ওই_আকাশটা_আমার_ছিল পর্ব ৮

#ওই আকাশটা আমার ছিল
#রোকসানা আক্তার
বোনাস পর্ব

১১.
তুলতুলে সাদা বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে পৃথী।তার মাথার ছোট্ট ছোট্ট চুলগুলো বাতাসের গতিতে বারবার দুলে উড়ছে।সাথে গোলাপী ভেঁজা ঠোঁট দুটোও।
অয়ন দুই হাত ভাঁজ করে বিছানার এককোণে দাঁড়িয়ে পৃথীর দিকে স্থির চাহনিতে তাকিয়ে আছে।খুব বেশিই ভয় পেয়েছে মেয়েটি।যার কারণে সেন্স হারিয়ে ফেলেছে।ডাক্তার বলেছে আগামী চার-পাঁচ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরতে পারে।কিছুক্ষণ আগেই হলো পৃথীকে ডাক্তার দেখে গেছে।এখন পৃথী অয়নের বাসায়ই আছে।পৃথীর জ্ঞান ফিরলে অয়ন পৃথীকে বাসায় পাঠাবে।
িি
“ভাই?আপনার কফি?”

অয়ন পাশ ফিরে তাকায়।দেখে রিফাত কফি নিয়ে এসেছে।পৃথী সেন্স হারানোর পর থেকেই তার মাথাটা প্রচন্ড মাথা ধরেছে।তাই রিফাতকে দিয়ে এক মগ কফি বানিয়ে আনায়।অয়ন এগিয়ে রিফাতের হাত থেকে কফির মগটা হাতে নেয়।তারপর দরজা থেকে কিছুটা সরে এসে ভ্রু যুগল কুঁচকে কফিতে চুমুক লাগায়।এক ঢোক গিলতেই রিফাত বলে উঠে,

“ভাই,কফিটা কেমন হয়েছে?”

অয়ন জবাব দেয়না।সে আবার কফিতে চুমুক লাগায়। রিফাত আবারো বলে উঠে,
“ভাই বলেন না কেমন হয়েছে?”
“তোমাকে আমি কি এখন কফির মেটেরিয়ালস ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেছি?”
“নাহ ভাই!”
“তাহলে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করছো কেন?জানোই ত আমি বেশি কথা বলতে পছন্দ করি না।”
“সরি ভাই।আসলে ভাই ভাবলাম চিনিটিনি আবার কম হলো কি না…!”
“যাও এখন!”

রিফাত মাথাটা নুইয়ে চলে যায়।অয়ন কফিটা শেষ করে মগটা টি-টেবিলে রাখে।তারপর সালমাকে ডাক দেয়।সালমা এই বাড়িরই একজন গৃহকর্মী।তার কাজ প্রতিটি রুম,রেলিং,জানলা এবং দরজা মোছা।অর্থাৎ মোছামুছির কাজ।মোছামুছি তে সে খুবই পারদর্শী।অত্যন্ত নিঁখুতভাবে করে সব।এরজন্যে অয়ন খুশি হয়ে তাকে মাসের বেতনের পাশাপাশি এক্সট্রা টাকাও বাড়িয়ে দেয়।সালমা এসেই বলে,

“জ্বী সাহেব,বলেন?”
“পৃথীর দিকে এলার্ট থেকো।ওর জ্ঞান ফিরলে আমাকে ডাক দিও।আমি পাশের রুমেই আছি।”
“আচ্ছা ভাইজান।”

