#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১১
দুইদিন পর বিকেলে নয়নতারা বেগমকে বাড়িতে আনা হয়েছে। আরো একদিন থাকতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু হাসপাতালের সাদা পরিবেশ ওনার দম বন্ধ করে দিচ্ছিলো। নিজের চেনা পরিবেশে ফিরতে পেরে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। দাদিকে বিশ্রাম করতে দিয়ে নিজের রুমে যেতেই প্রয়াসের তলবে ছুটতে হলো তার বাড়ি। প্রয়াস ড্রইংরুমে বসে মোবাইল স্ক্রল করছিলো। নাবিলাকে আসতে দেখেই এক কাপ কফি চাইলো। নাবিলা মুখ ঝামটা দিয়ে বললো,
‘পারবোনা। বাড়িতে তো জেসি আপুও আছে তাকে বললেই তো হয়।’
‘জেসি আমার অতিথি। ওকে দিয়ে কেনো কাজ করাবো? এটা তোর কাজ।’
‘হ্যা আমি কাজের লোক।’
বিড়বিড় করে বললো নাবিলা।
‘কি হলো দাঁড়িয়ে না থেকে করে দে জলদি। আর হ্যা দুই কাপ করবি। জেসিও খাবে নিশ্চয়ই।’
‘পারবোনা।’
মুখে পারবোনা বললেও শেষমেশ দুই কাপ কফি বানিয়ে আনলো নাবিলা। জেসি ততক্ষণে প্রয়াসের পাশে বসে ল্যাপটপে কিছু করছিলো। নাবিলা টেবিলে কফি রাখলে প্রয়াস ওর হাত ধরে টেনে দুজনের মাঝে বসিয়ে দিলো। কোলের ল্যাপটপটা সামনের টি টেবিলে রাখতেই একটা বাচ্চার হাসিমুখ নজরে এলো নাবিলার।
বাচ্চাটা অলিভার৷খুব মিষ্টি একটা ছেলে। সামনে যখন দেখেছিলো ততটা খেয়াল করেনি নাবিলা। তখন একেরপর এক ঝামেলায় এমিলি কিংবা অলিভার কারো সাথেই কথা হয়নি। কিছুক্ষন পরেই এমিলিকে দেখা গেলো স্ক্রিনে। ভিডিও কল দিয়েছে এমিলি। প্রয়াসের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এমিলি এবং অলিভারের। বিশেষ করে অলিভারের সাথে। ও প্রয়াসকে সামনাসামনি দেখেছে একবার আর বাকি সব সময় ভিডিও কলে। এর মধ্যেই প্রয়াস আঙ্কেলকে মনে ধরেছে অলিভারের।
‘কেমন আছো নাবিলা?’ এমিলি প্রশ্ন করলো।
নাবিলা কি করবে বুঝতে পারলো না তাই প্রয়াসের মুখের দিকে তাকালো। প্রয়াস চোখের ইশারায় কথা বলতে বললো,
‘জি ভালো।’
‘তোমার সাথে পরিচিত হতে পারিনি সে জন্য দুঃখিত। আসলে সে দেশে থেকে অলিভারকে হারানোর ঝুকিটা নিতে চাচ্চিলাম না তাই জলদি চলে এসেছি। তবে তোমাদের বিয়েতে নিশ্চয়ই আসবো।’
‘আমাদের?’
নাবিলা প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে রইলো এমিলির দিকে। প্রয়াস সাথে সাথেই প্রসঙ্গ বদলাতে বললো,
‘অয়ন কি এর মধ্যে আপনার সাথে যোগাযোগ করেছে?’
