#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৪)
রিধির ঘুম ভাঙল কারও গুনগুন সুরে। সে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হালকা চোখে তাকাল। সাথে সাথে ভ্রু কুঁচকে এলো। ভারি স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“অফিস যাচ্ছেন নাকি?”
শ্রাবণ শার্টের বোতাম লাগাতে গিয়ে বাঁকা চোখে তাকাল। উত্তর দিল না। বর্ষা বিরক্ত হলো। গা থেকে কম্বল সরিয়ে বলল,
“কী সমস্যা উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”
শ্রাবণ রিধিরর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। সে মেঝেতে পা ফেলে শক্ত আঁটে বিছানার কিনারে বসে আছে। চোখের নিচে ফোলা, শুষ্ক ও বিষন্ন মুখ। শ্রাবণের উত্তর দেওয়ার বদলে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো,’রিধি,আপনি কি অন্য কাউকে ভালোবাসেন?’
“আবার ক্যাবলা চোখে তাকিয়ে আছেন। আপনাকে না বলেছি এভাবে তাকাবেন না?”
শ্রাবণ চোখ সরিয়ে নিল। মানি ব্যাগ আর ঘড়ি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো নীরবে। রিধি কতক্ষণ থম মেরে থাকল। তারপরে হনহনিয়ে ছুটে আসল খাবার রুমে।
শ্রাবণের প্লেটের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হলো! সেই কখন থেকে বসে আছে অথচ তার প্লেট খালি! এদিকে আজিজুল হক ও হৃদ্য দিব্যি খেয়ে যাচ্ছে। শায়লা হক একটু পর পর গরম পরোটা ও ডিম ভেজে এনে দিচ্ছেন। হৃদ্য তো গরম পরোটা ধরতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলল!
রিধি চুপচাপ সবটাই চক্ষু গোচর করল। মনের পটে ভাবনা উদিত হলো,শ্বশুর বাড়িতে বউরা অত্যাচারিত হয়, এখানে দেখি উল্টো হচ্ছে! তার কি স্বামীর পাশে দাঁড়ানো উচিত? অবশ্যই উচিৎ। সে গমগম পায়ে মায়ের পাশে দাঁড়াল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
“উনার অফিসের দেরি হয়ে যাবে,আম্মু।”
শায়লা হক মুখ বাকিয়ে তাকালেন। মুখের হাবভাব বলছে মেয়ের কথার অর্থ ধরতে পারছেন না। রিধি অনেকটা ফিসফিসে বলল,
“উনার প্লেট খালি।”
শায়লা হক প্রথমে শ্রাবণের খালি প্লেটের দিকে তাকাল। তারপরেই কঠিন স্বরে বললেন,
“তাতে আমার কী?”
মায়ের এমন চড়া স্বরে রিধি হকচকিয়ে যায়। মাকে সামলিয়ে নিতে দ্রুত বলল,
“তোমার কিছু না। আমার সব কিছু।”
কথাটা শেষ করেই মায়ের কাছ থেকে দুটো পরোটা নিল রিধি। শ্রাবণের প্লেটে রেখে ডিমের জন্য হাত বাড়াতে শায়লা হক মেয়ের হাত চেপে ধরলেন। শ্রাবণের সামনে থেকে প্লেট সরিয়ে বললেন,
“তুমি এখানে বসেছ কেন? চেয়ার ছাড়ো। এখানে শুধু আমাদের পরিবারের সদস্যরা বসার অধিকার রাখে। তুমি আমাদের কেউ না।”
রিধি স্পষ্ট বুঝল মা শ্রাবণকে অপমান করছে। লজ্জায় সারা শরীরে কালি মাখামাখির অবস্থা! প্রতিবাদ পরায়ণতায় ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠতে শায়লা হক বললেন,
“আমি শুধু আমার পরিবারের জন্য রাঁধতে পারব আর কারও জন্য না। কেউ যেন ভুলে না যায় আমি এ বাড়ির কর্ত্রী,কাজের মহিলা নই।”
