মায়াবিনী_মানবী পর্ব ১২

#মায়াবিনী_মানবী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১২

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই দরজার সামনে আনবক্স স্মার্টফোন দেখলে যে কোন ব্যক্তিই অবাক হবে।তবে জুইঁর অবাক এতটুকুতেই নয়।তার অবাকের মাত্রা চরম পর্যায়ের হওয়ার কারণ হলো দরজার সামনে থাকা আনবক্স স্মার্টফোন আর তার সাথে থাকা শুভ্র বর্ণের জামদানি শাড়ি, দুমুঠো শুভ্র বর্ণের চুড়ি।এদের মধ্যে থেকে শাড়ির উপর রাখা শিউলি ফুলের মালাটা জুইঁকে তার রূপ প্রদর্শনে ব্যস্ত।

ফুলের ব্যাপারে জুইঁ একটু বেশিই দুর্বল।ধুতরা ফুল থেকে বেলীফুল হোক কিংবা গন্ধরাজ ই হোক না কেন সবই জুইঁর পছন্দের। জুইঁ কখনো কোন ফুলেরই তুলনা করে দেখে নি।

সর্বপ্রথম জুইঁ শিউলি ফুলের মালাটাই ফ্লোর থেকে হাতে তুলে নিল।নাকের অতিকাছে নিয়ে বুক ফুলিয়ে প্রাণ ভরে লম্বা এক দম নিল।সঙ্গে সঙ্গে ই জুইঁর মুখমন্ডলে হাসির ছাপ প্রগাঢ় হতে লাগলো।

পরমুহূর্তে ই জুইঁর বাকি জিনিস গুলোর কথা মনে পড়তেই ফ্লোর থেকে ওগুলো উঠিয়ে নিল।সামনে ই আলআবির দরজার দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখতে পেল আলআবির দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক। সচারাচর আলআবি বাসায় থাকলে রুমের দরজা ভিতর থেকে লক করাই থাকে।জুইঁর এ বিষয়ে জানা আছে। তবে সেই সাথে এও জানা আছে যে আলআবি অফিসে বা বাইরে গেলে দরজা চাপিয়ে রেখে যায়।অর্থ্যাৎ এখন যেমন কিঞ্চিৎ ফাঁক করা অবস্থায় আছে। তখনও এরূপ ই থাকে।

আলআবি বাসায় নেই। জুইঁ বুঝতে পেরে ওই জিনিস গুলো সমেত রুমে এসে পড়ে। আলআবি এখন বাসায় থাকলে জুইঁ সরাসরি আলআবির কাছেই যেত।আর শাড়ি,চুড়িগুলো দেখাত।কারণ আলআবি ছাড়া এবাড়িতে এমন কেউ নেই যে এভাবে কারো অগোচরে এসে জুইঁকে এসব দিয়ে যাবে।তার উপর আবার জুইঁ তো আজকে রাতে চলে যাবে।সব মিলিয়ে জুইঁর কেন যেন মনে হচ্ছে আলআবি ই রয়েছে এর পিছনে।সাদা চুড়ি গুলো দেখে জুইঁর বারবার করে মানতে ইচ্ছে করছে এই কাজ টা আলআবিরই যেন হয়।

জুইঁ ভেবে নিয়েছে যদি এগুলো তাকে আলআবি ই দিয়ে থাকে তাহলে সে প্রত্যেকটা জিনিস ই গ্রহন করবে। তবে ফোনটা কোন মতেই সে নিতে পারবে না।

জুইঁর বাবা সোজা বলে দিয়েছে ভার্সিটির আগে কোন ফোন হবে না।তার নিয়াজ ভাইর বেলায়ও এরকমটাই হয়েছিল। জুইঁর নিয়াজ ভাইকে তার বাবা ভার্সিটির গন্ডিতে পা রাখার পরে একটা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিল।বাড়িতে ওই একটা স্মার্টফোন ছাড়া আর কোন স্মার্টফোন নেই। জুইঁর মাকে জুইঁর বাবা নোকিয়ার একটা বাটন ফোন দিয়েছে আর নিজেও নোকিয়ার একটা বাটন ফোন নিয়েছে।এ নিয়ে জুইঁর আক্ষেপের কোন শেষ নেই। কিন্তু তার এই আক্ষেপ শুধু মনে মনে ই।

