঐশী?
পরক্ষণেই সায়াহ্নর মনে হয় মানুষ তার ওপরেই দিনের পর দির অভিমান করে থাকতে পারে,তার বিরুদ্ধেই বহু যত্নে অভিযোগের পসরা সাজাতে যাকে তারা ভালোবাসে।
তারমানে ঐশীও তাকে ভালোবাসে।খুব খুব ভালোবাসে।কথাগুলো স্নায়ুশিরায় হানা দিতেই ঐশীর দিকে সহাস্যে তাকায় সে।ঐশীর দৃষ্টিও তার প্রতি নিবদ্ধ।
তাদের দুজনের অভিমানের পালা শেষ করতে দিয়ে রায়া সেখান থেকে সরে আসে অতি সন্তর্পনে।
রায়া চলে যেতেই গুটিগুটি পায়ে ঐশীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সায়াহ্ন। সে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় ঐশী। সায়াহ্ন কাঁপাস্বরে বলে ওঠে,
“কথা বলবেনা আমার সাথে? এখনো অভিমান করে থাকবে?”
ঐশী উত্তর দেয়না।টালমাটাল অভিমানের পসরা নিয়েই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে সে।সায়াহ্ন নিজেই আবার বলে ওঠে,
“আমার কথাগুলো কি একটাবার শুনবেনা ঐশী? প্লিজ।একবার আমার না বলা কথা গুলো শুনে দেখ।কথা দিচ্ছি সবটা শুনেও যদি তোমার মনে হয় যে আমার সাথে তুমি কথা বলতে চাওনা তবে বলো না।আমিও আর জোর করবোনা।”

ঐশী ফুঁসে ওঠে।রাগত স্বরে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ তাই তো!আমি কথা না বললে তো সুবিধাই হয় আপনার।আমি কি আর সেসব জানিনা?এতই যখন আমাকে সব বলার শখ তখন তিনটে বছর কেন এলেন না শুনি?কেন জানানোর চেষ্টা করলেন না সবটা।বলুন,কেন?”

সায়াহ্ন ম্লান হেসে জবাব দেয়,
“তুমিই তো আসার আগে বলে এসেছিলে,আমার মুখ কোনদিন আর দেখতে চাওনা তুমি।আমার কন্ঠস্বরটাও আর কখনো যেন কর্ণগোচর না হয় তোমার।তবে তুমি নিজেকে শেষ করে দেবে।এটা জেনেও আর কোন সাহসে আসতাম তোমার সামনে সবটা জানাতে বলতো!বিশ্বাস কর,তুমি যে এতদিন দুরে ছিলে,তবুও লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায় আমি তোমায় একবার দেখে যেতাম।এটাই তো অনেক আমার কাছে।তোমাকে চোখের পলক দেখতে পেলেই আর কিছু চাইবার নেই আমার।কিন্তু সবটা তোমাকে জানাতে এসে যদি সত্যি সত্যিই তুমি নিজের কোন ক্ষতি করে বসতে তখন আমি কি নিয়ে বাঁচতাম বলতো!”
ঐশীর চোখের জল বাঁধনহারা হয়ে গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।জীবনে এ প্রথমবার নিজের জমে থাকা কষ্টটুকুকে কারো সম্মুখেই জল হয়ে গড়াতে দিল সে।ভালোবাসার মানুষ টার সামনে কোন বাঁধা কাজ করেনা তাই কি এমন টা হল আজ!কে জানে?
ভেজা কন্ঠে ঐশী বলে ওঠে,
“তো আজ এলেন কেন?এই এতগুলো বছর পরে?”
সায়াহ্ন পুর্বের ন্যায় ম্লান হেসেই জবাব দেয়,
“আজও আসতাম না তো।তোমার ঐ একটা বাঁধায় হয়তো আজীবন বেঁধে থাকতাম।কিন্তু রায়া,ও বললো জানো তো আজ তোমার সামনে এলে তুমি আর রেগে থাকতে পারবে না ঐশী।ঠিক কথা বলবে আমার সাথে। দেখ,তাই তো হচ্ছে। আমাদের মেয়েটা একদম তোমার মতো হয়েছে জানো তো!ওর মাঝে মন ভালো করে দেবার অদ্ভুত এক ম্যাজিক আছে।দেখ আজ এতদিন পরে কেমন ম্যাজিকের মতো আমাকে তোমার সামনে নিয়ে এলো।এটা ম্যাজিকই তো!যা কখনো সম্ভব বলে মনে হয়না যখন আমাদের জীবনে তাই বাস্তবতার রুপ নেয় তখন সেটাকেই তো আমরা ম্যাজিক বলি!আর এই ম্যাজিক যে করে সেই তো ম্যাজিশিয়ান।সেদিক থেকে আমাদের রায়াও কিন্তু একজন ম্যাজিশিয়ান।আমাদের মন ভালো করার ম্যাজিশিয়ান! ”