কথাগুলো তীরের ফলার মতো বিঁধল রিধির বুকে। এত খারাপ লাগছে! সে কাতর চোখে শ্রাবণের দিকে তাকাল। সে সময় শ্রাবণ অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। খাবার টেবিল ছেড়ে নীঃশব্দে বেরিয়ে যেতে নিলে রিধি ছুটে আসল। শার্ট খামচে ধরে অনুরোধের সুরে বলল,
“একটু বসুন আমি কিছু বানিয়ে দিচ্ছি।”
শ্রাবণ এক পলক রিধির দিকে তাকাল। নিজেকে ছাড়িয়ে ভেতরে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি কেন বানাবেন? আমি তো আপনারও কেউ নই।”
_____________
শরীফা খন্দকার দুপুরের খাবার কর্মচারীদের সাথে খান সব সময়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। খাওয়া শেষে নামাজে বসেন। মোনাজাতের জন্য হাত জড়ো করতে স্বামী ও মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দুটো ভেসে ওঠে। খুশিতে চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু ঝরে পড়ে। মীর খন্দকার এবার বেশ কয়েক দিন থেকেছেন। মেয়েকে প্রচুর সময় দিয়েছেন। ভালোবেসেছেন। তিনি যেমন আসঙ্কা করেছিলেন তেমন কিছু হয়নি। তবুও ভেতরে ভেতরে একটা চাপা অস্থিরতা টের পান মাঝে মাঝেই। তা দূর করতে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। জায়নামাজ ভাঁজ করতে হঠাৎ মনে পড়ল মীর খন্দকার যে কয় দিন এখানে ছিলেন নিয়ম করে দুবেলা ভ্রমরকে নিয়ে কলেজ যাওয়া-আসা করেছেন। আজ দুদিন হলো তিনি নিজ বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। মেয়েটা কি একলা পড়ে গেল? একলা অবশ্য পড়ার কথা না,শুরু থেকেই তো নীলাকে এ দায়িত্বটা দিয়ে এসেছেন তিনি। আজও নিশ্চয় নীলা বাড়ি দিয়ে আসবে। কিন্তু বাবার জায়গায় নীলাকে পেয়ে ভ্রমরের মন খারাপ কাটবে তো? শরীফা খন্দকারের মনে সংশয় ধরা পড়ল। সে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপরেই কর্মচারীদের কিছু একটা বলে বুটিক হাউজ থেকে বেরিয়ে এলেন। আজ নাহয় মেয়েকে সে নিয়ে আসবে। ভ্রমর নিশ্চয় খুব অবাক হবে!
শরীফা খন্দকারকে নিয়ে চলা রিক্সা কলেজের প্রাঙ্গনে এসে পৌঁছেতে দূরে চোখ পড়ল। নীলা এদিক আসছে। একা! তিনি রিক্সা থামিয়ে ডাকলেন,
“নীলা?”
নীলা প্রথম ডাকে শুনল না। দ্বিতীয় ডাকে এদিক-ওদিক খোঁজ চালালে শরীফা খন্দকার উঁচু স্বরে বললেন,
“এই যে এদিকে। আমি রিক্সায়।”
নীলা চট করে রিক্সার ভেতরে তাকায়। মুহূর্তে হকচকিয়ে যায়। শুরু হয় হাতে,পায়ে কাঁপা-কাঁপি! শরীফা খন্দকার মাথা বের করে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি একা? ভ্রমর কোথায়?”
নীলার মুখ রক্তশূন্য। চোখের তারায় তীব্র ভয়। উত্তর দিতে গিয়ে টের পায় শব্দগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। শরীফা খন্দকার নিজ থেকেই পুনরায় বললেন,
“ছুটি হয়নি? আমি মনে হয় আগে চলে এসেছি। আচ্ছা,তুমি দোকানে চলে যাও। আজ আমি ওকে নিয়ে যাব।”
কথা শেষ করে রিক্সাওয়ালার দিকে মনোযোগ দিলেন শরীফা খন্দকার। ছোটার জন্য আদেশ দিতে নীলা চটজলদি বলল,
“ভ্রমর তো কলেজে নেই।”
“নেই মানে?”