অয়ন পাশের রুমে এসে একটা সিগারেট ধরায়।তা মুখে নিয়ে হা করে বড় একটা ধোঁয়া ছেড়ে চেয়ারে আবার মাথাটা এলিয়ে দেয়।ইদানীং তার কেনজানি কোনোকিছুই ভালো লাগছে না।সবকিছুই খুব উলোটপালোট লাগে। এমনটা শুধু পৃথীকেই দেখলে অনুভূত হয়।অথচ এর আগে কতশত মেয়েকে সে দেখেছে তাদের কাউকেই তার ওরকমটা ফিল হয়নি।বাচ্চা মেয়ের মতো ফুটিফুটি কথা বলে,অতি সাধারণ তার চলাফেরা তারপরও মেয়েটির সবকিছুই তার ভালো লাগে।সে জানে না কেনো এতটা ভালোলাগে।কখনো নিজেকে সে খুঁটিয়ে দেখে না।খুঁটিয়ে দেখতে প্রয়োজন বোধও করে না।সে তার অনুভূতিকে শুধুই যন্ত্র মনে করে।কারণ যন্ত্রের যেমন অনুভূতি নাই।মায়া নাই।ভালোবাসা নাই।আবেগ নাই।ঠিক তারও সেইম!ভাবতে ভাবতে অয়ন আরেকটা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে।তারপর আবার আরেকটা সিগারেট হাতে নেয়।তারপর আবার ধোঁয়া ছাড়ে।এভাবে করতে করতে পুরো একটা প্যাকেট শেষ করে।তারপর আবার আরেকটা প্যাকেট হাতে নেয়।এভাবো তার সিগারেটের পেছনে দুই ঘন্টাই ব্যয় হয়ে যায়।এত সিগারেট সে কীভাবে খেতে পারে তা নিজেও জানে না।এই নিয়ে অয়ন মাঝে মাঝে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে।তারপর প্রশ্নটি নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবে।কিছু সময় ভাবার পর একটা উত্তর বের করে “পৃথিবীর একাকীত্ব মানুষগুলোই সবথেকে বেশি সিগারেট খায়।কারণ সিগারেটের নিকোটিনে তাদের মনের কষ্ট দূর হয়।ভুলে যায় তারা তাদের অতীত।বাঁচতে শিখে নতুন করে।এই সিগারেট আছে বিধায় ই তারা সুখে আছে।উৎসাহ পায় নতুন করে বেঁচে থাকার।”
ঠিক তখনই পাশের রুম থেকে সালমা দৌড়ে আসে।এসেই বলে,

“সাহেব?সাহেব?পৃথী ম্যামের জ্ঞান ফিরছে।”

সালমার কথায় অয়ন তার হাত ঘড়িটির দিকে তাকায়।সময় এখন-রাত ৯ টা বেঁজে চল্লিশ মিনিট।অর্থাৎ দীর্ঘ চার ঘন্টা পর পৃথীর জ্ঞান ফিরেছে!অয়ন তরহর পৃথীর কাছে যায়।গিয়ে দেখে পৃথী পিটপিট করে চারপাশে তাকাচ্ছে।সে আন্দাজ করতে চাইছে সে আসলে এখন আছে কোথায়।অয়ন দৃঢ় গলায় ডাকে,

“পৃথী?পৃথী?”

পৃথী অয়নের কথার শব্দ শুনে অয়নের দিকে তাকায়।অয়নকে দেখেই তার চোখমুখ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।অয়ন মুঁচকি হেসে বলে,

“তুমি এখন আমার বাসায় আছো!”

পৃথী মুহূর্তে শোয়া থেকে উঠে বসে।এতক্ষণে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে পৃথী বজ্র গলায় বলে উঠে,
“আপনার বাসায় আমাকে কেন এনেছেন?”
“তুমি সন্ধের দিকে চৌরাস্তা মোড়ে সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলে।সিদ্ধান্ত নিলাম তোমাকে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবো ।কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম চৌরাস্তা মোড় থেকে তোমাদের বাসাটা খুব দূরে।তোমার মেডিসিন দরকার আর্জেনলি,যেটায় তোমাদের বাড়ি গেলে খুব দেরী হয়ে যাবে।পাশেই যেহেতু আমার বাড়ি তাই এখানে নিয়ে এলাম।”
“আপনার মতো একটা খুনীর বাসায় আমাকে কেন নিয়ে এসেছেন।আপনার মতো খুনীর বাসায় আমি থাকতে চাই না।ঘেন্না লাগে আপনাকে আমার। এবং ভয়ও লাগে।প্লিজ আমার সামনে থেকে যান।”
“তাদের প্রাপ্যটা তাদের দিয়েছি।তারা এটারই প্রাপ্য ছিলো!”
“মেয়েদের একটু উত্ত্যক্ত করছে বলে তাদের একেবারে খুন করা লাগবে?আপনাকে আমি যদি কঠিন কিছু বলি তাহলে ত আপনি আমাকেও খুন করে ফেলবেন!কারণ আপনার ভেতরে মায়াদয়া বলতে কিচ্ছু নেই!আপনি একটা জানোয়ার থেকেও খারাপ!”