ঐশীর ভেজা চোখেও মুখের ভাষা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে পেরেছে।সায়াহ্নর মনে নিজের মেয়ের জন্য এক দৃঢ় স্থান তৈরী করতে সে পেরেছে।সায়াহ্নর মনে যে রায়াকে নিয়ে আর কোন সংসয় নেই ভেবেই আনন্দে ঐশী বুক ভরে শ্বাস নেয়।তারপর ঠোঁট উল্টে হালকা অভিমানের স্বরে বলে,
“আমি নাহয় রাগের মাথায় বলেছিলামই,তাই বলে আপনি সবটা মেনে নেবেন।একটাবার চেষ্টা করবেন না আমার ভুল ধারণা হোক বা যাই হোক সেটা ভাঙার?এমন ভাব আপনার যেন আমার সব কথা আপনি শোনেন!আমি যদি এক্ষুনি বলি আমাকে ভালোবাসতেই হবে,নইলে আমি আপনার সামনেই নিজেকে শেষ করে দেব!তবে?আপনি কি নাচতে নাচতে ভালোবাসবেন আমাকে?হুহহ্!বুঝি তো বুঝি!সবই বুঝি।আমার থেকে দুরে থাকতে চেয়েছিলেন তাই ছিলেন।এখন অযথাই আমার সেই রাগের মাথায় বলা কথার বাহানা দিচ্ছেন। আপনি না থাকলে তো আপনি খুশিই হন।আমি কি আর তা জানি না?”

সায়াহ্ন এবার বিস্তর হাসে।ঐশীর দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দুজনের মধ্যকার দুরত্বটা ঘুচিয়ে আনে বেশ অনেকখানি। দুহাতে ঐশীর কোমড় আকড়ে ধরে তাকে নিজের দিকে খানিকটা টেনে নিয়ে বাদবাকি ফাঁকটুকুও মুছে দেয় সে।ফিচেল কন্ঠে বলে ওঠে,
“বউয়ের থেকে দুরে সরে থাকতে কোন প্রেমিকপুরুষই পছন্দ করে না।আর রইলো বাকি তোমার কাছে আসার কথা, তো জেনে রাখ,যদি নিজের ক্ষতি করার হুমকি সেদিন রাতে আমাকে না দিতে তুমি!তবে তোমাকে কিডন্যাপ করিয়ে হলেও আমার কাছে নিয়ে যেতাম।কিন্তু আমার কাছে সবকিছুর আগেই তুমি।কোন কিছুর বিনিময়ে তাই তোমাকে হারাতে চাইনি আমি বুঝলে?তাই তো তোমার বারণ মেনেই এতদিন সামনে আসিনি তোমার!