শরীফা খন্দকারের কণ্ঠে বিস্ময়,আতঙ্ক। নীলা উত্তর দিতে পারল না। দুপুরের তেজেভরা সূর্যের তাপেও যেন তার ঠকঠক যাচ্ছে না। শরীফা খন্দকার কি বুঝলেন এটা শীতের নয় কিছু ধরা পড়ে যাওয়ার কাঁপন?
এ পর্যায়ে তিনি রিক্সা থেকে নামলেন। নীলার দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ফেলে সন্দিগ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী লুকোচ্ছ?”
নীলা চুপ। মাথা ঝুকে বুক ছুঁইছুঁই অবস্থা! শরীফা খন্দকার নীলার খুতনি চেপে ধরলেন। মাথা তুলে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“আমার বিশ্বাস তুমি মিথ্যে বলবে না।”
এ পর্যায়ে নীলা কেঁদে ফেলল। কান্না বিজড়িত অবস্থায় বলল,
“ভ্রমর হৃদ্য ভাইয়ের সাথে।”
“হৃদ্য? কে সে?”
নীলা খানিকটা স্বাভাবিক হলো। দায়িত্ব নিয়ে হৃদ্যের পরিচয় বুঝিয়ে দিল। সাথে এটাও বলল ভ্রমর ও হৃদ্য প্রায় একসাথে সময় কাটায়। সবটা শোনার পর শরীফা খন্দকার বিড়বিড়িয়ে বললেন,’ভ্রমরের ব্যাপারে আমি এত উদাসীন?’
____________
ভ্রমরকে বসিয়ে রেখে মীর খন্দকার চলে যেতে নিলে ভ্রমর বলল,
“থেকে যাও না,বাজান। আমার একা ভয় করে।”
মীর খন্দকার থমকালেন। গাঢ় চোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। এত দিন আপনি করে সম্বেধন করলেও আজ তুমি সম্বোধন করেছে। মৃদু হাসলেন। নিশ্চিত হলেন এই ভেবে, মেয়ে সম্পূর্ণ রূপে তার স্নেহে বন্দী হয়েছে। ভ্রমর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বাবার হাত ধরে বলল,
“থেকে যাও।”
“আমার থাকা যাবে না।”
“কেন?”
ভ্রমরের প্রশ্নের মধ্যেই মীর খন্দকারের ফোন বেজে উঠল। ফোন কানে ধরার পূর্বে ব্যস্ত স্বরে বললেন,
“তুমি বসো। নীরব এখনই চলে আসবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ও খুব ভালো ছেলে।”
নীরবের মুখোমুখি বসে আছে ভ্রমর। সেদিন এসে তাও জানতে চেয়েছিল সে ভ্রমর নাকি। আজ জানতে চায়নি। জানতে চাওয়ার কথাও না। কেননা,তার ভ্রমর নামের মেয়েটিকে চেনা হয়ে গেছে। তাই বলে কি অন্য কিছু বলা যায় না? ভ্রমর ভারি অস্বস্থিতে পড়ে গেল। জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। চঞ্চল মনি দুটো এদিক-সেদিক পড়ছে। ব্যাগটা নাড়াচাড়া করছে। জামা ঠিক করছে। নখে নখ খুঁটছে। পরিশেষে বিরক্ত হয়ে নিজ থেকেই সামনের মানুষটির সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল। কিছু বলার জন্য সামনে তাকাতে সব গুলিয়ে ফেলল। মস্তিষ্কে একটা প্রশ্নই পড়ে থাকল,’এনার সাথে কী কথা বলব?’ সেই সময় নীরব বলল,
“তোমার ফোন বাজছে।”
ভ্রমর ছিটকে উঠল। নীরবের কথা বুঝতে পারেনি এমনভাবে তাকালে নীরব জোর দিয়ে বলল,
“ফোন বাজছে।”
“কার?”