“জানোয়ার”-শব্দটি শুনামাত্রই অয়ন খুব জোরে পৃথীর গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়।চেঁচিয়ে বলে উঠে,

” এই মেয়ে?তুই আমার থেকে বেশি জানিস?বেশি বুঝিস?ওই দুইটা ছেলে কে চিনিস তুই?চিনিস না।এরা ওই এলাকার মস্ত বড় দুইটা বখাটে এবং ধর্ষকও!ওখান দিয়ে প্রায়শই মেয়েরা যাতায়াত করলে ওরা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে এমনকি এমন অনেক আগের সূত্র আছে এরা মেয়েদের ধর্ষণও করেছে।এদের আমি অনেক খুঁজেছি।পাই নি।তোমার মাধ্যমে ভাগ্য ভালো কাল খুঁজে পেয়েছি।এরকম বখাটেদের দুনিয়াতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। ব্যাস্ ফিনিসড!”

বলেই অয়ন রাগ রাগ চোখে পৃথীর দিকে তাকায়।দেখে পৃথী মাথা নুইয়ে গালে হাত রেখে অনবরত চোখের পানি ফেলছে।অয়ন এবার তার হাতের দিকে তাকায়,যে হাত দিয়ে সে পৃথীকে চড় মেরেছে।হাতের দিকে তাকাতেই তার
রাগটা আরো চড়ে যায়। তাও তার নিজের উপর।সে এবার বুঝতে পারে পৃথীর গাঁয়ে হাত তুলে সে খুব অন্যায় করে ফেলেছে।যেটা তার করা একদমই উচিত হয়নি। তার রাগ কেন এত বেশি!?কেন!কেন!এই রাগটার জন্যে তার সব শেষ!আজ সহ পৃথীর গাঁয়ে মোট সে দুইদিন হাত তুললো!কীভাবে পারলো? কীভাবে সে এতটা নির্দয় হতে পারলো?ভেবেই প্রচন্ড দিশেহারা মনে অয়ন ধপাস করে পৃথীর সামনে বসে পড়ে।ব্যথিত গলায় বলে উঠে,

“এই পৃথী কাঁদবে না। একদমই কাঁদবে না।”

পৃথী শুনছে না।শুধু চোখের পানি ফেলছে।তা দেখে অয়ন আবারো হতাশ হুতাশ কন্ঠে বলে,
“আই’ম সরি।আই’ম সরি,পৃথী। আমি একদমই কন্ট্রোলে ছিলাম না!আমি ইচ্ছে করে এরকম করিনি।আমাকে ক্ষমা করো দাও প্লিজ।নাহলে আমাকে চড় মারো।তোমার গাঁয়ের সর্বশক্তি দিয়ে চড় মারো!মারো!”

পৃথী এবার অয়নের দিকে তাকায়।তাকিয়ে থেকে তার ভেঁজা গাল মুছে নেয়।তারপর বিছানা থেকে নেমে বলে,

“কাউকে আমার চড় মারার ইচ্ছে নেই।আমি এখন বাসায় যাবো।।প্লিজ আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন!আমার আর এখানে ভাল্লাগছে না।”

অয়ন এ’কথায় আর কোনো প্রতিত্তর করলো না।সে নৈঃশব্দে পৃথীর কথা মেনে নেয়।তারপর সে নিজেই পৃথীকে বাসায় ছেড়ে দিতে আসে।তবে গাড়িতে থাকা বস্থায় দুজন দুজনের সাথে একটুখানিও কথা বলেনি।যখন পৃথী গাড়ি থেকে নামে তখন পৃথী অয়নের দিকে ফিরে বলে,
“আমাদের বাসায় ঢুকবেন না?”

অয়ন দু’পাশে মাথা নেড়ে বলে,
“আজ নয়।আরেকদিন যদি যাবো।তুমি বাসায় যাও।সবাই হয়তো চিন্তা করছে।টেক কেয়ার।”
বলেই অয়ন গাড়ি স্টার্ট করে পৃথীর সামনে থেকে চলে যায়।পৃথী অয়নের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আর মনে মনে বলে,
“অয়ন আমি তোমার উপর একদমই রাগ করিনি।তবে তোমাকে আইন নিজহাতে তুলে নেওয়ায় তা আমি মেনে নিতে পারছি না!”