‘এখনো অবধি কোনো ফোনকল করেনি। এমনকি অলিভারের জন্য কোনো ম্যাসেজও দেয়নি।’
‘বিষয়টা চিন্তার।’
প্রয়াস তর্জনী এবং মধ্যমা আঙুল দিয়ে কপালে ঘঁষে বললো।
‘নাবিলা এবং প্রয়াস কিছুটা সাবধানে থেকো। অয়ন চুপ হয়ে আছে মানে কিছুতো একটা করবেই। ওকে যতদূর চিনি সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। যেহেতু এখন ওর মানসম্মান সবই ডুবে গেছে তাই তোমাদের ক্ষতি করতে ও দুবার ভাববে না।’
‘চিন্তা করবেন না আমি সামলে নেবো এদিকটা।’
সামলে নেবো বললেও প্রয়াস মনে মনে কিছুটা চিন্তিত বিষয়টা নিয়ে।
জেসি বললো,
‘অলিভার তোমাকে আমি কি শিখিয়েছিলাম মনে আছে? মনে করে বলতো!’
অলিভার সব দাত বের করে হাসলো। তারপর খুব কষ্টে উচ্চারণ করলো,
‘টুমি কিমন আচো?’
সবাই একসাথে হেসে উঠলো অলিভারের বাংলা শুনে। সবার হাসি দেখে কিছু না বুঝে অলিভারও হেসে উঠলো।
এতক্ষন এমিলির সাথে নাবিলা এবং প্রয়াস ইংরেজিতে কথা বলছিলো। অলিভারকে বাংলাটা শিখিয়েছে জেসি। যে কয়েকঘন্টা সাথে ছিলো তারা সে সময় বেশ অনেকগুলো বাংলা শব্দ শিখিয়েছিলো ওকে। কিন্তু অলিভার সব ভুলে শুধু এই একটা লাইনই মনে রাখতে পেরেছে।
________
শহরে আলো ফুটেছে অনেকক্ষন। চারিদিকে কুয়াশার অল্পবিস্তর আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। শীতকাল এলো বলে। শেষ রাতে জানালা ভেদ করে অল্প শীতের ছোয়া লাগছেও বটে। সকালের রক্তিম সূর্যের তাপহীন মিষ্টি রোদের আলোয় নাবিলা বারান্দায় এসে দাড়ালো আড়মোড়া ভেঙে। চশমাটা চোখে দিয়ে সবার আগে নজর গেলো প্রয়াসের বারান্দায়। প্রয়াসের বারান্দার সাথের জানালাটা পুরো খোলা। সেদিক দিয়ে দেখলো প্রয়াস রেডি হচ্ছে কোথাও যাওয়ার জন্য। নাবিলা কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো সেদিকে। কালো রঙের শার্টে বেশ মানিয়েছে প্রয়াসকে।
হুট করে সেখানে জেসির আগমন ঘটলো। সেও একটা কালো টপস আর ছাইরঙা জিন্স পড়েছে। দুজনকে এমন ম্যাচিং পোশাকে দেখে সকালের সুন্দর ফুরফুরে মেজাজে ভাটা পড়লো নাবিলার। জেসি অনায়াসে প্রয়াসের ঘরে পর্যন্ত ঢুকছে! সে নিজেওতো অনায়াসেই যায়। কিন্তু জেসিকে সেখানে দেখে মনে হচ্ছে যাওয়া উচিৎ না। একদমই না। প্রয়াস ভাইয়া কেনো বাধা দিচ্ছে না! এমন হাজারো কথা ভেবে নাক ফুলালো নাবিলা। জেসি নাবিলাকে দেখেই বারান্দায় এলো।
‘গুড মর্নিং নাবিলা।’
জেসির কথায় নাবিলা হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘গুড মর্নিং। কোথাও যাচ্ছো তোমরা?’