আর কি যেন?আমি তোমার সবকথা শুনি কিনা?তাইতো?তবে শোন, ভেবে দেখ বিয়ের পরদিন রাতেই আমাকে যেভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুড়িয়েছ তুমি তারপর তো তোমার কথা না শুনলেই আবার কি না কি করে বস,সে ভয়ে তটস্থ থাকতাম আমি।
তাই মনে করে দেখ,সে রাতের পর থেকে বাধ্য হয়েই হোক আর স্বেচ্ছায়, তোমার সব কথাই শুনেছি আমি।
হ্যাঁ,প্রথম প্রথম তোমার বলা ঐসব লোভ,স্বার্থ হোয়াটেভার ওসব ফাউল কথায় রাগ হত,মিথ্যে বলবনা খানিকটা ঘৃণাও এসেছিল তোমার প্রতি,একটা ছোট বাচ্চা মেয়েকে অবলম্বন করে আমাদের বাড়িতে থাকার যে পরিকল্পনা সাজিয়েছিলে তুমি আমার চোখের সামনে,তা জেনে যে কেউই তোমার বিষয়ে অমনটাই ভাববে।আর সে মেয়েটা যদি নিজের মেয়ে হয় তবে তো কথাই নেই।তখন তো আর আমি আপনাকে চিনতাম না তাই না,আপনাকে বুঝতাম না।তাই ওটুকু ভুল বুঝে ফেলেছি।তার জন্য সরি।তবুও মনে করে দেখ তোমার কোন কথাই ফেলতাম না আমি।
আর কি? ও হ্যাঁ,তোমাকে ভালোবাসার কথা!তোমাকে কখনো বলতে হত না ঐশী,আমি তোমার বলার আগেই তোমাকে ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।আমার তোমাকে ভালোবাসারই ছিল,তোমার প্রেমে পড়ারই ছিল। কারণ তুমি এমনই কেউ যাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না!”

ঐশী দুহাতে নিজের কোমড় থেকে সায়াহ্নর হাতের বাঁধন সরাতে চাইল,তবে অনেক নড়েচড়েও কোন লাভ হলনা।তখন আবার অভিমানী স্বরে বলে উঠল,
“ছাড়ুন তো!যান!হুহহহ্!আমি মনে হয় বোকা,আমি কিছুই জানিনা?তাইনা?সব ভালোবাসা কি আর এমনি এমনি এসেছে?সবটাই এসেছে আমার ঐ ডায়েরি পড়ে।নইলে রাতারাতি সব রাগ,সব ঘৃণা,সব ভুল ধারণা এমন কর্পুরের মতো উবে যায় নাকি?আমি কি গাঁধা?”
সায়াহ্ন সাবলীল কন্ঠে প্রত্তুত্তর করলো,
“আজ্ঞে হ্যাঁ,তুমি গাঁধা।শুধু গাঁধা না,উন্নতমানের গাঁধা।”
ঐশী ঠোঁট উল্টে রাগী চোখে সায়াহ্নর দিকে তাকাতেই সায়াহ্ন মিষ্টি করে হাসলো।কোমড়ে রাখা হাতের স্থান বদল ঘটিয়ে দুহাত রাখলো ঐশীর দু গালে।নিদারুণ কোমল কন্ঠে বলে উঠল,
“তোমার ডায়েরি পড়ে কেবল তোমার বলা মিথ্যা কথা গুলো ধরতে পেরেছিলাম আমি ঐশী। তোমার মনের কোথাও যে অর্থ প্রাচুর্যের কোন লালসা নেই,এই বোধটুকু ছাড়া আর কোন কিছুই আমার মনে জাগাতে পারেনি তোমার ডায়েরি।হ্যাঁ,ডায়েরিটা পড়ে তোমাকে নিয়ে থাকা আমার ভুল ধারণাগুলো ভেঙেছে বৈ কি!তবে তার থেকে বেশি আর কিছুই না।মনে রেখ,কতগুলো কালো অক্ষরের এত সাধ্য থাকে না যে রাতারাতি কারো মনের মাঝে নতুন করে অনুভুতির জন্ম দিতে পারে!আমার মনে যদি তোমার জন্য কোন কোমল স্থান না থাকে তবে একটা কেন,অমন হাজার খানিক ডায়েরিতেও মনের মাঝে প্রেমের পদ্ম ফুটবেনা ঐশী।সেটা সম্ভব না।কেবল মন থেকে আসা অনুভুতির কারণেই আমরা ভালোবাসি।আমিও সেই মনের তাড়নাতেই তোমাকেই ভালোবাসি। তোমার জন্য একান্ত গোপন কিছু স্থান সাজাই আমার মনের মণিকোঠায়, তেমনভাবেই যেভাবে তুমি চাইতে।যে স্থানে কেবল আর কেবল তোমারই আধিপত্য থাকবে।শুধুই তোমার।
এতে তোমার ডায়েরি পড়া বা না পড়া,কোনটারই প্রভাব নেই।
আমি কোনদিনও তোমাকে দয়া করিনি। সে ভাবনাও কখনো আসেনি আমার হৃদয়ে।আমি যে মুহুর্ত থেকে বুঝতে পেরেছি,যে শুধু মাত্র রায়াকে তার সবটা ফিরিয়ে দিতে নিজের মাথায় এত বড় একটা কলঙ্ক চাপিয়েছ তুমি,কোন অন্যায় না করেও আমার চোখে ঘৃণার পাত্রী হিসেবে সাজিয়েছ নিজেকে সেদিন,সে মুহূর্ত থেকে আমার মনে তোমার জন্য কেবল সম্মানই ছিল।আর তোমার সাথে থাকতে থাকতে,তোমাকে বুঝতে বুঝতে কখন যে সে সম্মানের অনুভুতি কে ছাপিয়ে নতুন অনুভুতির সৃষ্টি হয়েছে আমার মনে,ধীরে ধীরে জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে তোমার মায়ায়,পড়ে গেছি তোমার প্রেমে,ভালোবেসে ফেলেছি তোমায় তা বুঝতেই পারিনি।
আর যখন বুঝতে পারলাম তখন তুমি কিছু বুঝতে চাইলে না।আমাকে কিছু বলার সুযোগটা না দিয়েই চলে এলে আমাকে একা ফেলে।”