১২.
পৃথী ঘরের ঢোকামাত্রই রহিমা এবং পিয়ারা বেগমের চোখ আনন্দে ছলছল করে উঠে।তৎক্ষনাৎ বসা থেকে দাড়িয়ে যান।তাদের ভাব-ভঙ্গিমা বলছে তারা এতক্ষণে পৃথীর জন্যে ভীষণ চিন্তায় ছিলেন।রহিমা এগিয়ে এসে বলেন,

“মা তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”
“গ্যাংটার অয়নের বাসায়!”

এ’কথা শুনে রহিমা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। সেইম পিয়ারা বেগমও!দুজনে দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় ইঙ্গিত করে বলেন”মেয়ে এসব কী বলছে?!”পিয়ারা ইশারায় উত্তর করে,”আমিও বুঝতেছি না।”

“পৃথী ওই বাসায় কেন গিয়েছিলি?কী জন্যে?”
“এখন এতকিছু বলতে পারবো না মা।আমার ভীষণ ক্লান্তি লাগছে।একটু ঘুমাবো।”

বলেই পৃথী রহিমা এবং পিয়ারা বেগমকে পাশ কেঁটে সোঁজা নিজের রুমে চলে আসে।পৃথী তার রুমে ঢোকার পর রহিমা বলে,
“মেয়ে কোথায় যাচ্ছে কী করছে কিছুই বুঝতেছি না।”

চলবে….#ওই আকাশটা আমার ছিল
#রোকসানা আক্তার
পর্ব-০৮

পৃথী রুমে ঢুকেই ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে বিছানার দিকে যায়।মাথাটা তার খুব ধরেছে।তারসাথে অনেকটা ক্লান্তিভাবও।ঘুম দিলে হয়তো দুটোই ঠিক হয়ে যাবে।কিন্ত সে চাইলেও এখন আর তার ঘুম আসবে না।ইতোমধ্যে অয়নের বাসায় সে কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে এসেছে। বিছানার উপর আলতোভাবে বসে পৃথী।চোখজোড়া কিছুটা ছোট করতেই চোখের সামনে আজকের দিনে ঘটে যাওয়া সবগুলো ঘটনা এক এক করে ভেসে ওঠে।অয়ন বখাটে দুটোকে হত্যা করা।তার অজ্ঞান হওয়া।সেই অজ্ঞানে আবার অয়নের বাসায় যাওয়া।জ্ঞান ফিরলে অয়নের সাথে মিসআন্ডার্সটেন্ডিং হওয়া..!মায়ের সাথে হাসিমুখে বেরিয়ে এমন খারাপ মুহূর্তগুলোতে সে শিকার হবে ভাবতেও পারে নি।তবে সবথেকে মনে দাগ কেঁটে থাকবে অয়ন ওই দুটা ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যা করার দৃশ্যটি।এই ঘটনাটায় পৃথী খুব হার্ট হয়ে যায়।এখনো তার হার্টবিট টগবগ করছে।টগবট হার্টবির্টের প্রতিটি শব্দ বারবার বলছে,”প্লিজ অয়ন,কাউকে হত্যা করবেন না!হত্যা করার মুহূর্তটা খুবই ভয়ংকর হয়।আমার খুব ভয় লাগে।”

এরইমাঝে রহিমা একগ্লাস শরবত হাতে নিয়ে মেয়ের রুমে ঢুকেন।মেয়ের কাছে যেয়ে বলেন,
“পৃথী?তোরজন্যে একগ্লাস লেবুর শরবত এনেছি।শরবতটা খা।মাথাটা একটু ঠান্ডা হবে।তারপর আমরা দুজনে অনেক কথা বলবো।”

পৃথী রহিমার কথায় মাথাতুলে তাকায়।কথা বলার মাঝে তার মার চোখমুখে একটা ছলছলা ভাব।ছলছলা ভাবটা কিসের পৃথী তা ধরতে পারে।অত্যুক্তি গলায় বলে,
“অয়নের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে তাই তো?”