“তোমার।”
ভ্রমরের হুঁশ এলো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে রেগে গেল। কল কেটে দিয়ে ব্যাগে ভরে বিড়বিড় করল,’ধরব না। ভুলেও ধরব না। আগের বার ঝামেলা করেছ। এবার করতে দিব না। কিছুতেই না।”
সে মনে মনে শপথ নিয়ে সামনে তাকালে নীরব বলল,
“আমাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। তুমি কল এ্যাটেন্ড করতে পার। আমার জন্য সমস্যা হলে আমি দূরে যাচ্ছি।”
ভ্রমর শশব্যস্তে বলল,
“না,না। ঠিক আছে। আপনি কী বলতে এসেছেন বলুন।”
ভ্রমরের কথার মধ্যেই ফোনটা আবার বেজে উঠল। ভ্রমরের রাগ হলো। মনে মনে বকতে বকতে ফোন বাইরে বের করতে রাগ উবে গেল। হৃদ্য নয় রিধি কল দিয়েছে। ভ্রমর সামনে না তাকিয়ে বুঝতে পারল নীরব চেয়ার টেনে কোথাও একটা যাচ্ছে। সেই ফাঁকে সে কল ধরল। ওপাশ থেকে রিধি বলল,
“হৃদ্য কি তোর সাথে আছে?”
“না তো। কেন?”
“কেউ একজন ওর ফোন থেকে কল করে বলল,হৃদ্য এক্সিডেন্ট করেছে।”#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৫)
“তুমি হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাড়িতে কী করছ?”
হৃদ্য চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। ভ্রমরের কণ্ঠে তাকাল। হলুদ ও কালো রঙের মিশ্রণের থ্রি-পিসটায় দারুন লাগছে। বাহু মোড়ানো সোনালী সুতায় বুনা চাদরটা মাথা থেকে পড়ে যেতে মনে হলো,ভ্রমর পাল্টাচ্ছে! হৃদ্য চোখ বন্ধ করে ফেলল। আপনমনে বলল,’কেন পাল্টাচ্ছিস? আমার ভালো লাগছে না। মেয়ে বড় হলে বাবা,মায়ের চিন্তা হয়। এই তোর বেলায় উল্টো হলো। সব চিন্তা আমার ঘাড়ে এসে পড়ছে।’
ভ্রমর দরজা ছেড়ে ঘন পায়ে হৃদ্যের কাছে এসে দাঁড়াল। আগাগোড়া দেখে নিয়ে বলল,
“কোথাও তো ব্যান্ডেজ দেখতে পাচ্ছি না।”
হৃদ্য আবার চোখ মেলল। খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ব্যান্ডেজ থাকবে কেন?”
“আপু যে বলল,তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছে?”
হৃদ্য সাথে সাথে কিছু বলল না। শোয়া থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসল। পাশ থেকে একটা বালিশ কোলে নিয়ে ভ্রমরের দিকে তাকাল। সেই সময় ভ্রমর বলল,
“তাহলে কি আপু মিথ্যে বলেছে?”
প্রশ্নটা করতে করতে ওর চোখ দুটো জলপূর্ণ হলো। চোখে,মুখে দিশাহারা ভাব। কান্নায় ভেঙে পড়ার পূর্বে হৃদ্য বলল,
“না। আপু মিথ্যে বলেনি।”
মুহূর্তে ভ্রমরের দিশাহারা,ঠকে যাওয়া ভাবটা কেটে গেল। চিন্তিত হলো ভীষণভাবে। অস্থিরতায় হৃদ্যের পাশে বসে উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় লেগেছে? রক্ত বেরিয়েছে? দেখি!”
