#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া
২৮ এর (১ম অংশ)
আহফিন উত্তপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিল ভিতর থেকে। মিজান পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে আছে। তার ভেতরেও কষ্ট হচ্ছে। কতটা করুণ নিদারুণ ভালোবাসার কাহিনী। কি অসহনীয় কষ্টই না মানুষটা ভেতরে পুষে রেখেছে। মিজানের খুব রাগ হচ্ছিল তূবার উপর। এত ভালো একটা মানুষকে কতটা কষ্ট দিয়েছে ওই মেয়েটা। হয়তো আহফিন সেদিন ওই কথা গুলি না বললে তূবা যেতো না। কিন্তু এখানে আহফিনের কোনো দোষই দেখতে পাচ্ছে না মিজান। আহফিনের দিক থেকে সে একদম ঠিক করেছে। তার রাগ করে বলাটা স্বাভাবিক। আর তূবা? সেই বা কেন এত দরদ দেখাতে গেল আরেক ছেলের উপর? এত মানবতা দেখানোর কি দরকার ছিল? এতই যখন ভেতরে মায়া তখন আহফিন কে সব টা বলে বুঝিয়ে করল না কেন? ভালোবাসার মানুষের কষ্টের চেয়েও কি আরেক জনের প্রতি মায়া বেশি ছিল? রনির দেওয়া কছমের কথা চিন্তা করলেও মিজানের শুধু মনে হচ্ছে তূবারই দোষ। আহফিনের কষ্টের কথা শুনে তার ভেতরেই এখন কত টা কষ্ট হচ্ছে। না জানি ওই মানুষটার ভেতরে কতটা আগুন জ্বলেছে জ্বলছে এত গুলি বছরে।
আহফিন ব্যালকুনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিজান ঘর থেকে এগিয়ে গেল সেদিকে।
“স্যার।”
“….
“স্যার আপনি একদম ওই মহিলার জন্যে আর কষ্ট পাবেন না। ওই মহিলা কে আপনি ভুলে যান স্যার।”
“সুশশশ। এসব বলো না মিজান। তূবা আমার অন্তরে আমার অস্তিত্বে মিশে গেছে।”
“কিন্তু উনি তো.”
“তূবা কে আমার বুকে নিশ্বাস থাকা কালিনী আমি ভুলতে পারব না।”
“….
মিজানের চোখের কোণায় পানি চলে এসেছে।
“মিজান তুমি এখন যাও। আমি একটু একা থাকি।”
“স্যার আপনি এখন কাঁদবেন তাই না?”
আহফিন দ্রুত মিজানের দিকে তাকাল। নিষ্পল তাকাল। মায়াভরা কন্ঠ আর চোখ দেখে আহফিন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। হুট করে মিজান কে জড়িয়ে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল আহফিন। শব্দ করে কাঁদছে সে। মিজানের বড্ড কষ্ট হচ্ছিল আহফিনের কান্না তে। মনে হচ্ছিল আহফিনের কান্নার আওয়াজে এই বুঝি বুকটা ফেটে যাবে। কি কষ্টই না লোকটার ভেতরে জমা। আহহ এতটা যন্ত্রণা মানুষটা পুষছে কি করে।
একাধারে বর্ষণের পর শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশের মতো নির্মল লাগছে আহফিন কে। শান্ত গলায় সে মিজান কে বলল
“গাড়ি বের করো পার্কে যাবো।”
মিজানের চাউনি দেখে আহফিন নিজ থেকেই বলল “অপেক্ষা করতে করতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন অপেক্ষা করাটা এমন কঠিন কাজ নয়। মনের কোণায় আশা আছে। হয়তো আমি আমার জীবনের সুখ আবার ফিরে পেলাম।” ঠোঁট প্রসারিত করে বিষাদময় হাসল আহফিন।
—-
ডায়রি নিয়ে সুন্দর করে লিখতে বসেছে আহফিন। খোলা আকাশের নিচে মনের যত কথা, যন্ত্রণা, আবেগ, অভিমান সব ঢেলে দিচ্ছে এখানে। ভেতরে কত কষ্ট অভিমান যন্ত্রণা আছে তা আল্লাহ আর সে ছাড়া শুধুমাত্র এই ডায়রিরই জানে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ বলে উঠল “হিরো আঙ্কেল।”
বুকটা ধক করে বারি দিয়ে উঠল আহফিনের। আচমকা তাকাল ডাকের অনুসারে। তাহফিবা কে দৌড়ে আসতে দেখে ছুটল সেও। তাহফিবা কে কোলে তুলে নিয়ে অসংখ্য চুমু দিতে লাগল সে। তাহফিবাও হেসে তার গলা জড়িয়ে ধরল।
“কেমন আছো হিরো আঙ্কেল?”
বুক ভারি হয়ে আসে আহফিনের। চোখ গুলি ঝাপসা হতে শুরু করেছে কেন? আহফিন তাহফিবার দিকে তাকিয়ে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। দূর থেকে মিজান গার্ডের সাথে চা খেতে খেতে এমন মনোরম দৃশ্য দেখে তৃপ্তির হাসি দিল।
“আমার লক্ষ্মী সোনা কোথায় ছিলে এই তিন দিন?”
“আসলে মাম্মাম খুব বিজি তো তাই আসতে দেয় নি। তুমি কি আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলে?”
আহফিন এবার চোখের পানি ছেড়েই দিল।
“খুব অপেক্ষা করেছিলাম।”
চোখের পানি মুছে দিয়ে তাহফিবা চুমু দিল আহফিনের গালে। তারপর আহফিন বলল
“আমার লক্ষ্মী সোনা পাখি চকলেট খাবে?”
“চকলেট?”
“জানো তিন দিনে তোমার জন্যে কতগুলি চকলেট এনেছি?”
