#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮
শাইনি বলল, “তুমি কী আমাকে ভয় পাও?”
“না। আপনি বাঘ, ভাল্লুক না যে ভয় পাব!”
“এখন ভয় হচ্ছেনা? আমি যদি কিছু করে বসি?”
“আপনি বড্ড বেশি কথা বলেন। দয়া করে চুপ থাকুন আর বিরক্ত করা বন্ধ করুন!”
শাইনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। দুজনে সামনে এগিয়ে চললো৷ কিছুক্ষণ পর ওরা নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে গেল। শাইনি বলল, “এখানেই।”
বেলা মুগ্ধ হয়ে চারিপাশ দেখছে। সবুজের সমারোহে ঘেরা প্রকৃতি কন্যার নতুন রুপ ধরা পড়লো তার চোখে। উঁচুনিচু পাহাড়ের একটা বিরাট অংশজুড়ে দখল করে আছে সমতল জায়গা। তার একপাশ জুড়ে আছে মাঝারি আকারের একটা হ্রদ। তার পানি স্বচ্ছ নীল। পানির ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা রঙের হাঁস ও তাদের ছানারা। হ্রদের পাড়ে আছে বন্য গাছ। পাহাড়ের গা ঘেঁষে এত সুন্দর একটা জায়গা দেখে বেলা বিমোহিত নয়নে চেয়ে রইলো। শাইনি ওর হাত ধরে টানলো৷ ওর ধ্যান ভাঙতেই দুজনে সামনে এগিয়ে গেলো। কার্পেটের মতো বিছিয়ে থাকা ঘাসের ওপর গিয়ে বসলো। শাইনি জিজ্ঞেস করলো, “জায়গাটা সুন্দর না?”
বেলা বলল, “হুম। আপনি এখানে আগে এসেছেন?”
“বললাম তো। শ্রাবণ এলেই আসি!”
“কেন আসেন?”
“ভালো লাগে!”
“কেন?”
“ভালো লাগে।”
“কেন?”
শাইনি বলল, “এক প্রশ্ন বারবার করছো কেন?”
বেলা চোখ বড়বড় করে বলল, “বিরক্ত হচ্ছেন আমার ওপর?”
শাইনি অট্টহাস্যে বলল, “তুমিতো তাই চাচ্ছো৷ যাতে আমি বিরক্ত হয়ে কিছু একটা করে বসি। সেই সুযোগে তুমি পালিয়ে যাবে! মিসেস..আমি এতটাও বোকা না।”
বেলার মুখ কালো হয়ে গেল। ও কিছুতেই শাইনিকে ইম্প্রেস করতে পারছেনা। শাইনির বিশ্বাস অর্জন করায় বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। এ লোক আস্ত ঘাড়ত্যাড়া এটা বুঝতে ওর বাকি নেই। আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও।
“ভালোবাসি বউ!”
চমকে তাকালো বেলা। শাইনি মুখ গম্ভীর করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রোদের আলো লুকোচুরি খেলছে শাইনির চোখেমুখে। বেলা চুপ করে বসে রইলো। ওর মাথায় কোনো শব্দ আসছেনা, মস্তিষ্ক কোনো শব্দ গঠন করতে পারছেনা। নির্মল চোখে দেখে যাচ্ছে টুপি পরিহিত শাইনিকে।
“আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করোনা।”
“বলবেন না আমাকে এসব কথা।”
“আচ্ছা বলবোনা৷ আসলে ভালোবাসা অদ্ভুত একটা বিষয়। কখন যে কী হয়ে যায় বোঝা মুশকিল।”
“হুম।”
“তবে এটুকু নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারি যে, আমাকে ভালোবাসতে আর দেরি নেই। আমার প্রেমে পরতে দেরি নেই তোমার।”
বেলা মুখ ভেঙিয়ে বলল, “আপনি সবজান্তা? নন তো! একটা কথা জানেন তো? কনফিডেন্স ভালো, তবে ওভার কনফিডেন্স ভালো নয়।”
শাইনি কাঠ কাঠ গলায় বলল, “ওটা তোমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এতক্ষণে আমার ওপর তোমার ছোট্ট একটা বিশ্বাস হলেও জন্মেছে যে, আমি পাশে থাকলে তোমার কোনো ক্ষতি হবেনা। নইলে কোনো মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে জানার পর এত সহজ-স্বাভাবিক ভাবে বিহেভ করতে পারেনা। আর তুমি দেখো, আমার সঙ্গে হেসে-খেলে ঘুরাঘুরি করছো!”