ঐশীর দুচোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে ক্রমাগত।আজ সে খুশি খুব খুশি। তবুও সে কাঁদছে।হাজার চেষ্টা করেও চোখের জল আটকাতে পারছেনা।সে চোখের জলটুকু মুছতে নেবে তার আগেই সায়াহ্ন আবার বলে ওঠে,
“আজ আর মুছোনা এই অশ্রু কণাকে।এদের নিজের মতো ঝড়তে দাও।এরা যে আনন্দাশ্রু। এদের ঝড়ে পড়ে প্রকাশ করতে দাও তোমার আনন্দটুকু।”

ঐশী কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলে ওঠে,
“আপনি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন সায়াহ্ন? এতটা সুখও আমার ভাগ্যে লেখা ছিল?আমি তো ভাবতেই পারিনি!আমার জীবনের প্রতিটা স্তরেই তো আমি পুড়েছি,কষ্ট,গ্লানির সীমাহীন আঁচে।কখনো বা অবিশ্বাস আর ঘৃণার তীব্র তাপে ঝলসে গেছে মন,দগ্ধ হয়েছি আমি,সেই আমার জীবনে এই ভালোবাসার আগমণ কি তবে সত্যি আজ ঘটলো সায়াহ্ন? বলুন না?”
সায়াহ্ন পূর্বাপেক্ষা মোলায়েম স্বরে বলে ওঠে,
“তোমার জীবনের পুরনো দিনগুলোতে তোমাকে হয়তো অনেক কষ্ট সইতে হয়েছে,দুঃখ কষ্টের তীব্র তাপে পুড়তে হয়েছে!হতেই পারে,কারণ তখন তো আর আমি ছিলাম না তোমার জীবনে।মানছি আমি আসার পরেও কম কষ্ট পাওনি তুমি।প্রতিটা মুহুর্তে জ্বলতে হয়েছে তোমায় ঘৃণার অনলে,তবে তখন যে আমি তোমায় ঘৃণা করতাম সে আমির কোন অস্তিত্ব আর এখন নেই।এখন যে আমি আছি,সে শুধুই ঐশী নামের একটা জাদুপরী কে ভালোবাসে,খুব ভালোবাসে।তাই পুরনো দিনের সব কষ্টকে ভুলে যাও।তোমার সব কষ্টের আঁচকে নিভিয়ে দিতে আমি #হতে_পারি_বৃষ্টি ঐশী।ভালোবাসার বৃষ্টি।যে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে তোমার সব না পাওয়া, সব ব্যাথা ধুঁয়ে দেব আমি।কথা দিচ্ছি, তোমাকে খুব খুব ভালোবাসব।খুব।”