“কই দাও।”
আহফিন তাকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসল। গাল ভরা হেসে সে তাহফিবা কে চকলেট দিল। তাহফিবাও মুচকি হেসে খেয়ে বলতে লাগল “মজা।” ফিক করে হাসল আহফিন।
তাহফিবা যাওয়ার সময় আহফিন ব্যাগে আনা চকলেট গুলি দিয়ে দিল তাকে। তাহফিবা যখন চলে যাচ্ছিল তখন তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তার আন্টি এসে নিয়ে গেছে তাকে। তাহফিবা ব্যাগ নিয়ে চলে গেল। অথচ আহফিন জানেই না ব্যাগের ভেতর চকলেট ছাড়াও আরেকটা জিনিস চলে গেছে।
আজ একটু শান্তি লাগছে বুকে। ভালো ঘুম হবে বোধহয় আজ। আহফিন এক গাল হেসে বাড়ি ফিরল।
—-
তাহফিবা কাল যাওয়ার সময় তাকে দাওয়াত দিয়েছিল তার মাম্মামের শপের একটা অনুষ্ঠানে যেতে। কিন্তু ঠিকানাটাই তো নেওয়া হয়নি। তাহলে সেখানেই চলে যেতো। কিন্তু এখন উপায় না পেয়ে পার্কেই যেতে হবে। তাহফিবা কথা দিয়েছে আজ আসবে। আজ মন খারাপ করে নয়। হাসি নিয়ে সে পার্কে গেছে।
তাহফিবা এখনো আসে নি। আজ আসতে দেড়ি হচ্ছে দেখে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তবে কি আজ আসবে না? কিন্তু সে তো বলেছে আজ আসবেই। তাকে কেন সবাই এত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করায়?
আহফিন তখন মন মরা হয়ে বসে ছিল। পিছন থেকে তাহফিবা পা টিপেটিপে এসে আহফিনের চোখ ধরল। ছোট দুটি হাতের স্পর্শ পেয়ে আহফিনের বুঝতে বাকি রইল না এটা তার তাহফিবাই।
“আমার টুনটুনি ময়না পাখিটা বুঝি এতক্ষণে আসল?”
“আমি আবার এখনি চলে যাবো।”
“কেন?” বলে আহফিন তাকে পিছন থেকে সামনে এনে কোলে তুলে বসাল।
“কেন চলে যাবে তুমি? এসে তো বসলেও না আর এখনি..”
“তোমাকে না বলেছিলাম মাম্মামের বুটিকশপের অনুষ্ঠান টায় যেতে।”
“তাহফিবা কি আমাকে ঠিকানা দিয়ে গিয়েছিল?”
তাহু কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। তারপর চোখ খুলে বলল “ইশশ মনেই নেই।”
তাহফিবার ভাব দেখে হেসে উঠল আহফিন। নরম তুলতুলে গালে চুমু খেলো সে। কি যেন বলতে যাবে তার আগেই অতিচেনা সেই সুরেলা মধুরকন্ঠ শুনা গেল।
“তাহফিবা।”
আহফিনের বুকে ধরাক করে আওয়াজ হলো। হৃদপিন্ড টা অনবরত কাঁপছে। হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না সে। আসলেই সে ঠিক শুনেছে কি না বুঝে উঠতে পারছে না। ভীষণ ভয় নিয়ে আহফিন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। হঠাৎই তার চোখ ঝাপসা হতে শুরু করেছে। ঠোঁট গুলি অনবরত কাঁপতে লাগল। চোখের সামনে এত গুলি বছর পর তূবা কে দেখে আহফিন বিশ্বাসই করতে পারছে না। তাহফিবা কে নামিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ আহফিন কে দেখে চমকে উঠল তূবা। ভেতরে উথালপাতাল ঝড় বইছে। ভেতর থেকে চিৎকার করা কান্না ভেসে আসতে চাইছে। চোখ টলমল হয়ে আসছে তূবার। ভেতরের চাঁপা কান্না যেন উপছে আসতে চাইছে।
তূবা আগের থেকে কত সুন্দর হয়েছে। কি সুন্দর শাড়ী পড়ে গুছিয়ে রেখেছে নিজেকে। একদম পাক্কা মোহনীয় রমনী। আহফিন নিজেকে স্থির করতে চাইল। পাশ ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ফের সামনে তাকাল। না সে সত্যিই দেখছে। তার সামনে তার ভালোবাসা। সেই পরিচিত আর কাঙ্ক্ষিত মুখ। পাঁচ বছর পর তূবা কে দেখে ভেতর থেকে কতশত আবেগ ভেসে উঠছে উথাল সাগরের ঢেউয়ের মতো তা নিজের থেকে ভালো আর কেউ বুঝবে না। মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠে তার। কিন্তু নিমিশেই মিলিয়ে যায় সেই হাসি। তাহফিবা দৌড়ে গিয়ে তূবা কে জড়িয়ে ধরে বলল “মাম্মাম।”
তূবা কে দেখে যতটা অবাক হয়েছিল তার চেয়ে হাজারগুন বেশি বিস্মিত হয়েছে মাম্মাম ডাক শুনে। তূবার মেয়ে তাহফিবা? তারমানে তূবা.. আহফিন নির্জীব শরীর টা নিয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেল। তার চিন্তা শক্তিতেও আসছে না তূবা.. চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তার।
“মাম্মাম এটা আমার হিরো আঙ্কেল। আসো পরিচয় করিয়ে দেই।”
তূবার ভেতরটা টা মরিচা পড়তে পড়তে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়ার মতো লাগছে। আহ কি যে কষ্ট আর জ্বালাপুড়া হচ্ছে ভেতরটায়!