আলআবি বাসায় নেই বলে আজ সকালে হাটতে যাওয়া হয়নি।জুইঁ ওগুলো টেবিলে রেখে ফ্রেশ হতে চলে যায়।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মুখ মুছতে মুছতে জুইঁ একপলক টেবিলের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ মুছতে থাকে।হঠাৎ করেই মনে হলো শুভ্ররাঙা চুড়ির মধ্যে শুভ্র রঙের ই কিছু একটা দেখল।জুইঁ টেবিলের আরও নিকটে গিয়ে পরখ করতে ই দেখল চুড়ির সঙ্গে সুতোয় বাঁধা একটা ছোট চারকোণার চিরকুট ফ্যানের বাতাসে নিজেকে দুলিয়ে যাচ্ছে। দুলতে থাকা চিরকুট নিজের গায়ে “#মায়াবিনী_মানবীর জন্য” লেখা জড়িয়ে আছে।

জুইঁ সন্তপর্ণে চিরকুট টা খুলে কয়েকবার লেখাটায় হাত বুলিয়ে নিল।আলআবির বলা সেই-

“#মায়াবিনী_মানবী পাশে থাকলে গার্লফ্রেন্ডের কি দরকার?” কথা টার মানে জুইঁ এখন ভালো করেই বুঝতে পারছে।

জুইঁর মুখের হাসি যেন আজ ফুরচ্ছেই না।জুইঁ হাতে চুড়ি গুলো পড়ে ঘরময় রিনরিনে আওয়াজের মেলা বসিয়ে দিয়েছে।শিউলিফুলের মালা একবার নাকের কাছে নিচ্ছে তো একবার হাতখোপায় গুঁজে দিচ্ছে। শাড়ি টা একবার গায়ে মেলে ধরছে তো একবার মাথায় ঘুমটার ন্যায় দিচ্ছে।

ছোট শিশু যখন তার নতুন কোন খেলনা পেলে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বারবার তা নেড়েচেড়ে খেলা করে জুইঁও তেমন করছে।খেলনা পাওয়া শিশু আর জুইঁর মধ্যে এখন তফাত পাওয়া মুশকিল।

সকালে আজ সব নাস্তা জুইঁ নিজ হাতে বানিয়েছে। বায়না ধরেছে দুপুরের খাবার ও জুইঁ নিজ হাতে রান্না করবে।এখন মিসেস পারভীন এর সঙ্গে রান্নার ব্যাপার নিয়েই লড়ে যাচ্ছে জুইঁ। সবশেষে সিরাজ সাহেব ওদের লড়াই দেখে জুইঁ কে বিজয়ী বলে ঘোষণা করলেন। মানে জুইঁ দুপুরে রান্না করবে।তবে লিপি জুইঁ কে সাহায্য করবে।

রান্নায় সকলের পছন্দের একটা করে আইটেম থাকবে।সিরাজ সাহেবের একটা, মিসেস পারভীন এর একটা,আলআবির একটা।

জুইঁ মিসেস পারভীনের থেকে জানতে পারে আলআবি সকাল সকাল অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে।কম্পানি খুব বড় একটা ডিল পেতে চলেছে। তাই কয়েকদিন রেগুলার অফিসে যাবে আলআবি।

দুপুরের লাঞ্চ করে রুমে এসে বসেছে জুইঁ।আলআবির জন্য ড্রাইভারকে দিয়ে লাঞ্চ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। জুইঁর হাতে মিসেস পারভীনের ফোন। ফোনের ওপাশে রয়েছে জুইঁর মা।কথা শেষ করে জুইঁ মিসেস পারভীন কে ফোন ফেরত দেয়ার জন্য অগ্রসর হয়েও আবার পিছিয়ে গেল।পুনরায় ডায়াল নাম্বারে গিয়ে সাদুর নাম্বারে কল লাগালো।উদ্দেশ্য মাত্র একটা ই তাহলো জুইঁ যে আজ যশোর আসবে তা জানানো।