‘হ্যা একটু কেনাকাটা করতে যাচ্ছি দুজনে।’
নাবিলা মনে মনে ব্যথিত হলো। হাজার হোক প্রয়াস ওর ভালোবাসার মানুষ। সে তার চোখের সামনে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা তার জন্য কষ্টের।
প্রয়াস একপলক এলোমেলো চুলে দাঁড়ানো নাবিলার দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর জেসিকে তাড়া দিয়ে চলে গেলো। জেসিও বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। নাবিলার রাগ হলো। অন্যসময় তো জোর করে এখানে ওখানে নিয়ে যেতে চায়। আর এখন একবার বললোও না নাবিলা যাবে কিনা। নিশ্চয়ই ডেটে যাচ্ছে। কান্না পেয়ে গেলো নাবিলার। কিন্তু সে কাদবে না। যে মানুষটা তার মন বোঝে না তার জন্য একদম কাদবে না।
নিজের মনকে ভালো করতে কয়েকদিনের জন্য দূরে কোথাও চলে গেলে ভালো হতো। তাতে হয়তো চোখের সামনে প্রয়াসকে অন্য মেয়ের সঙ্গে সহ্য করতে হতো না। কিন্তু দাদি নাবিলাকে কোথাও যেতে দেবে না এখন। তিনি এমনিতেই অসুস্থ সেজন্য তাকে নিয়ে কিংবা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই নাবিলা ভাবলো তানজিলার বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে।
এখন থেকে নাবিলা মুক্তভাবে আবার চলা শুরু করবে। যেখানে থাকবে না অয়নের ছায়া কিংবা প্রয়াসের জন্য অনুভূতির দহন। কিন্তু চাইলেই কি সেই দহন এড়ানো যায়? হয়তো যায়। হয়তো না। তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!
খাবার টেবিলে কাছে আসতেই দাদি কাছে ডাকলো নাবিলাকে। বাবা এবং দাদির মাঝে বসলো নাবিলা। সায়মা বেগম রান্নাঘরে টুংটাং আওয়াজে সকালের খাবার প্রস্তুতে ব্যাস্ত। বাবার দিকে তাকালো নাবিলা। তারেক হোসেন এখনো মেয়ের সামনে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে আছেন। কিছুতেই ভুলতে পারছেন না অয়নের প্রতারণা। নাবিলা বাবার অবস্থা বুঝে নিলো সহজেই। হাত বাড়িয়ে বাবার বাম হাতের ওপর নিজের ডান হাতটা রাখলো। তারেক হোসেন সাথে সাথেই মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরলো।
নাবিলা বললো,
‘সব ভুলে যাও বাবা। আমিও ভুলে গেছি।’
‘তুমি সত্যিই ভুলতে পারবে তো! আমরা অন্যায় করতে যাচ্ছিলাম তোমার সাথে।’
‘একশবার পারবো বাবা। আমি তো আর সেই প্রতারককে ভালোবাসিনি। তাই আমার কোনো কষ্টও হচ্ছে না। বরং খুশিই হয়েছি। তোমরা আমার ভবিষ্যৎ সুখের কথা ভেবেছিলে এবং সেখানে তোমরাও ঠকে গেছো। তাই ওইসব কথা বাদ দাওতো। এখন খাও। বড্ড খিদে পেয়েছে।’
তারেক হোসেন একজন স্বল্পভাষী মানুষ। তবে পরিবারের সবার সাথেই মন খুলে কথা বলেন তিনি। ঝামেলাহীন জীবন কাটাতে বেশি পছন্দ করেন। সেখানে হুট করেই একটা অপ্রীতিকর ঘটনা তাকে একদমই অন্তর্মুখী স্বভাবের করে ফেলেছে। অয়নের পরিবারের সাথে যত ধরনের ব্যাবসায়ীক যোগাযোগ ছিলো সব ছিন্ন করে অয়নের কু কীর্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। আর যাইহোক এতে তার মেয়ের সম্মান যাবে না। আর কেউ মেয়ের বিয়ে ভাঙা নিয়ে কিছু বললেও এখন আর ওনার কিছু যায় আসে না। বরং একটা প্রতারণার থেকে মেয়েকে বাচাতে পেরেই খুশি তিনি।
দাদির সাথে কিছুটা সময় কাটালো নাবিলা। তারপর বেড়িয়ে পরলো তানজিলার বাড়ির উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে মাহিকেও ডেকে নিলো ফোন করে।
সেখানে পৌঁছাতেই জানতে পারলো তানজিলার কাজিনের সাথে তানজিলার বিয়ের কথা চলছে।
ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার। ছোট থেকেই তানজিলার সাথে খুব ভাব ছেলেটার। দুজন দুজনকে পছন্দ করলেও কেউ মুখ ফুটে বলেনি। শেষে দুই পরিবারই তাদের বিয়ে ঠিক করেছে। কথাটা শুনেই নাবিলার মন ভালো হয়ে গেলো। যাক! কেউতো ভালোবাসার মানুষকে পাচ্ছে। মাহি আর্তনাদ করে বললো,
‘তোরা কি শুরু করেছিস বলতো? যাকেই ভাবছি পটাবো তাকেই দখল করে নিচ্ছিস। মানে সারাজীবন আমাকে আইবুড়ো সিঙ্গেল রাখার পায়তারা করছিস তাইনা?’