বেলা মুখ বাঁকালো। আসলেই শাইনির কথাটা ঠিক। অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে, ছোটখাটো বিশ্বাস এই লোকটার প্রতি বেলার জন্মেছে। কিন্তু এটা কিছুতেই শাইনির সামনে স্বীকার করা যাবেনা। ও কথাটা গোপন করে বলল, “ম মোটেও না।”
“মেয়ে ভাঙবে তবুও মচকাবে না। জিদ্দি কোথাকার।”
“হুহ!”
“চলো ফিরে যাই। একটু পর সন্ধ্যা নেমে যাবে।”
বেলার মোটেও ইচ্ছে করছেনা যেতে। ইচ্ছে করছে সারাজীবন এখানে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে। ও ক্লান্ত কন্ঠে বলল, “আরেকটু থাকি!”
“কেন?”
“নিয়ে গিয়ে তো ওই খড়ের গাদায় ফেলে রাখবেন। তারচেয়ে এখানেই ভালো। বসে বসে সন্ধ্যে নামা দেখব। আমি আগে কখনো সূর্যাস্ত দেখিনি।”
“সূর্যাস্ত দেখতে হয় ওই পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে।”
“সত্যি?”
“হুম। যাবে?”
“নিয়ে যাবেন আপনি?”
“যেতে চাইলে আমি নিয়ে যেতে পারি।”
বেলা সাথে সাথে রাজি হয়ে যায়। ঘটনাক্রমে যখন এত সুন্দর একটা জায়গায় এসেই পড়েছে তাহলে মুহূর্তটা উপভোগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। শাইনি ওকে জানিয়েছে বাসায় নাকি খবর পাঠানো হয়েছে। ওদিকের সবাই এই খবর শুনে না জানি কি রিয়েক্ট করেছে খোদা মাবুদ জানে। পুলিশের কাছে গেলেও বেলা অবাক হবেনা। কারণ নাইমুদ্দীন সাহেব নিশ্চয়ই শাইনির ওপর রেগে আছেন। মেয়ের জন্য কিছু না কিছু তো ঠিক করবেন ওনি। বেলা ওঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। শাইনি ওকে একনজর পরখ করে বলতে লাগলো,
“আমার শ্রাবণ দিনের আকাশে
সে তাকায় স্বপ্নালু চোখে,
সে রংধনু ফোটায় আকাশপানে।
সে দেখে ভোরের সূর্য
শিশিরে ভেজা পদ্মফুল,
গোধূলির লাল আকাশ
রাতের প্রস্ফুটিত তারাদের।
আমার ভালোবাসার আকাশটাই
যে শ্রাবণ চোখে দেখলো!
তাঁকে দেখেই আমার বেঁচে থাকার সাধ জাগলো,
হাজারো বছর!”