“ও মাম্মাম।”
তূবার চোখ পানিতে টলমল করছে। দৃষ্টি সামনে থাকা কান্নারত সেই অতিপ্রিয় মানুষটার দিকে। ইচ্ছা করছে কাছে গিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরতে। বুকে ব্যথা হচ্ছে ভীষণ। তূবা প্রাণশক্তি দিয়ে ঢোক গিলে দাঁতে দাঁত কাটল। তারপর তাহফিবার হাত ধরে হাটতে শুরু করল। অথচ শরীরে এক বিন্দু শক্তি পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এখনি বুঝি ঢলে পড়বে জমিনের বুকে।
তূবা কে চলে যেতে দেখে আহফিন নিজেকে শক্ত করল। ভেতরের সুপ্ত রাগ টা পিন পিন করে নড়তে শুরু করেছে। চোখ মুখ শক্ত করে সে তূবা কে ডাকল। পিছু যেতে যেতে তূবা কে ডাকতে লাগল। তার সব টা জানতে হবে। কি করে তূবা নতুন করে সব কিছু শুরু করতে পারল? একবারও কি তার কথা মনে পড়ল না তার? দ্রুত পায়ে যেতে যেতে আহফিন “তূবা তূবা” বলে ডাকতে লাগল।
চলবে♥
ইনশাল্লাহ ২য় অংশ কাল পাবেন।😊❤️#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া
২৮ এর (২য় অংশ)
তূবা এত করে চেয়েও পারল না আহফিন কে একটা বার দেখার লোভ সামলাতে। সে ভেবেছিল তাহফিবার হিরো আঙ্কেল আহফিন। ভাবনাটা আজই ঠিক হলো। মনে মনে চেয়েছিল লুকিয়ে একবার দেখবে আহফিন কে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝল না সে। হঠাৎ কেনই বা জোরে মেয়েকে ডাকতে গেল সে জানে না। ভেতরে যে এখন ঝড় হচ্ছে তা থামাবে কি করে। বারবার কেনই বা ভুল করে সে!
কাল সারারাত ভরে তূবা আহফিনের ডায়রি পড়েছে। এক মুহূর্তের জন্যে চোখের পানি টা লুকায়নি তার। টপটপ করা পানিতে ডায়রির প্রতিটা পৃষ্ঠা ভিজেছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী লেগেছে। সে ভুল করেছে সে অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু আহফিন সে ঠিক করেছিল এমনও নয়। আহফিন তার সবটা কথা না শুনেই চরিত্রের দাগ কেন টেনে দিয়েছিল সেদিন? ভেতরটা আবার ভারি হয়ে আসতে লাগল। দাঁত কিটে নিজেকে কঠিন শক্ত করার চেষ্টা করে তাহফিবা কে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল।
ওদিকে আহফিন গলা ছেড়ে তূবা আর তাহফিবা কে ডাকতে লাগল। তূবা তো একবারও পিছু ফিরছে না। আর তাহফিবা নিষ্পাপ অবুঝ ফুলের মতো তার দিকে বার বার তাকাচ্ছে।
তূবার পিছু যেতে যেতে আহফিন তার বাড়ির সামনে পর্যন্ত চলে এসেছে। তবুও একবার তূবা পিছন ফিরে তাকাল না। মেয়েকে টেনে নিয়ে গিয়ে গেইট লাগিয়ে ভেতরে চলে গেল। আহফিন চাইলেই অর্ধ প্রাচীরের দেওয়াল টা টপকে ভেতরে যেতে পারে। কিন্তু তবুও গেইটের ওপাড় থেকে চেঁচিয়ে ডাকছে তূবা কে। তূবার সাথে তার কথা আছে। সে জানতে চায় এসবের মানে।
ঘন্টাখানেক এখানে দাঁড়িয়ে আহফিন ডেকেও তূবার খুঁজ পেল না। ওদিকে তূবা ঘরের ভেতরে চুপচাপ বসে আছে। সামনে মন মরা হয়ে বসে আছে তাহফিবা। রাগের মাথায় খুব বকেছে মেয়েকে। মারতে চেয়েও মারেনি। সে কিছুই বুঝতে পারছে না এসবের। তার ছোট মস্তিষ্কে এসব বড় প্যাঁচ ডুকছে না। চুপচাপ গাল ভার করে বসে আছে মায়ের সামনে। তাহফিবার পাশেই রিমা দাঁড়িয়ে আছে। সে আহফিনের ব্যাপারে সব জানে। তূবা কে বার কয়েক বলেছে আহফিন কে ভেতরে আনতে। তখন সে রিমার দিকে রাগি লুকে তাকাতেই চুপ করে যায় সে। এতিম রিমার দায়িত্ব সেই কবে থেকে নিয়েছে তূবা। নিজের বড় বোন আর একমাত্র অভিভাবক মনে করে তাকে। তাই তূবার কোনো কথাই অমান্য করে না রিমা।
“তূবা তূবা তুমি আমার সাথে একটু কথা বলো। আমি তোমার কাছে জানতে চাই। আমার প্রশ্নের উত্তর গুলি দিয়ে যাও।”
“আমাকে ছেড়ে তুমি কি করে আবার নতুন করে শুরু করতে পারলে? একবারও কি আহফিন নামের মানুষটাকে মনে পড়ল না তোমার? এতটা নিষ্ঠুর কি করে হলে? মানছি আমার ভুল ছিল। তাই বলে তুমি..”
“তূবা আমার প্রশ্নের উত্তর গুলি দিয়ে যাও। তাহফিবা সত্যিই কি তোমার মেয়ে? তাহফিবার বাবা কে তূবা? আমি তোমার নতুন স্বামীর নাম জানতে চাই তূবা। তূবা প্লিজ বাহিরে আসো।”
“তূবা বলো তাহফিবার বাবা কে? নাকি রনি..”
তূবা চোখ মুখ কঠিন করে লম্বা কদমে এগিয়ে এলো ঘর থেকে। গেইট খুলে তূবা এসেই আচমকা ঠাসস করে এক চর বসিয়ে দিল আহফিন কে। হঠাৎ এমন ঘটনায় প্রস্তুত ছিল না সে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আহফিন।
“কি মনে করেন কি আপনি নিজেকে? কেন আমার বাড়ির সামনে এমন চিৎকার চেঁচামিচি করছেন? কি চাই আপনার?”