সাদুর সাথে কথা বলে জানতে পারে সাদমান ভাইর কথা সাদুর পরিবারে জেনে গিয়েছে। তাই বলে ওকে পরিবার থেকে একটু বকাঝকা শুনতে হয়েছে। বকা খেয়েও সাদু খুশি। কারণ দুই পরিবার ওদের দুজনের বিয়ে নিয়ে আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল।এখন পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সাদমানের পড়াশোনা শেষ হলে কেবল আকদ করিয়ে রাখবে।পরে সাদমান নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে সাদুকে অনুষ্ঠান করে বাড়িতে নিবে।

জুইঁ সাদুকে আলআবির কথা আর বলে না।বলেছে সাদুর জন্য সারপ্রাইজ আছে।আসলে জুইঁ সাদুকে সব সামনা সামনি ই বলতে চায়।আর কাল সকালে তো সাদুর সঙ্গে দেখা ই হচ্ছে।মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যবধান মাত্র।

দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল।আলআবি এখনো বাড়ি আসেনি।আসরের নামাজ পড়ে জুইঁ ড্রয়িংরুমে বসে বারবার ঘড়ি দেখছে আর দরজায় চোখ বুলাচ্ছে।মিসেস পারভীন এসে জুইঁকে বলল…

–জুইঁ তোর জামা কাপড় গোছানো সব?

–না। গোছানো হয়নি তো কিছু। (জুইঁ)

মিসেস পারভীন ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলেন…

–সেকি।আরে যা যা তারাতাড়ি গুছিয়ে নে সব।বাড়ি গিয়ে আবার বলবি এটা আনি নি ওটা আনি নি।গুছানো শুরু কর যা।

জুইঁ ধীর পায়ে রুমে এসে সব গুছাতে লাগলো।সব গুছানোর শেষে কিছু একটা মনে করে শিউলি ফুলের মালাটা নিজের কাছে রেখে শাড়ি,চুড়ি আর ফোনটা হাতে নিয়ে আলআবির রুমে ঢুকে পরলো। রুমে ঢুকে জুইঁ থ হয়ে গেল।রুমে দুপাশে ই বইয়ের বিশাল বড় বড় দুটো সেল্ফ।রুমে মাঝ বরাবর হালকা নীলরঙা চাদর বিছানো বেডে দুটো বালিশ পাশাপাশি রাখা। এই বেডেই বেনজি আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। বেনজিকে ঘুমাতে দেখে কিঞ্চিৎ পরিমাণে হাসলো জুইঁ।বিশাল জানালার ধারের কম্পিউটার টেবিলটার উপর জুইঁ হাতের জিনিসপত্র গুলো রেখে দিল।ধীর পায়ে বেনিজর কাছে গিয়ে আদর করতে গিয়েও থেমে গেল।ভাবলো বেচারার ঘুম টা শুধু শুধু ভেঙে দিয়ে কি লাভ।

জুইঁ আলআবির রুম থেকে বের হয়ে আসতেই কারো বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে গেল।জুইঁর মাথা কারো বুকের বা পাশে গিয়ে ঠেকলো।ব্যক্তিটার গা থেকে ভেসে আসছে পারফিউম আর ঘামের মিশ্রনের একটা গন্ধ।গন্ধ টা সহ্য করার মতো।জুইঁ বুঝতে পারছে এটা আলআবি। সেই সাথে আলআবির শ্বাসক্রিয়া জুইঁকে জানান দিচ্ছে যে আলআবি হাঁপাচ্ছে।এভাবে থাকায় জুইঁর কিছু টা অস্বস্তি হচ্ছে। তাই জুইঁ নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।

আলআবি জুইঁর সামনে ক্লান্ত মুখে ঘামে ভেজা শার্টে দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার চোখ দুটো স্তব্ধ।এই চোখ আজ একদৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে জুইঁ কে।

জুইঁ আলআবি কে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হালকা গলা ঝেড়ে নিল।আলআবির হুঁশ ফিরতেই দ্রুত বলতে লাগলো…

–সরি! সরি!রিয়েলি সরি!আমি ভেবেছিলাম তোমাকে দেখতে পাব না।তার আগেই তুমি চলে যাবে।তোমাকে দেখতে পেয়ে তাই ভুলবশত জড়িয়ে ধরে ফেলেছি।সত্যি সরি!