ভ্রমর হৃদ্যকে স্পর্শ করতে গেলে সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত বলল,
“কোথাও লাগেনি। রক্ত বের হওয়ার মতো দুর্ঘটনা হয়নি। ছোট দুর্ঘটনা।”
ভ্রমর হৃদ্যের দিকে ঘুরে বসল। বলতে চাইল,’ছোট,বড় বুঝি না। এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনেই তো আমার বুক কেঁপে উঠল। দেখ,এখনও কাঁপছে।’
“আমার কল ধরিসনি কেন?”
হৃদ্যের হঠাৎ প্রশ্নে ভ্রমরের মনে চলা কথাগুলো হারিয়ে গেল। মনে পড়ল,সেদিনের মতো আজকেও সাংঘাতিক কাণ্ড করে ফেলেছে। নীরবকে ফেলে রেস্টুরেন্ট থেকে ছুটে পালিয়ে এসেছে। এতক্ষণে বাবা নিশ্চয় জেনে গেছেন? প্রথম বার তো ক্ষমা পেয়েছিল,দ্বিতীয় বারও কি পাবে? বাবার কঠিন মুখটা চোখের পর্দায় ভেসে উঠতে ভ্রমরের কলিজা শুকিয়ে এলো। অসহায় কণ্ঠে বলল,
“আমি বাবাকে একটুও খুশি করতে পারছি না। আবার হারিয়ে যাবে না তো?”
ভ্রমরের মুখের দিকে তাকাতে হৃদ্যের মায়া হলো। একটু কাছে এসে বলল,
“কোথাও হারাবে না। বাবা কি হারানোর জিনিস?”
ভ্রমর জোর দিয়ে বলল,
“আমার বাবা হারানোর জিনিসই। এত দিন তো হারিয়ে ছিল। আজ যখন পেলাম…”
ভ্রমর মাঝ পথে থেমে গেল। আচমকা বলল,
“সব তোমার জন্য হচ্ছে। তুমি ইচ্ছে করেই এমন করছ তাই না? আমার বাবাকে তুমি একটুও পছন্দ করছ না। কেন বলো তো?”
হৃদ্য খানিকটা চুপসে গেল। একটু পিছিয়ে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“আশ্চর্য! তোর বাবাকে আমি কেন অপছন্দ করব?”
ভ্রমর হৃদ্যের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলে হৃদ্য বিছানার কাছে হেঁটে আসল। টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে পানি ঢালল গ্লাসে। ভ্রমরের দিকে চোরা চাহনি রেখে গ্লাস তুলে নিল। হঠাৎ টের পেল গ্লাস মুখের কাছে যাচ্ছে না। মাঝ পথে আটকে আছে।
“এমন মূর্তি হয়ে আছো কেন? পানি না খেলে রেখে দেও।”
হৃদ্য ভ্রমরের দিকে তাকাল। কাতর চাহনি! ভ্রমর বুঝি কিছু টের পেল না। সে বিরক্ত হয়ে গ্লাস ধরে রাখা বাঁকা হাতটির দিকে তাকাল। হাতে ধরে মুখের দিকে চাপ দিতে হৃদ্যের মুখ থেকে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। সাথে সাথে গ্লাস পড়ে গেল নিচে। পানি ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ভ্রমর ভয় পেয়ে বলল,
“কী হয়েছে?”
হৃদ্য উত্তর দিতে পারল না। চোখের শূভ্র অংশ রক্তিম হয়ে আসল। সে অবস্থায় বাম হাত দিয়ে ডান হাত হালকা বাঁকা করতে চাইল। সাথে সাথে ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল। ভ্রমর পুনরায় বলল,
“এমন করছ কেন? কী হয়েছে?”
হৃদ্য ব্যথিত স্বরে বলল,
“হাত বাঁকা করতে পারছি না।”
“মানে?”
“মনে হয় হাত মচকে গেছে।”
ভ্রমরের চোখ বড় হয়ে আসল। আঁতকে উঠে বলল,
“কী বলছ!”