রহিমা মগটা একপাশে রেখে ওমনি মেয়ের একদম গাঁ ঘেঁষে বসে যান।তারপর বাচ্চামেয়েদের মতন বলে উঠেন,
“তুই অয়নের বাসায় গিয়েছিস আমাকে একবারও বললি না কেন?”
“তো বললে কী করতে?”
“আমিও যেতাম।”
“একবার তো গিয়ে ফিরে আসলে।”
“কিন্তু আবার গেলে ত দেখা করতে পারতাম।”
“কে বলেছে দেখা করতে পারতে?”
“এই যে তুই দেখা করে আসলি?”
“আমার সাথে উনার দেখা হয়নি।”
“তাহলে তুই গিয়েছিলি কেন ওই বাসায় তাও আবার এতরাত করে বাসায় ফিরলি?”
“আমার টিউশনি শেষ হয় ৬ টায়।তারপর ওখান থেকে অয়নের বাসায় যাই।বাসায় যাওয়ার কারণ তখন তোমার সাথে গিয়ে মনের ভুলে ব্যাগটা ওখানে রেখে আসি।ওটা আনতে যাই।তবে ভাগ্য ভালো দারোয়ান আমার ব্যাগটা পেয়ে তার কাছে রেখে দিয়েছে।তারপর ওখান থেকে ফিরবো এমন সময় দেখি রাস্তার উপর বাস,কার,মোটরবাইক একে একে সব দাঁড়িয়ে।পরে খবর নিয়ে জানলাম অর্থমন্ত্রী যাবে সেকারণে সামিয়ক সময়ের জন্যে যানবাহন সব বন্ধ রেখেছে।এবার বুঝতে পেরেছ কেন দেরী হয়েছে?”
“ওহ..!কিন্তু তুই প্রথমে বাসায় ফিরে যেভাবে বললি অয়নের বাসায় গিয়েছিলি আমিতো মনে মনে কতকিছুই না ভেবে ফেলেছি!”
“কী ভেবেছিলে?”
“অয়ন তোকে দেখে খুশি হবে। হাসিমুখে বলবে বসতে।তুই বসবি।তারপর তোকে চা দিবে।বিস্কুট দিবে।আরো অনেক আইটেমের খাবার দিবে।খাওয়ার মাঝেই হুট করে আমার কথা জিজ্ঞেস করবে -আমি কেমন আছি?সুস্থ হয়েছি কি না।তুই বলবি-তেমন সুস্থ হইনি।সময় লাগবে।অয়ন বলবে-আচ্ছা,আমি সময় পেলে আপনার মাকে দেখতে যাবো।তারপর আমাদের বাসা আসবে।আমাদের সাথে ভালো একটা সম্পর্ক হবে।পরে তোর সাথে সেই একটা ভাব হয়ে যাবে।জানিস তোর পিয়ারা নানু কি বলে?”
“কি?”
“অয়নের সাথে তোর নাকি ভাব আছে!”
“কেন?”
“এই যে রাত করে বাসায় ফিরেছিস তাই সন্দেহ করেছে।তা আমি কি জবাব দিয়েছি জানিস?”
“কি?”
“বলেছি আমার মেয়েকে ত অয়ন এখনো দেখেই নি এবং চিনেও না।তা ভাব হবে কীভাবে!তবে দোয়া করো ভাবটা যেন হয়। ”
বলেই রহিমা চোখ টিপে একটু হাসেন।পৃথী তার মার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে।এই মহিলাকে তার মাঝে মাঝে মনে হয় এই তিনি মা, এই বান্ধবী,এই আবার বাচ্চা।
“পিয়ারা নানু চলে গেছে?”
“হুম।”
“ওহ। আমার মাথাটা খুব ধরেছে।একটু টিপে দিবে মা?”
” আচ্ছা কোলে মাথা রাখ ।টিপে দিচ্ছি।”

পৃথী তার মার কোলে মাথা রাখে।রহিমা অতি যত্ন হাতে মেয়ের মাথা টিপে দিতে থাকেন।মার প্রতিটি আদুরে স্পর্শে মুহূর্তে পৃথীর মাথাটা হালকা হতে থাকে।চোখে তন্দ্রাচ্ছন্ন একটা ভাব চলে আসে।পৃথী দুইচোখ বুঁজে নেয়।রহিমা বলেন,
“ঘুম আসে তোর?”
“নাহ..!”
“ভাত খাবি না?”
“পরে।”
“শরবতটা?
“পরে ।”
তারপর রহিমা আর কথা বাড়ান নি।মেয়ের শরীরটা একটু হালকা লাগলে পরে তিনি নিজেই নিজ হাতে মেয়েকে খাইয়ে দিবেন। এখন ক্লান্তি এবং মাথা ধরাটা কমুক।

১৩.