আলআবির এরূপ অবস্থা দেখে জুইঁ নিঃশব্দে ই হেঁসে কুটি কুটি হতে লাগলো।আলআবি কে উদ্দেশ্য করে বলল…

–ঠিকাছে। আমি কিছু মনে করিনি।এতো সরি বলা লাগবে না।

পরমুহূর্তেই আবার আলআবি কে উদ্দেশ্য করে জুইঁ সন্দিহান হয়ে বলল…

–তা আমাকে না দেখলে কি হতো?মানে আমি চলে গেলে আপনার কি?

আলআবি কাতর কন্ঠে বলে উঠলো…

–তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না আমার কি।

আলআবি এরপর জুইঁর চোখে চোখ রেখে বলল…

–সকালে কিছু ই পাওনি?

জুইঁ বুঝতে পেরে বলল…

–কি পাব?কিছু পাওয়ার কথা ছিল কি

জুইঁর কথায় আলআবি স্পষ্ট দুষ্টুমির আভাস পেল।
আর তখনি আলআবির চোখ পড়ল টেবিলের উপর। আলআবির দেয়া জিনিস গুলো নিজের রুমে ই দেখে আলআবি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল জুইঁর উপর।তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলল…

–এগুলো ফেরত দিতে এসেছ তুমি?

জুইঁ না বোঝার ভাব করে বলল…

–কোন গুলো?

আলআবি দাঁতে দাঁত পিষে বলল…

–আমার দেয়া গিফ্ট তুমি আমাকেই রিটার্ন করছ?সাহস হলো কি করে তোমার?

অবস্থা বেগতিক দেখে জুইঁ হড়বড় করে বলতে লাগলো…

–আমাকে গিফ্ট কোথায় দিলেন আপনি? গিফ্ট কি কেউ এসে দরজার সামনে রেখে যায়?দেখেছেন জীবনে কখনো এমন?আপনাকে ই কেউ দরজার সামনে এসে গিফ্ট রেখে দিয়ে চলে গেলে আপনি তা নিতেন?আমি কেন নিব?

আলআবি জুইঁকে পাশ কাটিয়ে টেবিলের উপর থেকে ওগুলো নিয়ে জুইঁর সামনে ধরে বলল…

–নিন তোতাপাখি! এবার এগুলো গ্রহন করুন।

জুইঁ আলআবির কথায় ফিক করে হেসে দিয়ে বলল…

–আমি এগুলো নিলেও এই ফোনটা নিতে পারবো না।

আলআবি ভ্রুকুচকে বলল…

–কেন?ফোনে কি সমস্যা?

–এটা নিয়ে আমি কি করব?আর বাসায় কি বলবো?বাবা আমাকে ভার্সিটির আগে ফোন দিবে না। (জুইঁ)

–তোমার বাবা কি করবে জানি না।কিন্তু এখন এটা না নিলে আমি যে এত কষ্ট করে ছবি গুলো বাঁধাই করিয়ে আনলাম তা তোমার বাবাকে পাঠিয়ে দিব। (আলআবি)

–উফ! আপনি কিছু বুঝতে চান না।আমি এই ফোম দিয়ে কি গরুর ঘাস কাটব?(জুইঁ)

–আমার সঙ্গে কথা বলবে। (আলআবি)

হুট করে ই জুইঁ মুখ ফসকে বলে ফেলে…

–কেন আমরা কি প্রেম করছি যে আপনার সঙ্গে কথ বলতে ই হবে।

আলআবি দুষ্টু হেসে বলল…

–এখন করছি না তো কি হয়েছে? তখন করব।

কথা শেষ হতেই আলআবি জুইঁ কে একটা চোখ টিপ মারে।

চলবে………….

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক।গল্পের সকল প্রকার চরিত্র, উক্তি কাল্পনিক।অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here