সে চট করে হৃদ্যের হাত ধরে ফেলল। শার্টের হাতা গুটিয়ে পরখ করতে গিয়ে দেখল চামড়ার এখানে ওখানে কাটাছেঁড়ার দাগ। ভ্রমর ভীত চোখে হৃদ্যের মুখের দিকে তাকাল। তারপরেই হৃদ্যের অন্য হাত,ঘাড়,বুক দেখে চিৎকার করে উঠল,
“আংকেল? আন্টি?”
ভ্রমর হৃদ্যকে ফেলে দৌড় দিতে হৃদ্য এক হাত চেপে ধরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছিস? কিছু হয়নি। মোটর সাইকেল নিয়ে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ছিলাম তাই হয় তো..”
“মোটর সাইকেল?”
ভ্রমরের চোখে,মুখে আতঙ্ক! সে আবার চেঁচিয়ে উঠল,
“আপু? কোথায় তুমি? এ্যাম্বুলেন্স ডাকো। হৃদ্য ভাইয়ের সব ভেঙে গেছে!”
হৃদ্য সারা শরীরের ব্যথা ভুলে হতভম্ব দৃষ্টি ফেলল ভ্রমরের দিকে। বিস্ময় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“সব ভেঙে গেছে? এসব কী বলছিস,ভ্রমর?
ভ্রমর উত্তর দেওয়ার পূর্বেই আজিজুল হক,শায়লা হক ও রিধি ছুটে এলো।
___________________
ঘড়ির ছোট ও মোটা কাঁটা ছয়ে পড়তে রিধি রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। এখন সে নিয়ম করে দু’বেলা রান্না করছে। সকাল ও রাতের খাবার শ্রাবণের সাথে নিজ রুমে খেলেও দুপুরে মা,বাবার সাথেই খাচ্ছে। তার এই আচরণ পরিবারের কাউকে খুশি অথবা অখুশি করতে পারল না। সব কিছু স্বাভাবিক। যেন এমন ভাবে চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
রিধি ভাত বসিয়ে মিষ্টি কুমড়া হাতে নিল। ফ্রিজ থেকে রুই মাছ নামাল। দুটোকে মিশিয়ে কোনো এক পদ রাঁধবে হয় তো। সে মিষ্টি কুমড়া দুই ভাগ করতে শায়লা হক বললেন,
” এই যা! আমি করলা ভাজি করলাম কেন? তোর বাবা তো করলা খায় না।”
রিধি মায়ের দিকে তাকাল। ব্যস্ত স্বরে বলল,
“এতে হা-হুতাশ করার কী আছে,আম্মু? যেটা খায় সেটা রাঁধলেই হয়।”
শায়লা হক হাসলেন। সশব্দের হাসি। রিধি না চায়তেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ফেলল। সে সময় তিনি রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“রিধির বাবা? আজ রাতে ভাতের সাথে কী করব?”
রিধি মিষ্টি কুমড়া ফেলে কান চেপে ধরল। কপট রাগ নিয়ে বলল,
“চেঁচাচ্ছ কেন,আম্মু? বাবা কী খেতে পছন্দ করে তুমি জানো না?”