আহফিন তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল তূবার দিকে। চড়ের কথা বেমালুম ভুলে সে তূবা কে বলল
“আমার চাওয়া পাওয়া সবটা জুড়ে শুধু তুমি আছো।”
“থামুন। বন্ধ করুন আপনার এসব। আমি আপনার এই গুলি আর নিতে পারছি না। আপনি এখান থেকে যান।”
“যাবো না।”
“কেন যাবেন না? কেন যাবেন না বলুন।”
তূবা কেমন অস্থিরতা নিয়ে জোরে জোরে কথা গুলি বলছে তাকে।
“আমি আপনাকে চিনি না। চিনি না আপনাকে। আপনি এখান থেকে চলে যান।”
আহফিন দাঁত কিটে তূবার বাহু চেঁপে ধরল।
“তাহফিবা কার মেয়ে? বলো তাহফিবা কার মেয়ে?”
তূবা সর্বশক্তি দিয়ে আহফিন কে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দিল। চেঁচিয়ে বলল
“আপনার লজ্জা করে না এসব বলতে? ছিঃ। আমার চেয়ে আপনার মনমানসিকতা আরো নিচু। আর আপনার লজ্জা করবে নাই বা কেন? আপনি তো আমার চরিত্রেই দাগ কেটে দিয়েছেন। উপাধি দিয়েছে আমি নষ্ট চরিত্রের মেয়ে। আমার সাথে নাকি সংসার করতে পারবেন না আপনি। আমার চরিত্রের ঠিক নেই। তাহলে আমার বাসার সামনে আপনার কি? চলে যান এখান থেকে।”
“তূবা তূবা আমি ভুল করেছিলাম। আমি..”
“ভুল? কোনটা ভুল আহফিন? আপনার সব কিছুই কি ভুল ছিল? ওটাকে আপনি ভুল বলেন?”
“….
আহফিনের বলার মতো কিছু নেই। সে নিবার্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
“ভালোবাসায় বিশ্বাস থাকতে হয় আহফিন। আর আপনি? অবিশ্বাসের বেড়াজালে ঘিরে ফেলেছিলেন আমাকে। এতবার বলেছিলাম আমাকে একটু সময় দিন। দিয়েছিলেন? দেন নি। বরং অবিশ্বাস করে গেছেন। আমি ভুল করেছিলাম। আপনাকে জানানো দরকার ছিল আমার। জানায় নি সেদিন। পারিনি। কারণ আমি জানতাম আপনাকে জানালে কোনো মতেই রাজি হতেন না। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমারও একটা মায়া আছে। হয়তো নারী জাতির মায়ার কারণেই এত প্রবলেম। আর রনি কে আমি সেদিন মানা করেই দিতাম। কিন্তু সে আপনার কছম দেওয়াতে এটা না করে আমি আর পারিনি। কিন্তু আপনি আমার কথা না শুনেই চলে এলেন এখান থেকে। তারপর? তারপর কি করেলন? আমার চরিত্রের সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন। সেখানে কি লেখা? আমার চরিত্র নষ্ট। আমাকে লেম দিয়েছেন বুকে টেনে তুলেছেন আরো কত কি। আমাকে আপনি ডিভোর্স দিতে চান। সেদিন না আমি সাইন করে দিয়ে এলাম। তারপর সব শেষ। হয়েছে কথা এখন আপনি যান। এখান থেকে চলে যান আপনি।”
চোখের পানি পড়তে পড়তে এক নাগাড়ে কথা বলে দম নিল সে। ভেতরটা রীতিমত কাঁপছে। খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছে।
“আমি স্বীকার করে নিচ্ছি আমি ওগুলি বলে ঠিক করিনি। হয়তো পরিস্থিতি আমাকে অবিস্বাস করতে বাধ্য করেছে। তূবা একবার ভেবে দেখো আমার বিষয়টা। আমার জায়গায় নিজে দাঁড়িয়ে দেখো। সেদিন আমি ওগুলি করলে তুমি কি করতে? তুমি কি অবিশ্বাস না করে আমাকে সুন্দর ভাবে মেনে নিতে?”
থমকে গেল তূবা। সত্যি এটা কখনো সে চিন্তা করেনি। সে ওই জায়গায় থাকলে কি করতো তা জানে না। মাথাটা এখন শূন্য লাগছে। তবুও অবচেতন মন আহফিনের বলা সেদিনের কড়া কথাগুলিই মনে করাচ্ছে। অভিমানের পাহাড়টার ওজন ক্রমশ আরো ভার হয়ে উঠছে।
“বলো তূবা কি করতে তখন? ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো প্রতি মায়া দেখানো দেখলে কতটা জ্বলতে তা তোমার ধারণায় নেই তূবা। আমি অসহায় ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল তুমি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছো। তোমাকে হারানোর ভয় ছিল মনে। তোমার চেয়ে আমাকে আর কে ভালো জানে তূবা? তুমি তো জানো আমার রাগ টা একটু বেশি। সামলাতে পারি না নিজেকে। রাগের বসে বলে ফেলেছিলাম। তাই বলে তুমি আমাকে এত বড় শাস্তি দিয়ে চলে আসবে?”
তূবার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আশপাশ ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে। কিছু না বলে চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই আহফিন তার হাত ধরে নিল। হেচকা টানে নিজের দিকে ফিরিয়ে বাহু আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করল।
“এত বাড় শাস্তি কেন দিলে আমায়? একটু চিন্তা করলে না আমি তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকব কি করে?”
“….
“তুমি তো দেখি বেশ সুখেই আছো। হয়তো স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ আছো।”
তূবা রাগে কিংবা অভিমানে চোখ বন্ধ করে নিল। আহফিন তাকে ঝাঁকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
“তাহফিবা কে তূবা? বলো তাহফিবা কে? কি করে তুমি পারলে এমন টা? তাহফিবা..”