তানজিলা শব্দ করে হেসে ফেললো। নাবিলা ক্ষানিক শ্লেষের হাসি দিয়ে বললো,
‘দখল করতে আর পারলাম কই? সেখানে অন্যকেউ বসতি স্থাপনে ব্যস্ত।’
মাহি বললো,
‘তুই শুধু একবার বল, ওই জেসিকে তোর প্রয়াস ভাইয়ার জীবন থেকে দূর করার হাজারটা আইডিয়া দেবো তোকে।’
নাবিলা আগের মতোই বিষন্ন মনে বললো,
‘না রে। আমি আর কারো জীবনে দ্বিতীয় ব্যাক্তি হতে চাই না। এবার নাহয় কিছুটা নিজের মতো বাচিঁ। প্রয়াস ভাইয়া থাকুক তার বান্ধবী অথবা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে।’
‘তুই শিওর কি করে হচ্ছিস যে জেসি আপু তার গার্লফ্রেন্ড? এমনতো হতেই পারে যে তারা শুধুই বন্ধু।’
তানজিলা নাবিলার দিকে কোল্ড ড্রিংকের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো।
নাবিলা গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে উত্তর দিলো,
‘ জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না।একবার মনে হয় শুধুই বান্ধবী আবার মনে হয় তার থেকে বেশি কিছু। সরাসরি প্রশ্ন করেও উত্তর পাইনি ভাইয়ার কাছে।’
তানজিলা বিরক্তি নিয়ে বললো,
‘ভাইয়া যখন কিছু বলেইনি তখন ধরে কেনো নিচ্ছিস যে তাদের সম্পর্ক আছে?’
‘হয়তো তার মৌনতাই সম্মতি ছিল। তাছাড়া জেসি আপু বলেছে বিয়ে করেই ফিরবে এখান থেকে।’
সবাই হতাশ নিশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর মাহি আবার উচ্ছ্বসিত হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
‘ বাদ দে সেসব কথা। তানজিলা ম্যারিড ট্যাগ গ্রহন করতে যাচ্ছে তাও আবার নিজের পছন্দের মানুষটাকে এখন আমরা সেটাই সেলিব্রেট করবো।’
তানজিলা মাহির কাধে হাত দিয়ে বললো,
‘বলাতো যায় না আমার বিয়েতেই নিজের পছন্দের মানুষটাকে পেয়ে যেতে পারিস।’
‘আরে এটাতো মাথায়ই আসেনি। তোর বিয়েতে পরীর মতো সাজবো আমি হুম। ছেলেদের লাইন লাইন লেগে যাবে একদম। হা হা।’
নাবিলা আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। বন্ধুমহলই একমাত্র যায়গা যেখানে হাজার দুঃখ কষ্ট ভুলে একটু হাসিতে মেতে থাকা যায়। পার্থিব দুশ্চিন্তা, অন্তর্দহন, না পাওয়ার মাঝে একটুখানি স্বস্তি হিসেবে বন্ধুদের আড্ডায় ডুবে রইলো নাবিলা।
চলবে….