শায়লা হক উত্তর দেওয়ার পূর্বে আজিজুল হকের গলা ভেসে এলো,
“চিংড়ি দিয়ে আলু ভাজি করতে পারো। অনেক দিন হলো খাই না।”
রিধি ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাতে শায়লা হক বললেন,
“জানি। কিন্তু পছন্দ তো সব সময় এক রকম থাকে না তাই না? এই যেমন আমি শ্রাবণের জন্য প্রথম দিন গরুর মাংস রাঁধলাম। সে খেতে এসে বলল,আমি গরুর মাংস খাই না। মুরগির মাংস খাই। একটু ঝাল ঝাল হলে তো আঙুল চেটে খাই। পরের দিন যখন ঝাল করে মুরগি রাঁধলাম মুখ শুকনো করে বলল,আজ আমার মাংস খেতে ইচ্ছে করছে না। মাছের কিছু রান্না নেই? আমি চিংড়ি দিয়ে মিষ্টি কুমড়ার তরকারিটা সামনে দিতে মন খারাপ করে বলল,আমি মিষ্টি কুমড়া খাই না,আম্মা।”
রিধি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এসব আমাকে কেন শোনাচ্ছ,আম্মু? রাগ উঠানোর জন্য? আমার পরিবার যে দুমুখো সাপ এটা তো কল্পনাতীত ছিল। ছি! আম্মু।”
শায়লা হক মেয়ের নাক সিটকানো উপেক্ষা করে সহজ গলায় বললেন,
“তুই আগে রান্না শেষ কর। আমি পরে আসছি।”
রিধি আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ কাজে মন দিল। একটু পরেই শ্রাবণ চলে আসবে। সে মিষ্টি কুমড়া টুকরো করায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে হঠাৎ মায়ের বলা কথাগুলো মনে পড়ল। সে তড়িৎ গতিতে রুমে ছুটে গেল। শ্রাবণের নাম্বারে কল ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি মিষ্টি কুমড়া খান না?”
রিধির কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শ্রাবণ আশা করেনি। সে ভারি আশ্চর্য হয়ে বলল,
“হঠাৎ মিষ্টি কুমড়ার কথা মনে পড়ল কেন?”
রিধি মায়ের কথা চেপে গিয়ে বলল,
“আমি মিষ্টি কুমড়া কাটছিলাম। হঠাৎ মনে হলো,আপনি মিষ্টি কুমড়া খান না।”
শ্রাবণের বলতে ইচ্ছে হলো,’তুমি মিষ্টি কুমড়া কেন,তিতা কুমড়া রাঁধলেও আমি হেসে হেসে খেয়ে নিব।’
“বলছেন না?”
“না।”
“তাহলে কী খান?”
“এটা বাদে একটা কিছু হলেই হবে।”
রিধি রেগে গেল। ঝারি দিয়ে বলল,
“একটা কিছু হলে আবার কী? নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না?”
“বলতেই হবে?”
“বলবেন না তো কী করবেন? আপনার জন্য রাঁধছি আর আপনার পছন্দ জানব না?”
“মাছ ভাজা,সাথে শুকনো মরিচ ভাজা।”
রিধি কল কেটে দিল। কেটে রাখা মিষ্টি কুমড়ার দিকে চোখ পড়তে চিন্তায় পড়ে গেল। এখন এগুলো কী করবে?
_____________
শ্রাবণ বাসায় আসল রাত আটটায়। হাত,মুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টাতে রিধি বলল,
“আপনি একটু বসুন। আমি ভাত বেড়ে নিয়ে আসছি।”
শ্রাবণ মুগ্ধ চোখে রিধির চলে যাওয়া দেখল। আপনমনে বিড়বিড় করল,’আমি তোমার চিন্তায় নয়,মনেও ঢুকতে চাই। ঐখানে অন্য কারও বসত আমি সহ্য করব না। একটুও না।’
রিধি রান্নাঘরে গিয়ে অবাক! ভাতের হাড়ি,তরকারির কড়াই খালি। তলায় ঝোল পর্যন্ত লেগে নেই। ধোয়া-মোছায় তকতকে ঝকঝক হয়ে উল্টো পড়ে আছে। সে রান্নাঘর থেকে বের হলো চিৎকার,চেঁচামেচি নিয়ে। শায়লা হক ছুটে আসলে রিধি রাগ নিয়ে বলল,
“আমার ভাত কোথায়,তরকারি কোথায়,আম্মু?”
শায়লা হক স্বাভাবিক গলায় বললেন,
“টেবিলে সাজিয়ে রেখেছি।”
“কেন?”
“কেন আবার? খাওয়ার জন্য। তোর বাবা আর হৃদ্য বসে গেছে। তুইও বসে পড়।”
শায়লা হক খাবার টেবিলে ফিরে আসলেন। রিধিও ছুটে এলো। বাবা আর ভাইয়ের প্লেটে তাকিয়ে বিস্ফারিত চোখে বলল,
“এগুলো তোমরা খাচ্ছ কেন?”
মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিলেন শায়লা হক,
“তাহলে কে খাবে?”
“কে আবার? যার জন্য রেঁধেছি সে খাবে।”
“কার জন্য রেঁধেছিস?”
“শ্রাবণের জন্য।”
শায়লা হক ছেলের প্লেটে আরেক টুকরো মাংস দিয়ে বললেন,
“তুই রাঁধলেই তো বাইরের ছেলের জন্য হয়ে যাবে না। চাল,মাংস,মশলা সব আমাদের। যে রেঁধেছে সেও আমাদের। এখানে শ্রাবণের কিছু নেই।”
রিধি থম মেরে যেতে শায়লা হক আবার বললেন,
“তাকে যদি এতই রেঁধে খাওয়াতে ইচ্ছে করে,বল বাজার করে আনতে। একটা বাইরের ছেলের জন্য তোর বাবা কেন বাজার করবে? পকেটের টাকা নষ্ট করবে?”
রিধি থমথমে মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল মুহূর্তকাল। চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে নিজের রুমে ছুটে গেল। শ্রাবণকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। খাতা,কলম নিয়ে চটপটে একটা লিস্ট তৈরি করে শ্রাবণের হাতে ধরিয়ে দিল। বলল,
“জলদি এগুলো নিয়ে আসুন। আবার রাঁধতে হবে।”
_________________
“নে,ওষুধটা খেয়ে নে।”
ওষুধ হাতে আপুকে দেখে হৃদ্য পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে বলল,
“ভ্রমর আসেনি?”
রিধি ভাইয়ের হাতে ওষুধ দিয়ে বলল,
“না।”
হৃদ্য ওষুধ হাতে গম্ভীর মুখে বসে রইল। রিধি ভাইয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,
“তোর এক্সিডেন্টের পর তো মেয়েটাকে বাসায় ফেরত পাঠাতে কষ্ট হতো। ঐটুকু মেয়ে কী সুন্দর তোর খেয়াল রাখছিল! সারাক্ষণ এ ঘর থেকে ও ঘর ছুটাছুটি করছিল। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ভ্রমর এ বাড়ির মেয়ে নয়।”
হৃদ্য আপুর দিকে তাকাল। রিধি ভাইয়ের পাশে বসে ওষুধ খাওয়ার জন্য ইশারা করল। তারপর বলল,
“আজ সকালে ভ্রমর যখন ফোন করে বলল,আপু আজ তুমি একটু হৃদ্য ভাইয়ার যত্ন নিও। আমি মনে হয় আসতে পারব না। আমি অবাক হয়েছিলাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ভ্রমর তার খুব প্রিয় জিনিসটা আমার কাছে গচ্ছিত রাখছে। একটু পরে নিয়ে যাবে! মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে তাই না? গোছাতে শিখছে।”
হৃদ্য আপুর দিকে তাকিয়েই থাকল। রিধি আবার বলল,
“সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো,বিকেল হলো,সন্ধ্যা হলো ভ্রমর এলো না। একটু খারাপ লাগল। মনে মনে হয় তো আমিও ওর আসার অপেক্ষা করছিলাম। অপেক্ষা যখন আরও দীর্ঘ হলো আমি ওকে কল দিলাম। ধরল না। তখন একটু খটকা লাগল। চলে গেলাম ওদের বাসায়। গিয়ে দেখি…”
রিধি থেমে যেতে হৃদ্যের মুখের রঙ পাল্টে গেল। অজানা ভয়ে শিউরে উঠল সারা শরীর। সে শুকনো ঢোক গিলে ধীরে ধীরে বলল,
“কী দেখলি আপু?”
চলবে
[কাল খুব মাথা ব্যথা ছিল তাই লিখতে পারিনি। আপনাদের অপেক্ষায় রাখার জন্য দুঃখিত!]
চলবে