কথাটা শেষ করার আগেই তূবা আবার ফের ঝাটকা দিয়ে সরিয়ে দিল আহফিন কে। গলা ছেড়ে বলল “তাহফিবা আমার মেয়ে। ও আমার মেয়ে শুনেছেন আপনি? ওর বাবা মা সব আমি। ওকে একাই জন্ম দিয়েছি। একা বড় করছি। আর সেটাই করব। ওর আর কাউকে দরকার নেই। দরকার নেই কাউকে। এসব জেনে আপনার কি? কেউ না আপনি ওর। কেউ না। তাহফিবার রক্তে আমি বাদেও আহফিন নামের একটা মানুষের রক্ত বইছে। কিন্তু ওর বাবার দরকার নেই। ওর জন্যে ওর মা’ই যথেষ্ট। চলে যান এখান থেকে।”
তূবা এক প্রকার দৌড়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল দিল।
আহফিন নির্জীব নিবার্ক। মনে হচ্ছে আসমান ভেঙ্গে তার মাথার উপর এসে পড়েছে। শেষের কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারছে না সে। দুই পা পিছিয়ে গেল। নিশ্বাস টা গলায় এসে যেন আটকে গেছে। বুকের বা পাশে যেই মাংসপিন্ড টা আছে। যার নাম হৃদপিন্ড সেটা থেমে থেমে উঠানামা করছে। সেখানে চিনচিনে একটা ব্যথাও হচ্ছে। একদমই সহ্য করতে পারছে না আহফিন। অতি কষ্টে শুকনো গলাটা ঠোঁটের লালা দিয়ে ভিজিয়ে নিল সে। ঢোকটাও যেন গিলতে পারছিল না। চোখ গুলি এখন অনেক ঝাপসা হয়ে আসছে। তাহফিবা তার মেয়ে। তার রক্ত চলাচল করছে তাহফিবার শরীরে? নিজের মেয়েকে নিজেই চিনতে পারল না। আহফিন ধপ করে জমিনে দেওয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল। ঠোঁট গুলি অনবরত কাঁপছে। হঠাৎ গলা ছেড়ে বিকৃতস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠল আহফিন। সেই চিৎকার তূবার বুকে ছুড়িঘাত করছিল। কান গুলিতে গরম তেল ফেলে দেওয়ার মতো জ্বলে উঠছে। আহফিনের চিৎকার করা কান্না গুলি তার চোখের পানি আর বুকের কষ্ট কে দ্বিগুণ করে দিচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে তূবা। চলে আসার সময় নিজেও জানত না তার মাঝে আরেকটা প্রাণ আছে। তাহফিবা কে দুই মাসের গর্ভে নিয়ে সিলেট এসেছিল সে। কম কষ্ট সহ্য করতে হয়নি তাকে। মায়ের একটা চেইন আর বালা দুটি বন্ধক রেখে শুরু করেছিল নতুন করে। দিনের পর দিন না খাওয়া পরিশ্রম আর চেষ্টায় আজ সে স্বাবলম্বী। কিন্তু এখন বোধগম্য হারাতে বসেছে রাগ আর অভিমানের বশে। সে জানে না কি করবে এখন। কিন্তু ভেতরটা যে ফেটে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।
সন্ধ্য গড়িয়ে রাত নেমে এলো। আহফিন নিজের কান্না থামিয়ে চোখ মুছে নিল। মাটি থেকে উঠে দেওয়াল বেদ করে ভেতরে প্রবেশ করল। বাঁধা হলো দ্বার। দরজায় অনবরত ডেকে চলেছে তূবা কে। তাহফিবা কে সে জড়িয়ে ধরতে চায়। আহ মেয়ে কে কাছে পাওয়ার কত সেই আকুতি আহাজারি! কত বেদনাময় দৃশ্য!
“মাম্মাম হিরো আঙ্কেল কাঁদছে কেন?”
“….
“ও মাম্মাম হিরো আঙ্কেল কে ভেতরে আসতে দিচ্ছে না কেন?”
সোফা থেকে টেনে তুলল তাহফিবা কে। কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে চুমু খেলো। তারপর স্নিগ্ধ স্বরে বলল,
“মাম্মাম তুমি না বলতে তোমার পাপা কোথায়? সবার বাবা আছে তোমার কেন বাবা নেই বলতে না?”
“হ্যাঁ মাম্মাম আমার বাবা কোথায়? কোথায় আমার পাপা?”
“যাকে তুমি হিরো আঙ্কেল বলো সে তোমার আঙ্কেল নয়। উনিই তোমার পাপা। তোমার বাবা সে তাহফিবা।”
তাহফিবা অস্থিরস্বরে বলতে লাগল “আমি বাবার কাছে যাবো আমি বাবার কাছে যাবো।”
“না তুমি বাবার কাছে যাবো না।”
“আমি যাবো।”
তূবা ধমক দেওয়াতে তাহফিবা কান্না করা শুরু করল। দরজার ওপাড় থেকে সব কথাই শুনছিল আহফিন। মেয়ের কান্না শুনে ভেতরটা মরীচিকার মতো হাহাকার করছে। ফেটে যাচ্ছে বুক টা। এক নাগাড়ে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলতে লাগল “তূবা দোহাই লাগে দরজা খুলো। আমাকে আমার মেয়ের কাছে যেতে দাও। ও কাঁদছে। প্লিজ দরজা খুলো তুমি। তূবা।”
ভেতর থেকে আওয়াজ না পেয়ে এবার রেগে মেগে আহফিন আবার বলল,
“তুমি যদি দরজা না খুলো তাহলে কিন্তু আমি দরজা ভেঙ্গে ফেলব তূবা। দরজাটা খুলো। আমাকে আমার মেয়ের কাছে একটু যেতে দাও তূবা।”
ধারস্ত গলায় তূবার জবাব পাওয়া গেল।
“আমি দরজা খুলব না। আপনার আবার কিসের মেয়ে? কোথায় ছিলেন এতদিন? একটু আগেই তো উল্টাপাল্টা কথা বলছিলেন। এখন আমি বলার পর মেয়ের প্রতি দরদ বেড়ে গেছো? চাই না আমাদের কাউকে। চলে যান আপনি।”
“আমাকে কেন বুঝতে চাইছো না তুমি? কেন এত টা নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছো আমার প্রতি? আমাকে এত বড় শাস্তি দিও না তুমি তূবা। অনুরোধ তোমাকে আমার মেয়ের কাছে যেতে দাও। যেতে দাও তূবা। ও আমার কাছে আসার জন্যে কাঁদছে তূবা। প্লিজ যেতে দাও আমাকে আমার মেয়ের কাছে।”
কান্নার স্বরে বলতে বলতে আহফিন নিচে বসে পড়ল।
হঠাৎ ঝুম ধারে বৃষ্টি নামল। ঝপঝপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষণের শব্দে চারিদিক মুখরিত করে তুলছে। অন্ধকার রাত। তার মধ্যে সেই যোগসূত্রের বৃষ্টি। এমনি এক বর্ষার মুষলধারে বৃষ্টি ভেজা রাতে তাদের দেখা হয়েছিল। প্রথম মিলন হয়েছিল। মনে গেঁথে গিয়েছিল মুখ। আজ আবার সেই বৃষ্টি। সেদিনের বর্ষার এক রাতে এর মতোই কি আজও একত্রিত হওয়া সম্ভব? পরিবেশ পরিস্থিতি কি তাই চায়?