খুব বেলা করে পৃথীর ঘুম ভাঙ্গে।সে কাঁচুমাচু চোখ শোয়া থেকে উঠে বসতে নিলেই হঠাৎ চোখ যায় তার পড়ার টেবিলের দিকে।চেয়ারে নুহা বসে বসে টেবিলের উপর রাখা কিছু গুরুত্বপূর্ণ নোটস ঘাটাঘাটি করছে।নুহা পৃথীর বান্ধবী।দুজনে একই ভার্সিটি এবং একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে।তাছাড়া দুজনের বাসাটাও খুব একটা দূরে না,কাছাকাছি ই। দুজনে ভার্সিটি যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই একসাথে যাওয়া আসা করে।এই কয়েকদিন তাদের একসাথে যাওয়া হয়নি।রহিমার অসুখ থাকার কারণে।এবার রহিমা একটু সুস্থ্য হয়েছেন,হালকা হাঁটাচলা করতে পারছেন তিনিই নিশ্চয়ই নুহাকে গিয়ে খবর দিয়ে বলেছে,” আমার অসুখটা ভালো হয়েছে।কাল থেকে আবার আমার মেয়েকে নিয়ে ভার্সিটি যাস।”পৃথীর যতটা কম পেরেশানি পড়াশুনার জন্যে, রহিমার তার থেকেও বেশি।এ’কদিনে পৃথী ভার্সিটি মিস গিয়েছে আর রহিমা মনে হয় শুয়ে শুয়ে কত বার যে পৃথীর ভার্সিটির কথা মুখে নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।পৃথী বুঝতে পেরেছে নুহা হঠাৎ বাসায় এসে হাজির হওয়ার একমাত্র কারণ তার মা ছাড়া আর কেউ না।গলা ছেড়ে বলে,

“মা নিশ্চয়ই তোকে আসতে বলেছে তাই না?”

নুহা নোটস ঘাটাঘাটির দিকে দৃষ্টি রেখেই উত্তর করে,
“হু।এবার তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে।ভার্সিটির টাইম চলে যাচ্ছে। অনেক ঘুমাইছিস বাব্বাহ!”

“আজ যাবো না।কাল আসিস।কাল যাবো।”

নুহা এবার হাত চলাচল বন্ধ করে পৃথীর দিকে হতবাক চোখে তাকায়।
“তোর মাথা ঠিক আছে?তুই জানিস স্যাররা মিডটার্ম এক্সাম খুব যে কাছে?ক’দিন যাস নি তুই ভার্সিটিতে?আঁট আঁটটা দিন!এই ক’দিনে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস হয়েছে।স্যাররা সাজেশন্স দিছে।পোলাপান এখন দুমচে পড়া শুরু করে দিছে।আর তুই অনেকদিন মিস ত করলিই এখন আসছিস মাথামোটা কথা বলতে!পরিক্ষার সময় বুঝবি।”

এই একজন আছে আল্লাহ দিলে রহিমার মতন!
একদিন ক্লাস মিস হলেই যেন তার সব শেষ হয়ে যায়!সেদিন ভার্সিটির পিরিয়ড শেষ না হতেই পৃথীর বাসায় দেয় এক ছুট।পৃথী সবে ড্রেসটা চ্যান্জ করবে ওমনি -“দোস,প্লিজ ড্রেসটা পড়ে চ্যান্জ করে নিস আগে আমাকে একটু বল স্যার কি পড়া দিয়েছে?এক্সাম হবে বলেছে?কয়টা এক্সাম হবে?প্লিজ বল?বল?”
সব অবাঞ্চিত কথাবার্তা।এই যে মিডটার্ম এক্সামের কথা তুলেছে তাও ভুয়া।মিডটার্ম এক্সাম হতে দুই মাস দেরী।পৃথী বলে,

“এত পড়া পড়া করিস না তো বইন।শরীরটা ভালো না!”
“তা তুই এখন ভার্সিটি সত্যিই যাবি না?”