ঐশী আর আটকাতে পারলো না নিজেকে।ভালোবাসার মানুষটার মুখে ভালোবাসার এমন আবেগময় স্বীকারোক্তি শুনে আবেশে জড়িয়ে ধরলো তাকে।দুহাত সায়াহ্নর পিঠে ঠেকিয়ে লেপ্টে রইলো পরম ভালোবাসায়।
সায়াহ্নও দুহাতে আগলে নিল তার প্রিয়তমাকে।আজ অনেক অপেক্ষা, অনেক মান অভিমানের পাহাড় ডিঙিয়ে অবশেষে পরিণতি পেল তাদের ভালোবাসা,অবশেষে হয়ে উঠলো,তাদের একে অপরের কাছে আসা।আর তাদের এই মিলনের সাক্ষী হয়ে রইলো,শারদ আকাশ,বাতাসের তালে মাতোয়ারা কাশ,আর নদীর স্বচ্ছ জল।
.
“রায়া ঘুমিয়ে পড়েছে?”
সায়াহ্নর ধীরকন্ঠ শুনে পিছু ফিরে চাইলো ঐশী। সামনে ফিরে ঘুমন্ত রায়ার নিষ্পাপ মুখখানি একবার গভীর মমতা নিয়ে দেখে নিল সে।রায়ার কপালে একটা স্নেহের পরশ দিয়ে পায়ের দিক থেকে কাঁথাটা টেনে দিল গলা অবধি তার।মেয়ের মাথায় পরম মমতায় আরো দু বার হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে।
সায়াহ্নর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলে উঠল,
“হ্যাঁ,কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়লো।অনেক খুশি ও আজ জানেন তো,আমাকে নিয়ে আবার এ বাড়িতে ফিরতে পেরেছে বলে।ওর চোখে মুখের উথলে পড়া খুশিটুকু দেখে আমার কি যে আনন্দ লাগছে!শান্তিতে মন প্রাণ সব জুড়িয়ে যাচ্ছে! ”

সায়াহ্ন হাসি মুখে খানিক তাকিয়ে রইলো তার প্রাণেশ্বরীর সহাস্য মুখপানে।কত অল্পেই মেয়েটার চেহারা কানায় কানায় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে!ইশশ!কতটা ভাগ্যবান সে,এমন একটা জীবন সঙ্গী পেয়ে ভেবেই হাসি আরো দীর্ঘ হয় তার।
তাকে হাসিমুখে চেয়ে থাকতে দেখে ঐশী বলে ওঠে,
“ওভাবে কি দেখছেন?”
সায়াহ্ন মাথা নেড়ে কিছু না বোঝায়।তারপর ঐশীর দিকে হাত বাড়িয়ে তিয়ে বলে ওঠে,
“আস রাতের আকাশ দেখি।”
ঐশীও হাসি মুখে আকড়ে নেয় প্রিয় মানুষটির হাত।একসাথে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই সায়াহ্ন পাশে রাখা মোড়াটায় বসে ঐশীকে কাছে টেনে বসিয়ে নেয় নিজের কোলে।পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,
“বারোটা বাজতে তো এখনো মিনিট পনের বাকি!আজ তো তোমাকে এখনো উইশই করিনি আমি ঐশী!যাই হোক বাকি কাজটা তবে এখন করে ফেলি!
শুভ জন্মদিন প্রিয়তমা।আমি এমন আরো অনেক জন্মদিন তোমার সাথে একসাথে কাটাতে চাই প্রাণপ্রিয়া!তোমার হাতে হাত রেখে চলতে চাই প্রাণেশ্বরী!”
সায়াহ্নর বলা কথায় ঐশী লাজুক হাসে।লাজুকতা ভরা কন্ঠেই বলে ওঠে,
“আমিও তাই চাই সায়াহ্ন! আমার জীবনের এমন সব কটা জন্মদিনে আপনার এই ভালোবাসার সঙ্গই আমি চাই।খুব করে চাই!”
সায়াহ্ন হাতের বাঁধন আরো কিছুটা দৃঢ় করে জিজ্ঞেস করে বসে,
“জন্মদিনে কি উপহার চাই বল!যা চাইবে তাই দেব!”
ঐশী হাসি মুখে জবাব দেয়,
“আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার তো আপনি আমাকে আমার এবারের জন্মদিনেই দিয়েছেন সায়াহ্ন, স্বামী -সন্তান সবাইকে নিয়ে এক সাথে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন।শুধু তাই নয়,আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসাও যে আজ আমাকে দিয়েছেন আপনি।এর বেশি আমার আর কিই বা চাওয়ার থাকতে পারে বলুন।তবুও যদি একান্তই কিছু দিতে চান,তবে আপনার মিষ্টি কন্ঠে একটা সুন্দর গান শোনান।সেটাই হবে আমার জন্য সবচেয়ে দামী উপহার।”