জানালার ঝাপটা হওয়ায় আসা বৃষ্টির পানি ঘরকে ভিজিয়ে তুলছিল। জানালা লাগাতে দিয়ে তূবা সামনে তাকিয়ে বৃষ্টি ভেজা আহফিন কে দেখে চমকে উঠল। সে ভেবেছিল আহফিন বোধহয় চলে গেছে। কিন্তু একি আহফিন তো বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে গেছে। তবুও ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। তূবা স্পষ্ট দেখছিল আহফিন কাঁপছে ঠান্ডা হওয়ায়। তূবার ভেতরে মায়ার থেকে বেশি রাগ হলো। এই লোকটা বড্ড জেদি। আগেও জেদ ছিল ওখনো আছে। সারারাত ভিজবে অর্ধেক মরে যাবে তবুও এখান থেকে সরবে না। রাগে দাঁত কটমট করতে করতে তূবা গিয়ে দরজা খুলে দিল। আহফিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছিল তূবা কে। বৃষ্টির পানি মাথা বেয়ে চোখে পড়তে লাগল। মিটিমিটে চোখের আভায় দেখা যাচ্ছে তূবা কে। ওই তো তূবার গাল ফুলে আছে। তার আগের মতোই কি রাগ হলে গাল ফুলে যায়? নাকের ঢগাও কি লাল হয়ে আছে?
তূবা কিছু না বলে দরজা থেকে সরে ভেতরে চলে গেল। এক বিন্দু হেসে আহফিন মৃদু পায়ে ভেতরে গেল। দরজায় পা রাখতেই তাহফিবা “বাবা” বলে দৌড়ে এলো। এসেই জড়িয়ে ধরল আহফিন কে। ভিজে শার্টের পানিতে তাহফিবাও ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু বাবার গলা ছাড়ছে না। তার মুখে মিষ্টি হাসি। খুব শক্ত করেই ধরেছে বুঝতে পারছে আহফিন। বারবার বাবা বাবা বলে ডাকছে শুধু। আহফিন চোখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েকে জড়িয়ে। এটা কতটা সুখের আর তৃপ্তির কান্না সে কাউকে বলে বুঝাতে পারবে না। আহফিনের কান্নার ঝলকে উপরটান উঠে যাচ্ছে এবার। আড় চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে তূবা দেখছে। ভেতরটা তারও ভার হয়ে আসছে। রক্ত কি চাইলেও আলাদা করা যায়? এই ভালোবাসা কিভাবে ছিন্ন করবে সে? চোখের কোণার পানিটা মুছে নিল। নিজেকে শক্ত করে কাঠ কাঠ গলায় তাহফিবা কে বলল
“তুমি ভিজে যাচ্ছো তাহু। ভেতরে গিয়ে চেঞ্জ করে না।”
একটু থেমে আবার বলল “আর কাউকে বলে দেও জামা কাপড় খুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে নিতে। নয়তো নিউমোনিয়া হয়ে আমাদের বাড়িতে পড়ে থাকবে। ওসব জ্বালা নিতে পারব না।”
তূবা ভেতরে চলে গেল। যাওয়ার আগে রিমা কে ইশারা করলে সেও মাথা নাড়িয়ে ভেতরে গেল।
আহফিন মেয়ে কে বুক থেকে উঠিয়ে চোক মুখে সহস্র চুমু দিয়ে বড়িয়ে দিচ্ছে।
“আমার মেয়ে তুই। আমার রক্ত। আমার মেয়ে।”
আবার জড়িয়ে ধরল তাহফিবা কে।
“আমি ভুল করে ফেলেছি আম্মু। আমার টুনটুনি ময়না পাখি সরি এত দিন তোমার থেকে দূরে থাকার জন্যে। তোমার মাম্মাম টা না খুব পঁচা। খুব!”
“মাম্মাম মুটেও পঁচা নয়। মাম্মাম এখন রেগে গেছে।”
“মাম্মাম পাঁচ বছর আগে থেকেই রেগে আছে।”
মৃদু গলায় বলল আহফিন।
মেয়ে কে যতই জড়িয়ে ধরছে বুক যেন শীতল হয়ে উঠছে। স্বাদ মিটছেই না। মুখে চারপাঁচ ধাপে অসংখ্য চুমু দিয়ে ফেলেছে সে। মনে হচ্ছে কলিজায় ঢুকিয়ে রাখতে। একেই বুঝি বলে রক্তের টান! লুকিয়ে লুকিয়ে তূবা সব দেখছে। আহফিনের চোখ মুখ লাল হয়ে ফুলে যাচ্ছে। নিশ্চয় জ্বর উঠবে সেই করে।
“আম্মু যাও তুমি একদম ভিজে গেছো। কাপড় চেঞ্জ করে ঘুমাতে যাও।”
“তুমি চেঞ্জ করবে না বাবা?”