সত্যি কথা বলতে পৃথীর এখন ভার্সিটি যেতে ইচ্ছে করছে না।তাই চুপ করে রইলো।নুহার কথার জবাব দিলো না।নুহা জবাব না পেয়ে বলে,

“আন্টিকে ডাকবো?”

পৃথী এবার বিরক্ত।রহিমা এসেও এর মতো আবার ক্যাঁচাল ক্যাঁচাল শুরু করে দিবে। কথা না শুনা পর্যন্ত তার ক্যাঁচাল চলতেই থাকবে।সে জানে না এই মানুষ গুলা কেন যে খুব ত্যাড়া টাইপ হয়।ত্যাড়ামী কমার কোনো ওষুধ যদি আবিষ্কার হতো তাহলে সে প্রথমে তার মাকে ত্যাড়া ওষুধ খাওয়াতো তারপর নুহাকে।পরে শান্তিমতো একটু চলতে পারতো।পরে আর কি অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নুহার সাথে ভার্সিটির দিকে হাঁটা ধরে পৃথী।কিছু পথ যেতেই নুহা হঠাৎ থেমে যায়।

“পৃথী?তুই একটু আগে হাঁট ত?”
“কেন?”
“দরকার আছে!”
“কী দরকার?”

নুহা জবাব দেয় না।তবে তার দৃষ্টি অন্যদিকে।সেই দৃষ্টিতে কোনো এক চক্কর চলছে।পৃথী প্রথমে তা বুঝতে না পারলেও পরে দক্ষিণ পথের ত্রিসীমা গেড়ে আদিলকে আসতে দেখে বুঝে ফেলে নুহার ব্যাপারটা।সে ফিঁকে হাসি দিয়ে বলে,

“তুই আদিলের সাথে গিয়ে কথা বল।আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি।”

নুহা লজ্জা মাখা চোখে মাথা নেড়ে ছুটে যায় আদিলের দিকে। তা দেখে পৃথী আবারো মুখে ফিঁকে হাসি টানে আর মনে মনে বলে,”স্বার্থক হোক তোদের ভালোবাসা।”

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নুহাকে আসতে না দেখে পৃথী আশপাশে একটু ঘুরতে থাকে।আশপাশে কয়টা পলাশ গাছ,কয়টা বকুল গাছ,কয়টা ঝাউড়ি গাছ ইত্যাদি ইত্যাদি নিজমনে গুনতে থাকে আর হাসতে থাকে।তাকে এরকম বাচ্চাদের মতো করতে দেখে দূর থেকে একটা ছেলে তাকে ফলো করে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ছেলেটি পৃথীর দিকে এগিয়ে এসে বলে,

“তুমিতো গোলাপ, বকুল ফুল থেকেও সুন্দর!তাহলে এত পলাশ,বকুল গোনে কি হবে?”

পৃথী ছেলেটির দিকে তাকায়।সে ছেলেটিকে ঠিক চিনতে পারে নি।এই এলাকায় আর কখনো দেখেছে বলেও মনে হয় না।সন্দেহ মনে বলে,

“আপনি কে?আপনি কি আমাকে চেনেন?”
“আমি কে তা আপাতত না জানাই ভালো।আমি তোমাকে চিনি না।তবে কাল ওয়াটসএ্যাপে তোমার একটা ফটো দেখেছি।খুবই হট ছিল পিকটা..!রিয়েলি ইউ’র ভেরী হট!”
“মানে..!!”

মানে পর্যন্তই ছিল পৃথীর কথোপকথন।ছেলেটার আর জবাব পায় নি পৃথী ।তার আগেই ছেলেটা পৃথীর মুখের উপর একটা কাপড় শক্ত করে চেপে ধরে,যেটাতে ছিল নিশা।সাথে সাথে পৃথী জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটে পড়ার আগ মুহূর্তেই ছেলেটা হাতের ইশারায় একটা ব্লাক রঙ্গা গাড়িকে ডেকে সেখানটায় পৃথীকে তুলে ফেলে।পৃথী ঘুমাবস্থায় যাত্রা করে অজানা গন্তব্যে!

চলবে….

(দুঃখিত দুইদিন গল্পটি দিতে পারি নি।হয়তো আপনাদের অনেককে অপেক্ষা করিয়েছি।আসলে আহাদের অসুস্থতায় বাসায় মেহমান এসেছিলো তাই একটু বিজি ছিলাম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here