সায়াহ্ন হাসে।তৃপ্তির হাসি।সে যে তার মনের মাঝে সযত্নে থাকা ভালোবাসার স্থানটা একদম সঠিক ব্যক্তিকেই দিয়েছে তা নিয়ে সে নিশ্চিত, আর এই নিশ্চয়তাই তৃপ্তির স্পর্শ বুলিয়ে যাচ্ছে তার চোখে-মুখে। সায়াহ্ন তৃপ্তি নিয়েই হাসে।হাসিমুখেই গান ধরে তার প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে, তার ক্ষুদ্র চাওয়া পূরণে।
আর তার কিঙ্কর সঙ্গীত ধ্বনীই এই নীরব শারদ নিশিথের পরতে পরতে ছড়িয়ে দেয় ভালোবাসার বৃষ্টি হয়ে ওঠার গল্প,প্রেমের বর্ষায় প্রিয়জনকে ভালোবাসার গল্প।
আর সেই গানের সুরেই প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়ে প্রিয়তমর বুকে লেপ্টে রয় ঐশী,আর আবেশিত চিত্তে উপলব্ধি করে যায় প্রিয়তমর বলা গানের প্রতিটা কথা,প্রতিটা স্পন্দিত সুরের ছটা।

হতে পারি রোদ্দুর
#হতে_পারি_বৃষ্টি
হতে পারি রাস্তা
তোমারই জন্যে

হতে পারি বদনাম
হতে পারি ডাকনাম
হতে পারি সত্যি
তোমারই জন্যে

হতে পারি গল্প
তুমি কাছে টানলে
হতে পারি জানলা
এ হাওয়াও তোমার কারণে

শুধু তুমি চাও যদি
সাজাবো আবার নদী
এসেছি হাজার বারণে

শুধু তোমারই জন্যে
শুধু তোমারই জন্যে…

💙সমাপ্ত💙

[যাক,অবশেষে এই গল্পটাও শেষ করলাম।অনেকে ভাবতে পারেন,এত দ্রুতই কেন শেষ করলাম,তাদের বলব আমি গল্পের থিম এটুকুই ভেবে রেখেছিলাম।এর বেশি লিখলে তাই লেখা নিজের সৌন্দর্য হারাবে।তাই এখানেই ইতি টানলাম গল্পের।আশা করি শেষটা সবার ভালোই লেগেছে।যদি আপনাদের মনের মতো করে সমাপ্তি না টানতে পারি তবে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। 😔
আমার এই গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি আমাকে আপনারা সবাই অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন,অনেক সাপোর্ট করেছেন।তাই আশা করব এই অন্তিম পর্বেও আপনাদের সেই একই ভালোবাসা,একই সাপোর্ট পাব আমি।
তাই সকলের কাছ থেকে কিছু গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।
কেমন লাগলো এ গল্পটা পড়ে তা সবাই জানাবেন আমাকে।
ভালোবাসা সবার জন্য। হ্যাপি রিডিং।
আর হ্যাঁ,নতুন গল্প নিয়ে খুব জলদিই হয়তো হাজির হব আবার।ততক্ষণ আমার জন্য দোয়া করবেন।ধন্যবাদ সবাইকে।🥰]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here