ঠোঁট উল্টে আহফিন বলল, তোমার মাম্মাম কি আমার জন্যে কাপড়চোপড় এনে আদর করে ঘরে তুলেছে নাকি?”
তাহফিবা কি বুঝল কে জানে? দাঁত কেলিয়ে ফিক করে হাসল। আহফিনও মৃদু হাসল। তূবা অপলক তাকিয়ে রইল সেই হাসির পাণে। যেন মরুভূমিতে এক ফোঁটা বর্ষার আভাস।
তাহফিবা ভেতরে গেল। আহফিন এবার নিচ থেকে উঠল। এতক্ষণ টের না পেলেও শরীর টা এখন বেশ ঠান্ডা লাগছে। দাঁতে দাঁত বারি খাচ্ছে। ঠান্ডা আভা যেন হাঁড় কেও হীম করে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে কাঁপা হাতে নিজের শার্টের বোতাম খুলতে লাগল আহফিন। শার্ট টা খুলে দরজার একপাশে রেখে দিল। তূবা ধ্যান ধরে তাকিয়ে আছে আহফিনের বুকের দিকে। আহ কতশত রাত কেটে এই বুকে! এই বুকের উপর বালিশ হিসাবে না শুলে ওই মানুষটার নিশ্বাসের গরম আভা মুখে না পরলে তার ঘুমই হতো না। সব কিছু যেন তাজা লাগছে। সব স্মৃতি যেন চোখের সামনে ভাসছে তূবার। ভেতরটা কেমন আবেগে পুলকিত হতে শুরু করেছে তার।
একটা টাওয়াল নিয়ে গিয়ে তূবা আহফিনের দিকে এগিয়ে দিল। আহফিন শান্ত চোখের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তূবার দিকে। সেই অনুভূতি, সেই আবেগ, সেই মোহ। তূবা কে সেই আগের অজানা রাজ্যে নিয়ে যেতে লাগল। সে আহফিনের ওমন চাউনিতে ইতস্তত বোধ করছে। ঠিক যেমন মানুষটার সাথে দেখা হওয়ার প্রথম প্রথম লাগত সেরকম। বুকের ধুকবুকানি টা সেই আগের মতোই বাড়তে শুরু করেছে তার। তূবা ওকে ওমন আবেগি মোহময় চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহফিন কয়েক কদম এগিয়ে এলো তার দিকে। আহফিনের এগিয়ে আসা দেখে তূবার বোধগম্য ফিরে এলো। মস্তিষ্ক কাজ করতে শুরু করেছে মোহতা ভেঙ্গে। ঘন চোখের কালো পাপড়ি মিটিমিটি ফেলে দুই কদম পিছিয়ে গেল। ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বলল “এ এটা পড়ে নিন। নয়তো অসুস্থ কোনো মানুষ কে এখানে রেখে আমি টা টানতে পারব না।” আহফিন কোনো জবাব দিল না। সে এগিয়ে এলো আরো কাছে। তূবা দুই, তিন, চার কদম পিছিয়ে যেতেই খাম্মায় গিয়ে আটকাল। আহফিন এক হাতে তূবার যাওয়ার পথ আটকাল। তূবা অন্য পাশ দিয়ে যেতে চাইলে আহফিন সে দিকেও অন্য হাত খাম্মায় ঠেস দিল। এবার তূবার দূরে যাওয়ার সম্পূর্ণ পথ আটকা। তূবার নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। কাঁপা চোখের পাতায় তূবা তাকাল আহফিনের দিকে। আহফিন আচমকা তূবার কপালে চুমু দিয়ে দিতেই সর্বাঙ্গে কেঁপে উঠল সে। আহ শুকনো গলায় এক ফোঁটা পানি! সে কি অনুভূতি তূবার শিরায় শিরায়।
মৃদু গলায় বলল “সরি।”
তূবা কি জবাব দিবে বা এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্যে জোর খাটাবে। শরীরে কথা বলার মতোই এক বিন্দু শক্তি পাচ্ছে না সে। আহফিনের শরীরের স্পর্শে, ঠোঁটের পরশ, গরম নিশ্বাসে সে উষ্ণ হয়ে উঠছে ক্রমশ। চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে চাইছে।
হঠাৎ গলা কাঁশকি তে আহফিন তূবার হুশ এলো। দুজনই দুদিকে সরে গেল। রিমা মিটিমিটি হাসে। ইশশ কি ভুল সময়েই না সে এসে পড়ল! কি হতো একটু বাদে আসলে? নিজের কাছেই আফসোস হয় রিমার।
হাতে এক গ্লাস গরম দুধ। রিমা কেও এভাবে চুপ থাকতে দেখে তূবা ধরে আসা গলায় বলল
“রিমা গ্লাসের দুধ না উনাকে খেতে বলিস। অসুস্থ হয়ে এই বাড়িতে থাকার বাহানা চ চলবে না।”
তূবা লম্বা কদমে চলে গেল ওখান থেকে। আহফিন জানে তূবা রাগে নয় বরং লজ্জায় চলে গেছে। নাক টা ফুলে উঠেছে তার। গালও লাল হয়ে গেছে। সুতারাং তূবার মাঝে লজ্জা ঝাঁকে ঝাঁকে এসে বসেছে। কি ভেবে যেন এক চিলতা হাসল আহফিন।
একটু বাদে তূবা তাহফিবা কে ঘুম পাড়িয়ে সামনের রুমে গেল। বাহিরে তখনো ঝুম বৃষ্টি। আজ যেন বৃষ্টি কমার নামই নেই।