বেলা মাথা নত করে রইলো। ভাববার মতো কোনোকিছু মাথায় নেই। শাইনি প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “অপেক্ষায় থাকবে, একদিন ফিরে আসবো এই নীল হ্রদের ধারে।”
“চ চলুন।”
“হ্যাঁ।”
যে স্থান থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায় সেটাকে পাহাড় বলা যায়না। তবে বেশ উঁচু। একপাশে মাটি কেটে সরু সিঁড়ি তৈরি করা আছে৷ রেলিঙ দেওয়া আছে। তবুও বেলা শাইনির হাত ধরে চোখ বন্ধ করে ওপরে উঠে এলো৷ কারণ ও ভয় পায় উঁচুতে চড়তে৷ তবে ওদের ভাগ্য খারাপ, কারণ এত কষ্ট করে সূর্যাস্ত দেখতে এসে তা আর দেখতে পেল না। সূর্য ডুবে গেছে ইতোমধ্যেই। আকাশ অন্যরকম। ঘন-কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। শ্রাবণ মাস, বৃষ্টি উপহার দেওয়ার পায়তারা করছে সে। হঠাৎই ঝপ করে বৃষ্টিরাজি নেমে এলো পাহাড়ে। ওরা দুজন ভিজে গেলো। বেলা বেশ আনন্দিত হলো। অনেকদিন পর বৃষ্টিতে ভিজতে পেরে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছে।
শাইনি তাগড়া দিয়ে নেমে এলো নিচে। দুজনে কাকভেজা হয়ে গিয়েছে। বেলা কিছুতেই খড়ের বাড়িতে ফিরতে রাজি হলোনা। সে বৃষ্টিতে ভিজবেই। ওর অতি উৎসাহ দেখে শাইনি রেগে প্রচন্ড জোরে একটা ধমক দিলো। সঙ্গে সঙ্গে বেলার চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে গেলো।
শাইনি হতবিহ্বল হয়ে ওর গালে হাত রেখে বলল, “স্যরি স্যরি। এক্সট্রেমলি স্যরি বউ। প্লিজ কেঁদোনা। প্লিজ চোখ মুছো। ঠিক আছে, ঠিক আছে আমরা ভিজবো। যতক্ষণ থাকতে চাও, শুধু তোমার কান্না বন্ধ করো।”
শাইনি অপেক্ষা না করে নিজেই বেলার চোখের পানি মুছে দিলো। বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই। বেলা নিজেকে সামলে নিয়ে মনে মনে বলল, “দাঁড়াও বাছাধন। আজ এত ভিজা ভিজবো যে আমার সঙ্গে গলা উঁচিয়ে ধমক দেওয়া কাকে বলে সেটা ভুলে যাবি। কিডন্যাপ করার খুব শখ হয়েছে তাইনা? তোর শখ আমি ঘুচিয়ে দেব!আমার সঙ্গে যত অন্যায় করছিস তার শাস্তি পাবি হাড়ে হাড়ে। খুব ভালোবাসা উতলে উঠছে, যত্তসব নাটকবাজি! তোদের মতো বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া সন্তানদের আমি খুব ভালো করেই চিনি। তোরা কখনো শুধরানোর মানুষ নস। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলেই ডাস্টবিনে ফেলে দিস। যেমন নিশা আপুটাকে দিয়েছিস তেমন তো আমাকেও দিবি, হুহ!”
দীর্ঘ আধঘন্টা ওরা বৃষ্টিতে ভিজেছে। বেলা উপভোগ করলেও শাইনি তা পারেনি। ওর শরীর কাঁপছিলো প্রচুর। হাত-পায়ের তালু নীল হয়ে যাচ্ছিলো, মাথার শিরা দপদপ করছিলো তবুও সে বেলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রাবণের বর্ষণে নিজেকে মাতিয়ে তুলার অদম্য চেষ্টা করে চলেছিল। কোনো এক প্রতীক্ষার অবসান ঘটাতে, কোনো এক টানে, কোনো এক মোহে’র আশায় সে বিকারগ্রস্ত লোকের মতো ভুলেই বসেছিলো তার অসুস্থতার কথা! যেন ভালোবাসা পেলেই তার জীবন ধন্য। তার মানুষটার হাসিমুখটাই ওই সময়টাতে ওর জীবনের সবচেয়ে দামী বস্তু ছিল যেন। পৃথিবীর সবকিছু সেই মুহূর্তে ভুলে গিয়েছিল সে!
শাইনি ওর অসুস্থতা গোপন করেই চিৎকার করে বলেছিল, “তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ততোটাই স্নিগ্ধ, যতটা হলে এ জীবনে তুমি আমাকে ভুলতে পারবেনা। যতটা হলে আমি একজন স্বার্থক প্রেমিক পুরুষের মর্যাদা পাবো তোমার চোখে।”
পাহাড় সে কথাগুলো প্রতিধ্বনি হিসেবে ফিরিয়ে দেয়নি। দূর থেকে দূরান্তে ছড়িয়ে দিয়েছিল বার্তাগুলো। পৌঁছে দিয়েছিল ধোঁয়াটে মেঘের দেশে। মিলিয়ে গিয়েছিলো হাওয়ায়। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি ছড়িয়ে দিয়েছিল দুজন কপোত-কপোতীর মনে নতুন করে, আবারও!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!