আহফিনের গায়ে তখন শুধু মাত্র একটা টাওয়াল। সেই আগের মতোই লাগছে সব কিছু তূবার কাছে। যখন সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে সবেমাত্র গোসল করে এসে আহফিন তার সাথে খুনশুটি করত। সেদিন গুলির মতোই লাগছে সব। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তূবা। আহফিনের চোখের পলক যেতেই তূবা ঘাবড়ে গেল। চোখ নামিয়ে এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকাল। আহফিন কিঞ্চিৎ হেসে বলল “নজর দিচ্ছো নাকি?”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তূবার। ভ্রুকুঞ্চন করে সে আহফিনের দিকে তাকাল। অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলল না সে। এই লোকটাকে এখন একটু লেম দেওয়া মানে বাদর কে মাথায় তুলে ফেলা।
তূবা নাক শিটকে বলল “রাতের খাবার খেয়ে ড্রয়িংরুমে ঘুমিয়ে যাবেন আপনি। আর কাল সকালেই নিস্তার দিবেন আমাদের।”
তূবা চলে যেতে নিলে আহফিন তার হাত শক্ত করে ধরে হেচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। তূবা কে বুঝে উঠার সুযোগ না দিয়ে সে তার কোমড় পেঁচিয়ে আনল হাতে। আরো একটু টেনে কাছে এনে মুখের সামনে গরম নিশ্বাস ফেলে দিল। রাগে তূবা দাঁত কিটে বলল
“ছাড়ুন আমাকে। লজ্জা করে না চরিত্র নেই এমন মেয়ে কে ছুঁয়ে দেখছেন।”
“না করে না। তুমি জানো না পুরুষ মানুষের লজ্জাশরম কম।”
আহফিনের জবাবে তূবার রাগ করার কথা না হাসার সেটাই ভুলে গেছে। পুতুলের মতো তাকিয়ে রয়েছে আহফিনের দিকে। আহফিনের মাথায় হয়তো শয়তান বারি দিয়েছে তাই বাঁকা হেসে সে তূবার গালের পাশে হাত রাখল। কাছে এনে ঠোঁটে ঠোঁট বুলিয়ে দেওয়ার আগেই তূবা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তাকে।
“বেহায়া বেশরম লোক কোথাকার। এমন করলে এখনি এই বৃষ্টির মাঝে বের করে দিবো।”
“তো আমি আসতে চেয়েছি নাকি? তুমিই তো নিয়ে এলে।”
বিস্ময়ের চরম সীমায় উপনীত হয়েছে তূবা। এই লোক কি বলে? সে আসতে চায় নি?”
চোখ ছোট ছোট করে দিয়ে তূবা তার দিকে তাকিয়ে বলল “আল্লাহ কি ডাহামিথ্যে কথা। আল্লাহ সইবে না এসব কথা।”
“….
আহফিন মুখ এমন ভাব করেছে যেন সে সত্যি বলছে।
“আপনি বের হোন। এখনি বের হোন এখান থেকে।”
“প্রশ্নই আসে না।”
রেগে গিয়ে তূবা জোর গলায় কথা বলতে শুরু করেছে।
“প্রশ্ম আসে না মানে? আপনি আমার বাসা থেকে বের হোন। নাহলে আমি কিন্তু পুলিশ ডাকব।”
“তো ডাকো।”
“আপনি কিন্তু..”
“আমি তোমার হাজবেন্ট এটা মাথায় রাখো ডিয়ার।”
“হাজবেন্ট মাই ফুট। আমি না আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে এলাম?”
“ডিভোর্স? একটা সাদা কাগজে সাইন করে দিয়ে আসলেই ডিভোর্স হয়ে গেল?”
“সাদা কাগজ মানে? বলেছি না আপনি যা ইচ্ছা বসিয়ে নিবেন।”
“হ্যাঁ বসিয়েছি তো।”
কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল “কি বসিয়েছেন?”
“ওই যে তূবা আমার বউ। মরার আগ পর্যন্ত কঠিন আঠার মতো লেগে থাকব।”
“আপনি কিন্তু এখন বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।”
“আরে বাবা আমার ভুল হয়েছে তোমারও ভুল হয়েছে। সমান সমান। আমাদের দুজনেরই ভুল হয়েছে। এটা এখানেই শেষ। এখন এটা নিয়ে ঘাটলে কি হবে? আমাদের দুজনের জন্যে তো আর আমাদের মেয়ের ক্ষতি হোক সেটা কেউই চাই না। একবার সব ভুলে ফিরে এসো তূবা। আমি আর কখনোই এমন করব না। প্লিজ সরি তূবা। আমি তোমাকে আর আমার মেয়ে চাই।”
তূবা কিছু বলতে যাবে ওমনি আচমকা বিদ্যুৎ চমকিয়ে উঠল। বজ্রপাত হওয়ার আগেই তূবা দৌড়ে আহফিন কে জড়িয়ে ধরল। চোখ মুখ এক করে আহফিনের বুকে লুকিয়ে রয়েছে যেন। আহফিন কিঞ্চিৎ হেসে তূবা কে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল। বিকট শব্দে তূবা নখ খামছে ধরল আহফিন কে। আহফিন এতে আবেগের ছুঁয়ায় আগের চেয়ে বেশি ঠোঁট প্রসারিত করল।
পরিবেশ ঠিক হলে তূবা আহফিন কে ছেড়ে দিল। জোরে দূরে ঠেলে সরে এলো সে। চুল ঠিক করতে করতে আহফিনের দিকে তাকাল।
মৃদু হেসে আহফিন নিজ থেকে বলল “আর কিছু করেও তুমি আমার থেকে দূরে যেতে পারবে না। তোমাকে আর কোনো কারনেই যেতে দিবে না আহফিন। তোমাকে বাকিটা জীবন তার সাথেই কাটাতে হবে। আহফিন তোমাকে সবটা দিয়ে চায়। তুমি শুধু আমার।”
তূবা নির্বাক।
হঠাৎ বর্ষণের এই বৃষ্টি ভেজা রাতে বিকট আওয়াজে আবার আকাশ ফেটে গর্জে উঠা বজ্রপাতের ধ্বনি শুনা যায়।
সমাপ্ত